সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/দ্বিতীয় অঙ্ক/ষষ্ঠ গর্ভাঙ্ক
(পৃ. ৯৩-১০০)
ষষ্ঠ গর্ভাঙ্ক
কলিকাতা—গড়ের মাঠ
তদূরে নবাবের সৈন্য-শিবির
করিমচাচার প্রবেশ
করিম। (আকাশের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া) এই যে তারার ঝাঁক দেখা দিয়েছে। সন্ধ্যাবেলা থেকে আকাশে উঠে তো ভোর রাতটা জাগো, একটু আফিং-টাফিং খাও না কি? অন্ধকার রাত্রেই তোমাদের কিছু বাহার বেশী, চোরের মাসতুতো ভাই ছিলে না কি? এতদিন তোমাদের সঙ্গে আলাপ, ভোর রাত জেগে আলাপ কচ্ছি, কিন্তু চিন্তে পার্লেম না চাঁদ। প্যাট্ প্যাট্ ক’রে চেয়ে কি দেখছ? দেখ বাবা,—সমুদ্রের গর্ভে নজর যাবে, কিন্তু মানুষের পেটের মধ্যে সেঁধোনো তোমাদের কর্ম্ম নয়। বড় জবর মাটির দ্যাল, বুঝেছ বাবা! ও,—তোমাদের পাহারা দিতে রেখেছে। তোমাদের আকাশে বুঝি যুদ্ধ-হাঙ্গামা নাই? তাহ’লে বাবা ঘুমিয়ে পড়তে। এই সব দেখ না, নবাবী ফৌজের তাঁবু পড়েছে, বেবাক পাহারাওয়ালা নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে; দু’পিপে মদ খেলেও অমন ঘুম আসবে না। লড়াই দাঙ্গাটা বড় ঘুমের ওষুধ দেখ্ছি। নবাব থেকে ঘেসেড়া ব্যাটা পর্য্যন্ত তোফা নাক ডাকাচ্ছে। দেখ দেখ—এই কেল্লার দিক্টে মিট্মিটে আলো কি বলো দেখি? ওদের বিলিতি ধাত, দিশি ওষুধ খাটে না, লড়াই দাঙ্গা বাধলে বড় ঘুমোয় না। (ক্রমশঃ কুজ্ঝটিকায় দিক্ আবৃত হওন) এই যে তোমরাও দিব্যি কোয়াসার তাঁবুর ভিতর গা ঢাকা দিলে। একটু ঘুমুবে বোধ হ’চ্ছে। তোমাদেরও যুদ্ধ-হ্যাঙ্গাম বাধ্লো নাকি, নইলে খামকা এতটা ঘুম এলো কেন?
জহরার প্রবেশ
জহরা। কে তুমি?
করিম। প্রেয়সি, এতদিনে কি আমায় মনে পড়লো?
জহরা। কে তুমি?
করিম। কেন চাঁদ, চিন্তে পাচ্ছ না? আমি আফ্গানি আমলের বাঙ্গ্লার নবাব, মাম্দো হ’য়ে এই গাছটিতে থাকি। তোমার মতন আমার পেত্নী বেগম ছিল। আজ মাসকতক কে এক ব্যাটা গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আমার গৃহশূন্য করেছে। যখন এসে পড়েছ বিধুমুখী, চলো নিকে ক’রে, ডালে গিয়ে শুই। ঐ দেখ বেগমেরা পাতায় মহল ক’রে আছে, ঝর ঝর ক’রে রিশ জানাচ্ছে। চলো, নীচের ডালে গিয়ে শুই।
জহরা। করিম চাচা, নবাবী শিবির কোন্টা বলতে পারো?
