শিবির হইতে কিছু দুরে, পাহাড় হইতে অবতরণ করিতে করিতে
মহারাজ ও দুর্জ্জয় সিংহ উপত্যকার দিকে চাহিতেছেন,
ক্রমে শিবির দ্বারে উভয়ের আগমন।
মহারাজ।
বর্ষাকালে নদী প্রবাহের মত অবাধে শত্রুসৈন্য দেশমধ্যে প্রবেশ কর্চে, গিরিপথ কেন রোধ করা হয়নি?
দুর্জ্জয়।
এই পথ কুমারজীর রোধ কর্বার কথা ছিল। তিনি নাকি রাজধানী থেকে কিছু দূরে নিজের সেনাদল দাঁড় করিয়ে রেখে হঠাৎ অদৃশ্য হলেন। আমি সংবাদ পেয়ে প্রথমতঃ মনে করলাম কোন গুপ্ত শক্রর হাতে পড়েছেন, কিন্তু শেষে জানলাম—শুনলাম—
মহারাজ।
কি শুন্লে
দুর্জ্জয়।
তিনি রাজধানী ফিরে গিয়ে—
মহারাজ।
ফিরে গিয়ে-?
দুর্জ্জয়।
রাজান্তঃপুরে গোপনে প্রবেশ করেছিলেন; সেখানে অস্ত্রধারী প্রহরীদের হাতে ধৃত হয়েছেন।
মহারাজ।
কি! উজ্জ্বল পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়ে রাজধানী ফিরে গিয়ে মহারাণীর মহলে ধরা পড়েছেন? একি সম্ভব?
দুর্জ্জয়।
মহারাজ, এ সংসারে অসম্ভব কিছুই নাই।
মহারাজ।
তার প্রতি তোমার কি আদেশ ছিল?
দুর্জ্জয়।
সত্বর উত্তর পশ্চিমে গিরিপথ অবরোধ করবার
মহারাজ।
আমি বিস্মিত-একেবারে হতবুদ্ধি হচ্চি। মহারাণী পরিজনবর্গ নিয়ে দুর্গমধ্যে আছেন, দুর্গ পরিখা শত্রুভয়ে জলপূর্ণ রাখবার হুকুম দিয়ে এসেছি, মন্ত্রী আর নগরপাল সেখানে উপস্থিত
দুর্জ্জয়।
বিস্ময়ের ব্যাপার সংসারে অহরহ ঘটছে, তাতে ভবাদৃশ মহাপুরুষ বিচলিত হন না। তবে ঘোর আক্ষেপের বিষয় সন্দেহ নাই।
মহারাজ।
একি যথেচ্ছাচার! আমার অবর্তমানে অন্তঃপুরে প্রবেশ। প্রহরীরা কোথার ছিল?
দুর্জ্জয়।
বাহির হয়ে আসবার সময় তারা কুমারকে ধরেছে।
মহারাজ।
বাহির হতে, আসবার সময় ধরেছে, প্রবেশ করতে দিলে। কেন? জিজ্ঞাসা করেনি তার সেখানে কি দরকার?
দুর্জ্জয়।
তিনি প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে বাগানের ভিতর নেমেছিলেন, সদর দরজা দিয়া যান নাই।
মহারাজ।
আমি বুঝতে পাচ্ছিনা। আমার গৃহে উজ্বলের সর্বত্র গতিবিধি আছে। শিশুকাল হতে সে পুত্রের মত পালিত। দেবীর মৃত্যুর পর সে আমাকে ছেড়ে যেতে চেয়েছিল, তখন আমিই তাকে ছাড়তে চাইনি। তাকে অল্পবয়সে সেনানায়ক করে দিয়েছি, তার ভ্রাতার রাজ্য ছেড়ে সে তাই আমার রাজ্য আপন করে নিয়েছে।
দুর্জ্জয়।
আর একটু কম আপন করলেই ভাল হত। মহারাজের অন্তঃপুর তাঁর আপন না হওয়াই উচিত। সে যাহোক যতক্ষণ দুর্জ্জয় সিংহের দেহে প্রাণ আছে স্কন্ধে বাহুসংলগ্ন আছে, চরণ চলতে সমর্থ, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রভুর কোন আশঙ্কা নাই।
মহারাজ।
গিরিপথগুলি উজ্জ্বলের ভাল জানাছিল। ঐ দিকে শক্রসেনা রোধ করবার ভার কাকে দিই?
