সাবাইস বুদ্ধি/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পূর্ব্ববর্ণিত মুসলমানদিগের কথা শুনিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, মেমসাহেবের সহিত উহাদিগের বেশ পরিচয় আছে, আর যদি তিনিই ঐ কাজের কাজি হন, তাহা হইলে এই সকল ব্যক্তিই তাঁহার পারিষদ। আরও বুঝিতে পারিলাম, তিনি পশ্চিম প্রদেশে গমন করিয়াছেন। যদি তাহার দ্বারাই ঐ কার্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই সময় তাঁহার হঠাৎ পশ্চিম প্রদেশে গমন করার উদ্দেশ্য ঐ সকল অলঙ্কার বিক্রয় ভিন্ন আর কি হইতে পারে? দুই এক দিবসের মধ্যেই তাঁহার প্রত্যাগমনের কথা আছে। যদি তিনি ঐ সকল অলঙ্কার বিক্রয় করিবার মানসে পশ্চিম গমন করিয়া থাকেন, তাহা হইলে ঐ সকল অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া যে টাকা পাইবেন, তাহা লইয়া যে প্রত্যাগমন করিবেন, তদ্বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এরূপ অবস্থায় চন্দননগরের বাহিরে যদি তাহাকে ধরিতে পারি, তাহা হইলেই সুবিধা হয়। কারণ, চন্দননগরের মধ্যে তাহাকে ধৃত করিতে হইলে প্রথমতঃ ইংরাজ গবর্ণমেণ্টের পৃথক আদেশ লইয়া চন্দননগরের পুলিসের সাহায্য গ্রহণ করিতে হইবে এবং তাহাদিগের রাজত্বের ভিতর উহাকে ধরিতে হইলে ওয়ারেণ্টের প্রয়োজন। সেই ওয়ারেণ্টই বা কোথায় পাইব? প্রমাণাদির দ্বারা উহাকে দোষী সাব্যস্ত করিতে না পারিলে, ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব উহার বিপক্ষে আইন অনুসারে ওয়ারেণ্ট বাহির করিতে পারিবেন না। অথচ যে পর্যন্ত উহাকে দেখিতে পাওয়া না যায়, সেই পর্যন্তই বা কিরূপে বলিতে পারি যে, এই মেমসাহেবের দ্বারা ঐ কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে। তাহাকে দেখিয়া ঐ জহুরি বা তাঁহার কর্ম্মচারীগণ যদি চিনিতে পারে, তাহার পর তাহাদিগের সাক্ষ্য দ্বারা উহার নামে ওয়ারেণ্ট বাহির হইতে পারে। কিন্তু এত সময় পাইলে তাঁহার নিকট কি কোনরূপে অপহৃত দ্রব্য বা নগদ অর্থ প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা থাকে, কখনই নহে। মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া যাহাতে তাহাকে চন্দননগরের বাহিরে ইংরাজ, রাজত্বের মধ্যে ধৃত করিতে পারি, তাহারই উপায় চিন্তা করিতে লাগিলাম। পশ্চিম হইতে বা কলিকাতা হইতে রেলগাড়ীতে আসিতে হইলে চন্দননগর রেলওয়ে ষ্টেশনে গাড়ী হইতে অবতরণ করিতে হয়, ইহা সকলেই অবগত আছেন। আরও বোধ হয়, সকলেই অবগত আছেন যে, ঐ চন্দননগর রেলওয়ে ষ্টেশন ইংরাজ রাজত্বের অনুভূতি। সুতরাং ইহাই স্থির করিলাম যে, তাঁহাকে যদি ধরিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে রেলওয়ে ষ্টেশনের মধ্যে তাহাকে ধরিতে পারিলেই চন্দননগরের ভিতর ধৃত করিবার গোলযোগ হইতে নিষ্কৃতি লাভ করা যাইতে পারে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই স্ত্রীলোকটীকে যাহারা সেই জহুরির দোকানে দেখিয়াছিল, তাহাদিগের একজনকে সঙ্গে লইয়া ঐ রেলওয়ে ষ্টেশনে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। উভয়দিক হইতে যে সকল গাড়ী থামিতে লাগিল, তাহা দেখিতে লাগিলাম। দেখিতে লাগিলাম যে, ঐ সকল গাড়ী হইতে পূর্ব্বকথিত মেমসাহেব ঐ স্থানে অবতরণ করেন কি না?
