সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/তৃতীয় অঙ্ক/পঞ্চম গর্ভাঙ্ক

পঞ্চম গর্ভাঙ্ক

মুর্শিদাবাদ—মীরজাফরের বাটী

মীরজাফর ও মীরণ

মীরজাঃ। মীরণ, পালানই কর্ত্তব্য, নিশ্চয় আক্রমণ কর্‌বে সকল সংবাদ নবাব পেয়েছে।
মীরণ। পালান অসম্ভব, বাড়ীর চতুর্দ্দিকে গুপ্ত অস্ত্রধারী পাহারা রয়েছে;—মোহনলালের চর অনবরতই সন্ধান নিচ্ছে।
মীরজাঃ। তবে কি উপায়? আক্রমণ করতে সাহস কর্‌বে? রাজ্যে সকলেই বিরূপ। আমাদের পক্ষ হ’য়ে কে রটনা করেছে, যে ওমরাওদের পরিবারগণকে নষ্ট কর্‌বার জন্য সিরাজ দূতী নিযুক্ত করেছে, যে একজন কুলস্ত্রী দেবে, সে লক্ষ টাকা পারিতোষিক পাবে। এতে রাজা-প্রজা সকলেই বিরূপ হয়েছে, বোধ হয় সাহস কর্‌বে না। ক্লাইবও অগ্রসর হচ্ছে—এরূপ জনরব। কোথাও যেতে সাহস হচ্ছে না। সন্ধিপত্রের কি হলো কে জানে। অন্তঃপুরে শিবিকা বাহকের শব্দ পাচ্ছি,—দেখতো কে এলো।
মীরণের প্রস্থান
না মীরমদনের উত্তেজনায়, নিশ্চয় আমার মোকাম আক্রমণ কর্‌বে। বেগমদের স্থানান্তর কর্‌বারও তো উপায় নাই।