দুর্জ্জয়।
দাসের প্রতি যদি মহারাজের বিশ্বাস থাকে
মহারাজ।
আছেও, নাইও। তুমি সুরাসক্ত, সেই জন্য কোন কঠিন দীর্ঘকালব্যাপী কর্ম্ম তোমাকে দিতে ভয় পাই। যতক্ষণ তোমার বুদ্ধি পরিষ্কার থাকে কোন ভয় নাই; কিন্তু সুরা ও নারী তোমাকে মনুষ্যত্বহীন করে।
দুর্জ্জয়।
মহারাজের প্রাণাধিক উজ্জ্বল সিংহও এ দোষ থেকে নির্ম্মুক্ত নহেন, নতুবা যুদ্ধযাত্রার পথে প্রাচীর লঙ্ঘন করে মহারাজের অন্তঃপুরে প্রবেশ করবেন কেন?
মহারাজ।
তুমি কার কাছে সংবাদ পেলে?
দুর্জ্জয়।
যারা কুমারাজীকে ধরে এনেছে তারা নিকটেই আছে।
মহারাজ।
তারা আগে তোমার কাছে এল, আমার কাছে নয়?
দুর্জ্জয়।
মহারাজ অনুগ্রহ করে আমাকে সৈন্যাধ্যক্ষ করেছেন। সেনানামধারী যে যেখানে আছে, আগে আমার কাছে তাদের সকল আবেদন নিবেদন নিয়ে আসে। মহারাজ তাদের অনভিগম্য।
মহারাজ।
ব্যাপারটা কি হয়েছে মোটামুটী বলতো, তারপর সেই লোকদের ডাক।
দুর্জ্জয়।
ব্যাপারটা এই:-কুমার উজ্জ্বলসিংহ নর্ত্তকী চন্দ্রার প্রতি অযথা অনুরক্ত আর মহারাজের প্রতি কৃতঘ্ন।
মহারাজ।
(স্বগত) চন্দ্রার প্রতি অনুরক্ত; তবু ভাল। (প্রকাশ্যে) দেখতে পাই নর্ত্তকী চন্দ্রার প্রতি অনেকেই অনুরক্ত।
দুর্জ্জয়।
(স্বগত) একি আমার প্রতি ইঙ্গিত নাকি?
মহারাজ।
নারী পুরুষ সকলেই চন্দ্রার প্রতি আকৃষ্ট হয় দেখ্চি।
দুর্জ্জয়।
নারীর কথা জানিনে।
মহারাজ।
আমি তাও জানি। যাক্। উজ্জ্বল এখন কোথায়?
দুর্জ্জয়।
মহারাজ আমার যা কিছু অপরাধ ক্ষমা করতে আজ্ঞা হোক, আরও কিছু জানাবার আছে।
মহারাজ।
কি? একেবারে সব খুলে বলনা। একটু একটু করে প্রকাশ করবার কি দরকার। সব কথা পরিষ্কার করে বলে ফেল।
দুর্জ্জয়।
এই হস্তাক্ষর মহারাজের পরিচিত। আর এই গুলি(কাগজ হাতে দিয়া) এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন।
মহারাজ।
(কাগজ হাতে লইয়া পাঠ) “বহুকালসঞ্চিত আবর্জ্জনা রাশিৱ মত বর্ত্তমান রাজবংশ নিঃশেষে ঝাঁটাইয়া পুরীর সীমার পার করিয়া দিব। অতঃপর রাজলক্ষ্মীরূপা, চন্দ্রাননা তুমি আমার বাম পার্শ্বে বসিয়া সিংহাসনের শোভা বর্দ্ধন করবে।”-এ কোথায় পেলে এই স্বাক্ষর আর এই চিঠি এক কাগজে ও নয়!