করিম। কেন চাঁদ, নবাবী গাছের ডাল তোমার পছন্দ হচ্ছে না? তুমি গুয়ে পেত্নীর বাচ্ছা, পায়খানায় থাকো, কখনো গাছের ডালে শোও নি, তা হলে আরাম পেতে। যদি প্রেম ক’র্তে হয় তো গাছের ডালে,—এমন পীরিত কোথাও হয় না।
জহরা। করিম চাচা, তুমি বড়মানুষ হ’য়ে যাবে, যা চাও পাবে।
করিম। মানুষ ছিলেম, মাম্দো হয়েছি, আবার মানুষ কি করে হই বাবা! এসো মাম্দো পীরিত করি এসো। (নেপথ্যে তোপধ্বনি)—ঐ শোনো, আমাদের নিকের তোপ হচ্ছে।
জহরার প্রস্থানোদ্যোগ
গুয়ে পেত্নী প্রাণ, যদি মেছো পেত্নী হ’তে, তাহ’লে এই কোয়াসায় তোমায় মৎস্যগন্ধা করতেম। তা এ গাছের ডাল যদি পছন্দ না হয়, তবে তোমায় সেওড়াগাছেই চলো, আমি তোমার নির্ঘ্যাত পীরিতে পড়েছি।—(নেপথ্যে কলরব বুদ্ধি)
জহরার প্রস্থান
এই যে, এতক্ষণে নবাবী ফোজের নেশা ছুটেছে। এখানে বাবা বড় ঝাঁজ, সর্ষে পোড়া দিয়েছে। এখন কোন্ দিকে সরি, আওয়াজ ত চারদিকেই।মীরজাফর, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ
রাজবল্লভ প্রভৃতির প্রবেশ
মীরজাঃ। সর্ব্বনাশ হলো—সর্ব্বনাশ হলো! চতুদ্দিক হ’তে গোলাবর্ষণ হচ্ছে, অন্ধকারে শত্রু-মিত্র দেখা যাচ্ছে না। কোথায় যাই! কেন ষড়যন্ত্র ক’রে সন্ধি ভঙ্গ কর্লেম
করিম। ঐটুকু প্যাঁচ করেছ। ইংরাজ যেমন সদালাপী, ওদের গোলা তেমন নয়। এখানে আলাপ কর্তে এলেই কিছু প্যাঁচ। তবে দেখ চাচারা, যখন লড়্তে এসেছ, গাঙ্গ্পার হ’য়ে চ’লে গিয়ে, ডন্ ফেলগে।
করিম ব্যতীত সকলের প্রস্থান
নবাবীটে আমারই সাজে। যে ব্যাটার তিন কুলে কেউ নাই, সেই তো বাঙ্গ্লার নবাব। সিরাজদ্দৌলার এখন তবু এক আধ ব্যাটা আছে, নিদেন বেগমগুলো। আমার বাবা তিন কুলে কেউ নাই, আমিই পাকা নবাব। এই বোঝ না কেন বাবা, নবাবটা কোথায় তা একবার কেউ খোঁজ নিলে না।করিমের প্রস্থান
সিরাজদ্দৌলা, মীরমদন ও সৈন্যগণের প্রবেশ
সিরাজ। মীরমদন কি হবে, কি হবে! কোথা যাব!
মীরমঃ। জনাব, কোন শঙ্কা নাই। ইংরাজ-সৈন্য বিমুখ হয়েছে, ও আমাদের তোপধ্বনি। এইখানে অপেক্ষা করুন। আমি এখনই ইংরাজের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়ে কেল্লার ভিতর প্রবেশ করি। আজই ইংরাজ ধ্বংস হবে।
সিরাজ। না মীরমদন, যেও না, ইংরাজ ধ্বংসে আমার প্রয়োজন নাই। এই নবাবী—এই সুখের আশায় উন্মত্ত হয়েছিলেম! দিবারাজ কণ্টক-শয্যায় শোবার জন্য নবাবী গ্রহণ করেছিলেম!
মীরমঃ। জনাব জনাব, অমন কচ্ছেন কেন? অনেক দুর্গম রণে নির্ভয় অন্তরে সৈন্য সঞ্চালন করেছেন। ইংরাজ পরাস্ত;—ঐ শুনুন, বিপক্ষের তোপধ্বনি নাই। মুহুর্মুহুঃ আমাদেরই কামান গর্জ্জন হচ্ছে! একটু স্থির হোন, আমি সমূলে ইংরাজ উচ্ছেদ করি।
সিরাজ। মীরমদন মীরমদন, আমি ভীরু নই। দুর্গম রণসন্ধিতে আমাকে নির্ভয়ে প্রবেশ করতে দেখেছ। কিন্তু ফিরিঙ্গি নামে আমার দেহ কম্পিত হয়। সহস্র সহস্র তোপধ্বনির মধ্যে যদি একটী ইংরাজের তোপের শব্দ হয়, আমি তা বুঝতে পারি;—সে শব্দে আমার আপাদমস্তক কম্পিত হয়। দৈত্য, দানব, প্রেত, ভূত স্বদলে আমার সম্মুখে উপস্থিত হ’লে, আমি অসিহস্তে তাদের আক্রমণ কর্তে প্রস্তুত। কিন্তু ইংরাজ, কোন্ সয়তান বংশে জন্ম কে জানে, এরা কি যাদুকর? কোন কুহকবলে আমার বিপুলবাহিনী আক্রমণ করতে সাহস কর্লে! ইংরাজ কুশলে থাকুক, ইংরাজ বলবান হোক, যারা আমার সিংহাসন ঈর্ষা করে, তারা আমার সেই সিংহাসনে বসুক, ইংরাজ তাদের শত্রু হোক, দিবারাত্র আমার ন্যায় কণ্টকাসনে উপবিষ্ট হ’য়ে, ইংরাজ সম্মুখে দেখুক!
