রাজন্তঃপুরের উদ্যান। পুষ্পিতা ও সিতিমা বৃক্ষতলে আসীনা।
পুষ্পিতা।
পরশু মহারাণীর সভায় প্রথম যে গানটা গেয়েছিলি, সেই গানটা গানা ভাই। একটিবার গা।
সিতিমা।
কোন্টা রে? কোন্টা প্রথমে গেয়েছি, কোনটা মাঝখানে, আমার কি করে মনে থাকবে? এক এক জনের এক এক ফরমায়েস ছিল।
পুষ্পিতা।
সেই যে-এসো তুমি, এসো একবার।
সিতিমার গান।
এসো তুমি, এসো একবার!
মুখ তুলে চাহি নাই কভু লাজে অভিমানে,
এ প্রাণের ব্যাকুল বাসনা মিশে আছে প্রাণে;
বেশী কিছু চাহিনাতো আর,
এসো তুমি, এসো একবার।
পুঞ্জীকৃত অতৃপ্ত কামনা, এই ব্যথা ভার
লয়ে আমি কেমনে হইব। বৈতরণী পার?
এরা মোরে ফিরায়ে আনিবে, রাখিবে ধরিয়া,
এ জীবনে শান্তি না পাইনু, পাব না। মরিয়া,
না ছাইতে মৃত্যুর আঁধার এসো তুমি, এসো একবার।
সেই দিন বুঝায়ে বলিব বাকী যা বলিতে,
সেই দিন কাহারেও নাহি চাহিব ছলিতে;
খুলে দিব হৃদয়ের দ্বার,
এসো তুমি, এসো একবার!
সিতিমা।
হ’ল? এ গানটা একশোবার কেন শুন্তে চাস?
পুষ্পিতা।
ভালবাসার গানগুলো আমার বার বার শুন্তে ভাল লাগে—বিশেষ তোর মুখে।
সিতিমা।
খুব ভালবাস্তে জানিস কিনা! কাকে ভালবাসিস্ রে?
পুষ্পিতা।
তুই যে গানের মধ্যে প্রাণটা ঢেলে দিয়ে গাস্—তুই কাকে ভালবাসিস্ আগে তাই বল্।
সিতিমা।
আমাদের কাউকে ভালবাস্তে নেই, তা জানিস নে?
পুস্পিতা।
হ্যাঁ তা জানি। আমরা মহারাজের দাসী; যদি ভালবাসতে হয়, তাঁকে বাস্ব, নয়তে কাউকে নয়! কিন্তু ভাই ভালবাসা না পেয়ে দেওয়া—
সিতিমা।
না পেলে কিছু দেওয়া যায় না?
পুষ্পিতা।
না পেলে কিছুতো ভাল লাগেনা। তাই মহারাজ যেদিন একটু মুখের দিকে স্নেহের চোখে তাকান, ইচ্ছা হয় তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ি; যেদিন অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকেন, সেদিন আমার পায়ের নুপূর, হাতের কঙ্কণ খুলে ফেলে, কণ্ঠের হার ছড়া টেনে ছিঁড়ে, ওড়নাখানা উড়িয়ে দিয়ে, একেবারে বাইরে গিয়ে, ধূলায় মুখ গুঁজে পড়ে থাক্তে ইচ্ছা করে।
সিতিমা।
ও বাবা! কি অভিমান গো!
[গান]
মিছা এই সাজ সখি মিছা এই সাজ গো
বসনে ভূষণে মোর কিবা আর কাজ গো?
বলে দে’ কি দিয়ে ঢাকি জীবনের লাজ গো
ফেলে দে ফুলের শয্যা ধূলে শোব আজ গো।
পুষ্পিতা।
হয়েছে কবি মশাই, আর না।
সিতিমা।
[স্নেহভরে পুস্পিতার দিকে চাহিয়া, মৃদু হাস্য পূর্ব্বক] এত অভিমান তোর?
পুষ্পিতা।
ভাই, যে ভালবাসেনা তার উপর আবার অভিমান কি? যে ভালবাসা চেয়ে ভালবাসা দাবী কর্তে দেয়, তার উপরেই অভিমান সাজে। চন্দ্র সূর্য্যের উপর কি মানুষের অভিমান সাজে? প্রভুর উপর কি দাসীর অভিমান সাজে? হায়, অভিমান কর্বার ভাগ্যও যে আমাদের নাই!