দুর্জ্জয়।
তা নয়। কিন্তু উজ্জ্বল সিংহের ঘরে আর সব কাগজ পত্রের সঙ্গে এই কাগজের টুকরা পাওয়া গেছে।
মহারাজ।
উজ্জ্বল সিংহের ঘরে খানাতল্লাসী করতে তোমায় কে অধিকার দিলে?
দুর্জ্জয়।
ধর্ম্মাবতার, রাজবিদ্রোহের ষড়যন্ত্র জেনে শুনে, কোন রাজভক্ত প্রজা ফাঁকা ভদ্রতার নিয়ম রক্ষা করতে পারে? রাজার প্রাণ বড় কি প্রজার মান বড়?-আমি তদন্ত করে এই বুঝ্তে পেরেছি যে শত্রুরা উজ্জ্বলের আহবানে এই পথে এসেছে এবং সুযোগ মত উজ্জ্বলের সেনাদল তাদের সঙ্গে যোগ দেবে। তারা যুদ্ধে অগ্রসর হতে চায়না।
মহারাজ।
উজ্জ্বল সিংহকে উপস্থিত কর।
[ দুর্জ্জয়ের নিষ্ক্রমণ।
আমার নিজবাহু ভগ্ন দেখ্ছি, আমার নিজের হৃদয়কে বিদ্রোহী মনে হচ্চে। উজ্জ্বল বিদ্রোহী-একথা যে মনেই আনতে পারিনা! তার স্বর্গগতা ভগ্নীর দৃষ্টি তার চক্ষু দিয়ে আমার উপর প্রীতি বর্ষণ করতো; মনে হ’ত যেন তিনি তাঁর মুখের লাবণ্য, তাঁর সতীত্বের জ্যোতিঃ, তাঁর চরিত্রের মাধুর্য্য উজ্জ্বলের মুখে আর চরিত্রে ঢেলে রেখে গেছেন। সেই উজ্জ্বল যাকে পুত্রের মত স্নেহ করেছি, বন্ধুর মত বিশ্বাস করেছি, নিষ্পাপ বলে তার মৃতা সহোদরার প্রাপ্য শ্রদ্ধা দিয়েছি—
[ শৃঙ্খলিত হস্ত উজ্জ্বল সিংহকে লইয়া সৈনিক পুরুষ দ্বয়ের প্রবেশ।
সৈনিক।
মহারাজাধিরাজের অন্তঃপুরে রক্ষীগণ এঁকে দেখতে পেয়ে আমাদের খবর দেয়, আমরা শনিবার সন্ধ্যাবেলা একে সেখানে ধরি।
মহারাজ।
উজ্জ্বল সিংহ তুমি ধৃত শৃঙ্খলিত হয়ে এলে? কোন্ আকস্মিক বিপদ নিবারণ করতে তুমি সেনাদল পথে রেখে একলা গোপনে আমার অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছিলে? [কিয়ৎক্ষণ উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া] চুপ করে রইলে কেন?
উজ্জ্বল।
[স্খলিত কণ্ঠে] মহারাজ—
[ ওষ্ঠদংশন পূর্ব্বক কণ্ঠ স্থির করিবার চেষ্টা ]
মহারাজ।
তোমার বলবার কথা নাই?
উজ্জ্বল।
মহারাজ- [অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া আত্মসংযম পূর্ব্বক] কেবল এই কথা-আমাকে এইবার বিশ্বাস করুন। আমার হাতের বাঁধ খুলে আমার তরোয়াল খানা আমাকে ফিরিয়ে দিতে আজ্ঞা হোকমহারাজের শক্রদের দেশের বাহির করে দিয়ে, আমি ফিরে এসে মহারাজের হাতে আমার অপরাধের যোগ্য দণ্ড গ্রহণ করব। যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্য্যন্ত আমার বিচার ও শাস্তি স্থগিত থাক্।
মহারাজ।
ইতিমধ্যে শত্রু জয়লাভ কর্তে পারে, রাজদ্রোহীদের সাহায্যে আমার রাজ্য ও গৃহ নষ্ট হতে পারে।
উজ্জ্বল।
ভগবান না করুন। উজ্জ্বল সিংহের হাতে আসি থাকতে আর দেহে প্রাণ থাকতে তা কখনও হবেনা। মহারাজ আমি অবিশ্বাসী নই, এই যুদ্ধেই তার প্রমাণ হবে।
[দুর্জ্জয়ের প্রবেশ।
দুর্জ্জয়।
মহারাজাধিরাজ সেনাপতি কেশরী সিংহ গুরুতর আঘাত পেয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন, তাঁর সেনাদল ক্রমেই হঠে আসছে। আমি চললাম।
[ প্রস্থান।
উজ্জ্বল।
মহারাজ আমি যাই-?
