সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/গুপ্ত-মন্ত্রণা

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ।

গুপ্ত-মন্ত্রণা।

 আলিনগরের সন্ধিসংস্থাপনের সময়ে সিরাজদ্দৌলা ইংরাজ-সেনাপতি ওয়ান্ সাহেবকে লিখিয়াছিলেন “যুদ্ধ কলহের মধ্যে সিপাহীদিগের লুট তরাজের গতিরোধ করা কত কঠিন, তাহা তোমার অজ্ঞাত নাই। তথাপি তোমরা যদি কিছু কিঞ্চিৎ ত্যাগ স্বীকার কর, তাহা হইলে ক্ষতিপূরণ করিবার অন্য আমিও কিছু কিঞ্চিৎ ত্যাগ স্বীকার করিতে চেষ্টা করিব।”[১] এই প্রতিশ্রুতি পালন করিবার জন্য সিরাজদ্দৌলাকে যথেষ্ট ত্যাগস্বীকার করিতে হইয়াছিল। যখন সকল গোলযোগ শেষ হইয়া গেল, তখন সিরাজদ্দৌলা সেনাপতিদিগের কৃতকার্য্যের বিচার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। সে বিচারে মহারাজ মাণিকচাঁদের কীর্ত্তিকলাপ ক্রমশঃ প্রকাশিত হইয়া পড়িল,— তিনিই যে কলিকাতার রক্ষক হইয়া ভক্ষক হইয়াছিলেন, সে কথা বুঝিতে আর ইতস্ততঃ রহিল না! সিরাজদ্দৌলা অপরাধীর সমুচিত দণ্ডদান করিলেন,—মাণিকচাঁদ কারারুদ্ধ হইলেন! সেকালে উচ্চপদস্থ রাজ-কর্ম্মচারিগণ যাহা ইচ্ছা তাহাই করিয়া পদগৌরবে পরিত্রাণলাভ করিতেন, তাঁহাদের কৃতকার্য্যের কোনরূপ বিচার হইত না। সুতরাং মাণিকচাঁদের কারাদণ্ডে অনেকেই শিহরিয়া উঠিলেন।

 অনেক কাকুতি মিনতির পর দশ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বহন করিয়া মাণিকচাঁদ মুক্তিলাভ করিলেন;[২] কিন্তু ইহাতেই প্রধূমিত বিদ্রোহবহ্নি ধীরে ধীরে জ্বলিয়া উঠিবার উপক্রম হইল। রায় দুর্ল্লভ, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মীরজাফর,—সকলেই ভাবিলেন যে, মাণিক উপলক্ষ মাত্র, অতঃপর সকলকেই একেএকে উৎপীড়ন করিয়া সিরাজদ্দৌলা ইচ্ছানুরূপ অর্থশোষণ করিবেন। সুতরাং স্বার্থরক্ষার জন্য জগৎশেঠের মন্ত্রভবন পুনরায় নৈশসম্মিলনের সঙ্কেতস্থান হইয়া উঠিল।

 যাঁহারা গুপ্তমন্ত্রনায় মিলিত হইতে লাগিলেন, তাঁহারা কেহই দেশের জন্য বা দশের জন্য চিন্তা করিতেন না;—জৈন জগৎশেঠ, মুসলমান মীরজাফর, বৈদ্য রাজবল্লভ, কায়স্থ দুর্ল্লভরাম, সুদখোর উমিচাঁদ, প্রতিহিংসাতাড়িত মাণিকচাঁদ,—ইঁহাদের কাহারও সহিত কাহারও শোণিতসংস্রব বা স্নেহবন্ধন ছিল না; কেবল স্বার্থরক্ষার জন্যই একে অপরের পৃষ্ঠরক্ষার্থ দলবদ্ধ হইয়াছিলেন। যাঁহাদের সহিত অগণিত প্রকৃতিপুঞ্জের সুখ দুঃখের চিরসংস্রব, তাঁহাদের মধ্যে কেবল কৃষ্ণনগরাধিপতি মহারাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র ভূপ বাহাদুর এই গুপ্ত মন্ত্রণায় যোগদান করিবার কথা শুনিতে পাওয়া যায়; কিন্তু ইহাও শুনিতে পাওয়া যায় যে, অর্দ্ধবঙ্গাধিকারিণী প্রতিভাশালিনী রাণী ভবানী কৃষ্ণনগরাধিপতির কাপুরুষত্বের পরিচয় পাইয়া সঙ্কেতে সদুপদেশ দিবার জন্য “শাঁখা সিন্দুর” উপহার পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। যাঁহারা স্বার্থের চরণতলে দয়া, ধর্ম্ম, কর্ত্তব্যবুদ্ধি, রাজভক্তি বলিদান দিয়া সিরাজদ্দৌলার সর্ব্বনাশ সাধনে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন,—যাঁহারা স্বদেশের কল্যাণের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া কেবল আত্মকল্যাণের জন্যই শওকতজঙ্গের ন্যায় পরম সুপাত্রকেও সিংহাসনে বসাইবার আয়োজন করিয়াছিলেন,—তাঁহারা বীররমণীর ভর্ৎসনাবাক্যে কর্ণপাত না করিয়া, ইংরাজসাহায্যে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসাইবার জন্য চক্রান্তজাল বিস্তার আরম্ভ করিলেন!

 আত্মশক্তির উপর স্বাভাবিক বিশ্বাস বড়ই প্রবল;—রাজসিংহাসন যে এক ফুৎকারে উড়িয়া যাইতে পারে, স্বাধীন নরপতিগণ তাহা সহজে স্বীকার করিতে চাহেন না। সিপাহীযুদ্ধের বহুপূর্ব্বে বিদ্রোহের আভাস পাইয়াও কোম্পানী বাহাদুরের মতিভ্রম ঘটিয়াছিল; সিরাজদ্দৌলারও মতিভ্রম ঘটিল। তিনি ভাবিলেন, ফরাসিরাই বুঝি সকল গোলযোগের মূল, তাহাদিগকে দূর করিয়া দিলেই ইংরাজ শান্ত হইবে, এবং ইংরাজ শান্ত হইলেই পাত্রমিত্রগণ গুপ্তমন্ত্রণা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইবে। এই সময়ে ওয়াট্‌সন্ লিখিয়া পাঠাইলেন,—“চিরস্থায়ী শান্তিসংস্থাপনের ইহাই সুসময়, এসময় চলিয়া গেলে আর ফিরিয়া আসিবে না।”[৩] সুতরাং স্বদেশের কল্যাণকামনায় সিরাজদ্দৌলা শান্তিসংস্থাপনের জন্য ব্যাকুল হইলেন; তিনি ফরাসিদিগকে বিদায় দান করিয়া, ওয়াট্‌সন কে লিখিয়া পাঠাইলেন:—“স্বার্থান্ধ লোকের উত্তেজনায় ভুলিও না; সন্ধিভঙ্গ করাই তাহাদের উদ্দেশ্য! যদি কলহ বিবাদ বৃদ্ধি করিবার প্রবৃত্তি না থাকে তবে আর আমাকে সন্ধির বিরোধী প্রস্তাব লিখিও না। বরং লিখিবার পূর্ব্বে সন্ধিপত্রখানি আর একবার পাঠ করিয়া দেখিও।”[৪]

