সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/প্রমোদশালা
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
প্রমোদশালা।
ইংরাজ ইতিহাস-লেখকগণ সিরাজদ্দৌলাকে কুক্রিয়াসক্ত তরুণ বুবক বলিয়াই নিরস্ত হন নাই; তিনি যে বুদ্ধিবৃত্তিহীন পশুবিশেষ; তাহাও প্রমাণ করিবার জন্য অনেক কালি কলমের অপব্যয় করিয়াছেন। সিরাজ যে সকল অমানুষিক অত্যাচারে বাঙ্গালীহৃদয় দলন করিয়াছিলেন বলিয়া সাধারণ লোকের বিশ্বাস, তাহার স্মৃতি এখনও বিলুপ্ত হয় নাই। আমরা সেইজন্য সিরাজের নাম শুনিলে এখনও যেন আতঙ্কে শিহরিয়া উঠি। সুতরাং সত্যের সঙ্গে দশটা মিথ্যা অপবাদ রটনা করিয়া লোকে ইতিহাস এবং কবিতা লিখিয়া গেলেও, তাহার সত্যাসত্য নির্ণয় করিবার চেষ্টা করি না।
সিরাজদ্দৌলার যে বুদ্ধিবৃত্তির অভাব ছিল তাহা সত্য নহে; বরং তাঁহার বুদ্ধিবৃত্তি এতই অধিক ছিল যে, বুদ্ধিমান ইংরাজবণিকও অনেক সময়ে তাহার নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু সে বুদ্ধি কেবল দুষ্টবুদ্ধি! বনশার্দ্দূল যেমন অতি সংগোপনে নিঃশব্দপদবিক্ষেপে শিকারের অনুগমন করিয়া সময় ও সুযোগ পাইবামাত্র একলম্বেক চকিতের মধ্যে গ্রীবা ভাঙ্গিয়া রক্তপান করিয়া থাকে, সিরাজ সেইরূপ শার্দ্দূল বৃত্তি শিক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার গতিবিধি এত সরল, কথাবার্ত্তা এত বালকোচিত এবং আচারব্যবহার এত সন্দেহশূন্য বোধ হইত যে, নবাব আলিবর্দ্দী কিছুতেই তাঁহার প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিতেন না।
আলিবর্দ্দীর ধর্ম্মজীবনের প্রভাবে মুর্শিদাবাদের রাজপ্রাসাদ যেন পবিত্র তপোবন হইয়া উঠিয়াছিল; মসজেদে মসজেদে যথাসময়ে নামাজ হইত, দ্বারে দ্বারে গরীব কাঙ্গাল অন্নবস্ত্র লাভ করিত, ন্যায় ও ধর্ম্মানুসারে বিচারকার্য্য পরিচালিত হইত, অবসর সময়ে সুপণ্ডিত মৌলবীগণ শাস্ত্রব্যাখ্যায় চিত্ত্ববিমোহন করিতেন;[১] বারবণিতাশ্রেণী সিংহ দ্বার অতিক্রম করিতে পারিত না, নৃত্যগীত রাজকার্য্যের মধ্যে কলুষকালিমা ঢালিয়া দিবার অবসর পাইত না। ইহাতে বৃদ্ধের দিন কাটতে পারে, কিন্তু যুবক সিরাজদ্দৌলার দিন কাটিল না! মাতামহের সহবাস প্রথমে একটু অসুবিধাজনক এবং পরে একেবারেই অসহ্য হইয়া উঠিল। সিরাজ সেই সহবাসে অবরুদ্ধ হইয়া গৃহকোটরে ছটফট্ করিতেছিলেন; বুদ্ধিবলে তাহা হইতে মুক্তিলাভ করিবার জন্য এক নূতন উপায় অবলম্বন করিলেন।
আলিবর্দ্দী ভাল করিয়া সিরাজ-চরিত্র বুঝিয়াছিলেন। কিনা জানি না; কিন্তু চতুর সিরাজদ্দৌলা ভাল করিয়াই আলিবর্দ্দীর চরিত্র অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। তিনি জানিতেন যে, যুক্তিসঙ্গত কথায় যে কোন আবদার ধরিয়া বসিলেই মাতামহ তাহা পূরণ করিতে কিছুমাত্র আপত্তি করিবেন না। সুতরাং সিরাজ একটি নুতন বাটি নির্ম্মাণের জন্য আবদার জানাইলেন। “একখানি জীর্ণ কম্বলে দশজন ফকির একসঙ্গে বসিয়া বৎসর কাটাইয়া দিতে পারে, কিন্তু একটিমাত্র পুরাতন প্রাসাদে প্রবীণ এবং নবীন দুইজন ভূপতি একসঙ্গে বাস করিলে তাঁহাদের মান সম্ভ্রম শীঘ্রই উপহাসের বিষয় হইয়া পড়ে!” কথাটি এত সরল, এত সুযুক্তিপূর্ণ এত স্বাভাবিক বলিয়া বোধ হইল যে, বুদ্ধ নবাদ আর দ্বিরুক্তি না করিয়া দৌহিত্রের জন্য এক নূতন প্রাসাদ নির্ম্মাণ করিবার আদেশ দিলেন; ইহার মধ্যে যে সিরাজের গুপ্ত পাপ-লিপ্সা লুক্কায়িত থাকিতে পারে, সে কথা একবারও আলিবর্দীর প্রবীণ মন্তকে প্রবেশ করিতে পারিল না!
