সাহিত্যে প্রগতি/প্রলেটারীয় সাহিত্যের স্বরূপ

প্রলেটারীয় সাহিত্যের স্বরূপ

এইবার আমরা ‘গণ’ বা ‘প্রোলেটারীয়’ সাহিত্য বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব। এই কথাটির প্রথম উৎপত্তি হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষকালে জার্ম্মানীর স্যোসালিষ্টদের মধ্যে। ধনী শ্রেণীদের আদর্শ বিজড়িত কৃষ্টির বিকল্পে অর্থাৎ তাহা হইতে পৃথকভাবে জার্ম্মানীর প্রলেটারিয়েট শ্রেণী নিজের কৃষ্টি বা সংস্কৃতি উদ্ভব করিবার চেষ্টা করে। স্বীয় শ্রেণীর আদর্শানুযায়ী কৃষ্টি ও তাহার বাহন সাহিত্য, রঙ্গমঞ্চ, খেলাধুলা প্রভৃতির বিবর্ত্তনকে “প্রলেটারীয় কৃষ্টি” বলিয়া তাঁহারা নামকরণ করেন। এতদ্বারা গণ শ্রেণীসমূহের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীয় আদর্শানুযায়ী (কৃষ্টির) সৃষ্টিকরাকে “গণ সংস্কৃতি” (proletarian culture) বলিয়া অভিহিত করা হয়।

এই ভাবধারাই স্বামী বিবেকানন্দ দ্বারা এদেশে ‘শূদ্রের জাগরণ’ এবং গণসমূহ দ্বারা উদ্ভূত সভ্যতার কথা বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। যখন তিনি বলিয়াছেন “বেরুক নূতন সভ্যতা ভূনুরির উনান থেকে, চাষীর লাঙ্গল থেকে, জেলের চুবড়ী থেকে” ইত্যাদি, তখন তিনি অনাগত প্রোলেটারীয় কৃষ্টিরই কথা বলিয়াছেন।

আজ সোভিয়েট সংঘের রাষ্ট্রসমূহ ব্যতীত জগতের অন্যত্র এই কৃষ্টি অনাগত বটে, কিন্তু সোভিয়েট রাষ্ট্রসমূহে এই কৃষ্টি ও তাহার বাহন—সাহিত্য আজ বিশেষভাবে মূর্ত্ত হইয়া উঠিতেছে। আজ সেই সব রাষ্ট্রে কোন লেখক প্রাসাদস্থিত রাজকুমারীর বিরহ বেদনার কথা বিনাইয়া বিনাইয়া সাহিত্য সৃষ্টি করে না, আজ তথায় রাজকুমারের মৃগয়াকালে এক সুন্দরীর সহিত আকস্মিক সাক্ষাৎ ও প্রেমালাপ ইত্যাদির রূপকথা আর কেহ লেখেন না কিংবা ধনী যুবক ও যুবতীর মহানগরী পারীর বুলেভারে আমোদোৎসবের বর্ণনা করিয়া নিরন্ন ও কুটিরবাসী গরীবের ছেলেদের মন ভুলাইয়া রাখে না। আজ, তথায় গরীব “গণ” নিজেকে চিনিতে পারিয়াছে। আজ তথায় শোষিত ও পদদলিত শূদ্র তাহার স্বাধীকার পাইয়াছে, তাহার “আত্মদর্শন” হইয়াছে। এই জন্য তাহার সভ্যতাও তদনুযায়ী অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান সমূহ তাহার দৃষ্টিকোণ দ্বারা দৃষ্ট ভাবধারা দ্বারা বিবর্ত্তিত হইতেছে। এই কৃষ্টিকে এক কথায় সে আজ “প্রলেটকুল্ট” নামে অভিহিত করিতেছে।

প্রলেটারীয় রাষ্ট্র না হইলে প্রলেটারীয় কৃষ্টির উদ্ভব হয় না ইহা ঠিক। ইহার কারণ, প্রলেটারীয় রাষ্ট্র, সামন্ততান্ত্রিক বা জমিদার-সাহী রাষ্ট্রও নয় অথবা বুর্জ্জোয়া-তন্ত্র বা ধনিক-সাহী রাষ্ট্র নয়। এই রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে সমাজতান্ত্রিক বা স্যোসালিষ্ট রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে শ্রেণীভেদ নেই, বর্ণভেদ নেই; আছে কেবল মানুষ এবং তাহার সমুচিত মূল্য প্রদান। কাজেই অতীতের দিকে চাহিয়া “হা হতোস্মি” করার লোক এই সভ্যতার অন্তর্গত রাষ্ট্রে নাই, এইজন্য অতীতের সুখের গল্পের (রোমান্স) স্থান এই সাহিত্যে নাই।

প্রটোরীয় সাহিত্যের ভিত্তি বাস্তব বস্তুতান্ত্রিক জগতের ঘটনাবলীর উপর স্থাপিত। এই কারণবশতঃ ইহা প্রধানতঃ বাস্তববাদী (Realist) সাহিত্য। ইহার প্রথম কথা যে ইহা পূঁজীবাদী প্রকাশক ও সেই শ্রেণীর কবল বিমুক্ত। এই সাহিত্য অর্থোপার্জ্জনোদ্দেশ্যে বাবুদের খোস মেজাজ চরিতার্থ করিবার জন্য লিখিত হয় না। ইহা সমাজসেবা কর্ম্মেই আত্মনিয়োজন করে। ইহার কর্ত্তব্য হইতেছে সমাজের অবস্থা ব্যক্ত করা এবং অগ্রগমনশীলতার পথ নির্দ্দেশ করা। “বহুতম লোকের প্রচুরতম উপকার” করাই এই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। ফ্রয়েডের মত যে, যৌন সম্পর্ক (Edipus complex) উপর ভিত্তি স্থাপন করিয়া মানব সভ্যতা ও তাহার অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানাদি গড়িয়া উঠিয়াছে (Totem aad Taboo দ্রষ্টব্য)। এই মত প্রলেটারীয় সাহিত্য সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে। এই সব কারণ জন্য প্রলেটারীয় সাহিত্যিকের দায়ীত্বই অধিক!

পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত কৃষ্টি (cultural heritage) যেমন তাহার পক্ষে প্রয়োজনীয়, তদ্রূপ বর্ত্তমানও তাহার পক্ষে প্রয়োজনীয়। অতীত কৃষ্টির অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান— সমূহ কতটা বর্ত্তমানের ‘ধোপে টিকিবে’ ইহা আবিষ্কার করা যেমন তাহার দরকার, তেমনি বর্ত্তমানের পরিস্থিতি কতটা তাহার পক্ষে কার্য্যকরী ইহাও নির্দ্ধারণ করা প্রয়োজন। অতীতের স্মৃতির মোহে অন্ধ হইয়া ‘নিত্য’, “সনাতন”, “জাতীয়তা,” প্রভৃতি ছেঁদো বুলি আবৃত্তি করিলেই একটা নেশন উন্নতিশীল হইতে পারে না। অজিকাল, এই দেশের এই মনোবৃত্তির লোকদের মুখ থেকে “আমাদের কৃষ্টি” বলিয়া একটা গাল ভরা কথা প্রতিনিয়ত শ্রুত হওয়া যায়। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এই কৃষ্টি কয় জনের ছিল? আজও অতি উচ্চ শিক্ষিত ব্রাহ্মণবংশীয় ভারতীয় পণ্ডিতেরা বলিতেছেন, “হিন্দুর কৃষ্টি” কেবল জন কতক পুরোহিত শ্রেণীয় লোক দ্বারাই উদ্ভূত হইয়াছে। তাহা হইলে সমাজের বেশীর ভাগ লোক কী সহস্র সহস্র বৎসর ধরিয়া কেবল ভারবাহী পশু হইয়াছিল? ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রসমূহের প্রত্যেক পত্রে ধর্ম্মাচার, ব্যবহার, সামাজিকপদ প্রভৃতিতে বর্ণগত পার্থক্যের ব্যবস্থা প্রদত্ত হইয়াছে; আজও তাহা অনুসৃত হয়। এইজন্য “আমাদের কৃষ্টি” বলিয়া কোন কথা থাকিতে পারে না। এই বিষয়েই ঈঙ্গিত করিয়া স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়া গিয়াছেন, “You talk of your philosophy, that is class philosophy” (তুমি তোমার দর্শনশাস্ত্র বিষয়ে অহঙ্কার কর, তাহা একটা শ্রেণীগত দর্শন)!

পুনঃ জিজ্ঞাসা করি, ব্রাহ্মণের যে কৃষ্টি, শূদ্রের কি সেই কৃষ্টি? প্রত্যেক বিষয়ে কি তাহাদের পার্থক্য নাই? অনুসন্ধান করিলে ইহাই প্রতীত হবে যে “আমাদের” বলিয়া গোঁড়ামী করা সঙ্কীর্ণতা ও অজ্ঞতারই পরিচায়ক। ভারতের ইতিহাসের প্রত্যেক পত্রেই ইহা প্রমাণিত হইয়াছে যে, ‘সভ্যতা’ শাসকশ্রেণী দ্বারা প্রভাবাম্বিত হইয়া গঠিত হইয়াছে। পুনঃ, অর্থনীতিক পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সামাজিক বিবর্ত্তন এবং তজ্জন্য রাষ্ট্রিক পরিবর্ত্তন হয়। ভারতের ইতিহাসে এই সব বিষষের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান হয় নাই বলিয়াই তাহা ‘এই দেশে হয় নাই” বলা অজ্ঞতারই পরিচয় প্রদান করা হয়। এই বিষয়ে কার্ল মার্ক্স যাহা বলিয়াছেন তাহা ধ্রুব সত্যঃ “জড়জগতে বেঁচে থাকিবার জন্য ‘উৎপাদন পদ্ধতি’, সামাজিক, রাজনীতিক এবং চিন্তাজগতের জীবনের সমগ্র গতিই নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষের জ্ঞান তাহাকে বাঁচাইয়া রাখে না, বরং তাহার সামাজিক অস্তিত্ব তাহার জ্ঞান নিরূপণ করে। এই ক্রমোন্নতির একটা অবস্থায় সমাজের উৎপাদনের বস্তুতান্ত্রিক শক্তিসমূহ, উৎপাদনের তৎকালীন অবস্থিত সম্বন্ধ সমূহের অর্থাৎ আইনের ভাষায় সেই সময়কার বৈষয়িক সম্বন্ধের সহিত সংঘর্ষ হয়। এই অবস্থা থেকেই সামাজিক বিপ্লব আরম্ভ হয়। সমাজের অর্থনীতিক ভিত্তির পরিবর্ত্তনের সঙ্গে উপরের সৌধ কমবেশী শীঘ্রই রূপান্তরিত হয়”। যখনই এই অর্থনীতিক পরিবর্ত্তন সংসাধিত হইয়াছে, তখনই সমাজ পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। আজকের ভারতের সামাজিকাবস্থা ইংরেজ শাসন প্রবর্ত্তনের পূর্ব্বের অবস্থায় অবস্থিত নাই। অনুসন্ধান করিলেই তাহা প্রতীত হইবে। পূর্ব্বেকার দাস প্রথার ভিত্তিতে স্থাপিত সমাজ আর নাই, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তযুক্ত জমিদারী প্রথাও অল্পদিনের। আজ ভারতে, সর্ব্ব ধর্ম্ম সম্প্রদায়ই মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিক শ্রেণী উদ্ভূত করিতেছে। আজ ব্রাহ্মণ শ্রমিক হইতেছে এবং অসৎশূদ্রও তথাকথিত ‘অস্পৃশ্য’ রাষ্ট্রে অতিউচ্চ পদ পাইতেছে। আজ পুরাতন অভিজাত বংশীয় লোক শ্রমজীবী হইতেছে (ইহা চাক্ষুস উপলব্ধি করা ব্যাপার) এবং কৃষকের সন্তান “মাননীয় মন্ত্রী” হইতেছে। উৎপাদন প্রণালী এই দেশে যত দ্রুত পরিবর্ত্তন হইতেছে, সমাজবিপ্লবও তত শীঘ্র সংসাধিত হইতেছে। উট পক্ষীয় নীতি অবলম্বন করিয়া আত্মপ্রবঞ্চনা করিলে মনে শান্তি আসে বটে কিন্তু তাহা বাস্তবকে অস্বীকার করা হয়।

