সারদামঙ্গল।

প্রথম সর্গ।

গীতি।

[ রাগিণী ললিত,-তাল আড়াঠেকা।]
ওই কে অমরবালা দাঁড়ায়ে উদয়াচলে,
ঘুমন্ত প্রকৃতি পানে চেয়ে আছে কুতূহলে!
চরণ কমলে লেখা
আধ আধ রবি-রেখা,
সর্ব্বাঙ্গে গােলাপ-আভা, সীমন্তে শুকতারা জ্বলে।
যোগে যেন পায় স্ফূর্ত্তি
সদয়া করুণামূর্ত্তি,
বিতরেন হাসি হাসি শান্তিসুধা ভূমণ্ডলে।
হয় হয় প্রায় ভোর,
ভাঙো ভাঙো ঘুমঘাের,
সুস্বপ্নরূপিণী উনি, উষারাণী সবে বলে।

বিরল তিমির জাল,
শুভ্র অভ্র লালেলাল,
মগন তারকারাজি গগনের নীল জলে।
তরুণ-কিরণাননা
জাগে সব দিগঙ্গনা,
জাগেন পৃথিবী দেবী সুমঙ্গল কোলাহলে।
এস মা উষার সনে
বীণাপাণি চাননে,
রাঙা চরণ দুখানি রাখ হৃদয় কমলে!



কে তুমি ত্রিদিবদেবী বিরাজ হৃদি কমলে!
নধর নগনা লতা মগনা কমলদলে।
মুখখানি ঢল ঢল,
আলুথালু কুনতল,
সনাল কমল দুটি হাসে বাম করতলে।

কপােলে সুধাংশু ভাস,
অধরে অরুণ হাস,
নয়ন করুণাসিন্ধু প্রভাতের তারা জ্বলে।


মাথা থুয়ে পয়ােধরে
কোলে বীণা খেলা করে,
স্বর্গীয় অমিয় স্বরে জানিনে কি কথা বলে।
8
ভাবভরে মাতােয়ারা,
যেন পাগলিনী পারা,
আহ্লাদে আপনা-হারা মুগুধা মােহিনী,
নিশান্তের শুকতারা,
চঁদের সুধার ধারা,
মানস-মরালী মম আনন্দ-রূপিণী!
তুমি সাধনের ধন,
জান সাধকের মন,
এখন আমার আর কোন খেদ নাই ম'লে!




নাহি চন্দ্র সূর্য্য তারা,
অনল-হিল্লোল-ধারা,
বিচিত্র-বিদ্যুত-দাম-দ্যুতি ঝলমল;
তিমিরে নিমগ্ন ভব,
নীরব নিস্তব্ধ সব,
কেবল মরুতরাশি করে কোলাহল।


হিমাদ্রি শিখর পরে
আচম্বিতে আলাে করে
অপরূপ জ্যোতি ওই পুণ্য তপােবনে!
বিকচ নয়নে চেয়ে
হাসিছে দুধের মেয়ে,
তামসী-তরুণ-উষা কুমারীরতন।
কিরণে ভুবন ভরা,
হাসিয়ে জাগিল ধরা,
হাসিয়ে জাগিল শূন্যে দিগঙ্গনাগণে।
হাসিল অম্বরতলে
পারিজাত দলে দলে,
হাসিল মানস সরে কমল কানন।

হরিণী মেলিল আঁখি,
নিকুঞ্জে কূজিল পাখী,
বহিল সৌরভময় শীতল সমীর,
ভাঙ্গিল মােহের ভুল,
জাগিল মানব কুল,
হেরিয়ে তরুণ-উষা আনন্দে অধীর।



অম্বরে অরুণােদয়,
তলে দুলে দুলে বয়
তমসা তটিনী-রাণী কুলু কুলু স্বনে;
নিরখি লােচনলােভা
পুলিন-বিপিন-শােভা
ভ্রমেন বাল্মীকি মুনি ভাবভােলা মনে।