সিতিমা।
তবে ভাগ্যের উপর অভিমান কর্।
পুষ্পিতা।
তাতেই বা লাভ কি? দুর্ভাগ্য তাতে সরে দাঁড়ায় না।
সিতিমা।
তবে আর এক উপায় আছে। দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্য বলে বরণ্ কর, তখন সব নূতন ঠেকবে।
পুষ্পিতা।
একটুখানি ভালবাসা যদি পেতাম। তবে আর সব দুর্ভাগ্য আনন্দে বহন করতাম।
সিতিমা।
তুই পেয়ে তবে দিতে চাস্। একটুখানি পেলে পর অনেকখানি ঢালতে পারিস। পাস্নে এই তোর দুঃখ-নারে? বড় দুঃখ তোর!
পুষ্পিতা।
চন্দ্রা কি পুণ্য করেছে?
সিতিমা।
কি পাপ করেছে বল্।
পুষ্পিতা।
পাপ কেন? মহারাজের সুনয়নে পড়া কি পাপ?
সিতিমা।
তোরা কি বুঝিস্ জানিনে। মহারাজ কি আমাদের তেমনি পুরুষ? যে সুন্দরী সে কার না দৃষ্টি আকর্ষণ করে? তাই বলে’ সে মহারাজের অনুরাগ পেয়েছে এমন কথা কে বল্লে?
আহা! বেচারা তোমার চেয়েও ছেলেমানুষ-কিছুই বোঝে না! মহারাজও কিছু বোঝেন না, বড় সেনাপতিও না।
সিতিমা।
বড় সেনাপতি খুব ভালই বোঝেন। আর আমাদের মহারাজ গুণগ্রাহী পুরুষ, গুণের আদর করেন। তিনি আমাদের সকলের
প্রভু, যে সাহস করে' কাছে যায়, মিষ্ট কথায় তাকে তুষ্ট করেন, যে যা ভিক্ষা করে তিনি তা দিয়ে থাকেন।
পুষ্পিতা।
চন্দ্রা যদি রাণী হতে চায় তাকে রাণীর পদ দেবেন?
সিতিমা।
মনে তো হয় না। তবে সেনাপতির জন্য যদি একটা ছোট খাটো রাজ্য চায়, তা দিলেও দিতে পারেন।
পুষ্পিতা।
একি ভালবাসা নয়?
সিতিমা।
না, ভিখারীর প্রতি অনুগ্রহ।
পুষ্পিতা।
কি করে’ জান্লি?
সিতিমা।
মহারাজের অন্তঃপুরে ছেলেবেলা থেকে আছি। বড় মহারাণীর পায়ের কাছে বসে’ ছেলেবেলা যখন গান অভ্যাস করেছি, তখন দুজনার কথাবার্ত্তা শুনেছি। ভালবাসা যা ওঁদের দুজনার মধ্যে দেখেছি। ভালবাসা কি যাকে তাকে দেওয়া যায়? ওটা দেবতার যোগ্য-দেবতার ভোগ্য।
পুস্পিতা।
মানুষেয় নয়? তবে মহারাজ আর বড় মহারাণী দেবতা ছিলেন।
সিতিমা।
তা বই কি?
পুষ্পিতা।
বড় মহারাণী তোকে অনেক গান শিখিয়েছেন-না? নিজেই শেখাতেন?
সিতিমা।
কতগুলো নিজেই শিখিয়েছেন, আর বেশীর ভাগ ওস্তাদ রেখে শেখাতেন। কিন্তু সে সবও তাঁর ফরমায়েস মত গাইতে হ’ত। কোন্ কথায় কেমন সুর দিতে হবে, কোন্খানে কতটুকু জোর, কোন্খানটা কোমল করুণ, কোন্খানটা শান্ত গভীর, কোন্ খানটা উদ্দীপক, সব বলে দিতেন। কুমার উজ্জ্বল আর আমি একসঙ্গে এক ওস্তাদের কাছে গান বাজনা অভ্যাস করতাম। কুমার দিদির অঞ্চলের নিধি ছিলেন। মাতৃবিয়োগের পর এখানে এসে যখন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন, মহারাণী আমাকে ওঁর সঙ্গে খেলে, গল্প করে' গান করে' ভুলিয়ে রাখ্তে বল্তেন।
পুষ্পিতা।
উজ্জ্বলসিং তাই তোকে সই বলে’ ডাকেন?
