সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/পলাশির যুদ্ধ
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ।
পলাশির যুদ্ধ।
পীড়িত সেনাদলকে কাটোয়া-দুর্গে সুরক্ষিত করিয়া, অবশিষ্ট বৃটিশবাহিনী ২২শে জুন সায়ংকালে ভাগীরথী উত্তীর্ণ হইয়া মীরজাফরের পূর্ব্বকথিত সঙ্কেতানুসারে দলে দলে পলাশির দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। পলাশি সাড়ে সাত ক্রোশ দূরে;—পাছে নবাব সেনা পলাশি অধিকার করিয়া লয়, সেই আশঙ্কায় ইংরাজেরা বৃষ্টি বাদল মাথায় করিয়া তাড়াতাড়ি ছুটিয়া চলিল; এবং অক্লান্ত সমর-যাত্রায় গলদঘর্ম্ম কলেবরে রাত্রি একটার সময়ে পলাশির আম্রবনে আশ্রয় গ্রহণ করিল।[১]
সিরাজদ্দৌলা মনকরা ছাড়িয়া আরও দক্ষিণে অগ্রসর হইয়াছিলেন; এবং ভাগীরথী যেখানে অশ্বক্ষুরের ন্যায় বক্রগতিতে প্রবাহিত তাহার পূর্ব্বদিকে,—তেজনগরের উন্মুক্ত প্রান্তরের উত্তরাংশে শিবির সংস্থাপন করিয়াছিলেন। শিবিরের দক্ষিণে অল্পোচ্চ মৃৎপ্রাচীর; তাহার দক্ষিণে মৃত্তিকাস্তূপ এবং দুইটি পুরাতন সরোবর। সিরাজসেনার বাদ্যোদ্যমে বহুদূর পর্য্যন্ত বনভূমি প্রতিশব্দিত হইতেছিল;—ক্লাইব বুঝিলেন যে শত্রু অতি নিকটে। সে রজনীতে বৃটিশবাহিনী যথাসম্ভব নিদ্রালাভ করিল, কিন্তু সেনাপতি আর নিদ্রার অবসর পাইলেন না;—কেবল নিরন্তর মনে হইতে লাগিল, “কি হয় কি হয় রণে, জয় পরাজয়!”[২]
সিরাজদ্দৌলাও নিদ্রার অবসর পাইলেন না;—একাকী নির্জ্জন পটমণ্ডপে বসিয়া প্রহর গণনা করিতেই রজনী প্রভাত হইয়া গেল! তিনি চিন্তাক্লিষ্ট বিষণ্নবদনে একাকী স্তিমিতালোকে বসিয়া রহিয়াছেন, সুচতুর তস্কর অবসর বুঝিয়া তাঁহার সম্মুখ হইতেই ফর্শী উঠাইয়া লইয়া প্রস্থান করিল! সিরাজ সুপ্তোত্থিতের ন্যায় তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিলেন যে, তাঁহার পরিচরবর্গও কে কোথায় পলায়ন করিয়াছে। সিরাজ মর্ম্মপীড়িত কণ্ঠে অলক্ষিতে বলিয়া উঠিলেন, “হায়! না মরিতেই ইহারা আমাকে মৃতের মধ্যে গণ্য করিয়া লইয়াছে!”[৩]
সিংহাসনে পদার্পণ করিবার পূর্ব্বেই সিরাজদ্দৌলা পানদোষ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।[৪] তাঁহার পরমশত্রু সমসাময়িক ইংরাজলেখকেরাও বলিয়া গিয়াছেন যে, পূর্ব্বের কথা যাহাই হউক, আলিবর্দ্দির নিকট ধর্ম্মশপথ করিবার পর সিরাজ আর সুরাপাত্র গ্রহণ করেন নাই।[৫] পলাশির পটমণ্ডপে তিনি যখন একাকী চিন্তামগ্ন, সেই সময়ের চিত্রপট উদ্ঘাটন করিবার জন্য কেবল তাঁহার স্বদেশীয় কবিই লিখিয়া রাখিয়াছেনঃ—
ঢাল সুরা স্বর্ণপাত্রে ঢাল পুনর্ব্বার
কামানলে কর সবে আহতি প্রদান;
খাও ঢাল, ঢাল খাও, প্রেমপারাবার
উথলিবে, লজ্জাদীপ হইবে নির্ব্বাণ;
বিবসনা লো সুন্দরি! সুরাপাত্র করে
কোথা যাও নেচে নেচে? নবাবের কাছে?
যাও তবে সুধাহাসি মাখি বিম্বাধরে,
ভুজঙ্গিনী-সমবেণী দুলিতেছে পাছে;
চলুক চলুক নাচ, টলুক চরণ,
উড়ুক কামের ধ্বজা,—কালি হবে রণ।”
বর্ণনা-লালিত্যে, এই সরস কবিতা বাঙ্গালীর নিকট সমধিক সমাদর লাভ করিয়াছে! রঙ্গমঞ্চে “উজ্জ্বলিত দীপাবলিতেজে” বারবিলাসিনী-সাহায্যে এই সুলিখিত চিত্রপঠ পুনঃ পুনঃ প্রদর্শিত হইয়া, কত লোকের নৈতিক অধোগতির পথ প্রশস্ত করিয়া তুলিয়াছে! যাহা সিরাজদ্দৌলার কলঙ্করটনার জন্য কল্পনা-সাহায্যে কত সন্তর্পণে রচিত হইয়াছিল, তাহা যে আমাদিগেরই আধুনিক উদ্যান-বিহারী কুবেরসন্তানদিগের অবিকল ছায়াচিত্র, তাহাও স্পষ্টতর আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে!
ষ্টুয়ার্ট গোলাম হোসেনের পদানুসরণ করিয়া নবাবগঞ্জের যুদ্ধশিবিরে কামাসক্ত শওকতজঙ্গের যে অসাধুচিত্র অঙ্কন করিয়া গিয়াছেন, ইহা কি তাহারই প্রতিবিম্ব নহে? ‘পলাশির যুদ্ধকাব্য’ রচনা করিবার পূর্ব্বে কবি বোধ হয় ষ্টুয়ার্ট পাঠ করিয়া থাকিবেন। প্রমাণঃ—
“—সেই দিন করিয়া মন্ত্রণা,
বরিলাম পূর্ণিয়ার পাপী দুরাচার
কিন্তু পরিণামে হায়! লভিনু কি ফল?
সুরামত্ত, কামাসক্ত, পড়িল সংগ্রামে,
যেমতি পড়িল ক্রৌঞ্চ-মিথুন দুর্ব্বল,
ব্যাধ-কবি বাল্মীকির ব্যাধ-বিদ্ধবাণে।[৭]
ষ্টুয়ার্ট ভিন্ন আর কোন ইতিহাসে এইরূপ সুললিত বর্ণনা দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু সিরাজদ্দৌলার কপাল! ষ্টুয়ার্ট পড়িয়াও তাঁহার স্বদেশের কবি নবাবগঞ্জের শওকতজঙ্গের চিত্রপটখানি পলাশির সিরাজদ্দৌলার চিত্রপট বলিয়া জনসমাজে প্রচার করিতে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করিলেন না! “কবির পথ” কি এতই “নিষ্কণ্টক”?
সে কালের ইংরাজ বাঙ্গালী মিলিত হইয়া সিরাজদ্দৌলার নামে কত অলীক কলঙ্করটনা করিয়া গিয়াছেন তাহা ইতিহাসের নিকট অপরিচিত নাই। অবসর পাইলে একালের প্রতিভাশালী সাহিত্যসেবকগণ এখনও কত নূতন নূতন রচনা-কৌশলের পরিচয় প্রদান করিতে পারেন, “পলাশির যুদ্ধকাব্যই” তাহার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। যাহা সেকালের লোকেও জানিত না, যাহা সিরাজদ্দৌলার শত্রুদলও কল্পনা করিতে সাহস পাইত না,— একালের লোকে তাহারও অভাবপূরণ করিতে ইতস্ততঃ করিতেছেন না। লোকে বলে, নবাব সরফরাজ খাঁ অশান্তহৃদয়ে জগৎশেঠের পুত্রবধূর মুখাবলোকন করিয়া[৮] প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ গিরিয়ার যুদ্ধে জীবন বিসর্জ্জন করিয়াছিলেন;—কবি সেই জনশ্রুতি লতাপল্লবে সুশোভিত করিয়া, সিরাজদ্দৌলার স্কন্ধে আরোপ করিবার জন্য লিখিয়া গিয়াছেনঃ—
“______কি বলিব আর,
বেগমের বেশে পাপী পশি অন্তঃপুরে,
নিরমল কুল মম—প্রতিভা যাহার
মধ্যাহ্ন-ভাস্কর-সম, ভূভারত জুড়ে
প্রজ্বলিত,—সেই কুলে দুষ্ট দুরাচার
করিয়াছে কলঙ্কের কালিমা সঞ্চার।”
যিনি আশৈশব শিবিরে শিবিরে অসিহস্তে জীবন যাপন করিয়া, অন্যায় কৌশলে পলাশিক্ষেত্রে রণপরাজিত হইয়াছিলেন, কবি তাঁহাকে সমর ত্যাগ করাইয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন![৯] মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় এবং তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার শিবচন্দ্র ইংরাজের পক্ষাবলম্বী বলিয়া নবাব মীর কাশিমের আদেশে ১৭৬৩ খৃষ্টাব্দে প্রাণদণ্ডের প্রতীক্ষায় “মঙ্গীর দুর্গে” কারারুদ্ধ থাকিয়া ইংরাজ-কৃপায় মুক্তিলাভ করেন।[১০] কবি সময়-শ্রোত উত্তীর্ণ হইয়া সিরাজদ্দৌলাকেই তাহার জন্য অপরাধী সাজাইয়া, “কোন একজন বঙ্গ-সাহিত্য-সমাজে সুপরিচিত বন্ধুর মুখে” শুনিয়াছেন বলিয়া নিষ্কৃতিলাভ করিয়াছেন![১১] যে দেশের কবি-কাহিনী ইতিহাস রচনার ভার গ্রহণ করিয়াছে, সে দেশে সিরাজ-কালিমা যে উত্তরোত্তর দুরপনেয় হইয়া উঠিবে, তাহাতে আর বিস্ময়ের কথা কি?
