সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/তৃতীয় অঙ্ক/চতুর্থ গর্ভাঙ্ক
(পৃ. ১২৮-১৩৩)
চতুর্থ গর্ভাঙ্ক
কাশিমবাজার—ইংরাজকুঠির কক্ষ
ওয়াটস্ ও আমিরবেগের প্রবেশ
আমির। কর্ণেল ক্লাইব এই দুইখানি সন্ধিপত্র পাঠিয়েছেন। আপনি শীঘ্র মীরজাফরের সই ক’রে নিন, আর বিলম্ব না হয়। ক্লাইব সাহেব সসৈন্যে প্রস্তুত, আমি এই সন্ধিপত্র ল’য়ে যাবামাত্র তিনি অগ্রসর হবেন।
ওয়াট্স। এ দুইটা কেন?
আমির। এই সাদাখানা আদত সন্ধিপত্র, আর এই লালখানা, উমিচাঁদের চোখে ধূলো দেবার জন্য। এই লালটায় লেখা আছে, যে উমিচাঁদকে তার প্রার্থনা মত যত টাকা ওয়াট্স সাহেব এই সন্ধিপত্রে লিখ্বেন, সেই টাকা কৌন্সিলের মঞ্জুর; আর এই সাদাটায় উমিচাঁদের টাকার কিছু উল্লেখ নাই।
ওয়াট্স। এটাতো জাল হইল! দেখ আমিরবেগ,—যদ্যপি তুমি আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাসপাত্র না হইতে, যেখন নবাব Fort William লইয়াছিল, তেখন যদি তুমি মেম লোকদের না বাঁচাইতে,—আমি তোমার কথায় প্রত্যয় করিতে পারিতাম না। কর্ণেল ক্লাইব এরূপ জাল কাগজ পাঠাইয়াছেন, বা তোমরা মতলব বাহির করিয়া এমন করিয়াছ? সাফ্ জাল হইল—সাফ্ জাল হইল!
আমির। আবার সাহেব তুমিও বল্ছ—“জাল হইল?” এরূপ না কর্লে, ধূর্ত্ত উমিচাঁদ, সমস্ত ষড়যন্ত্রের কথা নবাবের নিকট প্রকাশ কর্বে।
ওয়াট্স। ক্লাইব এ জাল কাগজ সই করিয়াছেন, কিন্তু ওয়াট্সন্ সাহেব সই করিতে আপত্তি করেন নাই?
আমির। তিনি সই করেন নাই, লুসিংটন সাহেব তাঁর নাম জাল করেছে।
ওয়াট্স। উমিচাঁদটা বড়ই ধূর্ত্ত! তাহার সহিত এরূপ ব্যবহার উচিত। লেকেন কাজটা বড় খারাপি! ক্লাইব সাহেবকে তোম্লোক ভাল শিখাইয়াছো!
আমির। সাহেব, ক্লাইব সাহেবকে আর আমাদের শেখাতে হয় না, ক্লাইব সাহেব আমাদের সাত পুরুষকে শেখাতে পারেন। যখন ওয়াট্সন্ সাহেব সই করতে আপত্তি করেছিলেন, ক্লাইব সাহেব টেবিলে ঘুঁসি মেরে বল্লেন,—‘তুমি আপত্তি কচ্ছ, কিন্তু আমি বৃটিশ রাজ্য স্থাপনের জন্য আর উমিচাঁদের মত কপট লোককে দমন কর্বার জন্য, এমন একশো খানা কাগজ জাল কর্তে প্রস্তুত।
ওয়াট্স। ঠিক বাত, উমিচাঁদ আস্বে, আমি পালাই।
সন্ধিপত্রদ্বয় প্রদান করিয়া আমিরবেগের প্রস্থান
ওয়াট্স। It is insubordination to protest against superior, but there will be a stain on our character which Great Britain will surely resent.