এই সব কারণেই মার্ক্স বলিয়াছেন, একজন বুদ্ধিজীবীর উপর বস্তুতান্ত্রিক জীবন পদ্ধতি তাহার প্রভাব বিস্তার করে। মানবের মনে এই পরিবর্ত্তন জন্য অহর্র্নিশি দ্বন্দ্ব বিরাজ করে, অতীতের পিছটান ও বর্ত্তমানাবস্থা তাহার মধ্যে সংগ্রাম করিয়া তাহাকে ক্রমশঃ পরিবর্ত্তন করে। এই মানসিক দ্বন্দ্ব আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের মনে আজ চলিতেছে, বর্ত্তমানের চিন্তাধারা এবং সাহিত্যে নানাপ্রকারের সুর ও ভাবই তাহার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। ভারতীয় সর্ব্ব ভাষার প্রগতিশীল সাহিত্যে এই দ্বন্দ্বের সুর প্রতিধ্বনিত হইতেছে। উপস্থিত সময়ের রাজনীতিক-অর্থনীতিক দ্বন্দ্বভাব (Dialectic) চিন্তাক্ষেত্রের এই বেসুরো ভাবের জন্য দায়ী।

এই গোলমেলে সুরের মধ্য থেকে এইটুকু বেশ বোধগম্য হয় যে, ভারতে বুর্জ্জোয়া সমাজ আজও স্বীয় শ্রেণীগত লীলা প্রকট করিতেছে না, অর্থাৎ এই দেশের বুর্জ্জোয়াশ্রেণী অতীতের সামন্ততন্ত্রীয় সভ্যতা ও সমাজের বাহিরে আসিতে পারিতেছে না। অতীত, ভারতের বুকে জগদ্দল পাথরের ন্যায় চাপিয়া আছে। এইজন্য বুর্জ্জোয়া ক্রমবিকাশ দ্বারা নির্দ্ধারিত আবর্ত্তন আজ অনাগত আছে। অন্য পক্ষে দৃষ্ট হয় যে, শ্রমশিল্প দ্বারা একটা সর্ব্বহারা প্রলেটারিয়েট শ্রেণী সর্ব্বত্র উত্থিত হইতেছে। পাশ্চাত্যদেশ সমূহের ন্যায় নির্ধন বা ভূমিশূন্য কৃষক সন্তান দ্বারাই এই শ্রেণী গঠিত ও পরিপুষ্ট হইতেছে। তাহারাও রাজনীতিতে আসিয়া নিজের দাবী পেশ করিতেছে।

স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছিলেন, হয় রুশ না হয় চীন সর্ব্বপ্রথম প্রলেটারীয় রাষ্ট্র সংগঠন করিবে, কারণ তথায় একটি নিপীড়িত ও শোষিত বিশাল কৃষক শ্রেণী আছে। তাঁহার ভবিষ্যত বাণী রুশদেশে সফল হইয়াছে, চীনের কিয়দংশে হইয়াছে কিন্তু ভারতেও সেই সমস্যা আছে। পুনঃ, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দাবী করেন যে, ইহা কৃষক ও শ্রমিকের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান! এইজন্য যাহা আজ অনাগত এবং চক্ষুর অগোচর, ভবিষ্যতে তাহার রূপ পরিগ্রহণ করা আশ্চর্য্যের কথা নয়।

ভারতে বুর্জ্জোয়া শ্রেণী তাহার শ্রেণীগত চেতনা প্রাপ্ত হইয়া রাষ্ট্রে ও সমাজে স্বীয় ঐতিহাসিক বিবর্ত্তনের ধারা প্রকট করিতে পারিতেছে না বলিয়া এবং একটা বুর্জ্জোয়া শ্রেণীগত বৈপ্লবিক সাহিত্য গড়িয়া উঠে নাই বলিয়া, সর্ব্বহারা শ্রেণী নীরব হইয়া বসিয়া থাকিতে পারে না। তাহাদের ঐতিহাসিক কর্ম্ম রাষ্ট্রে ও সমাজে তাহারা প্রকট করিয়া যাইবে। প্রলেটারীয় কৃষ্টির কথা জার্ম্মানীতে বিগত শতাব্দীতেই উত্থিত হইয়াছিল, এবং রূশে চেকফের সমসাময়িক কালেই গর্কী ও ব্লকের উদয় হয়। প্রলেটারীয় শ্রেণী উত্থিত হইলে, এবং সংঘবদ্ধভাবে নিজের অস্তিত্ব প্রকট করিলে, তাহার মনস্তত্ত্বানুযায়ী সাহিত্যও প্রকাশ হইবে। প্রলেটারিয়েটের অভাব ও অভিযোগ, তাহার অধিকার ও দাবী, তাহার মনঃস্তত্ত্বও যে দৃষ্টিকোন্ দ্বারা সে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিরীক্ষণ করে তাহা অবশ্য প্রথম যুগে বিবর্ত্তিত হইবে। যখন রাজনীতির আসরে প্রলেটারিয়েট শ্রেণী আবির্ভূত হইবে তখন তাহার আশা ও অবস্থার প্রতিপাদ্য সাহিত্যও নিশ্চয়ই সৃষ্ট হইবে। ইহাই গণ-সাহিত্যের প্রথম যুগ।