“পলাশির যুদ্ধ-কাব্যের” এই সকল কাল্পনিক সিরাজ-কলঙ্ক প্রদর্শন করিয়া কবিবর শ্রীযুক্ত নবীনচন্দ্র সেন মহাশয়ের নিকট তত্ত্বজিজ্ঞাসু হইয়াছিলাম। কোন একজন বঙ্গ-সাহিত্য সমাজে সুপরিচিত বন্ধু দয়া করিয়া লিখিয়া পাঠাইয়াছেন,—“নবীন বাবুর উত্তর এক লাইনও নয়। পলাশির যুদ্ধ-কাব্য, ইতিহাস নয়; আপনাকে ইহাই লিখিতে অনুমতি করিয়াছেন।”[১২] নবীন বাবুর ‘পলাশীর যুদ্ধ’ যে ‘ইতিহাস নয়’ তাহা সকলে জানে না! তাঁহার ন্যায় স্বদেশভক্ত কৃতবিদ্য সাহিত্য-সেবক যে সর্ব্বথা স্বকপোলকল্পিত অযথা-কলঙ্কে সিরাজদ্দৌলার আপাদমস্তক কলঙ্কিত করিয়া কাব্যরসের অবতারণা করিবেন, তাহা সহসা ধারণা করিতে সাহস না পাইয়া, অনেকেই তাঁহার ‘পলাশির যুদ্ধ-কাব্যকে’ ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করিয়া থাকেন! অন্যের কথা দূরে থাকুক, সম্প্রতি “সান্যাল, এণ্ড কোম্পানী” পলাশির যুদ্ধ-কাব্যের যে “বিদ্যালয়ের পাঠ্যসংস্করণ’’ প্রকাশিত করিয়াছেন, তাহাতেও ইহাকে ‘ইতিহাস’ বলিয়া পরিচিত ও বিদ্যালয়ে প্রচলিত করিবার জন্য ভূমিকা লিখিত হইয়াছে!![১৩] “কবির পথ নিষ্কণ্টক” হইলেও ঐতিহাসিক চিত্রচয়নে সর্ব্বথা নিরঙ্কুশ হইতে পারে না। যে হতভাগ্য নরপতি তরুণ জীবনে অন্যায় কৌশলে পিঞ্জরাবদ্ধ হইয়া অকালে দেহ বিসর্জ্জন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, তাহার প্রকৃত ইতিহাস লইয়া কাব্যরচনা করিলে “পলাশির যুদ্ধ কাব্য” অধিকতর মর্ম্মস্পর্শ করিত। কবি আত্মকল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করিলেও বরং ভাল হইত,—তাহা হইলে, তাঁহার কল্পনা পদে পদে “মেকলের” ছাঁচে ঢালা হইত না। মেকলে লিখিত পলাশির যুদ্ধও কাব্য,—ইতিহাস নহে। কবি তাহাকেই অন্ধের যষ্টির ন্যায় প্রবল আগ্রহে আঁকড়িয়া না ধরিলে, হতভাগ্য সিরাজদ্দৌলার প্রেতাত্মা অনেক অলীক আক্রমণের কঠোর হস্ত হইতে পরিত্রাণ লাভ করিতে পারিত। কেবল সেইজন্য স্বদেশের কীর্ত্তিমান্ কবির ভ্রমপ্রমাদের সমালোচনা এরূপ কঠোর ভাষায় লিখিত হইল!
রজনী প্রভাত হইল। যে প্রভাতে ভারতগগনে বৃটিশসৌভাগ্য-সূর্য্য সমুদিত হইবার সূত্রপাত হইয়াছিল, সেই প্রভাতে,—“১১৭০ হিজরী ৫ সাওয়াল রোজপঞ্জসোম্বা”[১৪] (বৃহস্পতিবারে) পলাশিপ্রান্তরে ইংরাজ বাঙ্গালী শক্তিপরীক্ষার জন্য একে একে গাত্রোত্থান করিতে লাগিল।
ইংরাজেরা যে আম্রবণে সেনাসমাবেশ করিয়াছিলেন, তাহার নাম লক্ষবাগ”,—লোকে বলে তাহা লক্ষ বৃক্ষে পরিপূর্ণ ছিল। এই আম্রকাননের পশ্চিমোত্তর কোণে মৃগয়ামঞ্চ, ক্লাইব তাহার পার্শ্বে লক্ষবাগের উত্তরে,—উন্মুক্ত প্রান্তরে ব্যুহ রচনা করিলেন। সিরাজদ্দৌলা প্রত্যুষেই মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, এবং রায়দুর্ল্লভকে শিবির হইতে অগ্রসর হইবার অনুমতি করিয়াছিলেন। তাঁহারা অর্দ্ধচন্দ্রাকারে ব্যুহরচনা করিয়া শ্রেণীসম্বদ্ধ-বলাকাপ্রবাহের ন্যায় ধীর মন্থরগতিতে আম্রবণ বেষ্টন করিবার জন্য অগ্রসর হইতে লাগিলেন।
ইংরাজদিগের মনে হইল যে, এই চক্রব্যুহ যদি আম্রবণ বেষ্টন করিয়া কামানে অগ্নিসংযোগ করে, তবেই সর্ব্বনাশ![১৫] ক্লাইবের গোরাপল্টন চারি দলে বিভক্ত হইয়া মেজর কিলপ্যাট্রিক, মেজর গ্রাণ্ট, মেজর কূট, এবং কাপ্তান গপের অধীনে অস্ত্রধারণ করিল;—মধ্যস্থলে ‘গোরা লোগ’, বামে দক্ষিণে ‘কালা আদ্মীরা’ ছয়টি কামান সম্মুখে করিয়া সারি বাঁধিয়া। দণ্ডায়মান হইল। মীরমদনের সিপাহী-সেনা সম্মুখস্থ সরোবর-তীরে সমবেত হইয়াছিল; এক পার্শ্বে ফরাসীবীর সিনফ্রেঁ, এক পার্শ্বে বাঙ্গালী বীর মোহনলাল, মধ্যস্থলে বাঙ্গালী সেনাপতি মীরমদন সেনাচালনার ভার গ্রহণ করিলেন।
সিরাজ-বাহিনীর আস্তরণাবৃত রণহস্তী, সুশিক্ষিত অশ্বসেনা এবং সুগঠিত আগ্নেয়াস্ত্র যখন ধীরে ধীরে সম্মুখে অগ্রসর হইতে লাগিল, তখন ইংরাজেরা ভাবিলেন—সিরাজব্যূহ দুর্ভেদ্য![১৬]
বেলা ৮ ঘটিকার সময়ে মীরমদন সরোবরতীরে কামানে অগ্নিসংযোগ করিলেন;—প্রথম গোলাতেই ইংরাজপক্ষে একজন হত এবং একজন আহত হইল। তাহার পর মুহুর্মুহু কামান চলিতে লাগিল—মুহুর্মুহু ইংরাজসেনা ধরাশায়ী হইতে লাগিল। এই ভাবে আধ ঘণ্টা যুদ্ধ চলিয়াছিল; এই আধ ঘণ্টায় ১০ জন গোরা এবং ২০ জন কালা সিপাহী মৃত্যুক্রোড় আশ্রয় করিল।[১৭] ইংরাজের কামান নীরব ছিল না; তাহার প্রচণ্ড পীড়নে নবাবসেনাও ধরাশায়ী হইতেছিল; কিন্তু তাহাতে নবাবের গোলন্দাজদিগের কিছুমাত্র ক্ষতি হয় নাই, তাহারা অক্ষতদেহে বিপুলবিক্রমে ইংরাজ সেনাদলের মধ্যে মিনিটে মিনিটে গোলা প্রক্ষেপ করিতে লাগিল। আধ ঘণ্টাতেই ক্লাইবের সমরসাধ মিটিল; আধ ঘণ্টাতেই তিনি বুঝিতে পারিলেন যে প্রতি মিনিটে একটি করিয়া হত ও কতকগুলি আহত হইতে থাকিলে, তাঁহার তিন সহস্র সিপাহী অধিক ক্ষণ শৌর্য্যবীর্য্য প্রকাশ করিবার অবসর পাইবে না। সুতরাং আত্মরক্ষার জন্য ক্লাইকে সসৈন্যে হটিতে হইল।[১৮] ইংরাজসেনার দুইটি কামান বাহিরে থাকিল, আর চারিটি কামান লইয়া তাহারা আম্রবণের মধ্যে লুকাইয়া গেল; ক্লাইবের আদেশে সকলেই বৃক্ষান্তরালে বসিয়া পড়িল। নবাবের তোপমঞ্চগুলি ৪ হাত উচ্চ; সুতরাং মীরমদনের গোলা ইংরাজসেনার মাথার উপর দিয়া ছুটিতে লাগিল, কচিৎ বা বৃক্ষশাখায় প্রতিহত হইতে লাগিল।
বৃহ্মান্তরালে লুকাইয়া থাকিয়াও ক্লাইবের আশঙ্কা দূর হইল না। নবাব সেনার ব্যুহ রচনায় এবং সমরকৌশলে তাঁহার অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠিয়াছিল; তিনি উমিচাঁদকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন,—“তোমাদিগকে বিশ্বাস করিয়া বড়ই কুকর্ম্ম করিয়াছি। তোমাদের সঙ্গে কথা ছিল যে, একটা যৎসামান্য যুদ্ধাভিনয় হইলেই মনস্কাম পূর্ণ হইবে; সিরাজসেনা যুদ্ধক্ষেত্রে বাহুবল প্রদর্শন করিবে না। এখন যে তাহার সকল কথাই বিপরীত হইতেছে?”[১৯] উমিচাঁদকে বিনীতভাবে নিবেদন করিলেন যে, “যাহারা যুদ্ধ করিতেছে তাহারা মীরমদন এবং মোহনলালের সেনাদল; তাহারাই কেবল প্রভুভক্ত। তাহাদিগকে কায়ক্লেশে পরাজয় করিতে পারিলেই হয়, অন্যান্য সেনানায়কগণ কেহই অস্ত্র চালনা করিবেন না।”[২০]
