সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/ফরাসির সর্ব্বনাশ!

চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ।

ফরাসির সর্ব্বনাশ!

 ফরাসিদিগের দুর্দ্দশার একশেষ হইল! তাঁহারা ইংরাজের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া পথের ফকিরের মত নদীতীরে আসিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু সেখানেও তিষ্ঠিতে পারিলেন না! ইংরাজেরা দুর্গাধিকার করিয়াই পরিতৃপ্ত হইলেন না;—ফরাসিদিগকে ধনে বংশে বিনাশ করিবার জন্য পলায়িতের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। ভাগীরথীবক্ষে তীরবেগে ইংরাজতরণী ছুটিয়া চলিল; ফরাসিরা অনন্যোপায় হইয়া, বনজঙ্গল ভাঙ্গিয়া, প্রাণ লইয়া মুর্শিদাবাদে উপনীত হইলেন! ইংরাজেরা শত্রুসেনার সন্ধান না পাইয়া, নিরীহ প্রজাপুঞ্জের শস্যক্ষেত্র পদদলিত করিতে করিতে, গ্রাম নগর উৎসন্ন করিতে করিতে, হুগলী বর্দ্ধমান এবং নদীয়ার বিস্তীর্ণ জনপদ বিপর্য্যস্ত করিয়া তুলিলেন!

 মুর্শিদাবাদের লোকে ফরাসিদিগের মলিন মুখের দিকে চাহিয়া অশ্রুসম্বরণ করিতে পারিল না! সিরাজদ্দৌলা দেশের রাজা; সুতরাং ফরাসিরা তাঁহারই শরণাগত হইল। তিনি ফরাসিদিগের কাতরক্রন্দন উপেক্ষা করিতে পারিলেন না; অন্নবন্ত্রের ব্যবস্থা করিয়া তাহাদিগকে কাশিমবাজারে আশ্রয় দান করিতে বাধ্য হইলেন।

 বৃটিশবণিক বিজয়োন্মত্ত-হৃদয়ে গর্জ্জন করিয়া উঠিলেন। এত স্পর্ধা! এত সাহস! তাঁহারা যাহাদিগকে ধনে বংশে বিনাশ করিবার জন্য চন্দননগর কাড়িয়া লইলেন, সিরাজদ্দৌলা তাহাদিগকেই স্নেহক্রোড়ে আশ্রয়দান করিলেন? সিরাজদ্দৌলা এ দেশের রাজা, আর্ত্তত্রাণ তাঁহার পরম পবিত্র রাজধর্ম্ম,—সে কথা কেহ বিচার করিয়া দেখিলেন না। ইংরাজ মাত্রেই সিরাজদ্দৌলার উপর খড়্গহস্ত হইয়া উঠিলেন।

 ইংরাজেরা জানিতেন যে, চন্দননগরের অল্পসংখ্যক ফরাসিসেনা সমূলে বিনষ্ট করা খুব সহজ কথা; কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ ফরাসিজাতি যখন প্রতিশোধ লইবার জন্য সসৈন্যে অগ্রসর হইবে, তাহার গতিরোধ করা সেরূপ সহজ হইবে না! তাঁহারা সেইজন্য সিরাজদ্দৌলার সহায়তায় ফরাসিদিগকে নির্ম্মূল করিতে ব্যাকুল হইয়াছিলেন। যদি সিরাজদ্দৌলা সহায়তা করেন তবে ইংরাজ-বাঙ্গালীর সমবেত-শক্তির নিকট ফরাসিকে অবশ্যই নতশির হইতে হইবে। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা ফরাসিদিগকে আশ্রয় দান করায় ইংরাজের সে আশা নির্ম্মূল হইল! তখন তাঁহারা নানা উপায়ে সিরাজদ্দৌলার মতপরিবর্ত্তনের আয়োজন করিতে লাগিলেন।

 ইংরাজ এবং ফরাসি উভয়ের চিরশত্রু। তাঁহারা দুই জনেই ভারতবাণিজ্যে একাধিপত্য বিস্তার করিবার জন্য লালায়িত। সিরাজদ্দৌলা জানিতেন যে, ফরাসিদিগকে নির্ম্মূল করিবার অবসর দান করা, আর ইংরাজের নিকট আত্মবিক্রয় করা এক কথা। তিনি সেইজন্য ফরাসিদিগকে রক্ষা করিতে সমুৎসুক। ইংরাজেরাও ইহা জানিতেন;—সুতরাং তাঁহারা বড়ই ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।