এই সাহিত্য কে লিখিবে তাহার কোন নির্দ্দেশ ইতিহাস দেয় নাই। তবে ইহা ঠিক যে, যিনি প্রলেটারিয়েটের প্রাণের কথা, তাহার আকাঙ্ক্ষা ও আশার কথা সম্যকভাবে ব্যক্ত করিতে পারিবেন তিনিই এই সাহিত্যের একজন স্রষ্টা হইবেন। প্রলেটারিয়েট সাহিত্যের প্রথম যুগের লেখকদের স্বীয় শ্রেণী হইতে সম্পূর্ণভাবে কক্ষচ্যুত হইতে হইবে, তাঁহাদের প্রলেটারিয়েট মনোভাবাপন্ন হওয়া চাই। এইখানেই হয় আশঙ্কা, ইতিহাসে তাহার নজীরও আছে। রুশে বিপ্লবের কবি ব্লক, অক্টোবরের প্রলেটারিয়েট বিপ্লবের ঐতিহাসিক তাৎপর্য্য বুঝিতে পারেন নাই বলিয়া বোলশেভিষ্টরা অনুযোগ করিয়াছেন (Trotsky–Revolution and Literature দ্রষ্টব্য)। তিনি The 12 (১৯১৮) নামক কবিতায় রূপকভাবে বিপ্লবের গতি বর্ণনা করেন। তিনি বিপ্লবকে, নগরের অতি গরীব লোকদের বিশৃঙ্খলভাবে উত্থান বলিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন “শ্বেত গোলাপের জ্যোতির্ম্মণ্ডল” দ্বারা পরিবেষ্টিত “রক্তাক্ত পতাকা” হস্তে খৃষ্টের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার দৃশ্য তাহাদের চক্ষে প্রতিভাত হইয়াছিল। পুনঃ, এ, বেলী নামক একটী দার্শনিক কবিতা দ্বারা এই বিপ্লবকে সম্বর্দ্ধনা করেন। তিনি বর্ণনা করেন যে, মানবের আত্মা যাহা পুরাতন সমাজ ক্রসে নিহত করিয়াছিল, তাহারই পুনরুত্থান এই বিপ্লব দ্বারা সংঘটিত হইয়াছে (U.S.S.R. Handbook, p 445)। এতদ্বারা উদারনীতিক বুর্জ্জোয়া মনস্তত্ত্ব‍ই প্রকাশ পাইয়াছে!

সনাতনী সাহিত্যিকের ইতিহাসে এক একটা সামাজিক শ্রেণীর নির্দ্দিষ্ট লীলা (Role) বুঝিতে পারে না, এবং পারিপার্শ্বিক অসামঞ্জস্যকে ঢাকিবার জন্য নানাপ্রকারের ধর্ম্মের ব্যাখ্যা, অতীন্দ্রিয়বাদ, কর্ম্মফল, অদৃষ্ট প্রভৃতি দ্বারা ব্যাখ্যা করেন। ইহার অর্থ, লেখকের শ্রেণী চেতনানুসারে জ্ঞাত ভাবে বা অজ্ঞাতভাবে তিনি পারিপার্শ্বিক অনুষ্ঠান সমূহের অর্থ না বুঝিতে পারিয়া ধর্ম্মের আবরণে তাহা ঢাকা দিবার চেষ্টা করেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ খৃঃ ষোড়শ শতাব্দীতে জার্ম্মানীর শতছিন্ন অবস্থার কারণ অনুসন্ধান না করিয়া শ্রমজীবী (মুচি) শ্রেণীয় বোয়েম নামে এক ব্যক্তি অতীন্দ্রিয়বাদের উপদেশ প্রদান করিতে থাকেন। তিনি বলিলেন, “লোক, আকাশ, তারা, প্রকৃতি, স্বর্গ, নরক, দেবদূত সকলের উপর ধ্যান নিয়োজিত করিবে।” এত দ্বারা তদানীন্তন শাসকশ্রেণী তাঁহার উপর বড় খুসী হয় এবং তিনিও একজন মহাপুরুষ (mystic) বলিয়া ইতিহাসে গণ্য হইলেন। এই প্রকারে ভারতেও বৈষ্ণব পদাবলী সমূহ সৃষ্ট হইয়া লোককে ঘুম পাড়াইতে লাগিল। এই প্রকারের কারণবশতঃ ১৯১৮ খৃঃ জার্ম্মান বিপ্লবের পর, একদল লোক ধর্ম্ম নিয়া হৈচৈ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা বলিলেন ধর্মজ্ঞানের অভাবেই তাহাদের পতন হইয়াছে! তাঁহারা এই বিপ্লবের পশ্চাতের ঐতিহাসিক কার্য্য কারণ সম্বন্ধ আবিষ্কার করিলেন না; আর ইহাদের মুরুব্বী রাজনীতিকেরা “Stab behind the back” (পশ্চাৎদিক হইতে ছুরিকাঘাত) মত প্রচার দ্বারা পরাজয়ের গ্লানি ও বিপ্লবের আবির্ভাবের ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন। এই প্রকারে, একটা অনুষ্ঠানের (phenomenon) ভীমমূর্ত্তি দেখিয়া তাহার প্রকৃত কারণ নিরূপন করিবার অনিচ্ছা বা অস্বীকৃতি, বা ‘যেমন আছি তাহা বেশ আছি’ বলিয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া থাকা দ্বারা চিন্তাশক্তিরই দৈন্য প্রকাশ পায়। এই প্রকারেই প্রাচীন কালের জৈন, বৌদ্ধ ও মধ্যযুগের বৈষ্ণব ও সম্ভ আন্দোলনগুলির ব্যাখ্যা আমাদের দেশের অতীতের পণ্ডিতেরা করেন নাই। ইহা তাঁহারা বরাবর বেদ-বিদ্বেষী স্বার্থপরদের কুচক্র (খৃষ্টীয় সাহিত্যের Anti-Christ রূপ অনুষ্ঠানের ন্যায় বর্ণাশ্রম বিরোধী অনুষ্ঠানগুলিকে ভারতীয় সনাতনীরা এই প্রকারে ব্যাখ্যা করিয়াছেন); আর মধ্যযুগে তুলসীদাস বলিলেন, ‘কেহ বর্ণাশ্রম মানে না। শূদ্র বলে আমি ব্রাহ্মণ থেকে কিসে ছোট।’ এইজন্যই তিনি তাড়াতাড়ি ‘রামচরিত মানস’ রচনা করিয়া রাম রাজত্বের পরিকল্পনা করিলেন। আর, বিংশ শতাব্দীতে এই ‘ফ্যাসীবাদ’ একদলের আদর্শ হইয়াছে। এই সব ব্যাপারের উপরের আবরণ একটু আঁচড়াইলেই ধনী শ্রেণীর বনিয়াদী স্বার্থ বাহির হইয়া পড়ে!