শাখি-শাখে রসসুখে।
ক্রৌঞ্চ ক্রৌঞ্চী মুখে মুখে
কতই সােহাগ করে বসি দুজনায়,
হানিল শবরে বাণ,
নাশিল ক্রৌঞ্চের প্রাণ,
রুধিরে আপ্লুত পাখা ধরণী লুটায়।

১০
ক্রৌঞ্চী প্রিয় সহচরে
ঘেরে ঘেরে শােক করে,
অরণ্য পূরিল তার কাতর ক্রন্দনে।
চক্ষে করি দরশন
জড়িমা-জড়িত মন,
করুণ-হৃদয় মুনি বিহ্বলের প্রায়;

সহসা ললাটভাগে
জ্যোতির্ময়ী কন্যা জাগে,
জাগিল বিজলী যেন নীল নব ঘনে।
কিরণে কিরণময়
বিচিত্র আলােকোদয়,
ম্রিয়মাণ রবি-ছবি, ভুবন উজলে।
চন্দ্র নয়, সূর্য নয়,
সমুজ্জ্বল শান্তিময়,
ঋষির ললাটে আজি না জানি কি জ্বলে!
১২
কিরণ-মণ্ডলে বসি
জ্যোতির্ময়ী সুরূপসী
যােগীর ধ্যানের ধন ললাটিকা মেয়ে
নামিলেন ধীর ধীর,
দাঁড়ালেন হয়ে স্থির
মুগ্ধ নেত্রে বাল্মীকির মুখ পানে চেয়ে।

১৩
করে ইন্দ্রধনু-বালা,
গলায় তারার মালা,
সীমন্তে নক্ষত্র জ্বলে, ঝলমলে কানন;

কর্ণে কিরণের ফুল,
দোদুল চাঁচর চুল
উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকিয়ে আনন।
১৪
হাসিহাসি-শশি-মুখী,
কতই কতই সুখী।
মনের মধুর জ্যোতি উছলে নয়নে।
কভু হেসে ঢল ঢল,
কভু রোষে জ্বল জ্বল,
বিলোচন ছল ছল করে প্রতিক্ষণে।

১৫
করুণ ক্রন্দন রোল
উত উত উতোরোল,
চমকি বিহ্বলা বালা চাহিলেন ফিরে;
হেরিলেন রক্তমাখা
মৃত ক্রৌঞ্চ ভগ্ন-পাখা,
কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ক্রৌঞ্চী ওড়ে ঘিরে ঘিরে।

১৬
একবার সে ক্রৌঞ্চীরে
আর বার বাল্মীকিরে
নেহারেন ফিরে ফিরে, যেন উন্মাদিনী;

কাতরা করুণা-ভরে,
গান সকরুণ স্বরে,
ধীরে ধীরে বাজে করে বীণা বিষাদিনী।
১৭
সে শােক-সংগীত-কথা
শুনে কাঁদে তরু লতা,
তমসা আকুল হয়ে কাঁদে উভরায়।
নিরখি নন্দিনী-ছবি
গদ গদ আদি কবি
অন্তরে করুণা-সিন্ধু উথলিয়া ধায়।
১৮
রােমাঞ্চিত কলেবর,
টলমল থরথর,
প্রফুল্ল কপােল বহি বহে অশ্রুজল।



হে যােগেন্দ্র! যােগাসনে
ঢুলু ঢুলু দুনয়নে
বিভাের বিহ্বল মনে কাঁহারে ধেয়াও!
কমলা ঠমকে হাসি
ছড়ান‍্ রতনরাশি,
অপাঙ্গে ভ্রূভঙ্গে আহা ফিরে নাহি চাও!