 সিরাজদ্দৌলাকে স্বপক্ষে টানিয়া আনিবার জন্য চন্দননগর ধ্বংস করিবামাত্র সেনাপতি ওয়াট্‌সন্ লিখিয়া পাঠাইলেন:—

 “আমি যে গুরুতর কার্য্যের জন্য এখানে (চন্দননগরে) আসিয়াছি, তাহাতেই ব্যস্ত ছিলাম বলিয়া আপনার কয়েকখানি পত্র পাইয়াও যথাসমরে উত্তর দিতে পারি নাই।—তজ্জন্য ত্রুটি গ্রহণ করিবেন না। আমাদের সৌভাগ্যবলে, আপনার সৌহার্দ্দ সহায়তায় এবং ঈশ্বরের মঙ্গলময় ইচ্ছায়, দুই ঘণ্টামাত্র যুদ্ধ করিয়াই ২৩শে মার্চ্চ তারিখে চন্দননগর অধিকার করিয়া লইয়াছি। ফরাসিরা অনেকেই বন্দী হইয়াছে, যে কয়েকজন পলায়ন করিয়াছে, তাহাদিগকেও ধরিয়া আনিবার জন্য অস্ত্রধারী নিযুক্ত করিয়াছি;—তাহারা আর কাহারও উপর কোনরূপ উপদ্রব করিবে না, সুতরাং আপনি তজ্জন্য অসন্তুষ্ট হইবেন না! আমরা যে সন্ধিপালন করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করিব না, সে কথা পুনঃ পুনঃ নিবেদন করিয়াছি। আপনার শত্রু যখন আমাদিগেরও শত্রু, তখন আমাদিগের শত্রুও অবশ্যই আপনার শত্রু বলিয়া পরিগণিত হইবে। সুতরাং ফরাসিরা যদি আপনার নিকট উপস্থিত হয়, আপনি অবশ্যই তাহাদিগকে বাঁধিয়া পাঠাইয়া দিবেন। আপনি লিখিয়াছেন যে, ড্রেক সাহেব মহারাজ মাণিকচাঁঁদকে অসম্মানসূচক কথা বলিয়াছিলেন; আমি সে কথা শুনিবামাত্র ড্রেক সাহেবকে যথোচিত লিখিয়াছি, এবং তিনিও মাণিকাচাঁঁদের নিকট যথারীতি ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছেন। ভরসা করি আপনি সন্তুষ্ট হইয়াছেন। আমরা কি আপনাকে অসন্তুষ্ট করিতে পারি? আমাদের নিকট সেরূপ ব্যবহার পাইবেন না?[]

 ওয়াট্‌সন্ যে উদ্দেশ্যে এই পত্র লিখিলেন, সে উদ্দেশ্য সফল হইল না; সিরাজদ্দৌলা শরণাগত ফরাসিদিগকে বাঁধিয়া পাঠাইতে সম্মত হইলেন না! ওয়াট্‌সন্ নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া ভয় প্রদর্শনে কৃতকার্য্য হইবার জন্য পুনরায় পত্র লিখিলেন:—