ভারতের গণ-শ্রেণীকে চিরকালই অন্ধকারে রাখা হইয়াছে। সে বেদ পাঠ করিলে তাহার কানে তপ্ত তৈল বা সীসা ঢালিয়া দিবার, ব্রাহ্মণের আসনে বসিলে তাহার পশ্চাৎভাগের চামড়া ছাড়াইয়া লইবার, ব্রাহ্মণী হরণ করিলে তাহাকে মাদুরে জড়াইয়া পুড়াইবার ব্যবস্থা এই দেশের ধর্ম্ম ও অর্থ শাস্ত্রসমূহে আছে। কিন্তু উপরের স্তরের লোক নিম্ন স্তরের লোকদের প্রতি এইরূপ দোষ করিলে তাহার অতি লঘু দণ্ডের ব্যবস্থা হইয়াছে। এই “বৈর-দেয়” হিন্দুর আইনে বরাবরই আছে। অথচ বলা হয়, শূদ্র নিম্নস্তরের জীব এবং জ্ঞানার্জ্জনের অনুপযুক্ত। বিগত জন্মের কর্ম্ম সে ইহজগতে ভোগ করিতেছে আর এই জন্মে দেবদ্বিজে ভক্তি করিলে পরজন্মে সুখভোগ করিবে। এই প্রকারে শ্রমজীবী শ্রেণীসমূহকে চিরকালই বঞ্চিত ও দাবাইয়া রাখা হইয়াছে। অবশ্য ইহার ভীষণ প্রতিক্রিয়াও ইতিহাসে সংঘটিত হইয়াছে; ভারত পরাধীন হইয়াছে!

আজও যখন গণ-শ্রেণীসমূহ মস্তকোত্তলন করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তখন নানা দার্শনিক তত্ত্ব, নানা প্রকারের রাজনীতিক চালবাজী, রামরাজত্ব, রাজনীতিক জাতীয়তাবাদীয় সাহিত্য প্রভৃতি সৃষ্ট হইতেছে। রুশে ১৯০৫ খৃষ্টাব্দের বিপ্লবের পূর্ব্বে ভূতপূর্ব্ব বৈপ্লবিক পল ষ্ট্রুভেও এই প্রকারে গণ-শ্রেণীকে পুঁজীবাদীদের সহিত মিলিতে উপদেশ প্রদান করেন। এই কারণবশতঃই আজ ‘জাতীয়তাবাদী সাহিত্যে’র নাম শ্রবণ করা যাইতেছে, যেন শ্রমজীবী শ্রেণীসমূহ জাতির এবং জাতীয়তাবাদের বাহিরে! তাহা হইলে “জাতীয়তাবাদ” অর্থে কি কেবল জমিদার, পুঁজীবাদী, কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ী দোকানদারদের স্বার্থ? অবশ্য ভাড়াটিয়া রূপে ক্ষুদ্র বুর্জোয়া এই সঙ্গে আছেন। কিন্তু এই শ্রেণীর মনস্তত্ত্বানুযায়ী লোকেরা সর্ব্বদলেই ছোটাছোটি করে, সর্ব্বস্থানেই তাহাদের প্রাপ্ত হওয়া যায়। আসল কথা এই, ভারতের গণশ্রেণীর শক্তির প্রকাশ যেখানে যে সময়ই হইয়াছে তাহার রূপ দেখিয়া আমাদের পুঁজীবাদী জাতীয়তাবাদ ভয় পাইয়াছে, তাই এই শক্তিকে চাপ দিবার নানা প্রকারে তুকতাক, ঝাড়ন ফোড়নের চেষ্টা চলিতেছে, ভূতকে হাঁড়ি চাপা দিবার প্রচেষ্টা চলিতেছে। কিন্তু ইহারা ইতিহাসের গতির সহিত পরিচিত নহে, ভারতের ইতিহাসে যুগানুযায়ী প্রত্যেক শ্রেণীর লীলার অনিবার্য্যতার মর্ম্ম ইহারা হৃদয়ঙ্গম করেন না। তৎপরিবর্ত্তে নানা অবাস্তব ব্যাপার দ্বারা সাহিত্য ভরপুর করিয়া রাখেন। এই কারণবশতঃ ফ্রয়েডের প্রতি ইহাদের এত প্রীতি। এই সব সাহিত্যকে আমরা Decadent period এর (হ্রাস বা ক্ষয়ের যুগ) সাহিত্য বলিয়া নামকরণ করি।