সিতিমা।
তাই।
পুষ্পিতা।
আচ্ছা, সেনাপতিমশাই চন্দ্রার দিকে চেয়ে অজ্ঞান, কুমার উজ্জ্বল সিংহেরও সেই অবস্থা, তোর দিকেতো কুমার একবারও চান্ না।
সিতিমা।
আমিও চাই না, কেউ আমার দিকে চায়।
পুষ্পিতা।
কিন্তু তুই যখন গান গাস তখন আমি দেখি যেন কুমার তোর গানটা নিঃশব্দে পান কচ্চেন।
সিতিমা।
আমিও যেন দেখি, আমার গানের দোলায় তাঁর কবির প্রাণ দুলছে, উঠছে, নামছে; তাই ওঁকে আমি আমার গানের দেশের রাজা করে' রেখেছি।
পুষ্পিতা।
(তর্জ্জনী নাড়িয়া) তুই কুমারজীকে ভালবাসিস্।
সিতিমা।
বেশী আর কি বল্লি? আমি আকাশের চাঁদকেও ভালবাসি।
পুষ্পিতা।
তুই যে গাইলি—
একদিন বুঝায়ে বলিব বাকী যা বলিতে:
সেই দিন কাহারেও নাহি চাহিব ছলিতে;
খুলে দিব হৃদয়ের দ্বার
এসো তুমি এসো একবার!
ওটা তোর মনের কথা। সত্যি বল্-তা নয়?
সিতিমা।
তুই তো জানিস্ ভাই, মহারাজকে ছাড়া আর কোন পুরুষ মানুষকে আমাদের ভালবাস্তে নেই। তিনি আমাদের বিবাহ করেননি, অথচ তিনি ছাড়া আর কেহ নাকি আমাদের স্বামী হতে পারে না। তবে আর অন্য লোককে ভালবাসি কি করে’?
পুষ্পিতা।
সত্যি, আমাদের যে কি অদৃষ্ট!
সিতিমা।
তা এমন মন্দ অদৃষ্টই বা কি তোদের? ভাল খেতে পাস্, শুতে নরম বিছানা পাস্, পরতে সুন্দর সুন্দর দামী ঢাকাই আর বেনারসী শাড়ী, মখমলের জামা, কিংখাবের ওড়না, হীরামুক্তার অলঙ্কার পাস, যেদিন ভাল নাচিস্, মহারাজের কাছে বকশিশ পাস্-আবার চাই কি?
পুষ্পিতা।
ত। সত্যি। তবু পেট ভর্লেই প্রাণের পিয়াস মেটে না। প্রাণটা যেন আরও কিছু চায়। কোন একজনকে একেবারে আপন কর্তে চায়। একেবারে আপনার কাউকে পেলে কেমন লাগে একটিবার দেখ্তে ইচ্ছা করে। তাতো কখন হবে না॥
সিতিমা।
একেবারে আপনার কেউ কখনো হয় কিনা কে জানে? হয়তো গরীব মানুষদের মধ্যে হয়-দেখেতো সেই রকম মনে হয়। গরিব হয়ে একবার দেখ্বি?
পুষ্পিতা।
না বাপু, গরীব হতে ভয় করে।
সিতিমা।
তবে আর ভালবাসা-বাসি চাস্নে।
[একজন দাসীর দ্রুত প্রবেশ]
কিরে ভয় পেয়েছিস্ যে!
দাসী।
আমি এমন তো আর দেখিনি!
পুষ্পিতা।
কি দেখ্লি যা আর দেখিস্ নি? এ অন্দর মহলে নতুন কিছু দেখ্তে পেলে আমি যে বেঁচে যাই, এক ঘেয়ে তোদের মুখ আার ভাল লাগে না।
দাসী।
[ চুপিচুপি] ঐ নাচখানার ভিতরে তরোয়াল খুলে সব সেপাই দাঁড়িয়ে আছে। চাতাল থেকে বাইরে আসবার সময় দেখ্লুম সেখানেও অমনি!