 “আমরা যে চন্দননগর অধিকার করিয়া অধিকাংশ ফরাসিদিগকে বন্দী করিয়াছি এবং পলায়িতের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য ফৌজ পাঠাইয়াছি, সে কথা ইতিপূর্ব্বেই লিখিয়াছি; আবার যে সে বিষয়ে লিখিতে হইতেছে উহা বড়ই আক্ষেপের কথা! পরমেশ্বর এবং মহম্মদের পবিত্র নামে অপনি যে ধর্ম্ম প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন তাহা প্রতিপালন করিতেছেন না বলিয়াই আমাকে পুনঃ পুনঃ পত্র লিখিতে হইতেছে! কোম্পানির যে সকল কামান আপনার অধিকার রহিয়াছে,[] তাহা ওয়াট্‌স্ সাহেবকে প্রত্যর্পণ করিবেন, বন্ধুভাবে থাকিবার জনাই যে সন্ধিসংস্থাপন করিয়াছেন সে কথা কদাচ বিস্মৃত হইবেন না, এবং পলায়িত ফরাসিদিগকে অবিলম্বে বাঁধিয়া পাঠাইয়া দিবেন। যদি কোন ব্যক্তি ইহার বিপরীতাচরণ করিবার জন্য পরামর্শ দেয়, তবে নিশ্চয় জানিবেন যে সে কদাচ আপনার বন্ধু নহে। সে উপদেশে দেশের মধ্যে যুদ্ধানল জ্বলিয়া উঠিবে;— কিন্তু আপনি সত্যভঙ্গ না করিলে আমরা কিছুতেই যুদ্ধঘোষণা করিব না। এই মাত্র সংবাদ পাইলাম যে, ফরাসিরা পলায়ন করিয়া আপনার নিকট উপনীত হইয়াছে এবং আপনার সেনাদলে নিযুক্ত হইবার জন্য আবেদন করিয়াছে। আপনি তাহাতে সম্মত হইলে আমাদের সঙ্গে আর বন্ধুভাব থাকিবে না। আপনি সে দিনও আমাদের নিকট সেনা সাহায্য চাহিয়াছিলেন, তাহার পরেই লিখিয়াছেন যে আর চাহেন না; ইহাতে বুঝিতেছি যে ফরাসির সঙ্গে মিত্রতা সংস্থাপন করাই বোধ হয় আপনার অভিমত!’[]

 আলিনগরের সন্ধির পরিণাম যে এরূপ শোচনীয় হইবে, তাহা সিরাজদ্দৌলা স্বপ্নেও অনুমান করেন নাই। ক্রমে ইংরাজের গূঢ়নীতির মর্ম্মালোচনা করিয়া সিরাজদ্দৌলা অবসন্ন হইয়া পড়িতে লাগিলেন।[] তিনি আর ওয়াট সনের পত্রের কোনরূপ প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন না; কেবল নীরবে সতর্ক দৃষ্টিতে ইংরাজের সংকল্পনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন।

 মহানগরীর রাজপথে ভ্রমণ করিবার সময়ে সুচতুর দস্যুতস্কর হাতের উপর হইতে টাকা ছিনাইয়া লইয়া পলায়ন করিলে পথিক যেমন “চোর চোর” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠে, তস্করও তদ্রুপ “চোর চোর” বলিয়া কোলাহল করিতে থাকে। সেই জন্য কে সাধু কে চোর তাহার মীমাংসা করা সহজ হয় না। সিরাজদ্দৌলার অবস্থাও সেইরূপ হইল;—আলিনগরের সন্ধিভঙ্গ হইল, কিন্তু কাহার দোষে সন্ধিভঙ্গ হইল, সে কথার মীমাংসা হইতে পারিল না!

 এদিকে ইংরাজদরবারে হুলস্থূল পড়িয়া গেল! ওয়াট্‌সন্ সাদরসম্ভাষণে পত্র লিখিলেন, তাঁহার উত্তর আসিল না; সুর চড়াইয়া তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া পত্র লিখিলেন, তাহারও উত্তর আসিল না! তখন ইংরাজেরা বুঝিতে পারিলেন যে, ফরাসিদিগকে আশ্রয়দান করাই ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য। ইহাতে ইংরাজেরা শিহরিয়া উঠিলেন; ওয়াট সন্ স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন যে, ফরাসিদিগকে গৃহতাড়িত না করিলে ইংরাজের কল্যাণ হইবে না। তখন নানা উপায়ে নবাব এবং ফরাসিদিগের অভিনব সৌহার্দ্দ ভাঙ্গিয়া দিবার চেষ্টা চলিতে লাগিল। ওয়াট্‌সন্ স্তুতি মিনতি করিয়া লিখিয়া পাঠাইলেন:—