উমিচাঁদের প্রবেশ
আইসেন উমিচাঁদবাবু, মুখটা এমন ভার কেন?
উমি। সাহেব, আমি সব জোগাড় করলুম, আর আমিই ফাঁকি পড়্বো? স্পষ্ট কথা,—আমার ব্যবস্থা না হ’লে আমি কারো খাতির কর্বো না, নবাবকে সব জানাবো।
ওয়াট্স। আপনি কি বলিতেছেন, মনসা পূজা!—হইবে না? আপনার share আগে! আপনি কত টাকা চান?
উমি। কত টাকা কি সাহেব! আমার ত্রিশ লাখ টাকা চাই। সন্ধিপত্রের ভিতর লেখা দেখ্বো, তবে নিশ্চিন্ত হবো।
ওয়াট্স। হাঃ হাঃ উমিচাঁদবাবু, এইজন্য এত গরম? আপনার বড় অনুগ্রহ! আমরা ভাবিয়াছিলাম, পঞ্চাশ লাখ আপনি মাগিবেন। এই কাগজটা দেখেন, আমি ত্রিশ লাখ টাকা বসাইয়া দিতেছি, Council তাহা গ্রাহ্য করিবে। এই দেখুন, লিখিপড়ি রহিয়াছে।
উমি। আর নবাবী জহরৎ যা পাওয়া যাবে, তার সিকি আমার।
ওয়াট্স। জহরতখানা তো আপনারই, এই লিখিয়া দিতেছি। (জাল সন্ধিপত্রে লিখিয়া) এখন খোস হইয়াছ? একটু হাসি করো।
উমি। আমি জানি—জানি—জানি, ক্লাইব সাহেবের আমার প্রতি বড় অনুগ্রহ।
ওয়াট্স। তবে কি মোশা—সে বাত এখন কি বুঝিতেছেন? লড়াই ফতে হইলে কর্ণেল ক্লাইব, আপনার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করেন দেখিবেন, চমৎকৃত হইয়া যাইবেন, ঠিক রকম বুঝিবেন—কেতো বড় লোক!
উমি। হ্যাঁ সাহেব—হ্যাঁ সাহেব—তোমরা বরাবর অনুগ্রহ করো—তোমরা বরাবর অনুগ্রহ করো।
ওয়াট্স। আপনি ও কি বলিতেছেন? বাঙ্গলায় হামাদের কারবার কে শিখাইল? লেকেন একটা কথা, আপনার জন্যে আমার বড় ভাবনা হইয়াছে। নবাব এ সব সল্লা মালুম করিলেই হাঙ্গামা করিবে। আমরা সাহেব লোক ঘোড়া চড়িতে জানে, ঘোড়ার পিঠে পলাইবে। আপনি মোটা আদমি, কিরূপে যাইবেন? পাল্কীতে যাইতে বিলম্ব হইবে, আপনি আজই সরিয়া পড়ুন।
উমি। বেশ বলেছ সাহেব, ঠিক বলেছ, আজই আমি ষোলটা বেহারা ঠিক ক’রে পালাবো। দেখি দেখি, আর একবার সন্ধিপত্রটা দেখি।
ওয়াট্স। দেখুন—দেখুন,—যতক্ষণ না চক্ষু ক্লান্ত হইয়া বুজিয়া আইসে, দেখুন,—Here—Thirty Lakhs—Sir, in black and red.
উমি। আর জহরতের কথা—জহরতের কথা?
ওয়াট্স। Here Sir—here—one forth share. আজি হইতে আপনাকে রাজা উমিচাঁদ বলিব। Clive সাহেব জরুর আপনাকে রাজা বাহাদুর করিবেন, হ্যাঁ—এ কথাটা দেখিয়া লইবেন।
উমি। আমি চল্লুম। (যাইতে যাইতে পুনরায় ফিরিয়া)—দেখি দেখি, লিখ্তে ভোলেন নি তো, লিখ্তে ভোলেন নি তো?