মীরমদন ধীরে ধীরে সম্মুখে অগ্রসর হইয়া বিপুল বিক্রমে গোলা চালনা করিতে লাগিলেন। সেই সময়ে মীরজাফরের চক্রব্যুহ যদি আর একটু অগ্রসর হইয়া কামানে অগ্নিসংযোগ করিত, তাহা হইলে আর রক্ষা ছিল না![২১] কিন্তু মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্ল্লভ যেখানে সেনাসমাবেশ করিয়াছিলেন সেই খানেই চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রণকৌতুক দর্শন করিতে লাগিলেন।[২২] বেলা ১১ টার সময়ে গলদ্ঘর্ম্মকলেবরে ক্লাইব সমরসভার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে বসিলেন, স্থির হইল যে,—সমুদয় দিন আম্রবণে লুকাইয়া কোন রূপে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতে হইবে।[২৩] মহাবীর পলাশীবিজেতা যে এইরূপে প্রাণ রক্ষা করিয়াই সমর জয় করেন সে কথা তিনি নিজেই প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন।
ধূমপুঞ্জে গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, তাহার উপর আবার আষাঢ়ের নবমেঘে মধ্যাহ্নেই পৃথিবী তমসাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। ঠিক মধ্যাহ্ন সময়ে মেঘ বারিবর্ষণ করিল, মীরমদনের অনেক বারুদ ভিজিয়া গেল, তাঁহার কামানগুলি কথঞ্চিৎ শিথিল হইয়া পড়িল। তিনি পুনরায় বিপুলরিক্রমে শত্রুদলনের আয়োজন করিতেছেন এমন সময়ে ইংরাজের একটা গোলা আসিয়া তাঁহার উরুস্থল ছিন্ন করিয়া ফেলিল।[২৪]
বাঙ্গালী সেনাপতি বীরের ন্যায় পলায়িত শক্রর পশ্চাদ্ধাবন করিতে গিয়া দৈববিড়ম্বনায় সাংঘাতিক আঘাত প্রাপ্ত হইলেন। মোহনলাল যুদ্ধ করিতে লাগিলেন, মীর মদনকে সকলে ধরাধরি করিয়া সিরাজদ্দৌলার সম্মুখে উপনীত করিলেন। তিনি বেশী কিছু বলিবার অবসর পাইলেন না, কেবল এইমাত্র বলিলেন যে, শত্রুসেনা আম্রবণে পলায়ন করিয়াছে তথাপি নবাবের প্রধান সেনাপতিগণ কেহই যুদ্ধ করিতেছে না, সসৈন্যে চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন।[২৫] মীরমদনের বীরবাহু অবসন্ন হইল, সিরাজদ্দৌলার মাথায় আকাশ ভঙ্গিয়া পড়িল। মাত্র মীরমদনের ভরসা পাইয়া সিরাজদ্দৌলা শত্রুদলের কুটিল কৌশলে ভ্রূক্ষেপ করেন নাই; তাঁহার আকস্মিক মৃত্যুতে সিরাজের বল ভরসা অকস্মাৎ তিরোহিত হইয়া গেল।
সিরাজ অনন্যোপায় হইয়া আর একবার মীরজাফরকে উত্তেজিত করিবার জন্য তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মীরজাফর অনেক ইতস্ততঃ করিয়া, অনেক কালহরণ করিয়া, অবশেষে প্রিয়পুত্র মীরণ এবং পাত্রমিত্রদিগের সহিত দলবদ্ধ হইয়া সতর্কপদবিক্ষেপে সিরাজের পটমণ্ডপে প্রবেশ করিলেন।[২৬] মীরজাফর ভাবিয়াছিলেন যে, সিরাজদ্দৌলা হয় ত তাঁহাকে বন্দী করিয়া ফেলিবেন, কিন্তু পটমণ্ডপে প্রবেশ করিবামাত্র সিরাজ তাঁহার সম্মুখে রাজমুকুট রাখিয়া দিয়া ব্যাকুল হৃদয়ে বলিয়া উঠিলেন, “যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, তুমি ভিন্ন এই রাজমুকুট রক্ষণ করেন এমন আর কেহ নাই; মাতামহ জীবিত নাই, তুমিই এখন তাঁহার স্থান পূর্ণ কর। মীরজাফর! আলিবর্দ্দির পুণ্যনাম স্মরণ করিয়া আমার মানসম্ভ্রম এবং জীবনরক্ষার সহায়তা কর।” মীরজাফর সসম্ভ্রমে যথারীতি রাজমুকুটকে কুর্ণিশ করিয়া বুকের উপর হাত রাখিয়া বিশ্বস্তভাবে বলিতে লাগিলেন, “অবশ্যই শক্রজয় করিব; কিন্তু আজ দিবা অবসান হইয়াছে, সিপাহীরা প্রভাত হইতে রণশ্রমে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে, আজ সেনাদল শিবিরে প্রত্যাগমন করুক,—প্রভাতে আবার যুদ্ধ করিলেই হইবে।” সিরাজ বলিলেন, “নিশারণে ইংরাজসেনা শিবির আক্রমণ করিলে যে সর্ব্বনাশ হইবে?” মীরজাফর সগর্বে বলিয়া উঠিলেন, “আমরা রহিয়াছি কেন?”[২৭]সিরাজের মতিভ্রম হইল, তিনি মীরজাফরের মৌখিক উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত হইয়া সেনাদলকে শিবিরে প্রত্যাগমন করিবার জন্য আদেশ করিতে বাধ্য হইলেন। মহারাজ মোহনলাল তখন বিপুল বিক্রমে শত্রু সেনার দিকে অগ্রসর হইতেছিলেন, তিনি সসম্ভ্রমে বলিয়া পাঠাইলেন যে, “আর দুই চারি দণ্ডের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হইবে, এখন কি শিবিরে প্রত্যাগমন করিবার সময়? পদমাত্র পশ্চাদ্গামী হইলে সিপাহীদল ছত্রভঙ্গ হইয়া সর্ব্বনাশ সংঘটন করিবে,—ফিরিব না যুদ্ধ করিব।”[২৮] এ সংবাদে মীরজাফর শিহরিয়া উঠিলেন, তিনি বিবিধ বিধানে সিরাজদ্দৌলার মনস্তুষ্টি করিয়া পুনরায় সংবাদ পাঠাইলেন যে, “ক্ষান্ত হও, শিবিরে প্রত্যাগমন কর।” রোষে ক্ষোভে মোহনলালের নয়নযুগল হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিনির্গত হতে লাগিল; কিন্তু তিনি আর কি করিবেন? তিনি একজন মন্সবদার মাত্র, সমরক্ষেত্রে সেনাপতির আদেশ লঙ্ঘন করিতে পারিলেন না! যথা-সম্ভব শ্রেণীবদ্ধ হইয়া শিবিরের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। মীরজাফরের মনস্কামনা পূর্ণ হইল; তিনি তৎক্ষণাৎ ক্লাইবকে লিখিয়া পাঠাইলেনঃ—“মীরমদন গত হইয়াছেন, আর লুকাইয়া থাকা নিয়েজন; ইচ্ছা হয় এখনই অথবা রাত্রি ৩ ঘটিকার সময়ে শিবির আক্রমণ করিবেন, তাহা হইলে সহজেই কার্যসিদ্ধি হইবে।”[২৯]
মোহনলালকে শিবিরে প্রত্যাগমন করিতে দেখিয়া ইংরাজসেনা আম্রবণ হইতে বাহির হইতে লাগিল। ক্লাইব এই সময়ে মৃগয়ামঞ্চের কক্ষমধ্যে বেশপরিবর্ত্তন করিতেছিলেন; কেহ কেহ বলেন যে, তিনি সে সময়ে নিরাপদে নিদ্রামগ্ন হইয়াছিলেন; মেজর কিলপ্যাট্রিক আম্রবণে সেনাচালনা করিতেছিলেন![৩০] ইংরেজসেনা পুনরায় উন্মুক্ত প্রান্তরে সমবেত হইয়াছে, এই সংবাদে ক্লাইব দ্রুতপদে সেনাদলে প্রবেশ করিলেন, এবং তাঁহার অনুমতি না লইয়াই কিলপ্যাট্রিক এরূপ অসমসাহসের পরিচয় দিয়াছিলেন বলিয়া সেই অপরাধে তাঁহাকে বাঁধিয়া ফেলিলেন![৩১] পরে আত্মভ্রম বুঝিতে পারিয়া স্বয়ং সেনাচালনার ভারগ্রহণ করিয়া মেজর সাহেবের দৃষ্টান্তানুসরণ করতঃ ক্রমশঃ সম্মুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এতদ্দর্শনে অনেকেই পলায়ন করিতে লাগিল, কিন্তু ফরাসীবীর সিনফ্রেঁ এবং বাঙ্গালীবীর মোহনলাল ফিরিয়া দাঁড়াইলেন;—তাঁহাদের সেনাদল হটিল না; যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ,তাহারা অকুতোভয়ে অমিতবিক্রমে প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে লাগিল!