ভাবে ভােলা খোলা প্রাণ,
ইন্দ্রাসনে তুচ্ছ জ্ঞান,
হাসিয়ে পাগল বলে পাগল সকল।
১৯
এমন করুণা মেয়ে
আছে যাঁর মুখ চেয়ে,
ছলিতে এসেছ তাঁরে কেন গাে চপলা!
হেরে কন্যা করুণায়
শােক তাপ দূরে যায়,
কি কাজ—কি কাজ তাঁর তােমায় কমলা।
২০
এস মা করুণারাণী,
ও বিধু-বদন-খানি
হেরি হেরি আঁখি ভরি হেরি গো আবার;
শুনে সে উদার কথা
জুড়াক মনের ব্যথা,
এস আদরিণী বাণী সমুখে আমার!
যাও লক্ষ্মী অলকায়,
যাও লক্ষ্মী অমরায়,
এস না এ যােগী-জন-তপােবন-স্থলে।


১১
সারদামঙ্গল।
ব্রহ্মার মানস সরে
ফুটে ঢলঢল করে
নীল জলে মনােহর সুবর্ণ-নলিনী,
পাদপদ্ম রাখি তায়
হাসি হাসি ভাসি যায়
ষোড়শী রূপসী বামা পূর্ণিমা-যামিনী।
২২
কোটি শশী উপহাসি
উথলে লাবণ্য রাশি,
তরল দর্পণে যেন দিগন্ত আবরে;
আচম্বিতে অপরূপ
রূপসীর প্রতিরূপ।
হাসি হাসি ভাসি ভাসি উদয় অম্বরে।
২৩
ফটিকের নিকেতন,
দশ দিকে দরপণ,
বিমল সলিল যেন করে তক্‌ তক্‌;
সুন্দরী দাড়ায়ে তায়
হাসিয়ে যে দিকে চায়
সেই দিকে হাসে তার কুহকিনী ছায়া,

নয়নের সঙ্গে সঙ্গে
ঘূরিয়া বেড়ায় রঙ্গে,
অবাক দেখিলে, হয় অমনি অবাক; চক্ষে পড়েনা পলক।
তেমনি মানস সরে
লাবণ্য-দর্পণ-ঘরে
দাঁড়ায়ে লাবণ্যময়ী দেখিছেন মায়া।

২৪
যেন তাঁরে হেরি হেরি,
শূন্যে শূন্যে ঘেরি ঘেরি,
রূপসী চাঁদের মালা ঘূরিয়া বেড়ায়;
চরণ কমল তলে
নীলনভ নীলজলে
কাঞ্চন-কমলরাজি ফুটে শােভা পায়।

২৫
চাহিয়ে তাঁদের পানে
আনন্দ ধরে না প্রাণে,
আনত আননে হাসি জলতলে চান;
তেমনি রূপসী-মালা
চারি দিকে করে খেলা,
অধরে মৃদুল হাসি আনত বয়ান।

২৬
রূপের ছটায় ভুলি
শ্বেত শতদল তুলি
আদরে পরাতে যান সীমন্তে সবার,
তাঁরাও তাঁহারি মত
পদ্ম তুলি যুগপত
পরাতে আসেন সবে সীমন্তে তাঁহার।

২৭
অমমি স্বপন প্রায়
বিভ্রম ভাঙিয়া যায়,
চমকি আপন পানে চাহেন রূপসী;
চমকে গগনে তারা,
ভূধরে নির্ঝর ধারা,
চমকে চরণ তলে মানস-সরসী।

২৮
কুবলয়-বনে বসি
নিকুঞ্জ-শারদশশী
ইতস্তত শত শত সুরসীমন্তিনী
সঙ্গে সঙ্গে ভাসি যায়,
অনিমেষে দেখে তাঁয়,
যােগাসনে যেন সব বিহ্বলা যােগিনী।

২৯
কিবে এক পরিমল
বহে বহে অবিরল!
শান্তিময়ী দিগঙ্গনা দেখেন উল্লাসে।
শূন্যে বাজে বীণা বাঁশী,
সৌদামিনী ধায় হাসি,
সংগীত অমৃত-রাশি উথলে বাতাসে।