পুষ্পিতা।
আরে, লড়াই বেধেছে; রাজা রাজধানীতে নাই, পুরী শূন্য; আর আমরা হলাম দামী জিনিস; পাছে ডাকাত পড়ে’ আমাদের নিয়ে যায়, সেই জন্য ওরা সব আমাদের পাহারা দিচ্চে। তা তোকে কেউ নিয়ে যাবে না, ভয় কি?
দাসী।
বাইজী কি বলেন যে! [ হাসিয়া প্রস্থান]
সিতিমা।
এত সাজসজ্জা করে চন্দ্রা কোথায় যায়? [উদ্যানের অপরদিকে একান্তভাবে নিরীক্ষণ] চল আমরা একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়াই।
[ বাহিরে তুর্য্যধনি ]
পুষ্পিতা।
[ যাইতে যাইতে] দুর্গপরিখার উপর থেকে সেতু সরা’বে। লোকজনের বাইরে যাওয়া বন্ধ হবে তারই ঘোষণা।
সিতিমা।
যাই গোবিন্দজীর পূজার আয়োজন কর্তে। আজ সন্ধ্যায় আরতি হবে, পুরোহিত ঠাকুরকে ডাকিয়েছি। তাঁকে দেখ্ছি নৌকায় করে পাঠিয়ে দিতে হবে।
[ চারিদিক নিরীক্ষণ করিয়া স্বগত ] সিতিমার কণ্ঠে যেন চন্দ্রার আহবান শুন্লাম। কৈ কেউতো কোথাও নাই। চন্দ্রা ডেকেছে, চিঠি পেয়েও আসি কি না আসি বলে ইতস্তত: কচ্চিলাম। প্রাচীর পর্য্যন্ত এসে ফিরে গেলাম-মনে হ’ল সন্ধ্যাকালে রাজন্তঃপুরেবিশেষ মহারাজ যখন উপস্থিত নাই, তখন প্রবেশ করা ঠিক নহে-ফিরে গেলাম; কিন্তু শেষ ছত্র বারবার কাণে বাজ্তে লাগল, তাই আসতেই হলো। এই তো। চিঠি, তার নিজের হস্তাক্ষর-“এসো, একবার এসো”
(চন্দ্রার প্রবেশ।)
এই যে চন্দ্রা আমি এসেছি।
চন্দ্রা।
এসেছ? এত বিলম্ব কেন? আমি কখন থেকে প্রতীক্ষা। করে আছি। ছি! এই তোমার ভালবাসা!
উজ্জ্বল।
চন্দ্রা আমি সেনাদল নিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছি, পথে যেতে যেতে তোমার আহবান পেলাম। পথে সকলকে দাঁড় করিয়ে বল্লাম-তোমরা একটু অগ্রসর হয়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর, আমি রাজলক্ষ্মীকে প্রণাম করে আসতে ভুলে গিয়েছিলাম, শীব্র গিয়ে প্রণাম করে আস্চি।— আমার সময় নাই, কেন ডেকেছ বল।
চন্দ্রা।
[অভিমান ভরে] যদি অসময়ে ডেকে থাকি, যাও।
উজ্জ্বল।
কেন অভিমান প্রিয়ে? তুমি তো জান আমি তোমার আজ্ঞাধীন, মহারাজের আজ্ঞার উপর তোমার আজ্ঞা শিরোধার্য্য করে আজ যুদ্ধযাত্রার পথ থেকে ফিরে এসেছি।
চন্দ্রা।
বড় অন্যায় করেছি। কুমার, ক্ষমা কর, ফিরে যাও।
উজ্জ্বল।
চন্দ্রা, আমি দ্বিতীয় সেনাপতি-মহারাজের বিশ্বাসী বন্ধু ও ভৃত্য-আমি নিজে রাজপুত্র-ক্ষত্রিয়। আমাকে যদি চিনে থাক, বুঝবে কতখানি ভালবাসা আমায় এমন কাজে প্রবৃত্ত করেছে। চন্দ্রা, প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি সিতিমার কণ্ঠে তোমারি ডাক শুন্লাম। চন্দ্রা, তোমার ডাক মৃত্যুর ডাকের চেয়েও অলঙ্ঘ্য হয়ে এল, তাই আমি এসেছি। কিন্তু দাঁড়াবার সময় নাই, একবার বল কেন ডাক্লে।