এদিকে কতকগুলি সিপাহীসেনাকে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে দেখিয়া সুচতুর রায়দুর্ল্লভ সিরাজদ্দৌলাকেও পলায়ন করিবার জন্য উত্তেজনা করিতে লাগিলেন। সিরাজ সহসা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করিলেন না। মুসলমান ইতিহাসলেখক বলেন যে, যখন দিবা অবসান প্রায়, তখন সিরাজদ্দৌলা দেখিলেন যে বিপুল সেনাপ্রবাহের মধ্যে অল্প লোকেই তাঁহার জন্য যুদ্ধ করিতেছেন; এরূপ অবস্থায় তাঁহার মনে হইল যে,—পলাশিতে পরাজিত হইয়া রাজধানী রক্ষার জন্য মুরশিদাবাদে গমন করাই বুদ্ধিমানের কার্য্য।[৩২] রাজবল্লভও সেই মত পোষণ করিলেন; সুতরাং সিরাজদ্দৌলা আর ইতস্ততঃ না করিয়া দুই সহস্র অশ্বারোহী সমভিব্যাহারে গজারোহণে যুদ্ধভূমি হইতে প্রস্থান করিলেন![৩৩]
মীরজাফর সময় পাইয়া ইংরাজদলে যোগদান করিবার জন্য অগ্রসর হইতে লাগিলেন। ইংরাজেরা কিন্তু শক্রমিত্র চিনিতে না পারিয়া তাঁহার উপরও গোলাবর্ষণ করিতে ক্রটি করিলেন না![৩৪] অপরাহু ৫ ঘটিকা পর্যন্ত অবিশ্রান্ত যুদ্ধ করিতে করিতে মোহনলাল এবং সিনফ্রেঁ বিশ্বাসঘাতক নবাবসেনানায়কদিগের উপর বিরক্ত হইয়া সমরক্ষেত্র পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন। তখন নবাবের পরিত্যক্ত জনশূন্য পটমণ্ডপের দিকে ইংরাজসেনা মহাদম্ভে অগ্রসর হইয়া পলাশি যুদ্ধের শেষ চিত্রপট উদঘাটন করিল![৩৫]
পরিণাম ফল বড়ই উজ্জ্বল বলিয়া পলাশির যুদ্ধ এখন বৃটিশবাহিনীর মহাযুদ্ধের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে। যে সেনাদল পলাশিসমরে জয়লাভ করিয়াছিল, তাহাদের পতাকাশীর্ষে এখনও পলাশির নাম দেখিতে পাওয়া যায়।[৩৬] কিন্তু যেরূপভাবে পলাশিক্ষেত্রে সিরাজসেনার পরাজয় সাধিত হইয়াছিল, তাহাতে ইহাকে প্রকৃত সমর বলিয়া বর্ণনা করা যায় না। সিরাজসেনা যেরূপ ভাবে ব্যুহ রচনা করিয়াছিল, সেইরূপ ভাবে সমরক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া থাকিলেও তাহাদিগকে পরাজয় করা সম্ভব হইত না; তাহারা আম্রবণ বেষ্টন করিয়া বীরের ন্যায় যুদ্ধ করিলে ত কথাই ছিল না! রাজবিদ্রোহীদিগের কুমন্ত্রণায় সিরাজদ্দৌলা সমরক্ষেত্র পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলে, রাজবিদ্রোহী দলের চক্রান্তে সিরাজসেনা তাহাদের অধিকৃত সংকেত ভূমি হইতে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিলে, এবং মীরজাফরাদির চক্রব্যুহ আত্মকার্য্য সাধন করিতে অগ্রসর না হইয়া ধীরে ধীরে শিবিরাভিমুখে গমন করিতে আরম্ভ করিল,—শূন্যক্ষেত্রের উপর দিয়া ইংরাজেরা সদর্পে অগ্রসর হইবার অবসর লাভ করিয়াছিলেন। এই সকল কথার আলোচনা করিয়া ইংরাজ বীরকেশরী মহামতি ম্যালিসন বলিয়া গিয়াছেন, ইহাকে প্রকৃত যুদ্ধ বলিয়া বর্ণনা করা যায় না।[৩৭]পলাশির যুদ্ধভূমি ভাগীরথীগর্ভে বিলীন হইয়াছে; লক্ষবাগের শেষ আমবৃক্ষটিও সমূলে উৎখাত হইয়া বিলাতে চালান হইয়া গিয়াছে[৩৮] মহেশপুরের কুঠির সাহেবেরা নাকি সেই আম্রকাষ্ঠে একটি সিন্ধুক প্রস্তুত করিয়া মহারাণী ভারতেশ্বরীকে উপঢৌকন পাঠাইয়া দিয়াছেন। এখন কেবল স্থাননির্দেশের জন্য একটি আধুনিক জয়স্তম্ভে লিখিত অছে:—
PLASSY
ERECTED BY THE BENGAL GOVERNMENT, 1883.
এই স্বল্পাক্ষর ফলকলিপি ভিন্ন আরও একটি নিদর্শন বর্ত্তমান রহিয়াছে; তাহা একজন প্রভুভক্ত মুসলমান জমাদারের সমাধিস্তূপ। মুসলমান বীর সম্মুখ সংগ্রামে সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন রক্ষার জন্য প্রাণপণে অস্ত্রচালনা করিয়া অবশেষে চিরনিদ্রায় অভিভূত হইয়া রহিয়াছেন। প্রতি বৃহস্পতিবারে বাঙ্গালী কৃষাণ কৃষাণীরা তাহার উপর ভক্তিভরে ফুল ফল তণ্ডুলকণা “সিন্নি” প্রদান করিয়া এখনও সেই পুরাকাহিনী সঞ্জীবিত রাখিয়াছে।
পলাশি হইতে প্রস্থান করিয়া, পরদিবস—শুক্রবার প্রাতঃকালে[৩৯] সিরাজদ্দৌলা মন্সুরগঞ্জের রাজপ্রাসাদে উপনীত হইলেন। বাঙ্গালা, বিহার উড়িষ্যার অদ্বিতীয় অধিপতি বহুসহস্রসিপাহীসুরক্ষিত সমরক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়া বীরশূন্য মুরশিদাবাদের আশ্রয়গ্রহণ করিলেন কেন? ইংরাজেরা বলেন,—একে কাপুরুষ, তাহাতে দুর্ব্বলচিত্ত; সুতরাং ইংরাজভয়েই সিরাজদ্দৌলা উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। মুসলমান ইতিহাস-লেখক বলেন, “পিপীলিকা নিতান্তই ক্ষুদ্র কীট; তথাপি বহুসহস্র পিপীলিকার সমবেত শক্তির নিকট বনশার্দ্দূলকেও পরাভব স্বীকার করিতে হয়?”[৪০] বলা বাহুল্য যে, এইরূপ পিপীলিকাদংশনেই সিরাজদ্দৌলার সর্ব্বনাশ হইল!
রাজধানীতে প্রত্যাগমন করিতে না করিতে সিরাজদ্দৌলার পরাজয়কাহিনী চারিদিকে বিদ্যুৎদ্বেগে প্রচারিত হইয়া পড়িল। লুণ্ঠনভয়ে, যে যেখানে পারিল, পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল! মোগলপ্রতাপ তখন ধীরে ধীরে অস্তগমন করিতেছিল, মুসলমান আমীর ওমরাহেরা স্বার্থরক্ষার আশায় মহারাষ্ট্রসেনার নিকট, ফিরিঙ্গী বণিকের নিকট এবং পার্ব্বত্য পাঠান সেনার নিকট, বহুবৎসরের শাসনগৌরব পরিহার করিয়া একে একে রঙ্গভূমি হইতে অবসর গ্রহণ করিতেছিলেন; ভারতবর্ষের রত্নসিংহাসন বালকের ক্রীড়াকন্দুকে পরিণত হইয়াছিল;—সুতরাং সিরাজদ্দৌলার সকল চেষ্টাই বিফল হইয়া গেল। তিনি রাজধানী রক্ষার জন্য পাত্রমিত্রগণকে পুনঃ পুনঃ আহ্বান করিতে লাগিলেন; অন্যের কথা দূরে থাকুক, তাঁহার শ্বশুর মহম্মদ ইরিচ খাঁ পর্যন্তও তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া পলায়ন করিতে কৃতসংকল্প হইলেন।[৪১] তাঁহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া প্রাণরক্ষার জন্য সকলেই ব্যাকুল হইয়া উঠিল; কেহ কেহ ইংরাজের নিকট আত্মসমর্পণ করিবার জন্য সিরাজদ্দৌলাকে উত্তেজনা করিতেও ত্রুটি করিল না।[৪২] চারিদিকে আকুল আর্ত্তনাদের সূত্রপাত হইল।
এই সকল কাপুরুষোচিত প্রস্তাবে কর্ণপাত না করিয়া, সিরাজদ্দৌলা সেনাসংগ্রহের জন্য ইরিচ খাঁকে পুনরায় উত্তেজনা করিতে লাগিলেন। ইরিচ খাঁ কিছুতেই সম্মত হইলেন না; তখন অনন্যোপায় হইয়া সিরাজদ্দৌলা বিহার-যাত্রার উপযোগী সেনা সংগ্রহের প্রস্তাব করিতে লাগিলেন। ইরিচ খাঁ তাহাতেও অসম্মত হইয়া ধনরত্ন লইয়া পলায়ন করিলেন!
সিরাজদ্দৌলা ইহাতেও ভগ্নমনোরথ না হইয়া স্বয়ং সেনাসংগ্রহের জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। গুপ্ত ধনাগার উন্মুক্ত হইল;—প্রভাত হইতে সায়াহ্ন এবং সায়াহ্ন হইতে প্রথম রাত্রি, সেনাদলকে উত্তেজিত করিবার জন্য মুক্তহস্তে অর্থদান চলিতে লাগিল।[৪৩] রাজকোষ উন্মুক্ত পাইয়া, শরীররক্ষক সেনাদল যথেষ্ট অর্থশোষণ করিল, এবং প্রাণপণে সিংহাসন রক্ষা করিবে বলিয়া ধর্ম্ম প্রতিজ্ঞা করিয়া একে একে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।[৪৪] সিরাজের সকল চেষ্টা বিফল হইল!