এইরূপে দুইদিবসকাল ঐ চন্দননগর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থিতি করিবার পর পশ্চিমের মেলগাড়ীতে ঐ মেমসাহেব আসিয়া সেই ষ্টেশনে অবতরণ করিলেন। আমার সহিত জহুরির যে লোক ছিল, সে ঐ মেমসাহেবকে দেখিবামাত্রই কহিল, এই স্ত্রীলোেকই তাহাদিগের দোকানে গমন করিয়াছিল, এবং তাহারই সহিত তাহাদিগের দোকানের প্রধান কর্ম্মচারী অলঙ্কার লইয়া গমন করিয়াছিল।
এই কথা বলিবমাত্র আমি তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাষা না করিয়াই একেবারে তাহাকে সেই রেলওয়ে ষ্টেশনের প্লাটফারমের উপর ধরিয়া ফেলিলাম। এইস্থানে অনেক পাঠক মনে করিতে পারেন যে, তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া একেবারে তাহাকে গ্রেপ্তার করার উদ্দেশ্য কি? রেলওয়ে ষ্টেশনের বাহির হইতেই ফরাসীদিগের রাজত্ব আরম্ভ হইয়াছে, উঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেই যদি তাহার মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয় ও যদি তিনি ধৃত হইবার পূর্বে ষ্টেশনের বাহির হইয়া। ফরাসী রাজত্বের মধ্যে পদার্পণ করেন, তাহা হইলে তাহাকে ধৃত করা নিতান্ত সহজ হইবে না। অথচ সময় পাইলে তাঁহার নিকট যদি কিছু থাকে, তাহা তিনি অনায়াসেই হস্তান্তর করিতে সমর্থ হইবেন। সুতরাং তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া বা তাঁহাকে রেলওয়ে ষ্টেশনের বাহিরে গমন করিবার কোনরূপ সুযোগ প্রদান না করিয়া, তাহাকে সেইস্থানে ধৃত করিলাম। তাহাকে ধরিবার সময় তিনি ভয়ানক গোলযোগ করিয়া উঠিলেন, কিন্তু তাঁহার দিকে আমরা কিছুমাত্র দৃষ্টিপাত না করিয়া যাহাতে তিনি কোনরূপে ষ্টেশনের বাহিরে গমন করিতে সমর্থ না হন, তাহার উত্তমরূপ বন্দোবস্ত করিয়া পরিশেষে তাঁহাকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার নাম কি মেমসাহেব?”
স্ত্রীলোক। আমার নামে আপনার প্রয়োজন কি? সন্ত্রান্ত স্ত্রীলোককে এইরূপে অবমাননা করিলে, পরিশেষে তাহার পরিনাম কি হইবে, তাহা আপনি জানেন কি?
আমি। খুব জানি। বিশেষ আপনি যেরূপ সম্রান্ত স্ত্রীলোক, তাহাও আমি উত্তমরূপে অবগত আছি। এখন আপনি আমার কথার উত্তর প্রদান করিবেন কি না, অনুগ্রহ করিয়া তাহাই বলুন? আপনার কথার উত্তর পাইলেই আমার বিবেচনা মত কার্য্য করিব।
স্ত্রীলোক। আপনি আমাকে কি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?
আমি। প্রথমতই ত আমি আপনার নাম জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কিন্তু এখন পর্য্যন্ত তাহার কোনরূপ উত্তর পাই নাই। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিতেছি, আপনার নাম কি?
স্ত্রীলোক। আমার নাম মিস্ সুশীলা।
আমি। পূর্ব্বে আপনি মেহেদিবাগানে থাকিতেন না?
স্ত্রীলোক। সেইস্থানে কিছুদিবস ছিলাম।
আমি। এখন আপনি চন্দননগরে বাস করিতেছেন?