চিন্তাশীল ব্যক্তিদের এই সত্য স্বীকার করিয়া গ্রহণ করিতে হইবে যে, গণশ্রেণীদের পরিশ্রমই কৃষ্টির মূল উপাদান সমূহ সৃষ্ট করে এবং তদ্বারা নানা ভাব তরঙ্গের উদয় হয়! এই সত্য সোভিয়েট রুশে সম্যকরূপে বোধগম্য হইয়াছে বলিয়াই আজ অর্দ্ধশিক্ষিত শ্রমিক ও অশিক্ষিত এবং সভ্যতার পশ্চাদভাগে অবস্থিত কৃষক স্বীয় সমাজের মূল্য বৃদ্ধি করিয়াছে, এবং একটা বিশাল অজেয় রাষ্ট্র গঠন করিতেছে। এই রাষ্ট্রের লোকদের মধ্যে আর শ্রেণী ও বর্ণ বিভেদ নাই। সকলেই শ্রমজীবী বা শ্রমিক অর্থাৎ সকলকে শ্রম করিরা খাইতে হয়।

এ হেন প্রলেটারীয় রাষ্ট্রে যে সাহিত্য সৃষ্ট হইতেছে তাহাতে নূতন সুরই উত্থিত হইতেছে। ইহার ভিত্তি হইতেছে বাস্তবিকতা (Realism)। ইহাতে নিরাশা, অতীন্দ্রিয়বাদ, হাহুতাস নাই, আছে শ্রমের কথা, আছে সংগঠনেব কথা, আছে আশার কথা, আছে জীবনের সর্ব্বাঙ্গীন মুক্তির আস্বাদনের কথা, আছে আনন্দের কথা। সৎ-চিৎ-আনন্দ এই সমাজই ভোগ করিতে পায়। এই প্রলেটারিয়েট সাহিত্যের নায়ক হইবেন একজন “শ্রমিক” যিনি শ্রম শিল্পের সমস্ত তথ্য করায়ত্ব করিয়া নিজের সঙ্ঘবদ্ধাবস্থায় আছেন এবং অপরকে সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া শ্রমকে শিল্পের স্তরে উন্নীত করেন। শ্রমকে এই সাহিত্য ‘সৃষ্টি’ বলিয়া বুঝিবেন (Gorky - Problems of Soviet Literature)। যখন শ্রমজীবী বুঝিতে পারিবেন যে তিনি নিজের জন্যই পরিশ্রম করিতেছেন, অপরকে স্বীয় শ্রম বিক্রয় করিতেছেন না, তাঁহার শ্রমের বিনিময়ে সমাজ তাঁহার অব্যবহার্য্য দ্রব্যসমূহ প্রদান করিতেছে; যখন শ্রমজীবী বুঝিতে পারিবেন যে তিনি সমাজের একটি শোষণ বিহীন অঙ্গ; যখন তিনি তাঁহার সম্যকভাবে আত্মজ্ঞান লাভ করিবেন, তখন তাহার রচিত সাহিত্য ও অন্য রূপ ও রস প্রকাশ করিবে। তখন চণ্ডীদাসের বাণী:

“শুনহে মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য,
তাহার উপরে নাই,”

সফল হইয়া সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গী অন্যপ্রকার হইবে। এইটি হইবে প্রলেটারীয় সাহিত্যের দ্বিতীয়াবস্থা। তখন প্রলেটারিয়েট সাহিত্য আশার বাণী উচ্চারণ করিতেছে, জগতকে নূতনভাবে গড়িবার আকাঙ্খা করিতেছে, সমাজে সকল লোকের সাধ্যমত পূর্ণ বিকাশের সুযোগ প্রাপ্তির গান গাহিতেছে। তখন সমাজে Decadent (ক্ষয়শীল) যুগ অন্তর্হিত হইয়াছে, সাহিত্যে অতীন্দ্রিয় ধোঁয়াটে কথাতেই লোককে ভুলাইবার জন্য তখন “বিরিঞ্চি বাবা”র ভৌতিক ক্রিয়া অতীতের গল্প হইয়া গিয়াছে, আছে জগতের Stern Reality (কঠোর বাস্তব ঘটনা)। তখন এই শ্রেণীশূন্য সমাজের সাহিত্য, প্রকৃতিকে স্বীয় কার্য্যে নিয়োজিত করিবার জন্য উপায় নিদ্দেশ করিতেছে। তখন এই প্রলেটারিয়েট সাহিত্য নূতন সাম্যবাদী সমাজ ও তাহার সংস্কৃতির সৃষ্টির কথা বলিবে। প্রলেটারিয়েট সাহিত্য সুস্থ ও সবল জাতির চিহ্ন বহন করিবে। এইজন্যই লেনিন কম্যুনিস্ট তরুণদের ফ্রয়েডের বই পড়িয়া ভাব সংগ্রহ করিবার বিশেষ বিপক্ষে ছিলেন। (Klara Zetkin এর Reminiscences of Lenin দ্রষ্টব্য)।

এই প্রলেটারীয় সাহিত্যের প্রথমাবস্থার বাস্তবরূপ কি, তাহা প্রদর্শনজন্য এসিয়ার সোভিয়েট রাষ্ট্রসমূহে নবোত্থিত সাহিত্য হইতে কিঞ্চিৎ উদাহরণ এই স্থলে প্রদত্ত হইল (এই কবিতাগুলি Joshua Kunitz দ্বারা লিখিত “Dawn over Samarkand” নামক পুস্তকে ইংরেজীতে ভাষান্তরিত করা হইয়াছে):—“আমরা তাজিকেরা যাহা দেখি সেই বিষয়ে গান করি...যাহারা প্রায় তিন যুগ আগে গত হইয়াছে, ফুল ও সুন্দর নারীর কথা বলিত। কিন্তু তাহারা আর নারী ও ফুলের বিষয় গান করে না। তাহারা আমাদের নূতন মুক্তির কথার গান করে, তাহারা উড়ো জাহাজের বিষয় গান করে, তাহারা ভবিষ্যতের সুন্দর দিনের বিষয়ে গান করে।”