সায়াহ্নে আর রত্নদীপালোকে রাজধানী উজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল না;— রাজবৈতালিকের সুললিত যন্ত্র-সংগীত আর বায়ুভরে দুর দুরান্তরে মোগলের গৌরব-গীতি বিঘোষিত করিল না;—পার্শ্বচরগণ আর নবাব সিরাজদ্দৌলার আজ্ঞাপালনের অপেক্ষায় করজোড়ে কক্ষদ্বারে সম্মিলিত হইল না![৪৫] রাজপুরী জনসমাগমরহিত শ্মশান-সৈকতের ন্যায় হায়! হায়! করিতে লাগিল! সেই শ্মশানভূমি বিকম্পিত করিয়া অদূরে মীরজাফরের বিজয়োন্মত্ত আগ্নেয়াস্ত্র ভীমকলরবে গর্জ্জন করিয়া উঠিল! সিরাজদ্দৌলা সুপ্তোথিতের ন্যায় চাহিয়া দেখিলেন;—মোগলের রাজ্যাভিনয়ের শেষ চিত্রপট উদ্ঘাটিত হইয়াছে; জনহীন পাষাণপ্রাসাদ যেন চিরবুভুক্ষিতের ন্যায় তাঁহাকেই গ্রাস করিতে আসিতেছে! তখন মাতামহের মমতানুলিপ্ত হিরাঝিলের বিচিত্র রাজপ্রাসাদ এবং বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার বলদর্পিত মোগলরাজসিংহাসন পশ্চাতে রাখিয়া, নবাব সিরাজদ্দৌলা পথের ফকিরের ন্যায় রাজধানী হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন! কেবল একজন মাত্র পুরাতন প্রতিহারী এবং চিরসহচরী লুৎফউন্নিসা বেগম ছায়ার ন্যায় পশ্চাতে পশ্চাতে অনুগমন করিতে লাগিল।[৪৬]
সিরাজ স্থলপথে ভগবানগোলায় উপনীত হইয়া তথা হইতে নৌকারোহণে পদ্মার প্রবল তরঙ্গ উত্তীর্ণ হইয়া, শৈশবের লীলাভূমি গোদা গাড়ীর ক্রোড়বাহিনী মহানন্দানদীর ভিতর দিয়া উজান বাহিয়া উত্তরাভিমুখে চলিতে আরম্ভ করিলেন।
মুতক্ষরীণ-লেখক সিরাজের পলায়ন-প্রণালীর দোষপ্রদর্শন করিবার জন্য লিখিয়া গিয়াছেন যে,—“স্থলপথে পলায়ন করিলেই ভাল হইত; অর্থলোভেই হউক আর স্নেহবশতই হউক, অনেকে তাঁহার অনুগমন করিতে পারিত; এবং বহুজনবেষ্টিত সিরাজদ্দৌলাকে কেহ সহজে কারারুদ্ধ করিতে পারিত না।”[৪৭] কিন্তু সিরাজ কি উদ্দেশ্যে একাকী নোকারোহণে পলায়ন করিয়াছিলেন, তাহার রহস্য-নির্ণয় করিলে মুতক্ষরীণের সমালোচনায় আস্থা স্থাপন করিতে পারা যায় না।
কেবল প্রাণরক্ষার জন্য পলায়ন করা আবশ্যক হইলে, ভগবান্গোলা হইতে পদ্মাস্রোতে পূর্ব্বাভিমুখে তরণী ভাসাইয়া দিলেই অনায়াসে দূরাঞ্চলে উপনীত হইতে পারা যাইত। সিরাজদ্দৌলা যে আত্মপ্রাণ তুচ্ছ করিয়া কেবল মোগলগৌরব রক্ষা করিবার জন্যই জন্যশূন্য রাজধানী হইতে পলায়ন করিয়াছিলেন, তাঁহার পলায়ন-প্রণালীই তাহার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।[৪৮] কোনরূপে পশ্চিমাঞ্চলে পলায়ন করিয়া মসিয় লা সাহেবের সেনাসহায়ে পাটনা পর্য্যন্ত গমন করা ও তথায় রামনারায়ণের সেনাবল লইয়া সিংহাসন রক্ষার আয়োজন করাই সিরাজদ্দৌলার উদ্দেশ্য ছিল।[৪৯] বিহার প্রদেশের শাসনকর্ত্তা রাজা রামনারায়ণ যেরূপ সাহসী সুচতুর সেইরূপ অকৃত্রিম প্রভুভক্ত; সুতরাং কোনরূপে তাহার সহিত মিলিত হওয়াই সিরাজদ্দৌলার লক্ষ্য হইয়া উঠিল। সরল পথে রাজমহল গমন করিবার চেষ্টা করিলে মীরজাফরের অনুচরবর্গ সহজে তাঁহাকে কারারুদ্ধ করিবার অবসর পাইবে, এই আশঙ্কায় তিনি মহানন্দার ভিতর দিয়া গোপনপথে দীনদরিদ্রের ন্যায় পাটনার দিকে অগ্রসর হইতেছিলেন।[৫০]
রাজমহলের নিকট কালিন্দী নাম্নী জাহ্নবীর ক্ষুদ্র শাখা নিঃসৃত হইয়া, পুরাতন গৌড় জনপদের উত্তরাংশ দিয়া মালদহের নিকট মহানন্দার সহিত মিলিত হইয়াছে। নাজিরপুরের নিকট ইহার মোহানা ছিল, এখনও তথায় চিহ্ন রহিয়াছে। এই পথ নিরাপদ মনে করিয়া সিরাজদ্দৌলা নিঃশঙ্কচিত্তে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।
সিরাজদ্দৌলা আর ক্ষণমাত্র ‘হতইতিগজ’ করিলে, রাজধানীতেই কারারুদ্ধ হইতেন। তিনি যে প্রভাতে মুরশিদাবাদে প্রত্যাগমন করেন, সেই প্রভাতে মীরজাফর এবং মীরণের সঙ্গে দাদপুরের বৃটীশ-শিবিরে পলাশিবিজেতা কর্ণেল ক্লাইবের শুভসন্দর্শন হয়।[৫১] চতুর ক্লাইব মীরজাফরকে কালাতিপাতের অবসর না দিয়া অবিলম্বে মুরশিদাবাদে উপনীত হইয়া সিরাজদ্দৌলাকে কারারুদ্ধ করিয়া রাজকোষ হস্তগত করিবার উপদেশ দান করেন।[৫২]
মীরজাফর রাজধানীতে শুভাগমন করিবামাত্র শুনিতে পাইলেন যে, শিকার হাতের বাহির হইয়া গিয়াছে! তিনি কি আর করিবেন? অবিলম্বে হিরাঝিলের শূন্য রাজসিংহাসন অধিকার করিয়া সিংহাসনাধিপতি সিরাজদ্দৌলাকে কারারুদ্ধ করিবার জন্য চারিদিকে লোক লস্কর প্রেরণ করিতে আরম্ভ করিলেন।
মীরজাফরের ভ্রাতা মীর দাউদ রাজমহলের ফৌজদার ছিলেন। মীরকাশিম তাঁহার অধীনে সেনাচালনা করিতেন। মীরকাশিম এবং মীর দাউদের উপর সিরাজদ্দৌলার পশ্চাদ্ধাবনের আদেশ হইবামাত্র তাঁহারা মুরশিদাবাদ হইতে রাজমহল পর্যন্ত সমস্ত গ্রাম নগর তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। বেগমমণ্ডলীর রমণীগণ কারারুদ্ধ হইলেন; সিরাজের অজাতশ্মশ্রু কনিষ্ঠ সহোদর মিরজা মেহেন্দী আলী রুদ্ধ হইলেন; মহারাজ মোহনলাল কারারুদ্ধ হইলেন;—কিন্তু সিরাজদ্দৌলার আর কোনরূপ সন্ধান মিলিল না।
মহারাজ মোহনলাল অমিতপরাক্রমে সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন রক্ষা করিতে গিয়া পলাশির যুদ্ধে গুরুতররূপে আহত হইয়াছিলেন; তথাপি তিনি আহত-কলেবরে সিরাজদ্দৌলার পার্শ্বরক্ষার জন্য মুরশিদাবাদে ছুটিয়া আসিয়াছিলেন। রাজধানীতে আসিয়া সিরাজদ্দৌলার পলায়ন সংবাদে মন্ত্রণাকুশল মোহনলাল সিরাজের গন্তব্য পথ ও গুপ্ত উদ্দেশ্য সহজেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তিনি আর শত্রুসঙ্কুল মুরশিদাবাদে কালক্ষয় না করিয়া সিরাজের সহিত মিলিত হইবার জন্য ভগবানগোলায় গমন করিতেছিলেন। কিন্তু ভগবানগোলায় উপনীত হইবার পূর্ব্বেই মীরজাফরের অনুচরবর্গ তাঁহাকে কারারুদ্ধ করিয়া ফেলিল।[৫৩] যিনি নিয়ূত ছায়ার ন্যায় সিরাজদ্দৌলার পদানুসরণ করিয়া, কখন মন্ত্রণাকৌশলে কখন বা অপরাজিত বাহুবলে মোগলের সিংহাসনরক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়া দিয়াছিলেন, যাঁহার অতুলনীয় রণকৌশল এবং অকৃত্রিম প্রভুভক্তির পরিচয় পাইয়া বিদ্রোহী দল সর্ব্বদা সশঙ্কচিত্তে কালযাপন করিত, তাঁহাকে মীরজাফর নিষ্কৃতিদান করিতে সাহস পাইলেন না। তিনি মোহনলালকে বিদ্রোহী সেনানায়ক মহারাজ রায়দুর্ল্লভের হস্তে সমর্পণ করিলেন। মোহনলালকে দীর্ঘকাল কারাক্লেশ বহন করিতে হইল না; রায়দুর্ল্লভ তাঁহার ধন সম্পদ ও জীবন হরণ করিয়া মীরজাফরের আশঙ্কা নিবারণ করিলেন।[৫৪]
রাজধানী শত্রুশূন্য হইল; তথাপি মীরজাফর মস্নদে উপবেশন করিতে সাহস পাইলেন না। সকলে বুঝিল যে অতঃপর তিনিই বাঙ্গালা, বিহার উড়িষ্যার শূন্য সিংহাসন উজ্জ্বল করিবেন; তথাপি মীরজাফর সেই শূন্য সিংহাসন সম্মুখে করিয়া ক্লাইবের শুভাগমনের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। ক্লাইব সহসা রাজধানীতে পদার্পণ না করিয়া নগরোপকণ্ঠে কালযাপন করিতেছিলেন; ২৯ জুন দুইশত গোরা এবং পাঁচশত কালা সিপাহী সমভিব্যাহারে ইংরাজ-সেনাপতি মসুরগঞ্জে শুভাগমন করিলেন। ক্লাইব বলিয়া গিয়াছেন যে, “সে দিন যত লোক রাজপথপার্শ্বে সমবেত হইয়াছিল, তাহারা ইংরাজনিধনে কৃতসংকল্প হইলে, কেবল লাঠি সোটা এবং লোষ্ট্রনিক্ষেপেই তৎকার্যসাধন করিতে পারিত!”[৫৫]