 “চন্দননগরের নিকটে আমাদের কয়েকখানি যুদ্ধজাহাজ বাঁধা রহিয়াছে, এবং হুগলির নিকটে কয়েক পল্টন গোরা ছাউনী ফেলিয়াছে, এই জন্য আপনি নাকি বড়ই অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। এই সুযোগে আমাদের শত্রুদল নাকি আপনাকে বুঝাইয়া দিয়াছে যে, আমরা সসৈন্যে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করিবার জন্যই এই সকল অয়োজন করিতেছি! কেহ যে এমন ভয়ানক মিথ্যা কথা বলিয়া আপনাকে প্রতারিত করিতে সাহস পাইয়াছে, ইহাই সমধিক বিস্ময়ের ব্যাপার! আপনি যে এমন অলীক সংবাদও সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছেন, তাহা আরও বিস্ময়ের ব্যাপার! আপনিও ত একজন বীরপুরুষ;—আপনি কি বুঝেন না যে, আপনার রাজ্যমধ্যে একজন শত্রুসেনা লুকাইয়া থাকা পর্য্যন্ত তাহার পশ্চাদ্ধাবন না করা আমার পক্ষে কতদুর মতিভ্রমের কথা? সে যাহা হউক, আপনি যদি ফরাসীদিগকে বাঁধিয়া পাঠাইয়া দেন তাহা হইলেই ত সকল বিতর্কের অবসান হইতে পারে, এবং আমরাও সসৈন্যে ফিরিয়া যাইতে পারি। যতক্ষণ ইহা না করিতেছেন ততক্ষণ কেমন করিয়া বলিব যে আপনি ____ রক্ষা করিবেন?[]

 ওয়াট্‌সন্‌ যে কেবল রণপণ্ডিত তাহাই নহে,—সেকালের ইংরাজদিগের মধ্যে তাঁহার মত সুচতুর রাজনীতিবিশারদ সুলেখকও অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়! তিনি যখন অবলীলাক্রমে সিরাজদ্দৌলাকে লিখিতেছেন যে, মুর্শিদাবাদ আক্রমণের প্রস্তাব সর্ব্বৈব মিথ্যা, ঠিক সেই সময়ের কথা উল্লেখ করিয়া লর্ড ক্লাইব মহাসভার সম্মুখে মুক্তকণ্ঠে সাক্ষ্য দিয়া গিয়াছেন যে, “চন্দননগর হস্তগত করিবামাত্র তিনি সকলকে বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে, সেই পর্য্যন্ত আসিয়াই নিরস্ত হইলে চলিবে না; যখন নবাবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চন্দননগর অধিকার করা হইল, তখন আরও কিয়দ্দুর অগ্রসর হইয়া সিরাজদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করা হউক।”[] ক্লাইব বলিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহার এই সাধুসংকল্পে সকলেই সম্মতিদান করিয়াছিলেন! সুতরাং সিরাজদ্দৌলা যে অঙ্কুরেই ইংরাজের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়াছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই।[] কিন্তু দশজনে মিলিয়া তাঁহার মতিভ্রম জন্মাইবার জন্য নানারূপ আয়োজন করিয়া তাঁহাকে বুঝাইয়া দিল যে, ফরাসিরাই যত অনিষ্টের মূল—তাহাদিগকে রাজধানীতে আশ্রয়দান করিয়াছেন বলিয়া ইংরাজের সঙ্গে সন্ধিভঙ্গের উপক্রম হইয়াছে!

 সিরাজদ্দৌলা কি জন্য সন্ধি করিয়াছিলেন, ইংরাজেরা তাহার কিরূপ মর্য্যাদা রক্ষা করিতেছিলেন, এবং ফরাসিদিগকেও সিরাজদ্দৌলা কতদুর অবিশ্বাস করিতেন, তাহা তাঁহার লিখিত ২২শে মার্চ্চ দিবসীয় সামরিক লিপিতে প্রকাশিত রহিয়াছে;—সে পত্রখানি এইরূপ:—