রাজধানীর নিকটে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে হীরারিলে।[২]—সেইখানে সিরাজের জন্য প্রমোদভবন নির্ম্মিত হইতে লাগিল। গৌড়ের ইতিহাস-বিখ্যাত বাদশাহদিগের সযত্ন-সঞ্চিত কারুকার্যভূষিত বহুমূল্য প্রস্তররাশি সংগ্রহ করিয়া প্রমোদভবন সুসজ্জিত করা হইল। সে হীরাঝিল নাই, সে রাজপ্রাসাদও আর নাই;—মহাপাপের জ্বলন্ত হুতাশনে দগ্ধ হইয়া তাহার শেষ ভস্মরাশিও ভাগীরথী-স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে! হীরাঝিলের প্রমোদভবনে সিরাজের সিংহাসন স্থাপিত হইয়াছিল; হীরাঝিলের প্রমোদভবনেই বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর ক্লাইব সাহেবের হাত ধরিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিয়া রাজমুকুট মাথায় তুলিয়াছিলেন! এইখানে মুসলমানের অস্তগিরি—এইখানেই আবার ইংরাজের উদয়াচল; কিন্তু তাহা এখন লোকচক্ষুর অন্তরাল হইয়াছে।
হীরাঝিলের প্রমোদভবন নির্ম্মিত হইলে, দলবল লইয়া সিরাজদ্দৌলা বিলাস-তরঙ্গে দেহমান ভাসাইয়া দিলেন। কক্ষে কক্ষে, কুঞ্জে কুঞ্জে, ঝিলের শান্ত-শীতল-স্বচ্ছ-সলিলে এবং তীরতরুতলে—সর্ব্বত্রই বিলাসের অট্টহাস্য ছুটিয়া চলিল। মাতামহের প্রাচীন প্রাসাদে যে শক্তি গুহানিবদ্ধ নিঝরিণীর মত ধীরে ধীরে গোপনে গোপনে বহিয়া চলিত, হীরাঝিলে আসিয়া সেই শক্তি সমতলক্ষেত্রবাহিনী কালনাদিনী তরঙ্গমালিনী স্রোতস্বিনীর মত কালসমুদ্রের দিকে ছুটিয়া চলিল;—কে আর তাহার গতিরোধ করিবে? মাতামহ স্বাধীনতা দিয়াছেন, স্বহস্তে প্রমোদশালা গড়িয়া তুলিয়াছেন, প্রয়োজনানুরূপ বৃত্তি নির্দ্দেশ করিয়া ভোগবিলাসের পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন; সুতরাং দৌহিত্রের বিলাস-স্রোত প্রবল বেগেই ছুটিয়া চলিল! হায়, সিরাজদ্দৌলা! এই বিলাস-স্রোতই যে সময়ে ধন, মান, জীবন এবং সিংহাসন পর্য্যন্তও ভাসাইয়া লইবে, তাহা জানিলে তোমার জীবন বুঝি হীরাঝিলের। বর্ত্তমান ইতিহাসকে এত বিষাদপূর্ণ করিতে পারিত না!