 ফরাসিদিগকে পথিমধ্যে ধ্বংস করিবার জন্য ইংরাজেরা পল্টন পাঠাইবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। সিরাজদ্দৌলা আর ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিলেন না। তিনি তৎক্ষণাৎ ইংরাজের উকীলকে দরবার হইতে বাহির করিয়া দিয়া, ওয়াটস্ সাহেবকে বলিয়া পাঠাইলেন:—“হয় এখনই মুচলিকা লিখিয়া দিয়া ফরাসির পশ্চাদ্ধাবনাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ কর,—না হয়, এই মুহূর্ত্তেই রাজধানী হইতে দূর হইয়া যাও![৫] এ সংবাদে ক্লাইব ক্ষিপ্রহস্তে বাণিজ্যের তরণী সাজাইতে আরম্ভ করিলেন;—ভিতরে গোলা বারুদ,উপরে ধানের বস্তা, তাহার উপর ‘চড়ন্দার’ চল্লিশ জন সুশিক্ষিত সৈনিকপুরুষ,— এইরূপ সুকৌশলপূর্ণ ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকোষ’ ইংরাজ সওদাগরের বাণিজ্যভাণ্ডার বহন করিয়া মুরশিদাবাদাভিমুখে ছুটিয়া চলিল। কাশিমবাজারে যাহা কিছু ধনরত্ন সঞ্চিত থাকে, তাহা অবিলম্বে কলিকাতায় পাঠাইবার জন্য ওয়ট্‌স্‌কে গোপনে পত্র লিখিতেও ত্রুটি হইল না![৬]

 অতঃপর সেনাপতি ওয়াট্‌সন্‌ যে পত্র লিখিলেন, তাহাই তাঁহার শেষ পত্র; তাহাতে স্পষ্টাক্ষরে লিখিত হইল:—“একজনমাত্র ফরাসী জীবিত থাকিতেও ইংরাজ নিবৃত্ত হইবেন না। তাঁহারা শীঘ্রই কাশিমবাজারে সেনা পাঠাইতেছেন, কাশিমবাজার সুরক্ষিত হইলে, ফরাসিদিগকে বাঁধিয়া আনিবার জন্য পাটনা অঞ্চলে আরও দুই সহস্র ফৌজ প্রেরিত হইবে;—এ সকল কার্য্যে নবাবকে ইংরাজের সহায়তা করিতে হইবে।” এই পত্রে আত্মচরিত্রের গৌরব বৃদ্ধির জন্য ওয়াট্‌সন্ ইহাও লিখিলেন যে,—“কেবল শান্তির জন্যই তাঁহার যাহা কিছু ব্যাকুলতা, ধনাকাঙ্ক্ষা তাঁহার হৃদয়ে স্থানলাভ করিতে পারে না, তিনি তাহা সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করেন!!”[৭] সিরাজদ্দৌলা বুঝিলেন যে, আবার যুদ্ধ বাধিল; তিনিও সাধ্যমত আত্মরক্ষার আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন।

 ফরাসি-নিপাতে সহায়তা করিলে সিরাজদ্দৌলাকে এ সকল বিড়ম্বনা ভোগ করিতে হইত না; কিন্তু পদাশ্রিত শরণাগত দুর্ব্বল ফরাসিদলের সর্ব্বনাশসাধন করিতে সিরাজদ্দৌলার সাহস হইল না। একশত ফরাসিসেনার প্রাণরক্ষার জন্য শত সহস্র লোকের সুখ দুঃখের কথা বিস্মৃত হইয়া, রাজসিংহাসন এবং আত্মজীবনের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া, তিনি কুক্ষণে ইংরাজ সেনাপতিকে উপেক্ষা করিলেন। ইহার জন্য স্বাধীনতা গেল, সিংহাসন গেল, জীবন গেল,অবশেষে তাঁহার স্মৃতি পর্য্যন্তও কলঙ্কিত হইয়া রহিল!!

 পলাসির যুদ্ধবসানে কর্ণেল ক্লাইব বিলাতের কর্তৃপক্ষদিগের নিকট আত্মকার্য্য সমর্থন করিবার জন্য ফরাসীদিগের নিকট প্রেরিত সিরাজদ্দৌলার পত্রের কথা লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন।[৮]

 এই পত্র গুলি আলিনগরের সন্ধির অব্যবহিত পরের তারিখের এবং ইহা হইতে মনে হয় যে, সিরাজদ্দৌলা প্রকাশ্যে ইংরাজদিগের সঙ্গে সন্ধি করিয়া গোপনে ফরাসিদিগের সহায়তা করিতেছিলেন।[৯]

 এই পত্রগুলি উপলক্ষ করিয়া অনেকে সিরাজদ্দৌলাকে “বিশ্বাসঘাতক” বলিয়া ভর্ৎসনা করিয়া গিয়াছেন, এবং কেহ কেহ ইহাও রটনা করিয়া গিয়াছেন যে, গুপ্তচর-সাহায্যে মূল পত্রগুলিই ইংরাজদিগের হস্তগত হইয়াছিল। কিন্তু ক্লইব লিখিয়া গিয়াছেন যে, তিনি ওয়াট্‌স সাহেবের যোগে এই পত্র গুলির নকলমাত্র প্রাপ্ত হন। ক্রাফ্‌টন বলেন যে, যখন সিরাজদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য যড়যন্ত্র চলিতেছিল, সেই সময়ে তিনি এই পত্রগুলির সন্ধান পাইয়া ছিলেন।[১০] এই পত্রগুলি যে চক্রান্তকারীদিগের স্বকপোলকল্পিত নহে, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হইবার উপায় নাই। ইংরাজদিগকে স্বপক্ষে টানিয়া আনিবার জন্যই যে এগুলি রচিত হয় নাই, তাহাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সিরাজদ্দৌলার মীরমুন্সী এই সকল পত্রের নকল বাহির করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু এই মীরমুন্সী যে তৎকালে উৎকোচলোভ ইংরাজদিগের পক্ষ সমর্থন করিয়া সর্ব্ব প্রযত্নে ওয়াট্‌স্ সাহেবের সহায়তা করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই।[১১]