তাজিক কবি সুখাএলি বলিতেছেন: “”একটি বরের ন্যায় উজ্জ্বল সজ্জাকৃত একটি নূতন সহর দেখিবে, তুমি বরের সুখী গান শুনিবে, শুন! একটা যন্ত্র (Propeller) গুণ গুণ করিতেছে, রাস্তায় তাড়াতাড়ি একটা অটোমোবিল যাইতেছে, ধোঁয়া ও ধূলায় মেঘাচ্ছন্ন করিয়া একটা লৌহ রেলগাড়ী যাইতেছে।”

পুনঃ, ইনি গাহিতেছেন: “সূর্য্য অস্ত যাবার আগে, একটি কৃষকের কুঁড়েঘরে প্রবেশ কর, সে যে গান গাহিতেছে তাহা শুন, তাহার তাম্বুরিণের নৃত্যের ছায়া লক্ষ্য কর। দেখ, আকাশে মুক্তির সূর্য্য উদয় হইয়াছে। ঝরণার জলমুক্ত হয়ে আমাদের উপত্যকাসমূহ দিয়া গর্জ্জন করে প্রবাহিত হইতেছে। এবং আমাদের সোভিয়েট লোকেরা সর্ব্বত্র গান করিতেছে।”

মানসার নসো নামক একজন কবি বলিতেছেন:— “পূর্ব্বে তিনি ডাণ্ডাদ্বারা প্রহৃত হতেন...অন্ধকার গর্ভে তাহাকে ফেলে রাখা হত...চব্বিশ দিন বিনা আহারে তাহাকে রাখা হয়েছিল...কিন্তু অতীতকে স্মরণ করে লাভ কি?... আমার হৃদয় নূতন যুগের কথা গাহে! তাজিকভূমি। অবশেষে তোমার দিন এসেছে! নিষ্ঠুর যুগ অবসান হয়েছে, তোমার সময় অবশেষে এসেছে! মেসিন যাহা আমাদের মাঠে জমি চষে, তোমার সময় অবশেষে এসেছে! ও সোভিয়েট তোমার দিন এসেছে অবশেষে!”

আবার, তাজিক কবি লাখুটি তাঁহার কবিতাতে কল্পনা প্রসূত পুরাতন অলঙ্কার না ব্যবহার করিয়া আজকালকার সোভিয়েট সভ্যতাগত ভাষার শব্দ ব্যবহার করিতেছেন। তাঁহার কবিতাতে তিনি ‘কারখানার সাইরেন বংশী’, ‘কারখানার ধূম,’ ‘স্টালিনগ্রাড ট্রাক্টর’, ‘এখনও গরম ইস্পাত’, ‘ভারী হাতুড়ী’, ‘প্রত্যেক কলহজে (সমবায়ে কৃষিক্ষেত্র) শষ্যের শীর্ষ’, ইত্যাদি তাঁহার কবিতায় অলঙ্কার রূপে প্রয়োগ করিতেছেন। “প্রাভদা” পত্রিকায় রিপোর্ট করিয়া একটা কবিতার শেষে তিনি বলিতেছেন— “Our unions call for brigades. Shock work in our shops and our schools” (আমাদের সংঘগুলি পলটন চায়। আমাদের দোকানে এবং স্কুলে ধাক্কা দেওয়ার কার্য্যের জন্য)। পুনঃ, কলহজের একটি তাজিক কৃষক গাহিতেছেন—“যখন আমি দেখি আমাদের শুষ্ক মাঠে ফুল ফুটে, যখন তুলার জমিতে জল বহে যায়, যখন একটা বাঁধা বান্দ দেখি, তখন আমার নিশ্বাস মুক্ত ও গরম হয়।... যখন আমি দেখি আমার পুত্র মাঠে মেসিন চালাইতেছে, যখন আমি দেখি শস্য জমিতে শিকড় গাড়িতেছে, তখন আমি উচ্চৈস্বরে বলি, যাহারা পরিশ্রম করে তাহারা জয়যুক্ত হউক!”

অবশ্য ভারতের গণশ্রেণীর পারিপার্শ্বিকাবস্থা এখনও এই প্রকার গড়িয়া উঠে নাই, সেই জন্য তাহার গানের উচ্ছ্বাস আমরা আশা করিতে পারি না। কিন্তু তাহার নিজের মর্ম্ম বেদনার উচ্ছ্বাসের পরিচয় আমরা কোথায় পাইতেছি? জন ও গণের সম্বন্ধে যাহা আজ সাহিত্যাকারে প্রকাশিত হইতেছে তাহা উপরের স্তরের শিক্ষিত লোকদের দ্বারা লিখিত হইতেছে। এতদ্বারা আমরা সমাজে Liberal bourgeois (উদারহৃদয় বুর্জ্জোয়া) শ্রেণীয় লোকদের মনোভাবই পরিলক্ষিত করি। ইহা গণের নিজস্ব সাহিত্য নয়; বরং বর্ত্তমান ভারতীয় সাহিত্যের ধারা দেখিয়া ইহাই প্রতীত হয় যে ভারতে Decadant Feudal (ভগ্নমান সামন্ততান্ত্রিক) যুগের পরই গণ শ্রেণীয় যুগ আসিবার চেষ্টা হইতেছে।

এই স্থলে ইহাও বক্তব্য যে প্রলেটারিয়েট সাহিত্যে কেবল বাস্তব ঘটনার চিত্র থাকিবে না। Art for Art’s sake বলিয়া একটা কথার মূল্য নাই, “আর্ট কিছুর জন্য” (Art for something’s sake) ইহাই হইতেছে বৈজ্ঞানিক সত্য। এইজন্য প্রলেটারিয়েট সাহিত্য যখন নূতন জীবনের কথা