তীরে ঘেরে, যােড় করে
অমর কিন্নর নরে
সম স্বরে স্তব করে, ভাসে অশ্রুজলে
অমর কিন্নর নরে ভাসে অশ্রুজলে।

৩০
তােমারে হৃদয়ে রাখি
সদানন্দ মনে থাকি,
শ্মশান অমরাবতী দু-ই ভাল লাগে;
গিরিমালা, কুঞ্জবন,
গৃহ, নাট-নিকেতন,
যখন যেখানে যাই, যাও আগে আগে।

জাগরণে জাগ হেসে,
ঘুমালে ঘুমাও শেষে,
স্বপনে মন্দার-মালা পরাইয়ে দাও গলে।

৩১
যত মনে অভিলাষ,
তত তুমি ভালবাস,
তত মন প্রাণ ভরে আমি ভালবাসি;
ভক্তি ভাবে এক তানে
মজেছি তােমার ধ্যানে;
কমলার ধনমানে নহি অভিলাষী।

থাক হৃদে জেগে থাক,
রূপে মন ভােরে রাখ,
তপােবনে ধ্যানে থাকি এ নগর-কোলাহলে।


৩২
তুমিই মনের তৃপ্তি,
তুমি নয়নের দীপ্তি,
তােমা-হারা হলে আমি প্রাণ-হারা হই;
করুণা-কটাক্ষে তব
পাই প্রাণ অভিনব
অভিনব শান্তিরসে মগ্ন হয়ে রই।

যে ক দিন আছে প্রাণ,
করিব তােমায় ধ্যান,
আনন্দে ত্যেজিব তনু ও রাঙা চরণতলে।

~-~

৩৩
অদর্শন হ'লে তুমি,
ত্যেজি লােকালয় ভূমি,
অভাগা বেড়াবে কেঁদে নিবিড় গহনে;
হেরে মােরে তরু লতা
বিষাদে কবে না কথা,
বিষণ্ন কুসুম কুল বন-ফুল-বনে।
‘হা দেবী, হা দেবী,” বলি
গুঞ্জরি কাঁদিবে অলি;
নীরবে হরিণীবালা ভাসিবে নয়নজলে।

৩৪
নির্ঝর ঝর্ঝর রবে
পবন পূরিয়ে যবে
আঘােষিবে সুরপুরে কাননের করুণ ক্রন্দন হাহাকার,
তখন টলিবে হায় আসন তােমার,
হায় রে তখন মনে পড়িবে তােমার!
হেরিবে কাননে আসি
অভাগার ভস্মরাশি,
অথবা হাড়ের মালা, বাতাসে ছড়ায়;
করুণা জাগিবে মনে,
ধারা ববে দুনয়নে,
নীরবে দাঁড়ায়ে রবে, প্রতিমার প্রায়।

৩৫
ভেবে সে শোকের মুখ
বিদরে আমার বুক,
মরিতে পারিনে তাই আপনার হাতে;
বেঁধে মারে, কত সয়!
জীবন যন্ত্রণাময়
ছারখার চূরমার বিনি বজ্রাঘাতে।
অন্তরাত্মা জর জর,
জীর্ণারণ্য চরাচর,
কুসুমকানন-মন বিজন শ্মশান;
কি করিব, কোথা যাব,
কোথা গেলে দেখা পাব,
হৃদি-কমল-বাসিনী কোথারে আমার!
কোথা সে প্রাণের আলো,
পূর্ণিমা-চন্দ্রিমাজাল,
কোথা সেই সুধামাখা সহাস বয়ান!
কোথা গেলে সঞ্জীবনী!
মণি-হারা মহা খনি
অহাে সেই হৃদিরাজ্য কি ঘাের আঁধার।
তুমি তাে পাষাণ নও,
দেখে কোন্ প্রাণে সও,
অয়ি সুপ্রসন্ন হও কাতর পাগলে!