মহারাজ।
আগে কোথায় ছিলে? তোমার কর্ত্তব্য তুমি করলে কেশরী সিংহ মারা যেতনা। কাপুরুষ, কুলাঙ্গার।
[ দুর্জ্জয়ের পুনঃ প্রবেশ।
দুর্জ্জয়।
কুমার উজ্জ্বল সিংহের সেনাদলে বিদ্রোহের সূচনা হয়েছে, মহারাজাধিরাজ স্বয়ং গিয়ে তাদের শান্ত না কর্লে, তারা এ সময়ে মহা বিপদ ঘটবে।
উজ্জ্বল।
[ শৃঙ্খলিত হস্ত জোড় করিয়া ] আমাকে যেতে দিন মহারাজ। আমার মৃতা ভগিনীর—
মহারাজ।
পাপিষ্ঠ, স্বর্গীয়া দেবীর নাম মুখে এনোনা। [ কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া]
উজ্জ্বল তোমার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা এখন অসম্ভব। তুমি একাধিক অপরাধে অভিযুক্ত; বিচারের অবসর নাই। সম্প্রতি তোমাকে বন্দীভাবে কারাগারে কাটাতে হবে। তুমি এ রাজ্যের লোক নও; এক হিসাবে তুমি বিদেশী। তোমাকে অতিশয় ভালবেসে, অতিরিক্ত বিশ্বাস করে আমি ভুল করেছি। আমি আর আমার দেশী সেনাপতিরা এ রাজ্য রক্ষা কর্তে পারব। ভীমসিংহ—
[ ভীমসিংহের প্রবেশ ]
বীরগ্রামে সামন্ত মেঘরাজের অধিকারে যে কারাগার আছে, এঁকে সেখানে নিয়ে যাও। [ উজ্জ্বলের প্রতি ] যুদ্ধ শেষে তোমার বিচার হবে। তুমি রত্নপুর রাজের ভ্রাতা না হলে বিনা বিচারে তোমার প্রাণদণ্ড করতাম।
উজ্জ্বল।
যদি মহারাজের কখনও ইচ্ছা হয়, চিরদিনের ভৃত্যকে স্মরণ করলেই সে মহারাজের জন্য প্রাণ দিতে আসবে।
[ উজ্জ্বলাসিংহকে লইয়া ভীমসিংহের প্রস্থান।
মহারাজ।
হায়, হায়, দেবি, দেবি, একি হ’ল। বিশ্বাস আর সন্দেহ? স্নেহ আর কর্ত্তব্যবুদ্ধিতে দ্বন্দ্ব—[উচ্চৈঃস্বরে] ভীমসিংহ—
মহারাজ অপরাধ স্বীকার কচ্চি, আর প্রার্থনা কচ্চি আমাকে আমার সেনাদের কাছে যেতে দিন।
নেপথ্যে।
কুমারের সৈন্যরা রাজধানী লুণ্ঠন করতে যাচ্ছে সত্বর তাদের রোধ কর।
মহারাজ।
তোমার বলবার কিছুই নাই? ভীমসিংহ, খড়্গসিংহ, তোমরা দু’জনে একে শৃঙ্খলিত ক’রে সাবধানে বীরগ্রাম নিয়ে যাও। মেঘরাজকে বলবে যুদ্ধের পর বন্দীর বিচার হবে। আমি স্বয়ং বিদ্রোহী সেনাদের পশ্চাতে যাচ্চি।
[ প্রস্থান।
অতঃপর ভীমসিংহ ও খড়গসিংহ কর্তৃক উজ্জ্বলের হস্ত বন্ধন, সকলের প্রস্থান।