চন্দ্রা।
[ অভিমান ভরে ] সাধ করে মৃত্যুর ডাক কে শোনে? তুমি ফিরে যাও, কুমার।
[ পশ্চাৎ ফিরিয়া অশ্রুমোচন ]
উজ্জ্বল।
[ কাতর স্বরে ] চন্দ্রা কেন এমন বিমুখ হলে? একি কি আমি কি দোষ করেছি বুঝিয়ে দাও। না হয় তাও থাক্-আমাকে কি কর্তে হবে সেইটে বল। এমন করে লাঞ্ছিত ক’র না।
চন্দ্রা।
রাজপুত্র, আমি কে? সামান্য নটী। যুদ্ধে জয়ী হলে মহারাজ তোমাকে পুরস্কৃত কর্বেন।
উজ্জ্বল।
দেবতার কাছে প্রার্থনা কর যেন জয়ী হই। এখন হাসিমুখে বিদায় দাও, আমি যাই।
চন্দ্রা।
যাও। যদি দৈববশাৎ যশের মুকুট বা রাজানুগ্রহ না পাও, আমাকে দোষ দিও না। আমি স্ত্রীলোক, স্বভাবতঃ ভীরু। হঠাৎ যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য স্বপ্নের মত আমার চক্ষের উপর দিয়ে চলে গেল দেখলাম-তা মুখেও আন্তে নাই। হঠাৎ মনে হ’ল, তোমাকে যুদ্ধে যেতে দেব না; আমার এই দুই বাহুর মধ্যে তোমায় আটকে রাখব। তাই এই পাগলামি। এখন নিজের উপর রাগ হচ্চে,তোমার উপরও অভিমান হচ্চে। কেন জিজ্ঞাসা কচ্চ-কেন ডাক্লে? তোমাকে ডাকব না, ভয় পেয়ে কাকে ডাকব? ক্ষমা কর প্রিয়তম, ক্ষমা কর। [ কণ্ঠে পতন।
উজ্জ্বল।
চন্দ্রা, আমার প্রাণ, এতদিনে আমাকে ভালবাস্লে।
চন্দ্রা।
এতদিন পরে তোমাকে ভালবেসে আমি দুঃখকে বরণ কর্লাম।
উজ্জ্বল।
তবে আমি জন্মের মত যাই, তুমি চিরদিন সুখী থাক।
চন্দ্রা।
সুখ যদি আমার জন্য রেখে থাক। যখন মহারাজ জানবেন আমি অন্যের প্রতি অনুরক্তা, আমার মাথা রাখ্বেন? এ রাজপুরী অনেক নারীহত্যা দেখেছে, আর একটা দেখ্বে।
উজ্জ্বল।
তুমি তো চিরকাল আমায় ভালবাসনি, মহারাজ কি করে জান্বেন?
চন্দ্রা।
কি করে সবাই সব জানে? সংসারে কোন কথাই গোপন থাকে না। অগোচরে যা ঘটে। সেইটে আগে রটে, বরং সকলের সামনে যেটা হয়, সেটা লোকে কম দেখে, তা' নিয়ে কম কথা কয়।
উজ্জ্বল।
তবে কি কর্তে হবে? কিসে তোমার প্রতি মহারাজের অনুগ্রহ স্থির থাক্বে বল, মরবার আগে তাই করে যাব।
চন্দ্রা।
মর্বে কেন? প্রধান সেনাপতি মশাইকে সব খুলে বল, তিনি যা পরামর্শ দেন তাই কর। মহারাজ তাঁর অনুরোধে আমাদের জীবিত রাখ্বেন।
উজ্জ্বল।
আমি জীবনের এত মায়া রাখি না। এ জীবনের জন্য কারও অনুগ্রহ বা অনুরোধ চাই না। তবে তোমার যাতে অমঙ্গল না হয় তা কর্ব। যাই-। একবার- [মুখচুম্বন ]
বাহিরে তুর্য্যধ্বনি, চকিতে চন্দ্রার প্রস্থান এবং বৃক্ষান্তরাল হইতে সিতিমার প্রবেশ।
সিতিমা।
কুমারজী, নমস্কার। কোথায় চল্লে?