 ইয়ার লতিফ খাঁ দুই সহস্র অশ্বসেনার অধিনায়ক। তিনি সিরাজদ্দৌলার সেনাপতি কিন্তু জগৎশেঠের অন্নদাস![১২] এই মুসলমান সেনাপতি ২৩শে এপ্রিল তারিখে ওয়াট্‌স্ সাহেবের সহিত গুপ্ত-সন্দর্শন প্রার্থনা করিলেন। সাহেবের সাহসে কুলাইল না, তিনি সুচতুর উমিচাঁদকে পাঠাইয়া দিলেন।[১৩] তদনুসারে, ইয়ার লতিফ এবং উমিচাঁদের যোগে ইংরাজের নিকট বাঙ্গালীর রাজবিদ্রোহের প্রথম প্রস্তাব উপনীত হইল। স্বার্থসাধনের প্রলোভনে, হিন্দু, মুসলমান এবং খৃষ্টীয়ান, জাতিধর্ম্মের চিরবিচ্ছেদ বিস্মৃত হইয়া একাত্মা হইয়া উঠিলেন।[১৪]

 লতিফ বলিলেন, “সিরাজদ্দৌলা শীঘ্রই পাটনা প্রদেশে যুদ্ধযাত্রা করিবেন, কেবল সেই জন্য আপাততঃ ইংরাজদিগকে কিছু বলিতেছেন না;—কিন্তু রাজধানীতে প্রত্যাগমন করিলে আর ইংরাজের রক্ষা থাকিবে না! দেশের গণ্যমান্য সকল লোকেই সিরাজদ্দৌলাকে প্রাণের সহিত ঘৃণা করিয়া থাকেন। তিনি পাটনা যাত্রা করিলে, সেই অবসরে ইংরাজেরা যদি মুর্শিদাবাদ অধিকার করিতে পারেন, তাহা হইলে সহজেই কার্য্যোদ্ধার হইবে। আমাকে সিংহাসন দান করিলে, ইংরাজেরা যাহা চাহেন আমি তাহাই অম্লানবদনে প্রদান করিতে সম্মত রহিলাম।”[১৫]

 পর দিবস খোজা পিদ্রু নামক আরমাণী বণিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষভাবে ওয়াট্‌স্ সাহেবের কথোপকথন হইল। তিনি বলিলেন যে,— “মীরজাফরকে গোপনে হত্যা করিবার জন্য সিরাজদ্দৌলা অবসর অনুসন্ধান করিতেছেন; অগত্যা আত্মরক্ষার জন্য মীরজাফর বিদ্রোহী দলে যোগদান করিতে বাধ্য হইয়াছেন। রায়দুর্ল্লভ, জগৎশেঠ এবং আর আর সকলেই মন্ত্রণার মধ্যে আছেন; আপনারা সহায়তা করিলে তাঁহারাও সহায়তা করিবেন। এ কার্য্য আপনাদের কর্ত্তব্য হয় ত এখনই অগ্রসর হউন। সিরাজদ্দৌলাকে আপাততঃ নিশ্চিন্ত রাখা আবশ্যক; তজ্জন্য কর্ণেল ক্লাইবকে সসৈন্যে কলিকাতায় ফিরিয়া যাইতে হইবে।”[১৬]

 ক্লাইব অবিলম্বে কলিকাতায় গমন করিয়া ১লা মে তারিখে ইংরাজদরবারে উপনীত হইলেন। তাঁহার এবং ওয়াট্‌সের উপরে সকল ভার ন্যস্ত হইল।[১৭] তিনি শীঘ্র ছাউনী উঠাইয়া অর্দ্ধেক সেনাদল কলিকাতায় এবং অর্দ্ধেক সেনাদল চন্দননগরে লুকাইয়া রাখিয়া সিরাজদ্দৌলাকে শান্ত করিবার জন্য লিখিয়া পাঠাইলেন,—“আমরা ত সেনাদল উঠাইয়া আনিলাম; আপনি আর পলাসিতে ছাউনী রাখিতেছেন কেন?” যে পাত্রবাহক এই বিষকুম্ভপয়োমুখ পত্র লইয়া মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিল, ক্লাইব তাহার যোগেই ওয়াট্‌স্‌ কে লিখিয়া পাঠাইলেন, “মীরজাফরকে বলিও লতিফ মীরজাফরের নাম গোপন করিয়া রাখিলেন!</ref> কিছুতেই যেন তিনি ভীত না হন, যাহারা কখনও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেন নাই এমন পাঁচ হাজার ফৌজ লইয়া তাঁহার সহিত মিলিত হইব;—একজন মাত্র জীবিত থাকিতেও পলায়ন করিব না; দিবারাত্রি অক্লান্তচরণে অগ্রসর হইব।”[১৮]

 যাঁহার মনে যত পাপ তিনি প্রকাশ্যে তত সরলতা দেখাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু আহমদ শাহ ভারতবর্ষ হইতে প্রস্থান করায়, সিরাজকে আর পাটনা যাত্রা করিতে হইল না; তিনি ইংরাজের সুকৌশলপূর্ণ বাণিজ্যতরণী আটক করিয়া, পলাশির ছাউনী যেমন ছিল সেইরূপ রাখিয়া, গুপ্তচরসহায়ে ইংরাজের সঙ্কল্পানুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন।

 মতিরাম একজন বিখ্যাত গুপ্তচর। তিনি কার্য্যব্যপদেশে কলিকাতায় থাকিয়া গোপনে গোপনে সংবাদ পাঠাইলেন যে,—“কেবল অর্দ্ধেক ফৌজ কলিকাতায় আছে, অপরার্দ্ধ বোধ হয় কোন গোপনপথে কাশিমবাজার যাত্রা করিয়াছে!” সিরাজদ্দৌলা তৎক্ষণাৎ কাশিমবাজার তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলেন, ফৌজের সন্ধান মিলিল না, কিন্তু তথাপি তাঁহার সন্দেহ দূর হইল না। তিনি ফরাসিদিগকে ভাগলপুরে অপেক্ষা করিতে বলিয়া ভাগীরথীমুখে শালতরু প্রোথিত করিয়া, পঞ্চদশ সহস্র সেনাসমভিব্যাহারে মীরজাফরকে পলাশিমাত্রার আদেশ করিলেন। তাঁহাকে পলাশিতে অবস্থান করিতে হইলে গুপ্তমন্ত্রণার ব্যাঘাত হইবে বলিয়া ইংরাজ বাঙ্গালী সকলেই চিন্তাকুল হইয়া উঠিলেন। কিন্তু সিরাজদ্দৌলার সন্দেহ দূর করিবার জন্য মীরজাফরকে সহাস্যমুখে পলাশিযাত্রা করিতে হইল!