জহরা ও শিবিকা লইয়া বাহকগণের প্রবেশ

মীরজাঃ। এ কি!
ওয়াট্‌স। (রমণীবেশে শিবিকা হইতে বাহির হইয়া) Good morning, হামি আসিয়াছে।
মীরজাঃ। কে তুমি?
ওয়াট্‌স। (অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিয়া) চিনিতে পারিতেছেন না?
মীরজাঃ। ওয়াট্‌স সাহেব! সেলাম, কি সংবাদ?
ওয়াট্‌স। সন্ধিপত্রে সই করুন, ক্লাইব সাহেব পাঠাইয়া দিয়াছে।
মীরজাঃ। আর সন্ধিপত্রে কি ফল! নবাব সকল কথা টের পেয়েছে, বোধ হয় এখনই আমার গৃহ আক্রমণ করবে।
জহরা। না, সে ভয় করবেন না,— নবাব সে নবাব নাই, অহঙ্কার চূর্ণ হয়েছে।—আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, যান নাই, তাতে একবার জ্ব’লে উঠেছিল, কিন্তু সে ক্ষণিক, শুষ্ক তৃণের অগ্নির ন্যায়,—এখন ভয়ে অস্থির! কোন চিন্তা নাই, সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করুন।
মীরজাঃ। তুমি কে?
জহরা। আমায় চেনেন, আমায় জানেন। (মুক্তার মালা বাহির করিয়া) আপনার টাকার প্রয়োজন, এর মূল্য আপনার অবিদিত নাই। এ ঘসেটী বেগমের মুক্তার হার, এতেই রণব্যয় নির্ব্বাহ হবে। ঘসেটী বেগমের দু'হাজার সৈন্যও আপনাদের সাহায্যার্থে প্রস্তুত। নিন। স্বাক্ষর করুন, কোন ভয় নাই।
জহরার প্রস্থান
মীরজাঃ। কই, সন্ধিপত্র দিন।
ওয়াট্‌স। আপনি শপথ করিয়া স্বাক্ষর করুন, যে নবাব হইলে সন্ধির অনুরূপ কার্য্য করিবেন, অন্যরূপ কার্য্য করিবেন না।
মীরজাঃ। আমি এক হাতে কোরাণ স্পর্শ ক’রে, আর এক হাতে আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র মীরণের মস্তক স্পর্শ ক’রে শপথ কচ্ছি, যে কদাচ সন্ধি ভঙ্গ কর্‌বো না। মীরণ, কোরাণ দাও, (সহি করণ) এই আমি সই করলেম। (মীরণের কোরাণ দেওন) এই কোরাণ স্পর্শ ক’রে, মীরণের মস্তকে হস্ত দিয়ে প্যায়গম্বরের নামে শপথ কচ্ছি, যে যদি সন্ধিভঙ্গের কল্পনাও আমার মনে উদয় হয়, তা’হলে আমার প্রাণাধিক জ্যেষ্ঠ পুত্রের যেন বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়।
ওয়াট্‌স। (কানে হাত দিয়া) আর বলিবেন না, আর বলিবেন না! আমি চলিলাম। ক্লাইব সাহেব যুদ্ধের নিমিত্ত প্রস্তুত। আমি অদ্যই বায়ু সেবনের ছলে কলিকাতা পালাইব। সেলাম!
শিবিকারোহণে ওয়াট্‌সের প্রস্থান
মীরজাঃ। মীরণ, সন্ধিপত্র তো সই হলো। তুমি নগরে যাও, দেখ যদি কোনরূপ সন্ধান পাও। তোমার প্রতি বোধ হয় কোন অত্যাচার হবে না।
মীরণ। আমিও শিবিকা ক’রে অন্দর হ’তে বাহির হই। কোথায় যাবো, গুপ্তচরেরা যেন সন্ধান না পায়। সাহেব যাবার-আস্‌বার বড় কৌশল শিখিয়েছে।
মীরণের প্রস্থান
মীরজাঃ। বিস্তর টাকা ইংরাজকে দিতে হবে! চিন্তা কি? নবাব হবো!—নবাব-ভাণ্ডারে টাকা না থাকে, মহাতাবচাঁদের নিকট লব। নবাব হ’লে টাকার চিন্তা নাই! ইংরাজ কি আমার সহিত প্রতারণা কর্‌বে, আমি ইংরাজের সহিত দুর্ব্যবহার না কর্‌লে কেন প্রতারণা কর্‌বে? ওরা স্বার্থপর, নানা অছিলায় বার বার অর্থ চাইবে। নবাব হ’লে আর চিন্তা কি? আমি তো কাপুরুষ সিরাজদ্দৌলা নই! যতদিন কার্য্য সমাধা না হচ্ছে, কোনরূপে স্থির হ’তে পাচ্ছি না, কি হয় কে জানে! সাহস ক'রে তো ঝাঁপ দিলেম!
সিরাজদ্দৌলা ও আলিবর্দ্দী-বেগমের প্রবেশ
সিরাজ। মীরজাফর খাঁ বাহাদুর, চিন্তা-মগ্ন কেন? আপনাকে পুনরায় সেনাপতি-পদে বরণ কর্‌তে এসেছি। আপনার নিকট দূত প্রেরণ করেছিলেম, আপনি দরবারে উপস্থিত হন নাই, সেই নিমিত্তই এসেছি; ভূতপূর্ব্ব নবাব-মহিষীও এসেছেন।
মীরজাঃ। জনাব—জনাব, আমার সৌভাগ্য! নবাব-মহিষী এতদূর ক্লেশ করেছেন।