ওয়াটস্। না—না, নাকের উপর ত্রিশ লাখ, দেখিতেছেন না?
উমি। আর চার আনা জহরত?
ওয়াট্স। হ্যাঁ উমিচাঁদবাবু, হ্যা রাজা উমিচাঁদ।
উমি। তবে চল্লুম, আজই রওনা হবো; টাকাটা কিন্তু একেবারে নেব।
ওয়াট্স। নয় তো কি বিশ দফা? মীরজাফর খাঁ গদী পাইলে, হামাদের টাকা লিবো, আপনার টাকা লিবেন।
উমি। একেবারে ত্রিশ লাখ?
ওয়াট্স। সকল কথা খোলা রহিয়াছে, আপনি পাঠ করিলেন।
উমি। তবে চল্লেম। (স্বগত) ত্রিশ লাখ, আর জহরতের চার আনায়—অন্ততঃ লাখ ত্রিশ—এর কম হবে না, এই ষাট লাখ। পুরোপুরি ক্রোড় টাকা হ’লেই হতো!
ওয়াট্স। আর কি ভাবিতেছেন?
উমি। হ্যাঁ হ্যাঁ এই চল্লেম, এই চল্লেম। (স্বগত) ষাট আর লাখ চল্লিশ হ’লেই ঠিক হতো!
প্রস্থান
ওয়াট্স। The first born of an infernal bitch!
আমির বেগমের পুনঃ প্রবেশ
আমির। সন্দেহ করে নি তো?
ওয়াট্স। সাহেব, হাম লোক কাজ করিতে জানে। In the name of Christ, সয়তানকে ভুলাইতে কেত্তা দেরী!
আমির। তা যাও, এখন মীরজাফরের সই ক’রে নিয়ে এসো—আজই আমি যাবো, ডাক বসিয়ে এসেছি।
ওয়াট্স। আমি কেমন করিয়া যাইব ভাবিতেছি! আমি মীরজাফরের বাড়ী যাইলে, নবাবের spy দেখিবে। খাঁ সাহেব কাজ ছাড়িয়া বাড়ীতে বৈঠিয়া আছে, দরবার যায় না, কড়াকড় পাহারা রহিয়াছে, কেমন করিয়া দেখা করিব? তুমি খাঁ সাহেবের মুক্তিয়ার, তুমি যাইয়া সই করো।
আমির। না সাহেব, দেখছো না, আমি গোপনে হিন্দু পোষাকে এসেছি? মোহনলালের লোক আমায় দেখলেই প্রাণবধ কর্বে।
ওয়াটস। তবে কি করা যাইতে পারে?
জহরার প্রবেশ
জহরা। সাহেব, কাগজ জাল কর্তে পারো, আর আপনাকে জাল কর্তে পারো না? আপনাকে জাল করো, বেগম সাজো,—এই বেগমের পোষাক নাও। পাল্কীতে চলো, আমি তোমার সঙ্গে বাঁদী হ’য়ে যাবো। পাল্কী প্রস্তুত ক’রে রেখেছি, এসো, এখনি চলো।
ওয়াটস। তুমি কে?
জহরা। আমায় চেন না? কলিকাতার নিশিযুদ্ধে তোমাদের কে পথ দেখিয়ে ল’য়ে গিয়েছিল?
ওয়াট্স। হাঁ বিবি, হাঁ বিবি, সেলাম!
জহরা। আমি বিবি নই—সয়তানী! এসো—
ওয়াট্স (স্বগত) Yes! just the devil's sweet-heart!
জহরা। সাহেব তুমি কি ভাবছো বুঝেছি। ভাব্ছ সত্য সয়তানী। হ্যাঁ! সত্য সয়তানী,—প্রতিহিংসা-উদ্দীপ্তা রমণী!—কাল-ফণিনী—সন্তাপিনী—পতি বিরহিনী!!
সকলের প্রস্থান