 মহারাষ্ট্র-সেনাপতি বহুদিন চৌথ না পাইয়া লুণ্ঠন-লোলুপ সতৃষ্ণনয়নে ইংরাজগবর্ণর ড্রেক সাহেবের নিকট পত্র লিখিয়া গোবিন্দরাম নামক দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন।[১৯] সেই মহারাষ্ট্রদূত কলিকাতায় উপনীত হইলে কর্ণেল ক্লাইব বিষম বিপদে পতিত হইলেন।[২০] গোবিন্দরাম কাহার চর? তাহা স্থির করিতে না পারিয়া তাঁহার পত্রখানি সিরাজদ্দৌলার নিকট পাঠাইয়া দেওয়াই স্থির হইল। ইহাতে ইংরাজের সরলতার অকাট্য প্রমাণ পাইয়া সিরাজদ্দৌলা নিশ্চয়ই প্রতারিত হইবেন, এই ভরসায় ক্রাফটন্ সাহেব মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিলেন;—পথিমধ্যে পলাশিতে মীরজাফরের সঙ্গে পরামর্শ করাই মুখ্য উদ্দেশ্য।[২১] নবাবের গুপ্তচরগণ সে উদ্দেশ্য সাধন করিতে দিল না; তাহার ক্রাফটন্‌কে বরাবর মুর্শিদাবাদে পাঠাইয়া দিল। ক্লাইবের কৌশল জয়যুক্ত হইল। নবাব ইংরাজদিগের উপর এরূপ সন্তুষ্ট হইলেন যে, তাঁহার যাহা কিছু এখনও সন্দেহ ছিল, স্ক্রাফটন্ তাহা সহজেই দূর করিতে সক্ষম হইলেন; মীরজাফর সসৈন্যে পলাশি হইতে উঠিয়া আসিবার আদেশ প্রাপ্ত হইলেন। তিনি মুর্শিদাবাদে আসিবামাত্র গুপ্তসন্ধিপত্র লিখিত হইল।

 ১৭ই মে কলিকাতার ইংরাজদরবারে এই গুপ্ত সন্ধিপত্রের পাণ্ডুলিপির আলোচনা হইল। এই পাণ্ডুলিপিতে কোম্পানী বাহাদুর এক কোটী টাকা, কলিকাতাবাসী ইংরাজ বাঙ্গালী ও আরমানীগণ ৭০ লক্ষ টাকা এবং উমিচাঁদ ৩০ লক্ষ টাকা পাইবার ব্যবস্থা হইয়াছিল। ইহা ছাড়া যাঁহারা বিদ্রোহের প্রধান প্রধান পাণ্ডা, তাঁহাদের পুরস্কারের অঙ্ক এক পৃথক ফর্দ্দে লিখিত হইয়াছিল। সিরাজদ্দৌলার রাজভাণ্ডারে অবশ্যই এত টাকা থাকিবার কথা নহে;—কিন্তু সে কথার কেহ বিচার করিলেন না। চারিদিকে রাজবিপ্লব—ইংরাজের কাণ্ডারী সাজিয়া মীরজাফরের আশার তরণী তীরসংলগ্ন করিতে প্রতিশ্রুত,—সুতরাং তাঁহারা যাহা চাহিয়াছিলেন মীরজাফরকে তাহাতেই ‘তথাস্তু’ বলিতে হইয়াছিল।[২২]

 পাণ্ডুলিপি পাঠাইবার সময়ে ওয়াট্‌স্ সাহেব লিখিয়াছিলেন,—“উমিচাঁদ যাহা চাহিতেছে, তাহা স্বীকার করিতে ইতস্ততঃ করিলে সর্ব্বনাশ হইবে! সে সহজ পাত্র নহে;—নবাবের নিকট এখনই সকল চক্রান্ত প্রকাশ করিয়া দিবে!” এই সংবাদে ইংরাজেরা উমিচাঁদের উপর খড়্গহস্ত হইয়া উঠিলেন। যাঁহারা মীরজাফরকে কামধেনুর ন্যায় যথেচ্ছ দোহন করিতে লালায়িত, তাঁহারাই উমিচাদকে অর্থগৃধ্নু, স্বার্থপিশাচ বলিয়া ফাঁকি দিতে কৃতসংকল্প হইলেন। কিন্তু তাঁহাকে কেমন করিয়া ফাঁকি দেওয়া যাইতে পারে, সে কথার কেহ মীমাংসা করিতে পারিলেন না!

 অবশেষে একদিন এক রাত্রির গভীর গবেষণার পর ক্লাইবের “প্রত্যুৎপন্নমতি সমস্যাপূরণে কৃতকার্য্য হইল। তিনি দুইখানি সন্ধিপত্র লিখাইলেন; একখানি সাদা কাগজে,—সে খানি আসল, আর একখানি লাল কাগজে,— সে খানি জাল![২৩] এই জাল সন্ধিপত্রে উমিচাঁদের ত্রিশ লক্ষের উল্লেখ রহিল। ওয়াট্‌সন্ ইহাতে সাক্ষর করিতে ইতস্ততঃ করিয়া ক্লাইবকে একটু বিপদে ফেলিয়াছিলেন, কিন্তু ক্লাইবের আদেশে লসিংটন সাহেব ওয়াট্‌সনের নাম জাল করায় সকল বিপদ কাটিয়া গেল।[২৪] কেহ কেহ ক্লাইবের কলঙ্কমোচনের জন্য লিখিয়া গিয়াছেন,—“ওয়াটসনের সম্মতি লইয়াই তাঁহার নাম জাল করা হইয়াছিল।” এ কথার বিশেষ গৌরব দেখিতে পাওয়া যায় না; ক্লাইব নিজেই বলিয়া গিয়াছেন, “ওয়াটসন্ সম্মত না হইলেও তিনি তাঁহার নাম জাল করিবার অনুমতি প্রদান করিতেন।”[২৫]