 “আমি ধর্ম্ম প্রতিজ্ঞা করিয়া যে সকল কথা স্বহস্তে স্বাক্ষর করিয়াছি, তাহা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হইবে, কোন বিষয়ে কিছুমাত্র ত্রুটি হইবে না। ওয়াটস্ সাহেব যাহা যাহা দাবি করিয়াছে, তাহা সমস্তই পরিশোধ করিয়াছি; যৎকিঞ্চিৎ অপরিশোধিত আছে,—তাহাও বর্ত্তমান চান্দ্রমাসের প্রথম পক্ষান্তেই পরিশোধিত হইবে। বোধ হয় ওয়াটস্ সাহেব এ সকল কথা লিখিয়া পাঠাইয়াছে। আমার যাহা কর্ত্তব্য তাহা ত পালন করিতেছি; কিন্তু তোমাদের মতিগতি দেখিয়া মনে হইতেছে যে, প্রতিজ্ঞা পালন করা দূরে থাকুক, তাহা বিলীন করাই তোমাদের অভিপ্রেত। তোমাদের ফৌজের উৎপাতে হুগলী, ইঞ্জিলী, বর্দ্ধমান এবং নদীয়া প্রদেশ উৎসন্ন হইতেছে;—এ উপদ্রব কেন? বামদেবের পুত্রের দ্বারায় গোবিন্দ রাম মিত্র নন্দকুমারকে লিখিয়া পাঠাইয়াছে যে, কালীঘাট কলিকাতার জমিদাভুক্ত বলিয়া দখল পাইবার দাবি করে। এ কথার অর্থ কি? এ সকল যে তোমার জ্ঞাতসারে ঘটিতেছে তাহা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহি। তুমি সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিয়াছ বলিয়া কেবল তোমার বিশ্বাসেই আমিও সন্ধি করিতে সম্মত হইয়াছিলাম। সন্ধি না হইলে, উভয় সেনার তুমুল সংঘর্যে দেশের সর্ব্বনাশ হইত, প্রকৃতিপুঞ্জ পদদলিত হইত, রাজকর ধ্বংস হইত, রাজ্যের সমূহ অমঙ্গল হইত; তাহা নিবারণ করিবার জন্যই ত সন্ধি করিয়াছিলাম। আমাদের মধ্যে যে বন্ধুত্বের অঙ্কুরোদ্ভব হইয়াছে, তাহাকে সুদৃঢ় করাই কর্ত্তব্য। এ বিষয়ে দ্বিধা না থাকিলে এই সকল উৎপাত নিবারণ করিয়া মিত্রজকে বলিবা, সে যেন ভবিষ্যতে এমন মিথ্যা প্রবঞ্চনাময় অলীক প্রস্তাব উপস্থিত না করে।

 “পুনশ্চ। এইমাত্র শুনিলাম যে, ফরাসিরা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিবার জন্য দক্ষিণাত্য হইতে ফৌজ প্রেরণ করিয়াছে। তাহারা যদি আমার অধিকারে যুদ্ধ বিবাদ উপস্থিত করিতে চাহে, আমাকে লিখিবামাত্র আমি সিপাহী পাঠাইয়া তাহাদিগকে নিরস্ত করিতে ত্রুটি করিব না,—লিখিবামাত্র আমার সিপাহীসেনা অগ্রসর হইবে।”[]

 ওয়াট্‌সনের পত্রের সঙ্গে সিরাজদ্দৌলার পত্রগুলির তুলনায় সমালোচনা করা আবশ্যক। একজন সুশিক্ষিত পরিণামদর্শী সুচতুর বৃটিশ সেনাপতি আর একজন অপরিণতবয়স্ক ভারতব্যয় স্বাধীন নরপতি,—একজন ইতিহাসে চিরগৌরবান্বিত, আর একজন স্বদেশে বিদেশে সকলের নিকটেই চিরধিক্কৃত! কিন্তু দুইজনের কথা এবং কার্য্যের বিচার করিয়া দেখ,— কে কিরূপ সমাদর লাভ করিবার যোগ্যপাত্র! সিরাজদ্দৌলা কলঙ্কগ্রস্ত, কিন্তু কেবল রাজধর্ম্ম পালন করতে গিয়াই কি তিনি ইংরাজদিগের বিরাগভাজন হইয়াছিলেন না? ওয়াট সন্ তাঁহাকে যে সকল পাপকার্য্যে লিপ্ত হইবার জন্য বারম্বার অনুরোধ করিয়া পত্র লিখিয়াছেন, তাহাতে সম্মত হইলেই কি সিরাজচরিত্র কলঙ্কমুক্ত হইত?

 সিরাজদ্দৌলা শান্তিসংস্থাপনের জন্য ইংরাজদিগকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিয়াও আলিনগরের সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিয়াছিলেন। তাঁহার পাত্রমিত্রগণ ছিদ্রান্বেষী গৃহশত্রু; সুতরাং পুনরায় ইংরাজদিগের সঙ্গে শান্তিভঙ্গ করিতে সাহস হইল না। তিনি শান্তির জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।