. বলিবে, তখন নূতন শিল্পের রস ও রূপ থাকিবে, রোমান্স ইত্যাদিও থাকিবে, কিন্তু সকল দ্রব্যেরই নূতন মূল্য প্রদত্ত হইবে।

এই দেশের Decadent সাহিত্যকে পরিহার করা আশু প্রয়োজন। গোলামী ও পরাজিত মনোবৃত্তি প্রসূত এই সাহিত্য মনস্তত্ত্বকে অস্বীকার করিয়াই, চলিতেছে। মানব মনস্তত্ত্ব, সামাজিক মনস্তত্ত্ব, যৌন-মনস্তত্ত্ব কিছুরই বালাই নাই এই সাহিত্যে। ইহাতে স্ত্রীলোককে তাহার সম্মান প্রদান করা হয় না। “মহাসুখবাদ”ই এই ভোগেচ্ছু সাহিত্যের লক্ষ্য। শিক্ষিতা মহিলা কিরণ্ময়ী থেকে দুঃর্ভিক্ষ প্রপীড়িত দুঃস্থ। নারী পর্য্যন্ত সকলেই যেন ইন্দ্রিয়ের দাস। স্ত্রীলোক যেন কেবলমাত্র পুরুষের ভোগার্থ সৃষ্ট! তাহার স্বভাব ও শিক্ষাজাত Inhibition (সঙ্কোচন শক্তি বা সরম) এবং মনস্তত্ত্ব এই সাহিত্যে অস্বীকৃত হয়। এই সাহিত্যে পুরুষ ও স্ত্রীলোকের দৌর্ব্বল্যই কেবল অঙ্কিত হয়। নায়ক-নায়িকার প্রেমই এই সাহিত্যের প্রতিপাদ্য। ইহাতে সামাজিক মনস্তত্ত্বের কোন সংবাদ নাই। এই স্থলেই এই ক্ষয়শীল যুগের সাহিত্যের সহিত সোভিয়েট সাহিত্যের প্রভেদ! তথায় প্রত্যেক সাহিত্যিক স্বীয় সময়ের সামাজিক চিত্র স্বীয় নভেল মধ্যে প্রকাশ করিতেছেন। তথাকার সাহিত্যে কালোপযোগী সামাজিক তথ্যেরই পরিবেশ হয়। আর এই দেশে যথায় “ক্ষয়িষ্ণু হিন্দ”, “ক্ষয়িষ্ণু বাঙ্গালী” প্রভৃতির আর্ত্তনাদ উঠিয়াছে, যথায় লোকে বহু দিন ধরিয়া পরাধীনতায় আত্মবিস্মৃত হইয়া আছে, তথায় অযৌক্তিক ও মনস্তত্ত্ব বিরুদ্ধ যৌন সম্পর্কীয় গল্প তরুণ ও বিকারগ্রস্থ মনে প্রীতি উৎপাদন করিতে পারে। কিন্তু তাহা সুস্থ ও সবল সাহিত্য নয়। এই Decadent সাহিত্য দ্বারা নিরাশা ও পরাজিত মনোবৃত্তিই প্রকাশ পায়। যে সাহিত্যে জাতির মন ক্ষুণ্ণতা এবং হতাশাকে ঢাকিবার জন্য যৌন সম্বন্ধের অস্বাভাবিক গল্প, বুর্জোয়া রোমান্সের চাঞ্চল্যকর প্রেম কাহিনী ও জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে শ্রেণী স্বার্থের কথা ভরপুর হইয়া আছে, তাহা পরিত্যাগ করিয়া দেশের শোষিত ও পদদলিত লোকদের আশার কথা, নূতন সমাজ সংগঠনের কথা, ভবিষ্যতের সোনার ভারত এবং সোনার বাঙ্গলা গঠনের উপায়ের পথ নির্দ্দেশক সাহিত্যের সৃষ্টির প্রয়োজন। এই দেশের গণসমূহ যুগ যুগান্ত ধরিয়া অন্ধতার তিমিরে পড়িয়া আছে এবং পদদলিত হইয়াছে বলিয়া তাহার শ্রেণী চৈতন্য এখনও জাগ্রত হইতেছে না । তাহাকে জাগ্রত রাখিবার জন্যই তাহার মনস্তত্ত্বানুযায়ী সাহিত্য চাই। এই দেশের গণ সাহিত্যের প্রথম স্তরের ইহাই কার্য্য। উপরের স্তরের উদারনীতিক লেখকদের দ্বারা লিখিত “গণ” সম্বন্ধীয় পুস্তকের গরীবের উপর দয়ার ভাবে পিঠ চাপড়ানী আজকাল ফ্যাসান হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহা “গণ সাহিত্য” নহে। এবম্প্রকারের সাহিত্যে, পুঁজীবাদী মালিকের দুঃখী শ্রমিকের প্রতি এবং কৃষকের প্রতি জমিদার পুত্রের ‘দরদ’ দেখাইয়া গণের আত্ম-চেতনা বিনষ্ট করিবারই চেষ্টা আছে । এই প্রকারের সাহিত্যে গণকে তাহার যথার্থ মূল্য দেওয়া হয় না। যে সাহিত্য গণকে তাহার যথার্থ মূল্য প্রদান করিবে, সেই অনাগত সাহিত্যের অপেক্ষায় আমরা বসিয়া আছি। কিন্তু, ইতিহাসের দ্বন্দ্বজনিত গতি সেই অনাগতকে একদিন লোকচক্ষে সমূর্ত্ত করিবে। সেই জন্যই বৈদিক ঋষির কথা প্রতিধ্বনি করিয়া আমরাও বলি—আগে চল । আগে চল।