নিত্য নূতন কুসঙ্গী জুটিতে লাগিল, নিত্য নূতন পাপের উৎস খণিত হইতে আরম্ভ করিল। অবশেষে সিরাজদ্দৌলা বুঝিলেন যে, নবার-দত্ত নির্দ্দিষ্ট মাসিকবৃত্তিতে আর ইচ্ছানুরূপ পাপলিপ্সা চরিতার্থ করা অসম্ভব। চতুর সিরাজ কৌশলক্রমে অর্থসংগ্রহ করিবার জন্য এক নূতন উপায় উদ্ভাবন করিলেন। মাতামহকে পাত্রমিত্র লইয়া হীরাঝিলের নুতন প্রাসাদে পদধূলি দিবার জন্য সসম্ভ্রমে সাদর নিমন্ত্রন করিয়া পাঠাইলেন;—আলিবর্দ্দী আল্লাদে আটখানা হইয়া পড়িলেন।
এই সময়ে মুর্শিদাবাদের নবাব-দরবারে অনেক রাজা মহারাজা উপস্থিত থাকিতেন; আলিবর্দ্দী সকলকে সঙ্গে লইয়া মহাসমারোহে হীরাঝিলে শুভাগমন করিলেন। অভ্যর্থনার ক্রটি নাই, সাদর সম্ভা- ষণের বিরাম নাই—কেহ লতানিকুঞ্জে, কেহ শীতল শিলাখণ্ডে, কেহ বা সোপানশ্রেণীতে যথেচ্ছ বিশ্রামলাভ করিয়া,কখন গঠন-সৌষ্ঠবের প্রশংসায়, কখন সেকালের কারুকার্য্যের সহিত একালের শিল্পীদিগের ঝুটা কাজের সমালোচনায়, কখন বা সঙ্গীদিগের সঙ্গে কথাকৌতুকে সকলে মিলিয়া নবাবের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। নবাব একাকী প্রাসাদ-পরিদর্শনে গিয়াছেন, পরিদর্শন শেষ হইলেই বিস্তৃত কক্ষে দরবার বসিবে। কিন্তু যতই বিলম্ব হইতে লাগিল, ততই সকলে - অধীর হইয়া উঠিতে লাগিলেন। নবাব কোথায়, এতক্ষণেও পরি- দর্শন শেষ হইতেছে না কেন, নয়নে নয়নে সকলেই পরস্পরকে এই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিলেন।
এদিকে সিরাজদ্দৌলা নবাবকে একাকী প্রাসাদ-পত্মিদর্শনে আহ্বান করিয়া কক্ষে কক্ষে ভ্রমণ করিতে করিতে কৌশলক্রমে একটি কক্ষে বন্দী করিয়া ফেলিয়াছেন। বৃদ্ধ মাতামহ যতই দ্বার হইতে দ্বারান্তরে যাইতেছেন, ততই রুদ্ধদ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া দৌহিত্র উচ্চ করতালি দিয়া অট্টহাস্যে হৰ্মতল প্রতিশব্দিত করিয়া তুলিতেছেন। কিছুক্ষণ এ কৌতুকে নবাব বড়ই আমোদ অনুভব করিলেন; কিন্তু শেষে যখন একটি দ্বার খুলিল না, তখন বাহিরে আসিবার জন্য সিরাজকে দ্বার খুলিয়া দিতে অনুরোধ করিলেন। বালক-বুদ্ধির নিকট প্রবীণ নবাব পরাজিত হইয়া কৌশল-সংগ্রামে বন্দী হইয়াছেন,—সমুচিত অর্থদণ্ড না পাইলে বিজয়ী সিরাজদ্দৌলা তাঁহার বন্ধন-মোচন করিবেন না! নবাব কত বুঝাইলেন, প্রচুর অর্থদানের অঙ্গীকার করিলেন; চতুর সিরাজ সময় বুঝিয়া বলিতে লাগিলেন—যুদ্ধশাস্ত্রে নগদ অর্থই একমাত্র মুক্তিপত্র, রাজা বাদশাহের মুখের কথায় বিশ্বাস কি? নবাব নিরুপায় হইয়া সমবেত রাজা মহারাজার কথা উল্লেখ করিয়া বলিতে লাগিলেন—যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এ কথা বাহিরে প্রকাশিত হইলে, সকলে বড়ই উপহাস করিবে। সিরাজ আরও সুযোগ পাইয়া বলিলেন-বৃদ্ধ নবাবের পককেশ রাজা মহারাজাদিগের নিকট যদি এতই মূল্যবান বস্তু, তবে তাঁহারই কেন অর্থদানে নবাবের বন্ধনমোচন করুন না?[৩]