স্ত্রীলোক। হাঁ, এখন আমি চন্দননগরেই থাকি।
আমি। আপনি যে সে দিবস বড়বাজারের একজন জহুরির কতকগুলি গহনা খরিদ করিতে গিয়াছিলেন, তাহা কাহার জন্য?
স্ত্রীলোক। কিসের গহনা, আমি ইহার মধ্যে কাহারও দোকানে কোন গহনা খরিদ করিতে যাই নাই। গত এক বৎসরের মধ্যে আমার কোনরূপ অলঙ্কারের প্রয়োজন হয়। নাই।
আমি। আপনি কোন জহুরির দোকানে কোন অলঙ্কার খরিদ করিতে গিয়াছিলেন কি না, বা আপনার কোনরূপ অলঙ্কারের প্রয়োজন হইয়াছিল কি না, সেই সকল বিষয় পরে দেখা যাইবে। এখন বলুন দেখি, আজ কয়েক দিবস হইতে আপনি আপনার বাড়ী ছাড়িয়া কোথায় গমন করিয়াছিলেন, এবং কি নিমিত্তই বা গমন করিয়াছিলেন?
স্ত্রীলোক। আমি আমার নিজের কোন কার্য্যের নিমিত্ত কোন স্থানে গমন করিয়াছিলাম। কি কার্যের নিমিত্ত যে কোথায় এমন করিয়াছিলাম, তাহা আপনাকে বলিবার আমি কোনরূপ প্রয়োজন দেখি না। |
আমি। তাহা হইলে আপনি যে কোথায় এবং কি নিমিত্ত এমন করিয়াছিলেন, তাহা আমাকে বলিতে ইচ্ছা করেন না?
স্ত্রীলোক। না।
আমি। ইচ্ছা করুন বা না করুন, তাহা কিন্তু আপনাকে বলিতে হইবে। এখন না বলুন, সেই সকল কথা বলিবার যখন সময় আসিয়া উপস্থিত হইবে, তখন না বলিয়া আপনি কোন ক্রমেই থাকিতে পারিবেন না।
স্ত্রীলোক। কি সময় আসিয়া উপস্থিত হইবে? আমি। তাহা আপনি পরে জানিতে পারিবেন এখন বলুন দেখি, আপনার কাছে কি কি অলঙ্কার আছে?
স্ত্রীলোক। কিসের অলঙ্কার?
আমি। সোণার অলঙ্কার, হীরামতি বসান অলঙ্কার। স্ত্রীলোক। না, আমার নিকট কোন অলঙ্কার নাই।
অমি। নগদ টাকা কতগুলি আছে?
স্ত্রীলোক। আমার নগদ টাকা কি আছে না আছে, তাহার হিসাব আমি দিতে ইচ্ছা করি না।
আমি। তোমার নগদ টাকা কত আছে, সে হিসাব আমি চাহিতেছি না। আমি জানিতে চাহি, তোমার নিকট এখন নগদ টাকা কি আছে?