 এই জাল সন্ধিপত্রের আলোচনা করিতে গিয়া ইতিহাসলেখকেরা গলদঘর্ম্ম হইয়াছেন। ক্লাইব কিন্তু মহাসভায় সাক্ষ্য দিবার সময়ে অম্লানচিত্তে মুক্তকণ্ঠে বলিয়া গিয়াছেন যে,—“তিনি কখনও এ কথা লুকাইবার চেষ্টা করেন নাই। এরূপ ক্ষেত্রে এবম্প্রকার জাল জুয়াচুরি যে অনায়াসেই করা যাইতে পারে, ইহাই তাঁহার মত। একবার কেন,আবশ্যক হইলে, এরূপ অবস্থায় আরও একশ বার তিনি এরূপ কার্য্য করিতে প্রস্তুত।”[২৬]

 যিনি ভারতবর্ষে বৃটীশ-শাসনের ভিত্তিমূল সংস্থাপনের আদি পুরুষ, তাঁহার ধর্ম্মবুদ্ধি যে এতদূর নীচগতি প্রাপ্ত হইয়াছিল, সে কথা স্মরণ করিয়া ইংরাজ ইতিহাসলেখকেরা লজ্জায় অধোবদন হইয়া রহিয়াছেন;—একমাত্র স্যর জন ম্যালকম্ ভিন্ন আর কেহ ক্লাইবের পক্ষ সমর্থন করিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই।”[২৭] কিন্তু ইহার জন্য লোকে অনর্থক তিলে তাল করিয়া তুলিয়াছে। ঘটনাচক্রের উত্তেজনায় এদেশের দশজন গণ্যমান্য লোকের সহায়তায় কর্ণেল ক্লাইব যে মোগল রাজসিংহাসন উচ্চমূল্যে বিক্রয় করিবার অবসর প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কেবল বাহুবলে তাহা মুসলমানের নিকট হইতে কাড়িয়া লইবার সম্ভাবনা ছিল না। “বিষস্য বিষমৌযুধং”—মোগলগৌরবের অধঃপতন সময়ে হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান,বাঙ্গালী মরহাট্টা এবং ফিরিঙ্গি বণিক অক্লান্ত অধ্যবসায়ে ভারত-ভাগ্য-সমুদ্র মন্থন করিতে করিতে যে অরাজকতার কালান্তক হলাহল উত্তোলন করিয়াছিলেন তাহাতে ভারতবাসীর সুখ-সৌভাগ্য জর্জ্জরিত হইয়া উঠিয়াছিল। ক্লাইব সেই বিকারে বিষপ্রয়োগ না করিলে, আজ দিগন্ত-বিস্তৃত বৃটীশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া শাসন-কৌশলে এদেশের লোক পূর্ব্ব কাহিনী বিস্মৃত হইবার অবসর লাভ করিত না! পাঠানের শাণিত খরসান, মরহাট্টার অশ্বপদতাড়না, ইউরোপীয় বণিকের সর্ব্বসংহারিণী ক্ষুধা, এতদিনে এ দেশের অস্থিচর্ম খণ্ড খণ্ড করিত;— যে রাষ্ট্রবিপ্লবের অগ্নিশিখা ভারতবর্ষে লোলজিহ্বা বিস্তার করিয়াছিল, তাহা আজিও দেশে দেশে উন্মত্ত পিশাচের মত নৃত্য করিয়া বেড়াইত! পাশ্চাত্য শিক্ষার সহস্র দৃষ্টান্তে আজিও যাহাদের গৃহকলহ শান্তিলাভ করে নাই, তাহারা যে আত্মবলে বলীয়ান্ হইয়া স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে পারিত, সে আশা নিতান্তই আকাশকুসুম।

 রাজবিদ্রোহ মহাপাপ;—ইংরাজেরা জানিয়া শুনিয়া সেই মহাপাপে লিপ্ত হইয়াছিলেন ইহাই ত যথেষ্ট; তাহার তুলনায় আর জাল জুয়াচুরি এমন গুরুতর অপরাধ কি? আর ক্লাইবের ন্যায় লোকের পক্ষে তাহা এমন দুরপনেয় কলঙ্কই বা কি?[২৮] তিনি যে শ্রেণীর ইংরাজ, যে সহবাসে শিক্ষিত, যে উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে সমাগত,—তাহাতে তাঁহার নিকট আদর্শ ইংরাজের চরিত্রবলের প্রত্যাশা করাই বিড়ম্বনা! যখন যাহা অবশ্যক, তিনি তখনই তাহা অম্লানচিত্তে সম্পাদন করিয়াছেন; তাহাতে কখন তাঁহার “কেশাগ্রও” কম্পিত হয় নাই![২৯] যে দুর্দ্দান্ত ইংরাজ-যুবক আবাল্য শত সহস্র উচ্ছৃঙ্খল কার্য্যে জীবনযাপন করিয়া, নিরন্তর স্বজনবান্ধবগণকে সশঙ্কিত রাখিয়া অন্তিমে অশান্তহৃদয়ে আত্মহত্যা করিয়া ইহলোক হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার হতভাগ্য স্মৃতি নীরবে শান্তিলাভ করুক্‌। যাঁহারা তাঁহাকে মহাবীর পলাশি-বিজেতা “ব্যারণ” বলিয়া ভক্তিপুষ্পে চরণ বন্দনা করিবার জন্য সাগ্রহে দেব-মূর্ত্তি গঠন করিয়াছেন, তাঁহাদের অবসাদের অন্ত নাই! কিন্তু যে মহাজাতি আত্মগৌরবকাহিনীতে সভ্যজগৎ প্রতিশব্দিত করিয়া স্বদেশের রাজপথপার্শ্বে বৃটীশ বীরকেশরী নেল্‌সন্ ওয়েলিংটনের জয়স্তম্ভ গঠন করিয়াছে, তাহারা ক্লাইবের জন্য এখনও জাতীয় কীর্ত্তিমন্দিরে পাদপীঠ রচনা করে নাই![৩০]