সিরাজ। শিষ্টাচারের সময় নয়, শিষ্টাচারের জন্য আসি নাই,—ক্ষমা করুন, ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এসেছি। আমার ব্যবহার ভুলে যান। আমি ঘোর বিপদে আপনার শরণাপন্ন,—শরণাগতকে আশ্রয় দেন।
মীরজাঃ। জনাব, গোলামকে এত অনুনয়-বিনয় কেন?
সিরাজ। খাঁ বাহাদুর শুনুন;—মুসলমানের চন্দ্রাঙ্কিত পতাকা রক্ষা কর্‌তে কেবলমাত্র আপনিই সক্ষম,—বিজাতীয় দম্ভ চূর্ণ করুন, বাঙ্গ্‌লায় বীরবীর্য্য শত্রুকে প্রদর্শন করুন,—মাতামহের নামে মিনতি কচ্ছি, আর বিমুখ হবেন না।
মীরজাঃ। জনাব, ক্ষুব্ধ হয়েছিলেম সত্য, কিন্তু জনাবের বাক্যে সে ভাব সম্পূর্ণ দূর হয়েছে। কোন চিন্তা নাই, জনাব নিরুদ্বেগে সিংহাসন উপভোগ করুন। আপনার শত্রু দমনের ভার আমি গ্রহণ কর্‌লেম, কার সাধ্য আপনার অনিষ্ট সাধন করে। আপনি যেরূপ আজ্ঞা কর্‌বেন, আমি সেইরূপ কর্‌তে প্রস্তুত। আজ্ঞা দেন, আমি সসৈন্যে ইংরাজ বিরুদ্ধে যাত্রা করি। দৃষ্টিমাত্রে ইংরাজবাহিনী চূর্ণ কর্‌বো, এ প্রদেশে ইংরাজের নাম বিলুপ্ত কর্‌বো, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী অতীতে পরিণত হবে। নিশ্চিন্ত হৃদয়ে রাজপুরে গমন করুন। নবাব-মহিষী অকারণে ক্লেশ স্বীকার করেছেন। যদিচ আমার গরীবখানা আপনার পদার্পণে পবিত্র, তথাপি আপনি ক্লেশ ক’রেছেন, এতে আমি দুঃখিত। সংবাদ দিলেই গোলাম হাজির হতো।
সিরাজ। খাঁ বাহাদুর, আপনার কথায়, আমার ভগ্ন হৃদয়ে সাহস সঞ্চার হচ্ছে, দেখ্‌বেন আশা দিয়ে নিরাশ কর্‌বেন না। আমি আপনার মীরণের তুল্য, আমার বধ সাধন কর্‌বেন না। আদরে লালিত, তা আপনার অগোচর নাই। কিন্তু আমার আহার নাই, নিদ্রা নাই,—শয়নে-স্বপনে ক্লাইবের ভীষণ মূর্ত্তি আমার সম্মুখে বিরাজিত! বিদেশী বণিকের দ্বারা আপনার পূজ্য প্রভুর পালিত সন্তানের অপমান না হয়, বিদেশী রণভেরী আর না বাঙ্গলায় শব্দিত হয়, মোগল-প্রতাপ আর না ক্ষুণ্ন হয়! আপনি রাজ্যের ভরসা, আপনি সাহস দিন, আমি বড়ই কাতর হয়েছি।
বেগম। মীরজাফর, একবার মৃত নবাব, তোমার হস্তে আমার সিরাজকে অর্পণ করেছিলেন, এবার আমি তোমার হাতে আমার বালক সিরাজকে অর্পণ করি। অলিবর্দ্দীর সন্তানকে রক্ষা করো;—এ বৃদ্ধ বয়সে আলিবর্দ্দীর বেগমকে সন্তাপিত ক’রো না। মীরজাফর, তোমার হাতে আমি সিরাজকে অর্পণ কর্‌লেম্, আমায় শপথ ক’রে বলো, তুমি রক্ষা করবে?
মীরজাঃ। (স্বগত) বৃক্ষের মূলচ্ছেদ ক’রে শিরে সলিল সেচন!
বেগম। মীরজাফর, নীরব কেন? নাও—নাও—আমার সিরাজকে নাও। যে বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতির প্রাধানা বেগম ছিল—যার সম্মুখে শত শত জানু ভূমিস্পর্শ করেছে, শত শত রাজমুকুট অবনত হয়েছে, (জানু পাতিয়া) সেই আজ অবনত মস্তকে ভূমিতে জানু স্পর্শ ক’রে ভিক্ষা চাচ্ছে;—ভিক্ষা দাও—সন্তান-ভিক্ষা দাও—বঞ্চনা ক’রো না।
মীরজাঃ। (জানু পাতিয়া) গোলামকে অপরাধী কচ্ছেন, গোলামকে অপরাধী কচ্ছেন! আমি কোরাণ স্পর্শ ক’রে প্যাগম্বরের নামে শপথ কচ্ছি,—কার সাধ্য বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতির তিলমাত্র অনিষ্ট করে। অমি কোরাণ স্পর্শ ক’রে সেনাপতিত্ব গ্রহণ কর্‌লেম। আমি কল্য যুদ্ধযাত্রা কর্‌বো, ইংরাজ দমন না করে প্রতিনিবৃত্ত হবো না।
বেগম। মীরজাফর, আমি নিশ্চিন্ত হই?
মীরজাঃ। বেগম-মহিষী, আর কেন?—আল্লার দোহাই,—প্যাগম্বরের দোহাই, আল্‌কোরাণের দোহাই! (সিরাজদ্দৌলার প্রতি) চলুন, সৈন্য সমাবেশ করিগে।
সকলের প্রস্থান