মোগল রাজধানীর “সুবাসিত” প্রাসাদ কক্ষে পদার্পণ করিয়াও ক্লাইবের দুশ্চিন্তা দূর হইল না;—কেহ কেহ বলিতে লাগিল যে “তাঁহাকে গোপনে হত্যা করিবার জন্য ষড়যন্ত্র আরম্ভ হইয়াছে।”[৫৬] এরূপ জনরবে বিশ্বাস স্থাপন করিবার কারণেরও অভাব ছিল না! সেকালে গুপ্তহত্যা সকল দেশেই অল্পাধিক পরিমাণে প্রচলিত ছিল, তাহাতে আবার সিরাজদ্দৌলা ধরা না পড়ায় অনেকরূপ সন্দেহ ঘনীভূত হইয়া উঠিতেছিল। কে শত্রু কে মিত্র,—কে রাষ্ট্রবিপ্লবে আন্তরিক হর্ষযুক্ত, কে ক্লাইবের সর্ব্বনাশসাধনের জন্য সুযোগ অনুসন্ধান করিতেছে,—তাহার কিছু স্থিরতা নাই। এরূপ অবস্থায় ক্লাইব এবং মীরজাফর উভয়ে উভয়ের কণ্ঠলগ্ন হইয়া আত্মপক্ষ সবল করিবার আয়োজন করিতে লাগিলেন।
ক্লাইব ক্ষণমাত্র কালবিলম্ব না করিয়া পাত্রমিত্রগণের সাক্ষাতে দরবারকক্ষে মীরজাফরের নিকটবর্ত্তী হইলেন, এবং তাঁহাকে মস্নদে বসাইয়া দিয়া[৫৭] কোম্পানী বাহাদুরের প্রতিনিধি স্বরূপ স্বয়ং সর্ব্বপ্রথমে ‘নজর’ প্রদান করিয়া মীরজাফরকে বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার সুবেদার বলিয়া অভিবাদন করিলেন।[৫৮]
রাজ্যাভিষেক সুসম্পন্ন হইল, লঙ্কাভাগও সুসম্পন্ন হইল, কিন্তু সিরাজদ্দৌলার আর কোন সন্ধান মিলিল না! পুনরায় তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিবার জন্য চারিদিকে সিপাহীসেনা ছুটিয়া চলিল।
যুদ্ধের উপক্রম বুঝিয়াই সিরাজদ্দৌলা মসিয় লাকে রাজমহলের পথে মুরশিদাবাদে উপনীত হইবার জন্য সংবাদ পাঠাইয়াছিলেন। রাজা রামনারায়ণ অর্থাদি প্রদান করিতে বিলম্ব করায় মসিয় লা সংবাদ পাইবামাত্র যুদ্ধযাত্রা করিতে পারেন নাই।[৫৯] তিনি যখন সসৈন্যে ভাগলপুরের নিকটবর্ত্তী হইলেন, সিরাজদ্দৌলা তখন মহানন্দাস্রোত অতিক্রম করিতেছিলেন!
সিরাজদ্দৌলা মহানন্দাস্রোত অতিক্রম করিয়া কালিন্দীর জলপ্রবাহ উত্তীর্ণ হইতেছিলেন,—তাঁহার নৌকা যখন বখ রা বুরহাল নামক পুরাতন পল্লীর নিকটবর্ত্তী হইল, তখন সহসা তাঁহার গতিরোধ হইল। নাজিরপুরের মোহনা অতিক্রম করিতে পারিলেই বড় গঙ্গায় প্রবেশ করা যাইত, কিন্তু জলাভাবে নাজিরপুরের মোহানা শুষ্কপ্রায়;—আর নৌকা চলিল না।[৬০]
এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সিরাজদ্দৌলার সর্ব্বনাশের সূত্রপাত হইল। তিনি ভাবিয়াছিলেন যে, তাঁহার পরাজয়বার্ত্তা তখন পর্য্যন্তও দূর দূরান্তরে নীত হয় নাই; সেই ভরসায় সিরাজদ্দৌলা স্বয়ং নদীতীরে অবতরণ করিলেন, নাবিকগণ ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া নদীমুখের সন্ধান লইতে লাগিল, ইত্যবসরে যৎকিঞ্চিৎ খাদ্য সংগ্রহের জন্য সিরাজ নিকটস্থ মুসলমান মস্জেদে আতিথ্য গ্রহণ করিলেন। এই মস্জেদ দানশা নামক বিখ্যাত মুসলমান সাধুর সমাধিমন্দির; তাহা অদ্যাপি সাহপুর নামক গ্রামে ভগ্নাবস্থায় বিরাজ করিতেছে।[৬১] মস্জেদের লোকে ক্ষুদ্র পল্লীতে সিরাজদ্দৌলার ন্যায় অতিথির নৌকা দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিল, পরে নাবিকগণের নিকট সন্ধান লইয়া তাহারা সকল সমাচার অবগত হইল। মীর দাউদ এবং মীরকাশিমের সেনাদল নিকটেই অবস্থান করিতেছিল, অর্থলোভে লোকে তাহাদিগকে সিরাজদ্দৌলার সন্ধান বলিয়া দিল। সিরাজ ক্ষুধার অন্ন গলাধঃকরণ করিবারও অবসর পাইলেন না, সপরিবারে মীরকাশিমের হস্তে বন্দী হইলেন।
ইংরাজেরা বলেন যে, সিরাজদ্দৌলা সম্পদের দিনে দানশা নামক মুসলমান ফকিরের নাসাকর্ণ ছেদন করিয়া দিয়াছিলেন, বিপদের দিনে প্রতিহিংসাপরায়ণ দানশা তাঁহাকে ধরাইয়া দিয়াছিল।[৬২] মাহাত্মা বিভারিজ ইহা অবিশ্বাস করিয়া লিখিয়া গিয়াছেন যে, “এই জনশ্রুতি সত্য হইতে পারে না, কারণ মুতক্ষরীণের অনুবাদক হাজি মুস্তাফা স্বকৃত টীকায় লিখিয়া গিয়াছেন, ফকির আদৌ সিরাজদ্দৌলাকে চিনিত না, তাঁহার বহুমূল্য পাদুকা দেখিয়া তাহার সন্দেহ জন্মে, নাবিকদিগের নিকট সংবাদ সংগ্রহ করিয়া সে নবাবকে ধরাইয়া দেয়।”[৬৩] আমাদের নিকট ইহার কোন সিদ্ধান্তই সত্য বলিয়া বোধ হয় না। সিরাজ যেরূপ মুসলমান ধর্ম্মানুরাগী ছিলেন, তাহাতে সঁহার পক্ষে, দানশার ন্যায় একজন বিখ্যাত মুসলমান সাধুর নাসাকর্ণচ্ছেদ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব; আমরা দানশার সমাধি মন্দিরের ফলকলিপির সাহায্যে এবং তাঁহার বংশধরদিগের নিকট প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া জ্ঞাত হইয়াছি যে, দানশা আদৌ সে সময়ে জীবিত ছিলেন না।[৬৪]
সিরাজদ্দৌলা কালিন্দীতীরস্থ শাহপুর গ্রামে দানশার সমাধিমন্দিরের নিকটেই কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়। রিয়াজ-রচয়িতা শ্রীযুক্ত গোলাম হোসেন সলেমী মালদহের লোক, তাঁহার কথাই অধিকতর বিশ্বাস্য। কিন্তু দানশা বা তাঁহার বংশধরদিগের সহিত ইহার কোনরূপ সংস্রব ছিল বলিয়া বোধ হয় না। একমাত্র হণ্টার সাহেব লিখিয়া গিয়াছেন যে, “দানশা সিরাজদ্দৌলাকে ধরাইয়া দিয়া মীরজাফরের নিকট হইতে বহুমূল্য জায়গীর লাভ করিয়া স্বদেশে “সুভামার” খ্যাতিলাভ করেন; তাঁহার বংশধরগণ অদ্যাদি সেই জায়গীর উপভোগ করিতেছেন।”[৬৫] এ কথা সত্য হইলে মালদহের কালেক্টরীতে এই জায়গীরের সন্ধান পাওয়া যাইত। কিন্তু তথায় এরূপ জায়গীরের আদৌ কোন উল্লেখ নাই, মালদহের ভূতপূর্ব্ব কালেক্টর শ্রীযুক্ত উমেশ চন্দ্র বটব্যাল মহাশয় “সেরেস্তা তদন্ত করিয়াও তাহার সন্ধান পান নাই।”[৬৬] দানশার অধিকারে অনেক নিষ্করভূমি থাকার কথা শুনিতে পাওয়া যায়, তাঁহার সমাধিবিদ্যুত পুরাতন ইষ্টকসজ্জা দেখিয়া তাহাকে সম্পন্ন ব্যক্তি বলিয়াই বোধ হয়। কিন্তু তাঁহার বংশধরদিগের অধিকারে এখন অল্প কয়েক বিঘা মাত্র নিষ্কর ভূমি রহিয়াছে, তাঁহারা বলেন যে, তাঁহারা ঐ সকল নিষ্কর ভূমি গৌড়াধিপতি হোসেন শাহ নামক পাঠান বাদশাহের নিকট দানপ্রাপ্ত হইয়া দানশার পূর্বপুরুষের সময় হইতে উপভোগ করিয়া আসিতেছেন।
মিরকাশিম যখন সিরাজদ্দৌলাকে কারারুদ্ধ করেন, সিরাজ তখন নিরস্ত্র নিঃসঙ্গ; তিনি অনন্যোপায় হইয়া অর্থ বিনিময়ে স্বাধীনতা ক্রয় করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। মীরকাশিমের সেনাদল লুণ্ঠনলোভে উন্মত্তবৎ তাঁহার নৌকা আক্রমণ করিল, স্বয়ং মীরকাশিমও অর্থলোভ পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না। তিনি পাকেচক্রে লুৎফউন্নিসা বেগমের বহুমূল্য রত্নালঙ্কার গুলি আত্মসাৎ করিলেন![৬৭] মসিয় লা এই সময়ে ত্রিশমাইলমাত্র দূরে ছিলেন;— তিনি সিরাজের সহিত মিলিত হইবার পূর্ব্বেই সিরাজের সকল আশা নির্ম্মূল হইয়া গেল![৬৮]
মীর দাউদ মহোল্লাসে এই সংবাদ মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করিবামাত্র মীরজাফরের প্রবল উৎকণ্ঠা দূর হইয়া গেল। তিনি ক্লাইবের কণ্ঠলগ্ন হইয়া হিরাঝিলে মন্ত্রণা করিতেছিলেন, সংবাদ পাইবামাত্র সিরাজদ্দৌলাকে বাঁধিয়া আনিবার অন্য যুবরাজ মীরণকে সসৈন্যে রাজমহলে পাঠাইয়া দিলেন।[৬৯]
১৫ই সাওয়াল (৩রা জুন) আত্মভৃত্যবর্গের নিষ্ঠুর নির্য্যাতনে জীবন্মৃত কলেবরে সিরাজদ্দৌলা বন্দীবেশে মুর্শিদাবাদে উপনীত হইলেন।[৭০] আলিবর্দ্দীর স্নেহপুত্তলের এই ভাগ্যবিবর্ত্তনের জীবন্ত চিত্র সম্মুখে দেখিয়া মুর্শিদাবাদের লোকে হাহাকার করিয়া উঠিল;—মুসলমান ইতিহাসলেখক আত্মসম্বরণ করিতে না পারিয়া বাষ্পগদ্দকণ্ঠে বলিয়া গিয়াছেন:—