 যাঁহারা বাণিজ্যোপলক্ষে বাঙ্গালীর গুপ্ত-মন্ত্রণায় মিলিত হইয়া, রাজবিপ্লবের কল্যাণে এ দেশের রাজ-সিংহাসন কুড়াইয়া পাইয়াছিলেন, অর্থই তাঁহাদের নিকট একমাত্র “মূলমন্ত্র” বলিয়া পরিচিত ছিল।[৩১] তাঁহারা যে শাস্ত্রের উপাসক ছিলেন, তাহারই মর্য্যাদারক্ষা করিয়া গিয়াছেন। তজ্জন্য তাঁহাদিগকে তিরস্কার করা বিড়ম্বনা মাত্র। আমরা যে তাঁহাদিগকেই আদর্শ ইংরাজ বলিয়া তাঁহাদের কথায়, তাঁহাদের লেখায় তাঁহাদের প্ররোচনায়, সিরাজদ্দৌলাকে নরপিশাচ বলিয়া ইতিহাসের অবমাননা করিতেছি তজ্জন্য আমরাই বরং সমধিক তিরস্কারের পাত্র।

 উমিচাঁদকে প্রতারিত করিয়াই ইংরাজেরা নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন না; তাঁহাকে অবিলম্বে কলিকাতায় আনিয়া মুঠার মধ্যে রাখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। কি সুকৌশলে “ধূর্ত্ত উমিচাঁদকে” অধিকতর ধূর্ত্ততায় পরাস্ত করিয়া কার্য্যসিদ্ধি করা সম্ভব, স্ক্রাফ্‌টনের উপর সেই ভার নিক্ষিপ্ত হইল। তিনি উমিচাঁদকে নির্জ্জনে বুঝাইতে বসিলেন;—“কথাবার্ত্তা ত একরূপ শেষ হইয়া গেল। এখন দুই চারিদিনের মধ্যেই লড়াই বাধিবে। তখন সকলকেই তাড়াতাড়ি অশ্বারোহণে পলায়ন করিতে হইবে। আমরা হয় একরূপ করিব; কিন্তু তুমি,—একে স্থূলদেহ, তাহাতে স্থবির,— তুমি কি অশ্বারোহণে পলায়ন করিতে পারিবে?” উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল;— উমিচাঁদ একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। তিনি অনেক কথা ভাবিয়া রাখিয়াছিলেন, কিন্তু পলায়নের কথা একবারও তাঁহার মস্তকে প্রবেশ করে নাই! তিনি কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় স্ক্রাফ্‌টনের হাতে আত্মসমর্পণ করিলেন; তখন সুকৌশলে সিরাজদ্দৌলার অনুমতি লইয়া দুই জনেই কলিকাতা যাত্রা করিলেন।

 যাহারা পাপসংকল্পে লিপ্ত হয়, তাহারা কাহাকেও প্রাণ খুলিয়া বিশ্বাস করিতে চাহে না। ইংরাজেরা স্থির করিলেন যে, মীরজাফর যখন সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিবেন, সে সময়ে ইংরাজ-প্রতিনিধি ওয়াট্‌স্‌ সাহেব উপস্থিত থাকা চাই। কিন্তু সিরাজের সন্দেহে পড়িয়া মীরজাফর পদচ্যুত হইয়াছিলেন; গুপ্তচরগণ সতর্ক দৃষ্টিতে তাঁহার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিতেছিল;—এরূপ অবস্থায় সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়া দুষ্কর হইয়া উঠিল!

 অবশেষে ওয়াট্‌স সাহেব একদিন অসীম সাহসে নির্ভর করিয়া আস্তরণাবৃত শিবিকাররাহণে অবগুণ্ঠনবতী রমণীর ন্যায় সভয়ে সসঙ্কোচে মীরজাফরের অন্তঃপুরদ্বারে উপনীত হইলেন। সম্ভ্রান্ত মুসলমানগৃহের রীত্যনুসারে শিবিকা একেবারে অন্তঃপুরে নীত হইল। ওয়াট্‌স্ তাহার ভিতর হইতে বাহির হইয়া বেগম মহলে আসনগ্রহণ করিলেন।[৩২] তাঁহার সম্মুখে মীরজাফর মুসলমানের পরমপবিত্র ধর্ম্মগ্রন্থ মাথায় লইয়া, এক হাত প্রাণাধিক জ্যেষ্ঠ পুত্র মীরণের মাথায় রাখিয়া আর এক হাতে কলম ধরিয়া স্বাক্ষর করিলেন:—“ঈশ্বর এবং পয়গম্বরের দোহাই দিয়া শপথ করিতেছি, যতক্ষণ প্রাণ ততক্ষণ এই সন্ধিপত্রের অঙ্গীকার পালন করিতে বাধ্য থাকিলাম।”[৩৩]

 এই গুপ্ত সন্ধিপত্র লইয়া মীরজাফরের বিশ্বাসী অনুচর উমরবেগ জমাদার ১০ই জুন কলিকাতায় উপনীত হইলেন। গুপ্ত মন্ত্রণার কথা তখন একরূপ ঢাকে ঢোলে বাজিয়া উঠিয়াছে! আর কালবিলম্ব করিবার অবসর রহিল না;—ক্লাইব যুদ্ধযাত্রার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়া সগর্ব্বে সিরাজদ্দৌলাকে পত্র লিখিতে বসিলেন।

 মুসলমান-ইতিহাস-লেখকের কথার আভাসে বোধ হয় যে,—মীরজাফর কোরাণস্পর্শ করিয়াও ইংরাজদিগের বিশ্বাস জন্মাইতে পারেন নাই। তিনি যে সত্য সত্যই সন্ধিপত্রের লিখিত সমস্ত প্রতিশ্রুতি যথাধর্ম্ম পালন করিবেন, তজ্জন্য “উমাচরণ ও জগৎশেঠকে জামিন থাকিতে হইয়াছিল।”[৩৪]

 এ দেশের লোক বড়ই কুসংস্কারাচ্ছন্ন;—তাহারা এখনও বিশ্বাস করে যে, মীরজাফর পুত্রের মাথায় হাত রাখিয়া কোরাণ স্পর্শ করিয়া কৃতঘ্নের ন্যায় ফিরিঙ্গীর সঙ্গে গোপনে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিয়াছিলেন, সেই জন্য বিধাতার অভিসম্পাতে তাঁহার পাপহস্ত কুষ্ঠরোগে খসিয়া পড়িয়াছিল,[৩৫] এবং তাঁহার প্রিয়পুত্র মীরণের মস্তকে অকস্মাৎ বজ্রাঘাত হইয়াছিল! এরূপ কুসংস্কার কেবল আমাদিগেরই পৈতৃক সম্পত্তি নহে;—ক্লাইব যখন আত্মহত্যা করেন, তখন বিলাতের কত ভাল ভাল লোকেও বলিয়া উঠিয়াছিলেন যে, এত দিনে বিধাতার ন্যায়দণ্ডে সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইল।[৩৬]