নবাব হারিলেন; রাজা মহারাজা সকলে এই সংবাদ শুনিয়া চিন্তিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার সিরাজকে জানিতেন; জানিতেন যে, সিরাজ যাহা ধরিয়া বসেন, কেহই তাহা ঠেলিয়া ফেলিতে পারে না! অগত্যা’ যাঁহার কাছে যাহা ছিল, সমস্ত একত্র, করিয়া কিঞ্চিদধিক পাঁচ লক্ষ টাকা সিরাজকে দিয়া সকলে মিলিয়া নবাবের বন্ধন-মোচন করিলেন।[৪]সিরাজ এরূপ বালকোচিত পরিহাসপূর্ণ চতুরতার সঙ্গে এই কার্য্য সাধন করিয়া লইলেন যে, নবাব ক্রুদ্ধ হওয়া দূরে থাকুক, বরং বুদ্ধি কৌশলে বালকের নিকট পরাজিত হইয়া অধিকতর কৌতুক অনুভব করিয়াই রাজধানীতে প্রত্যাগমন করিলেন।
সিরাজের বুদ্ধিকৌশলের সঙ্গে অর্থবল মিলিত হইয়া নিত্য নূতন উৎসবের সৃষ্টি হইতে লাগিল। সে উৎসবে নৃত্যগীত, সুরা এবং সুরা- সহচরীদিগের প্রাধান্য বাড়িতে লাগিল। অবশেষে গৃহস্থের সুন্দরী ললনার অবগুণ্ঠন ভেদ করিয়াও সিরাজের অনুচরদিগের সূক্ষ্ম দৃষ্টি ধাবিত হইল! অর্থবলে, ছলকৌশলে, প্রলোভনে অনেক গৃহস্থকন্যার সর্ব্বস্বধন লুণ্ঠিত হইল। বাঙ্গালী যাহার জন্য সিরাজদ্দৌলার নাম শুনিলেই শিহরিয়া উঠে, সে এই মহাপাপ;—এই মহাপাপের কথা দিন দিনই চারিদিকে প্রচারিত হইয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু “বৰ্গীর হাঙ্গামার” নিত্য নূতন উপপ্লবে বিপর্যস্ত হইয়া বৃদ্ধ নবাব ইহার গতি- রোধ করিবার কোনই আয়োজন করিতে পারিলেন না। দিন যাইতে লাগিল,—কিন্তু দিন দিনই বিলাস স্রোত খরবেগ ধারণ করিতে লাগিল।
- ↑ Stewart's History of Bengal.
- ↑ হীরাবিলের স্থান নির্ণয় করিতে গিয়া পাদরী লং, হাণ্টার এবং আরও অনেকে গোলযোগ করিয়া গিয়াছেন। হীরারিলেই যে সিরাজের প্রমোদভবন এবং উত্তরকালে সিংহাসন স্থাপিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। হীরাঝিল ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে; মেজর রেণেল তাহার স্থান-নির্ণয় করিয়া গিয়াছেন।
- ↑ Grant's Analysis of Finances of Bengal.
- ↑ এই উপলক্ষে সিরাজদ্দৌলা নগদ ৫০১৫৯৭ টাকা পাইয়াছিলেন। কালক্রমে তাঁহাই “নজরাণ মনসুরগঞ্জ” নামে বার্ষিক বাজে জমায় পরিণত হইয়া তাঁহার স্বোপার্জ্জিত আয় বলিয়া নির্দিষ্ট হয়। ইংরাজদপ্তরের সেরেস্তাদার গ্রাণ্ট সাহেব স্বর- চিত রাজস্ববিষয়ক প্রস্তাবে এই কাহিনীর উল্লেখ করিয়া লিখিয়া গিয়াছেন যে, নবাব আলিবর্দ্দী দৌহিত্রের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াই বাজে জমা বার করিবার জন্য এইরূপ কৌশলজাল বিস্তার করিয়াছিলেন। ইহা কিন্তু গ্রাণ্ট সাহেবের অনুমানমাত্র,—" ইহার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ বর্তমান নাই।