Be warned by example, O ye men of understanding, and view well the revolutions of fortune. Place not your reliance upon the world's success, for it is uncertain and inconstant, like a public figure, who goes daily from house to house."[৭১]
সিরাজদ্দৌলার বিকশিতকুসুমলোভনীয় সুকুমার দেহকান্তি আত্মভৃত্যবর্গের নিষ্ঠুর নির্য্যাতনে মলিন হইয়া উঠিয়াছিল; তাঁহাকে দেখিবামাত্র নাগরিকদিগের সহানুভুতি উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। মীরজাফরের সেনাদল কৃতন্ত্রের ন্যায় সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন কাড়িয়া লইয়া তাঁহার কত না দুর্গতি করিয়াছে, তাহা তাহারাও বুঝিতে পারিল। তাহারা দেখিল যে, তাহাদের মহাপাপে রাজাধিরাজ বন্দী হইলেন, কৃতঘ্ন রাজকর্ম্মচারী শূন্যসিংহাসনে উপবেশন করিলেন, তাঁহার গুপ্তসংকল্পের প্রধান সহচরগণ মহোল্লাসে লঙ্কাভাগ করিয়া রাজকোষের ধনরত্ন কলিকাতায় চালান করিয়া দিলেন, অথচ মীরজাফরের সেনাদল রাজকোষের অর্থাভাব বলিয়া তাহাদের বেতন পর্য্যন্তও প্রাপ্ত হইল না! তখন তাহারা অধীরহৃদয়ে ওষ্ঠদংশন করিতে লাগিল, কেহ কেহ সিরাজদ্দৌলার মুক্তিলাভের সদুপায় চিন্তা করিবার জন্য রাজপথে সমবেত হইতে লাগিল, মুর্শিদাবাদ টলমল করিয়া উঠিল![৭২]
- ↑ The whole army reached Plassey-grove, after a very fatiguing march, and through a whole night's rain. Ive's Journal
- ↑ The soldiers slept, but few of the officers, and least of all the Commander.-Orme, ii, 172.
- ↑ Scrafton's Reflections.—এই ঘটনা প্রকারান্তরে ষ্টুয়ার্টেও বর্ণিত আছে, অন্যান্য ইতিহাসেও স্থানলাভ করিয়াছে।
- ↑ He used to drink, but he gave up this habit in accordance with a promise which he made to Aliverdi on his death-bed,—H. Beveridge, C. S.
- ↑ I have before mentioned Surajha Dowla, as given to hard-drinking; but Allyvherdi, in his last illness, foreseeing the ill consequences of his excesses, obliged him to sweer on the Koran, never more to touch any intoxicating liquor; which he ever after strictly observed.—Scrafton.
- ↑ পলাশির যুদ্ধ কাব্য।
- ↑ পলাশির যুদ্ধ কাব্য। কবিবর লেখককে বলিয়াছেন, তিনি পলাশির যুদ্ধকাব্য রচনার পূর্ব্বে ষ্টুয়ার্টের ইতিহাস পাঠ করেন নাই।
- ↑ Holwell's Interesting Historical Events, Part I, P. 70.
- ↑ ইতিহাসের হুগলীর সমর-কাহিনী অন্যরূপ। সিরাজ তাহাতে আদৌ উপস্থিত ছিলেন না। তিনি “দাঁতে তৃণ লয়ে “সভয়ে” সমরত্যাগ করা দূরে থাকুক,—ইংরাজেরা তাঁহার অগোচরে গোপনে তস্করের ন্যায় হুগলী লুণ্ঠন করায়, তাহাদিগকে সমুচিত শিক্ষা দিবার জন্যই দ্বিতীয়বার কলিকাতা আক্রমণ করেন। ক্লাইব তাঁহার গতিরোধ করিতে গিয়া তাঁহার দুই জন সেনানায়ক এবং সেক্রেটারী পঞ্চত্বলাভ করিয়াছিলেন; নিশারণে শত্রুসংহার করিতে গিয়া স্বয়ং ক্লাইব হেটমুণ্ডে পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। “কবির পথ” অবশ্যই “নিষ্কণ্টক", ইতিহাসের পথ সেরূপ হইলেই ভাল হইত।
- ↑ ইংরাজি ইতিহাস ভিন্ন সুপ্রসিদ্ধ “ক্ষিতীশ বংশাবলি চরিতেও” (১২৩-১২৬ পৃষ্ঠা) এই ঘটনা আনুপূর্ব্বিক বর্ণিত রহিয়াছে। “ক্ষিতীশ বংশাবলি চরিতের” চারি বৎসর পরে “পলাশির যুদ্ধকাব্য” প্রকাশিত হয়। অথচ শ্রীযুক্ত নবীনচন্দ্র সেন মহাশয়ের ন্যায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্য সেবক এবং তাঁহার “বঙ্গ সাহিত্য সমাজে সুপরিচিত” কোন একজন বন্ধু মহাশয় চারি বৎসরের মধ্যেও “ক্ষিতীশবংশাবলি চরিতের” ন্যায় “বঙ্গ সাহিত্য সমাজে সুপরিচিত” গ্রন্থখানি একবার মাত্রও পাঠ করিবার অবসর প্রাপ্ত হন নাই। অহো! স্বদেশের ইতিহাসের অপরিসীম সৌভাগ্য!
- ↑ পলাশির যুদ্ধকাব্য পরিশিষ্ট।
- ↑ সাহিত্য-সম্পাদক শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র সমাজপতি।}}
- ↑ Not only has a complete poen like this a merit of its own superior to that of mere compilation of fugitive pieces, but as it is also the history of Bengal of the period in verse, the introduction of such a book into our schools will be doubly beneficial to the students, and an encouragement to real talent and literature of Bengal.—Preface.
- ↑ মুতক্ষরীণ। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যগ্রন্থে (শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের সঙ্কলিত ইতিহাসে) লিখিত আছে যে, পলাশির যুদ্ধ ১৭ই জুন সংঘটিত হইয়াছিল। বলা বাহুল্য যে ইহা সম্পূর্ণ অমূলক অথবা লিপিকরপ্রমাদের নিদর্শন মাত্র।
- ↑ At daybreak of the 23rd. the Nabob's army was perceived marching out of their lines towards the grove, which we were in possession of; their intention seemed to be to surround us—Ive's Journal.
- ↑ What with the number of elephants, all covered with scarlet cloth embroidery, their horse, with their drawn swords glistening in the sun, their heavy cannon, drawn by vast trains of oxen, and their standards flying—they made a grand and formidable appearance.—Scrafton.
- ↑ Orme, vol. ii, 175.
- ↑ We soon found such a shower of balls pouring upon us from their fifty pieces of cannon * * * that we retired under cover of the bank,—Scrafton's Reflections.
- ↑ “সাবেদজঙ্গনে (ক্লাইব) আমীনচাঁদসে বাদগুমান্ হো কর, গোসা ফরমায়া, অওর কহা কে এসাহি ওয়াদা থা কে খাফিফ্ লঢ়াইমে বদরায় দিলি হাসিল্ হো যায় গা, অওর শাহী ফৌজভি সিরাজুদ্দৌলাসে মনহেরেফ্ হেয়; ওয়া সব তেরি বাতেঁ বরখেলাফ্ পায়ি জাতি হেঁয়!”-মুতক্ষরীণ (অনুবাদ)।
- ↑ Stewart's History of Bengal,
- ↑ As soon as their rear was out of the camp, failing in their plan to surround us, they halted. —Ive's Journal,
- ↑ মীর মহম্মদ জাফরখা ওগয়রহ, যো বায়েস ইস, কোস্তখুন কে হুয়ে থে, জিস, তরফ কে মোকরর থে, ওহ খড়ে তামাসা দেখ, রহে থে!-মুতক্ষরীণ (অনুবাদ)।
- ↑ At 11 o'clock Colonel Clive consulted his officers at the drumhead; and it was resolved to maintain the cannonade during the day but at midnight to attack the Nabab's camp.-Orme, vol. ii, 179.
- ↑ The battle being attended with so little bloodshed, arose from two causes; first,—the army was sheltered by so high a bank that the heavy artillary of the enemy could not possibly make them much mischief. The other, was,—that Suraja Dowla had not confidence in his army, nor his army any confidence in him, and there fore, they did not do their duty-Cliye's Evidence.