 এ দিকে সিরাজদ্দৌলা গুপ্ত সন্ধিপত্রের সন্ধান পাইয়া মীরজাফরকে কারারুদ্ধ করিবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। মীরজাফরের বাটীতে গোলাবারুদের অভাব ছিল না, সুতরাং তাঁহাকে কারারুদ্ধ করা সহজ হইল না! ওয়াট্‌স্ ইহার আভাস পাইয়া বায়ুসেবনের উপলক্ষ করিয়া সহযোগী সহযোগে রজনীমুখে অশ্বারোহণে পলায়ন করিলেন! তখন আর সিরাজদ্দৌলার ইতস্ততঃ রহিল না। তিনি তৎক্ষণাৎ সেনাপতি ওয়াট্‌সন্‌কে পত্র লিখিতে বসিলেন। ইহাই তাঁহার শেষ পত্র। তিনি লিখিলেন:—

“২৫ রমজান (১৩ই জুন ১৭৫৭)।

“আমরা যে সন্ধি সংস্থাপন করিয়াছিলাম, তাহার অঙ্গীকার পালনের জন্য ওয়াট্‌স্ সাহেবকে প্রায় সকল বস্তুই বুঝিয়া দিয়াছি। যৎসামান্য কিছু কিঞ্চিৎ বাকী থাকিতে পারে। মাণিকচাঁদের ব্যাপারও একরূপ শেষ করিয়াছিলাম। কিন্তু এত করিয়াও ফল হইল না! ওয়াট্‌স্ এবং কাশিমবাজারের কুঠিয়ালেরা বায়ুসেবনের ভান করিয়া রজনীযোগে পলায়ন করিয়াছেন। ইহা প্রতারণার স্পষ্ট লক্ষণ, সন্ধিভঙ্গের পূর্ব্বসূচনা। তোমার অজ্ঞাতসারে বা উপদেশ ব্যতীত যে এরূপ কার্য্য সংঘটিত হয় নাই তাহা আমার বিলক্ষণ হৃদ্বোধ হইয়াছে। এরূপ ঘটিবে বলিয়া চিরদিনই আশঙ্কা করিতাম, এবং তোমরা বিশ্বাসঘাতকতা করিবে বলিয়াই আমি পলাশি হইতে ছাউনী উঠাইয়া আনিতে সম্মত হইতাম না।

 “যাহা হউক, আমার দ্বারা যে সন্ধিভঙ্গ হইল না এজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমরা যে ধর্ম্মপ্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, ঈশ্বর এবং পয়গম্বর তাহার সাক্ষী। যিনি প্রথমে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিবেন, তিনিই সেই মহাপাপের শাস্তিভোগ করিবেন।”[৩৭]

 চারিদিকে রাজবিপ্লব; তাহার মধ্যে সিরাজের রাজসিংহাসন বটপত্রের মত ভাসমান হইল! তিনি সর্ব্বপ্রযত্নে সিংহাসন রক্ষার জন্য ব্যাকুল হইয়া পাত্রমিত্রগণকে আহ্বান করিতে বাধ্য হইলেন। এই সকল ঐতিহাসিক ঘটনার যথাযোগ্য সমালোচনা না করিয়া, লর্ড মেকলে সিরাজদ্দৌলাকেই প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী বিশ্বাসঘাতক সাজাইবার জন্য অবলীলাক্রমে গ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন।[৩৮] এই গ্রন্থ আমাদিগের বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার্থী যুবকবৃন্দের পাঠ্যরূপে নির্দিষ্ট হইয়া থাকে!