স্ত্রীলোক। আমি তাহা বলিতে চাহি না।
আমি। এখন আমি তোমাকে যাহাই জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহাই তুমি বলিতে চাহিতেছ না। তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই যে, তুমি এখন কিরূপ অবস্থায় পতিত হইয়াছ, এবং ইহার পরিণামই বা কি দাঁড়াইবে।
স্ত্রীলোক। আমি এমন কোন অপরাধ করি নাই, যাহাতে আপনাদিগকে ভয় করিয়া চলিতে হইবে।
ঐ স্ত্রীলোকের নিকট হইতে ঐরূপ উত্তর প্রাপ্ত হইয়া সেই সময় উহাকে আর কোনরূপ কথা জিজ্ঞাসা করা অনাবশ্যক বিবেচনা করিলাম। যখন সে গাড়ী হইতে অবতরণ করে, সেই সময় তাহার নিকট একটী চামড়ার পোর্টমেণ্ট, একটী গ্লাডষ্টোন ব্যাগ ও একটী বিছানা ছিল মাত্র। ঐ পোর্টমেণ্ট ও ব্যাগের চাবি চাহিলে, সে উহা আমাকে প্রদান করিল না ও কহিল, আমি চাবি দিব না। তবে চাবি ভাঙ্গিয়া উহা দেখিতে ইচ্ছা করিলে, অনায়াসেই করিতে পারেন।
উহার কথা শুনিয়া, উহার উপর একটু ক্রোধের উদয় হইল। তখন তাহাকে ষ্টেশনের মধ্যে যে ঘরে সন্ত্রান্ত স্ত্রীলোকগণ আসি। উপবেশন করে, সেই ঘরের মধ্যে লইয়া গেলাম। ঐ ঘরের স্ত্রীলোকদিগের কার্য্যের নিমিত্ত প্রায়ই একটা মেথরাণী স্ত্রীলোক রেলওয়ে কোম্পানি কর্তৃক নিযুক্ত থাকে। ঐ মেথরাণী স্ত্রীলোকটাকে উহার অঙ্গের কাপড় খুলিয়া উত্তমরূপে তল্লাসি করিয়া দেখিতে কহিলাম। সে প্রথমতঃ ঐ কার্য্য সম্পন্ন করিতে একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। কিন্তু পরিশেষে আমি ও সেই ষ্টেশনের ষ্টেশনমাষ্টার তাহাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া দিলাম, ইহাতে তাহার কোনরূপ অপরাধ হইবে না; আসামী স্ত্রীলোক না হইলে ঐ কার্য্য-আমি আপন হস্তেই সম্পন্ন করিতাম, কিন্তু স্ত্রীলোক বলিয়া সেই কার্য্য আমি স্বহস্তে সম্পন্ন করিতে সমর্থ নহি, তাই অপর স্ত্রীলোক দ্বারা ঐ কার্য্য সম্পন্ন করাইতে হইতেছে। এই কার্য্যও আমাদিগের নিজের কার্য্য নহে, সরকারি কার্য্য; সেও একরূপ সরকারি চাকর, সুতরাং ঐ কার্য্যসম্পন্ন করাও তাহার একরূপ কর্তব্য কর্মের মধ্যে পরিগণিত। এইরূপভাবে উহাকে বুঝাইবার পর, পরিশেষে সে ঐ কার্য্য সম্পন্ন করিতে সম্মত হইল ও সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া উহার বস্ত্রাদির অভ্যন্তরে অনুসন্ধান করিয়া কেবলমাত্র এক গোছা চাবি ও কয়েকটী মুদ্রা আনিয়া আমাদিগের হস্তে প্রদান করিয়া কহিল, ইহা ব্যতীত উহার নিকট আর কিছুই নাই।
সে চাবিগুচ্ছ আনিয়া আমাদিগের হস্তে প্রদান করিলে দেখিলাম, উহার মধ্যে তাহার নিকট যে পোর্টমেণ্ট ও ব্যাগ ছিল, তাহাদের চাবি ইহার মধ্যে আছে। তখন স্ত্রীলোকটাকে সেই ঘরের মধ্য হইতে বাহির করিয়া, ষ্টেশনমাষ্টার ও অপরাপর লোকের সম্মুখে ঐ পোর্টমেণ্ট ও ব্যাগ খুলিয়া তাহার ভিতর অনুসন্ধান করিলাম। উহার মধ্যে প্রায় তিন সহস্র টাকার ১০ টাকা হিসাবের নোট ও একখানি গহনা পাওয়া গেল। সেই জহুরির দোকানের যে কর্ম্মচারী আমার নিকট ছিল, ঐ গহনাখানি দেখিবামাত্রই সে কহিল, ইনি যে সকল গহনা লইয়া গিয়াছিলেন, এই গহনাখানি তাহারই একখানি। এরূপ অবস্থায় তাহার উপর আর কোনরূপ সন্দেহ থাকিল না, প্রথমেই যে ট্রেণ পাইল, সেই ট্রেণেই উহাকে লইয়া কলিকাতায় গমন করিলাম।