- ↑ He was immediately carried to the Nawab; and having uttered a few words, expressive of his own loyalty, and the want of it in others, died in his presence.-Stewart.
- ↑ মুতক্ষরীণ।
- ↑ Stewart's History of Bengal.
- ↑ মুতক্ষরীণ।
- ↑ Orme, vol. ii. 175.
- ↑ Some say he was asleep; which is not improbable, considering how little rest he had for so many hours before; but this is no imputation either against his courage or conduct -Orme, vol. ii. 176.
- ↑ Ibid.
- ↑ সিরাজদ্দৌলানে যব্ লস্করকা ইয়া হাল দেখা, নেয়ায়েৎ থৌক্মন্ হো খসুস্ তালা আদুসে, কেঁওকে বহুত কম্লোগোকে আপনা দোস্ত জান্তা থা* * * কৈ ঘড়িভড় রোজ বাকী রহাথা কে খোদাভি ভাগ্ নিক্লা। মুতক্ষরীণ (অনুবাদ)।
- ↑ অর্ম্মি সিরাজদ্দৌলাকে ‘উষ্ট্রারোহণ’ করাইয়াছেন; মেকলে তাহার উপর রং চড়াইয়া ‘দ্রুতগামী’ শব্দ যোগ করিয়া দিয়াছেন। স্ক্রাফ্টন যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন, তিনি লিখিয়া গিয়াছেন যে “সিরাজ গারোহণেই পলায়ন করিয়াছিলেন।”
- ↑ Orme, vol. ii. 176.
- ↑ It was only when treason had done her work, when treason had driven the Nuab from the field, when treason had removed his army from its commanding position, that Clive was able to advance without the certainty of being annihilated. Plassy, then, though a dicisive, can ever be considered a great battle.-Col. Malleson's Decisive Battles of India. p. 73.
- ↑ Praise was more particularly given to the 39th Regiment which still bears on its banners the name of “Plassy", and the motto, Primus in Indis - Great battles of the British Army; p. 169.
- ↑ It was not a fair fight. Col Mallison.
- ↑ H. Beveridge, C. S.
- ↑ ইংরাজেরা বলেন, সিরাজদ্দৌলা “দিবা দুই ঘটিকার” সময়ে পলাশি হইতে পলায়ন করিয়া “সেই রজনীতেই” রাজধানীর মহিলামণ্ডলীর বস্ত্রাঞ্চলের আশ্রয়গ্রহণ করিয়াছিলেন। মুতক্ষরীণে লিখিত আছে, তিনি “সায়ংকাল পর্যন্তও” যুদ্ধক্ষেত্রে অপেক্ষা করিয়া আত্ম-সেনানায়কদিগের “বিশ্বাসঘাতকতায়” বিপর্য্যস্ত হইয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হন, এবং পরদিবস প্রাতঃকালে, অর্থাৎ “৬ মাহ সাওয়াল রোজ জুমাকো দো তিন ঘড়ি দিন চঢ়ে মনসুরগঞ্জ আ পহঁছা।” শ্রীল শ্রীযুক্ত ড্রেক সাহেব বাহাদুরের পলায়নে ইংরাজ-গৌরব যেরূপ কলঙ্কিত হইয়া রহিয়াছে;—সিরাজদ্দৌলা পলায়নে মুসলমানের নাম সেরূপ কলঙ্কিত হয় নাই!
- ↑ মুতক্ষরীণ।
- ↑ Even his wife's father, Mahammed Eeruch Khan, though the Nabab begged him to stay and collect troops, either to defend him where he was, or to accompany him in his retreat, refused, and hastened to his own house at the city of Moorshidabad.—Scott's History of Bengal, p. 368.
- ↑ Some advised him to deliver himself up to the English, which he imputed to treachery.-Orme ii. 179.
- ↑ When Shirajadaula arrived at the city, his palace was full of treasure; but with all that treasure, he could not purchase the confidence of his army; he was employed in lavishing considerable sums among his troops to engage them to another battle.-First Report, 1772.
- ↑ As a last resource, the Nabab opened the doors of his treasury, and distributed large sums to the soldiers; who received his bounty and deserted him with it to their homes,—Scott's History of Bengal. p. 369.
- ↑ Scrafton.
- ↑ He was accompanied in his flight by his favourite concubine Latafunnissa. I am informed that this lady was originally a Hindu and none other than the sister of Mohan Lal - H. Beveridge, C. S. এ বিষয়ে অনেকে অন্যরূপ ধারণা আছে।
- ↑ Riyaz-us salateen. রেণেল-কৃত প্রাচীন মানচিত্রে গোদাগাড়ীর নিকট মহানন্দা নদীই দেখিতে পাওয়া যায়।—এখন কিন্তু সেখানে পদ্মার প্রবল তরঙ্গ!
- ↑ It was his intention to escape to M. Law, and with him to Patna, the Governor of which province was a faithful servant of his family.-Orme ii. 179.
- ↑ “সিরাজদ্দৌলা যে প্রাণরক্ষার জন্য পলায়ন না করিয়া সিংহাসন রক্ষার জন্যই পলায়ন করেন, স্বয়ং মীরজাফরেরও সেইরূপ ধারণা হইয়াছিল। তিনি সেই জন্য রাজমহলের পথে সিরাজদ্দৌলাকে ধরিবার জন্য লোক লস্কর প্রেরণ করেন। সিরাজদ্দৌলাও জানিতেন যে, তাঁহাকে রাজমহলের পথেই ধরিবার জন্য লোক লস্কর প্রেরিত হইবে। তিনি তজ্জন্য সরল সুপরিচিত স্থলপথ ছাড়িয়া অজ্ঞাতপূর্ব জলপথে মালদহ ঘুরিয়া রাজমহলে উপনীত হইবার আয়োজন করিয়াছিলেন।
- ↑ While we were thus happy in our success, Suraja Dowla was travelling in disguise, like a miserable, fugitive, towards Patna, where he hoped once more to appear in arms—Scrafton.
- ↑ Scrafton.
- ↑ (The Colonel) advised him to proceed immediately to the city, and not to suffer Suraja Dowla to escape, nor his treasures to be plundered.-Orme, ii. 178.
- ↑ মুতক্ষরীণ।
- ↑ The Dewan Mohun Lal had before this been seized at Moorshidabad and his effects and life were taken by Doolubram.-Scotts” History of Bengal, p. 371.
- ↑ He entered the city with 200 Europeans, and 500 Sepoys,—the inhabitants, who were spectators upon that occasion, must have amounted to some hundred thousands; and If they had had an inclination to have destroyed the Europeans, they could have done it with sticks and stones.—Clive's Evidence.
- ↑ Orme, ii. 180.
- ↑ Col. Clive took Mir Jaffier's hand and led him to the Musnud.—Tarikh-i-Mansuri.
- ↑ Scrafton.
- ↑ মুতক্ষরীণ।
- ↑ আষাঢ়ের প্রথমে এখনও নাজিরপুরের মোহনায় নৌকা চলাচল করিতে পারে না। According to the Riyaz (p. 373) Sirajudowla was obliged to stop at Bahral as the Nazirpore mouth was found closed.-H. Beveridge, c. s. অর্ম্মি লিখিয়া গিয়াছেন যে সিরাজ রাজমহল পর্যন্ত উপনীত হইয়া তথায় একজন ফকিরের চক্রান্তে কারারুদ্ধ হন। এই বর্ণনা সত্য বলিয়া বোধ হয় না।
- ↑ মালদহনিবাসী স্নেহভাজন বন্ধু শ্রীযুক্ত রাধেশচন্দ্র শেঠ বহুক্লেশে এই মস্জেদের ফলকলিপি সংগ্রহ করিয়া মস্জেদের কয়েকখানি কারুকার্য্যখচিত পুরাতন ইষ্টক উপঢৌকন পাঠাইয়া দিয়াছেন। কেহ বলেন সিরাজদ্দৌলা এই মস্জেদের নিকটেই কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন, আবার কেহ বলেন (Tarikh-i.rnansuri) তিনি রাজমহলের নিকট কারারুদ্ধ হন। এই মস্জেদ রাজমহলের নিকট না হউক, রাজমহল হইতে বহুদুরে নহে। রিয়াজ উস্ সালাতিনের মতে কালিন্দী তীরেই সিরাজদ্দৌলা কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন।
- ↑ Scrafton; Clive's Evidence etc.
- ↑ But this can hardly be true if the translator of the Sayer be correct in saying that the fakir did not recognize the Nawab, and only learnt who he was from the boatmen, after his suspicions had been arouserl by observing the richness of the stranger's slippers. H. Beveridge, C.S.
- ↑ সিরাজদ্দৌলার সময়ে দানশার পৌত্র জীবিত ছিলেন। ইঁহারা সকলেই সে অঞ্চলে বিশেষ প্রসিদ্ধ। তারিখ ই-মনসুরী লেখক কাহারও নামোল্লেখ করেন নাই; তিনি বলেন যে সিরাজ একজন দরবেশের দাড়ি গোঁফ মুড়াইয়া দিয়া অপমান করিয়াছিলেন, সেই ব্যক্তিই তাঁহাকে ধরাইয়া দেয়।
- ↑ Hunter's Statistical Accounts of Bengal, vol. vii. 84.
- ↑ H. Beveridge, C. S.
- ↑ মুতক্ষরীণ।
- ↑ Monsr. Law and his party came down as far as Rajmehal to Surajuddaula's assistance, and were within three hour's march when he was taken.-Clive's Letter to Court. 26 July. 1757
- ↑ Advice of it reaching the Subah, he sent his son to take him prisoner and bring him to the city.-Scrafton
- ↑ ১৫ সাওয়াল ১১৭০ হিজরীকে আপ্নে নৌকরুন্কি কয়েদ্মে মুরশিদাবাদ আয়া!-মুতক্ষরীণ (অনুবাদ)
- ↑ Scott's translation p. 372.
- ↑ It is said that several jammadars, as he passed their quarters, were so penetrated with grief and anger, as to prepare to rescue him, but were prevented by their superiors.-Scott's History of Bengal, p. 371.