 নবাব-দরবারের সুচতুর পাত্রমিত্রগণ বুঝিলেন যে, ইহাই উপযুক্ত অবসর। তাঁহারা বলিতে লাগিলেন যে, ফরাসিদিগকে কাশিমবাজারে আশ্রয়দান করার জন্যই পুনরায় শান্তিভঙ্গের সম্ভাবনা হইয়াছে, অতএব তাহাদিগকে পাটনা প্রদেশে প্রেরণ করা হউক। সিরাজদ্দৌলা এই নিঃস্বার্থ হিতবাক্যের মধ্যে কোনরূপ দুষ্টাভিসন্ধির সন্ধান পাইলেন না; তিনি ফরাসি-সেনায়ক লাস্ সাহেবকে তদনুরূপ আদেশ প্রদান করিলেন।[] লাস্ রাজধানীতে থাকিয়া অল্পদিনের মধ্যে সকল অবস্থা পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছিলেন, তিনি সিরাজদ্দৌলাকে বুঝাইয়া দিলেন যে, “তাঁহার মন্ত্রিদল ও অধিকাংশ সেনানায়কগণ ইংরাজের সঙ্গে মিলিত হইয়া তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিবার আয়োজন করিতেছে, কেবল ফরাসির ভয়ে প্রকাশ্য শত্রুতায় লিপ্ত হইতে সাহস পাইতেছে না। এমন সময়ে ফরাসিদিগকে রাজধানী হইতে বিদায় দিলেই সমরানল জ্বলিয়া উঠিবে।” সিরাজদ্দৌলা এ কথা একেবারে অস্বীকার করিতে পারিলেন না; কিন্তু তিনি আশু শান্তিসংস্থাপনের জন্য ব্যাকুল; সুতরাং বলিলেন যে, “আপনারা ভাগলপুর অঞ্চলেই থাকিবেন, বিদ্রোহের সূচনা বুঝিলেই সংবাদ পাঠাইব।” সেনাপতি লাস্ আর দ্বিরুক্তি করিতে পারিলেন না; কেবল বিদায় গ্রহণ করিবার সময়ে সাশ্রুনয়নে এই মাত্র বলিলেন; “এই শেষ সাক্ষাৎ,— আমাদের আর সম্মিলন হইবে না।”[১০]

  1. Ive's Journal.
  2. নবাবের তোপখানায় যে সকল বৃহদায়তন কামান প্রস্তুত হইত, সেগুলি যুদ্ধক্ষেত্রে সহসা ইতস্ততঃ পরিচালিত করা সহজ হইত না। কাশিমবাজার হইতে ইংরাজদিগের ‘ফিল্ড পিস’ নামক যে সকল ক্ষুদ্রায়তন কমান সংগৃহীত হইয়াছিল, তাহার আকার প্রকার দেখিয়া সিরাজ তদনুরূপ কামান ঢালাই করিবার জন্য তাহার ছাঁচ তুলিয়া লইয়াছিলেন। এই জন্য সন্ধি সংস্থাপন করিয়াও তৎক্ষণাৎ কামানগুলি ফেরত দিতে পারেন নাই। যাহারা সিরাজদ্দৌলাকে ইন্দ্রিয়াসক্ত অকর্মণ্য মুগ্ধ যুবক বলিয়া বুঝিয়া রাখিয়াছেন তাঁহারা দেখিবেন যে, ইংরাজেরও একথা স্বীকার করিয়া লিখিয়া গিয়াছেন:—
    It is a notorious truth, that at the capture of Cossimbazar and Fort William, the Government had store both of cannon in and field-pieces with their carriages, which they had six months in their possession. Sirajud-Dwla had 20 of the latter so well-constructed by his own people, that they could hardly be known from those made in Europe.—A Defence of Mr. Vansittart's conduct.
  3. Ive's Journal.
  4. The wrath of the Nobob at the crooked dealings and slow but steady advance of these foreigners increased daily -Tarikh-iMansuri.
  5. Ive's Journal.
  6. Clive's Evidence before the Committee of the House of Commons, 1772.
  7. The governing principle (in Sirajud Dowla) was political, and the real object of his proceedings the demolition of your forts and garrisons.—Holwell's India Tracts, p. 290.
  8. Ive's Journal.
  9. মুতক্ষরীণে এবং তারিখ-ই-মন সুরীতে ইঁহার নাম ‘মসিয় লাস্’ বলিয়া লিখিত আছে। “M, Las—In all English Histories of India known to me, his name is misspelt Mr. Law.”-Blochmann's Notes on Sirajud daula, Journal of the Asiatic Society, 1867.
  10. Serajaud Dowla felt the truth of his observation but had not the resolution to detain him; he however promised to send for him, should anything occur, but Mr. law prophetically said, “I know we shall never meet again."—Stewart's History of Bengal.