উজ্জ্বল।
যুদ্ধে।
সিতিমা।
কি যুদ্ধ? বাগ্যুদ্ধ, না গীতের, না পীরিতের?
উজ্জ্বল।
আসল যুদ্ধ। সেনারা রাজধানীর বাইরে গিয়েছে, তুমি শোননি?
সিতিমা।
শুনেছি কুমার। কিন্তু তুমি সকলের শেষে কেন?
উজ্জ্বল।
সে কথায় কি কাজ সিতিমা? আমি চল্লাম্। তোমাদের মঙ্গল হোক্, তোমার গান সকলের প্রাণ শীতল করুক।
সিতিমা।
বল উষ্ণ করুক- বীর, এখন উষ্ণ রক্ত চাই যে।
উজ্জ্বল।
ঠিক-ঠিক। একবার গলা ছেড়ে তোমার মৃত্যুর গানটি গাও, আমি শুন্তে শুন্তে সেতু পার হই। [ গমনোদ্যত ]
সিতিমা।
দাঁড়াও কুমার। সেতু কোথায়? দাঁড়াও।
উজ্জ্বল।
আমার সময় নাই।
সিতিমা।
তবু দাঁড়াও।
উজ্জ্বল।
ব্যাপারটা কি?
সিতিমা।
আমার গৃহে একবার এসো।
উজ্জ্বল।
তা পারি না। তুমি রাজান্তঃপুরের স্ত্রীলোক। সৈন্যেরা অগ্রসর হচ্চে, সেনাপতি পশ্চাতে থাক্বে?
সিতিমা।
তোমার সম্মুখে বিপদ-বিশ্বাসঘাতকতা।
উজ্জ্বল।
বটে? তা হোক, আমি লুকাবনা সম্মুখ যুদ্ধে আমি অনভ্যস্ত নই।
সিতিমা।
আমি তোমাকে অন্তঃপুরে ধরে রাখ্বনা; পুরীর সম্মুখের দরজা দিয়ে না গিয়ে, আমার অন্দরের গুপ্তদ্বার দিয়ে, গোবিন্দজীর মন্দিরের পিছন দিক দিয়ে, নৌকায় পরিখা পার হও। সেনাপতি যেদিকে যেতে বলেছেন যেও না।
উজ্জ্বল।
যাবার আগে একবার পুরী প্রদক্ষিণ করে যেতে সেনাপতিই তো বলেছিলেন। এদিকে এসে
সিতিমা।
চন্দ্রার চিঠি পেলে। আমি বুঝেছি। তোমাকে ধরবার জন্য সম্মুখে অস্ত্রধারী গুপ্তচর দাড়িয়ে আছে। আর সময় নাই; এখন এদিকে এস। [ উজ্জ্বলের হস্তাকর্ষণ ]
[ কাতর কণ্ঠে ] এদিক দিয়ে এস, কুমার। কথা শোন, কথা শোন।
উজ্জ্বল।
[ ক্রুদ্ধ ঘরে ] সিতিমা, বাধা দিও না।
অস্তঃপুর পার হইয়া চত্বরে প্রবেশ করিতে না করিতে দুই দিক হইতে
চারজন অস্ত্রধাবীর ক্ষিপ্র প্রবেশ ও অতর্কিতে উজ্জ্বলের
তরবারী ছিনিয়া লইয়া হস্তদ্বয় বন্ধন।
দুই রক্ষীর প্রবেশ।
১ম দ্বাররক্ষী।
[ সম্মুখে আসিয়া ] অসময়ে গোপনে মহারাণীর মহলে ঢুকেছেন বলে আমরা আপনাকে ধরেছি।
উজ্জ্বল।
কে তোমরা?
২য় দ্বাররক্ষী।
আমরা অন্দর মহলে পাহারা দিই।
উজ্জ্বল।
আর এরা?
সিতিমা।
সেনাপতির প্রেরিত গুপ্তচর।
১ম অংস্ত্রধারী।
গুপ্তচর নই, পলাতকের সন্ধানে প্রেরিত সৈনিক-পুরুষ।
সিতিমা।
সারাদিন ধরে ছদ্মবেশে তোমরা এই পুরীতে লুকিয়েছিলে; পলাতক তোমরা না কুমার?