  1. You know how difficult it is to prevent soldiers from plundering in war; therefore if you will, on your part, relinquish something of the damages you have sustained by being pillaged by my army, I will endeavour to give you satisfaction even in that particular, to gain your friendship and preserve a good understanding with your nation.— Nabob's letter to Admiral Watson.
  2. He had imprisoned Monikchand, and upon releasing had obliged him to pay a million of Rupees as a fine for the effects he had plundered in Calcutta.—Orme, vol. ii. 147.
  3. It is now in your power to settle ever-lasting peace in your country; and if you suffer the opportunity to slip, it may never offer again.—Watson's letter to the Nabob.
  4. I have written before and now repeat that if the English Company want to establish their trade, do not write me what is not conformable to our agreement, by the instigation of self-interested and designing men, who want to break the peace between us. If you are not disposed to come to a rupture with me, you have my agreement under my hand and seal, when you write, look upon that, and write accordingly.-Nabob's letter to Admiral Watson, 14 April, 1757.
  5. Orme. vol. ii. 147.
  6. Colonel Clive detatched 40 Europeans to protect the factory, and sent in several boats a supply of ammunition concealed under rice.—Ibid.
  7. Let me again repeat to you, I have no other views than that of peace. The gathering together of riches is what I despise.— Watson's letter.
  8. “Some of Suraja-Dowla's letters to the French having fallen into my hands. I enclose a translate of them just to show you the necessity we were reduced to of attempting his overthrow.” Clive's letter to Court, 6 August, 1757.
  9. These disturbers of my country, Admiral and Colonel Clive'. Sabut Jung, whom bad fortune attends, without any reason what ever, are warring against Zubdalook Toojah, Monsr. Rennault, the Governor of Chandernagore.—Suraja Dowla's letter to Monsr. Busie, Bahadre, supposed to be written in the latter end of, Febru. ary, 1757.
  10. Scrafton's Reflections,
  11. Partly by such arguments, and, taught by the French the power of money at the Subah's Court, partly by a handsome present of money to his first Secretary, he (Mr. Watts) produced the following letter from him to Mr. Watson.—Scrafton.
  12. He was at the same time in the pay of the Seilt.Thornton, vol. i. 226.
  13. Mr. Watts was too closely watched by the Subah's spies to venture himself, but sent one Omichund to him, who was an agent under him.—Scrafton.
  14. Necessity, which in politics usually supersedes all oaths, treaties or forms whatever, induced the English East India Company's representatives, about three months after the execution of the former treaty, to determine “by the blessing of God” upon dispossessing the Nabob Serajad Dowla of his Nizamut and giving it to another.—Bolt's Considerations, p. 40
  15. বোধ হয় বিদ্রোহীদলের এই সকল উক্তিতে আস্থা স্থাপন করিয়াই ইংরাজেরা লিখিয়া রাখিয়াছেন:—"Suraja Dowlah was such a monster that no security could be enjoyed either by the English or by the natives in Calcutta, so long as he sat upon the musnud at Moorshedabad, and ruled over Bengal, Bahar and Orissa.” -The Great battles of the British Army, p. 162.
  16. Orme, vol, ii. 149.
  17. Great dexterity as well as secrecy being necessary in executing the plan of a revolution, the whole management thereof was left to Colonel Clive and to Mr. Watts —Ive's Journal.
  18. He wrote to Surajah Dowlah in terms so affectionate that they for a time lulled that weak prince into perfect security. The same courier who carried this “Soothing letter,” as Clive calls it, carried to Mr. Watts a letter in the following terms: “Tell Meer Jaffier to fear nothing. I will join him with five thousand men who never turned their backs. Assure him, I will march night and day to his assistance, and standing by him as long as I have a man left.—Macaulay's Lord clive. বলা বাহুল্য যে, এ সময়ে ক্লাইবের আদৌ ৫ooo ফৌজ ছিল না; এবং কার্য্যকালেও তিনি তিন হাজারের অধিক ফৌজ লইয়া যাইতে পারেন নাই। আশ্বাস দিবার সময়ে ক্লাইবের মুখে এইরূপ করিয়াই খৈ ফুটিত। ইহাকে “large promises” বলা যায় কি না, মেকলে তাহার মীমাংসা করিয়া যান নাই!!
  19. “Your misfortunes have been related to me by Ragooje, son to Janooge. Make yourself easy, and be my friend; send me your proposals such as you imagine may be for the best; and with the divine assistance, Sumseer Caun Bhadre and Roghu Babu, son to Baje Row, shall enter Bengal with a hundred and twenty thousand horse.”—Letter from Ballaje Row Seehoo Baje Row, Vizir to Ram Rajah, brother to Raja Seehoo, from Hydrabad, to Roger Drake, Governor of Calcutta.
  20. For once the clear train of the director of the English policy was at fault, Clive could not feel quite sure that the letter might not be a devise of the Nawab to ascertain beyond a doubt the feelings of the English towards himself —Col. Malleson's Decisive Battles of India, p. 52.
  21. Another, and the principal object of Mr. Scrafton's mission, was to obtain an opportunity of consulting confidentially with Meer Jaffier; but this was prevented by the watchfulness of the Subahdar's emissaries. —Thornton's History of the British Empire, vol. i. 229. note.
  22. The plain truth was that the so-called treaties were mere agreements patched up on the eve of a revolution. The English were in a position to demand anything; the Nawab-expectant could refuse nothing. There was not even a shadow of deliberation, for there was no time to haggle over terms.—Early Records of British India, p. 316.
  23. His Lordship himself formed the plan of the fictitious treaty—First Report.
  24. Mr. Lushington was the person who signed Admiral Watson's name, by his Lordship's order.—Ibid.
  25. As far as Clive's reputation is concerned, the question is of no moment, as he declared (Evidence in first Report, p. 154) that he would have ordered Admiral Watson's name to be put, whether he had consented or not.—Thornton's History of the British Empire in India vol, i. p. 256 note.
  26. His Lordship never made any secret of it; he thinks it warrantable in such a case, and would do it again a hundred times.— Ibid.
  27. The greed for money, the ever-increasing demand for the augmentation of the sum originally asked for the dishonoring trick by which a confederate was to be baulked of his share in the spoil; these are actions the contemplation of which makes, and will always make, the heart of an honest man burn with indignation.-Col. Malleson's Decisive Battles of India, p. 73.
  28. His family expected nothing good from such slender parts and such a headstrong temper. It is not strange, therefore, that they gladly accepted for him, when he was in his eighteenth year, a writership in the service of the East India Company, and shipped him off to make a fortune or to die of a fever at Madras—Macaulays' Lord Clive.
  29. Clive was a man, “to whom deception, when it suited, his purpose, never cost a pang.”—Mill's History of British India vol. iii.
  30. The anniversary of Lord Clive's birth, though seldom observed or honored among us as continental people honor the heroes of their national Pantheon, must still fill every reflecting mind with crowding thoughts upon the strange and romantic rise of the British Power in the East.—the Indian Statesman, 30th September, 1896.
  31. In manufacturing the terms of the confederacy the grand concern of the English appeared to be money.—Mill's History of British India. vol. iii. 185.
  32. Orme, ii.
  33. “I swear by God and the Prophet of God to abide by the terms of this treaty while I have life.”
  34. “জামিন্ উসকে ওহি দোনো মহাজনান্ মজকুরা হুয়ে।”—মুতক্ষরীণ।
  35. মীরজাফরের মৃত্যুসময়ে তাঁহার পাপক্ষালনের জন্য মহারাজ নন্দকুমার শ্রীশ্রীশ্বরী কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত তাঁহার ওষ্ঠে সেচন করিয়া এই বিশ্বাসের পরিচয় দিয়াছিলেন। “Gholam Hossein has a story that, when Mir Jaffar was dying, Nanda Kumar gave him water that had bathed the image of Kiriteshwari,”—H. Beveridge; c. S.
  36. In the awful close of so much prosperity and glory, the vulgar saw only a confirmation of all their prejudices; and some, men of real piety and genius so far forgot the maxims both of religion and of philosophy as confidently to ascribe the mournful event to the just vengeance of God, and to the horrors of an evil conscience.—Macaulay's Lord Clive.
  37. পত্রখানি এইরূপ:—“25th Raimzan (13th of June 1757),
    According to my promises, and the agreement made between us, I have duly rendered everything to Mr. Watts, except very small remainder, and thad almost settled Monickchand's affair. Notwithstanding all this, Mr. Watts and the rest of the Council of the factory at Cossimbazar, under pretence of going to take the air in their gardens, fled away in the night. This is an evident mark of deceit, and of an intention to break the treaty. I am convinced it could not have happened without your knowleedge or without your advice. I all along expected something of this kind and for that reason I would not recall my forces from Plassey, expecting some treachery.
     I praise God, that the breach of the treaty has not been on my part: God and His Prophet have been witnesses to the contract made between us, and whoever first deviates from it will bring upon themselves the punishment due to their actions.—Ive's Journal. bring upon themselves the punishment due to their actions.—Ive's Journal.
  38. The Nabob behaved with all the faithlessness of an Indian statesman, and with all the levity of a boy whose mind had been enfeebled by power and self indulgence. He promised, retracted, hesitated, evaded,” Macaulay's Lord Clive.