১ম দ্বাররক্ষী।
বাইজী, আমাদের তো মাথা কাটা যাবে।
সিতিমা।
তোমরা কি আমাকে জান না? আমার গানের খ্যাতি শোননি?
২য় দ্বার রক্ষী।
বাইজী গান গেয়ে পাথর গলাতে পারেন, তা আমরা জানি, মানুষতো মানুষ।
সিতিমা।
কুমার আমার গীতের আহবান অগ্রাহ্য করতে পারেন নি— এসব সত্যি কথা ভাই-ফাঁকি নয়। কুমারের কোন দোষ নাই।
যুদ্ধে যাবার আগে ওঁকে একটা নূতন গান শোনাতে সাধ গেল। কুমারকে টেনে আন্লাম। আমি গাইলাম—
|}
[ গান ]
না ছাইতে মৃত্যুর আঁধার।
এসে তুমি এসো একবার!
কুমার মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে পড়লেন। সবটা শুন্বে তোমরা?
১ম দ্বাররক্ষী।
না বাইজী, আমাদের মাথা কাটা যাবে ষে!
সিতিমা।
যখন বিচারের সময় আস্বে আমি তোমাদের জন্য আর নিজের জন্য মহারাজের পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষে করব। তোমাদের কোন ভয় নাই। দোহাই মহারাজের, দোহাই মহারাণীর, এঁকে ছেড়ে দাও। উনি নিজে গিয়ে মহারাজের কাছে জবাব দেবেন।
১ম অস্ত্রধারী।
সেনাপতির আদেশে এখানে সারাদিন অপেক্ষা করে আছি, খালি হাতে যাই কি করে?
২য় অস্ত্রধারী।
বড় বাইজীর কাছেও বকশিশ্ পাবার আশা।
সিতিমা।
আমিও কিছু বকশিশ্, দেব [গলার হার উন্মোচন]
উজ্জ্বল।
কেন সিতিমা?-কিন্তু বড় বাইজী কে?
সিতিমা।
চন্দ্রা-তোমার প্রেয়সী; যে পাপীয়সীর জন্য কত রাজ কন্যার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব কাণে তোলনি!
উজ্জ্বল।
হা ভগবান, এ তারি যড়যন্ত্র? এ প্রেম নহে ছলনা?
সিতিমা।
নিতান্তই ছলনা। সেই জন্যই অন্য পথে মহারাজের কাছে যেতে বলেছিলাম। এখন চেতনা হল?
উজ্জ্বল।
মৃত্যুর চেতনা-পরজন্মে যদি কাজে আসে। এজন্মে একথা লজ্জায় কাউকে বলাও যাবেনা।
সিতিমা।
পরজন্মে তবে মনে রেখ, কুমার। আর কেবল রূপের মোহে মুগ্ধ হয়োনা। আজ নর্ত্তকীকে যে রূপে দেখ্লে সে রূপ ভুলোনা, মুখোসখোলা রূপ দেখে লও।
আমাকে এ আশীর্বাদ কেন? আমি যে রাজকুলে কলঙ্ক, চোরের মত অন্তঃপুরে ধৃত, সৈনিক নিয়ম লঙ্ঘন করে মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। স্বহস্তে মৃত্যু আমার এ কলঙ্ক মুছে দিক।
[ অসিগ্রহণের চেষ্টা। অস্ত্রধারীগণ কর্তৃরু বেষ্টিত ও নিবারিত]
সিতিমা।
কুমার, মৃত্যু কলঙ্ক মুছাতেও পারে না, ঘুচাতেও পারে না। জীবন দিয়া জীবনের কলঙ্ক মেজে ঘসে তুলে ফেলতে হবে। মৃত্যু যেখানকার যা সেইখানে রেখে যায়, আরো বরং স্তরে স্তরে নিভৃত কলঙ্ক অনাবৃত করে দেয়।
অস্ত্রধারীগণ।
চলুন কুমার।
[ সিতিমা ব্যতীত সকলের প্রস্থান।]
সিতিমার গান।
লভ জীবন, শুভ জীবন নব জীবন। আছে যে করিতে অনেক কাজ, আছে যে ঘুচাতে দারুণ লাজ,
ছাড়িতে নাহি একটি দিন, প্রহর, দণ্ড, ক্ষণ লভ জীবন, শুভজীবন, নব জীবন।