মীরমঃ। জনাব, তুচ্ছ ফিরিঙ্গি, জনাবের নফরের নফর যোগ্য নয়। বর্ব্বরতা বশতঃ আক্রমণ করেছিল, হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হ’য়ে আক্রমণ করেছিল, নিরুপায় হ’য়ে আক্রমণ করেছিল,—আজ্ঞা দিন, হস্তী-পৃষ্ঠে যুদ্ধ দর্শন করুন, মুহূর্ত্ত মধ্যে ফোর্ট উইলিয়ম ধূলিসাৎ কর্বো। জনাব, আপনার এই দশা দেখে আমার মৃত্যু ইচ্ছা হচ্ছে। প্রকৃতিস্থ হোন; বঙ্গেশ্বর আড্ডা দিন, স্বয়ং সয়তান স্বদলবলে ইংরাজের সাহায্য কর্লে, আজ নিস্তার পারে না,—কেবলমাত্র আজ্ঞা দিন, এই প্রার্থনা। জনাব প্রকৃতিস্থ হোন।
সিরাজ। মীরমদন তুমি জান না, মোগলবংশ উচ্ছেদ করতে ইংরাজ জন্মগ্রহণ করেছে। শিক গুরু তেগ্ বাহাদুরের অভিশাপ তুমি কি অবগত নও? শ্বেতকায় অর্ণবযানে এসে, মোগলবংশ উচ্ছেদ করবে। মহাপুরুষের অভিশাপ, সে অভিশাপ কখনও খণ্ডন হবে না। মোগলবংশ উচ্ছেদের জন্য ইংরাজ ভারতবর্ষে এসে উপস্থিত।
করিমের পুনঃ প্রবেশ
করিম। সূর্য্যোদয় হয়েছে, চাচারা বোধ হয় বারাণসী তুল্য গঙ্গার পশ্চিম পার হ’তে গঙ্গা দর্শন ক’রে নবাব দর্শনে আসছেন। চাচারা কেঁদে এখনি লুটোপুটি খাবে, আমায় শান্ত করতে হবে। ঐ যে সব চোখ ডব্ ডব্ করছে, কাণা মেঘের জল কোথায় লাগে!
মীরজাফর, রায়দুর্ল্লভ, রাজবল্লভ জগৎশেঠ, মহাতাবচাঁদ ও
স্বরূপচাঁদের পুনঃ প্রবেশ
সকলে। জগদীশ্বর রক্ষা করুন, এই যে নবাব!
রায়দুঃ। বড়ই ব্যাকুল হয়েছিলেম!
জগৎ। ভগবান রক্ষা করেছেন!
করিম। এখন তো প্রাণটা ঠাণ্ডা হলো। আমি রুমাল বাগিয়ে রেখেছিলুম, ভেবেছিলুম, চাচারা কাঁদবে, চোখ মোছাবে কে?
সিরাজ। রাজা রায়দুর্লভ! এই দণ্ডে সন্ধির প্রস্তাব ক’রে, ইংরাজশিবিরে দূত প্রেরণ করুন। যে স্বত্বে ইংরাজ সন্ধি করতে প্রস্তুত, সেই স্বত্বে সন্ধি হোক।
মীরজাঃ। জনাব,—
সিরাজ। আর জনাব নয়। কাল-রজনী প্রভাত হয়েছে,—সূর্য্যোদয়ে প্রকৃতিস্থ হয়েছি। বুঝেছি ইংরাজ সামান্য নয়; এ অপেক্ষা শতগুণ সৈন্য ল’য়ে ইংরাজ পরাস্ত করা আমাদের সাধ্য নয়। এই দণ্ডেই সন্ধি হোক্। তোমরা এই স্থানে অবস্থান করো, সন্ধি-পত্র আমাদের নিকট প্রেরণ ক’রো; আমরা স্বাক্ষর কর্বো। আর বলবীর্য্য প্রকাশে প্রয়োজন নাই! সূর্য্যোদয়ে যেমন গ্রহজ্যোতি নির্ব্বাপিত হয়, ইংরাজ উদয়ে সেইরূপ ভারতবীর্য নির্ব্বাপিত! ভারত-স্বাধীনতা ইংরাজের পদতলে। ঘোর নিশায় অচিরে ভারত আবরিত হবে। কালচক্র পরিবর্ত্তনে কারো সাধ্য নাই। অদ্যই যেন সন্ধিপত্র আমার নিকট প্রেরিত হয়। যাও যাও বিলম্ব করো না, এই দণ্ডেই দূত প্রেরণ করো।
অমাত্যগণের প্রস্থান
মীরমঃ। হা জননী জন্মভূমি!
সিরাজ। মীরমদন আক্ষেপ ক’রো না, আক্ষেপে আর উপায় নাই। যে দিন ইংরাজের জলতরী, বাঙ্গ্লার বন্দরে উপস্থিত হয়েছে, সেই দিন আশা-ভরসা বিলুপ্ত। ভারতবাসী ভারতবাসীর যুদ্ধে ক্লান্ত! মহারাষ্ট্রীয়েরা বলীয়ান—ভারতবাসী! তাদের দৌরাত্ম্যে বাঙ্গলা জজ্জরীভূত;—তাদের দৌরাত্ম্যে ইংরাজের ফোর্ট উইলিয়ম নির্ম্মিত হয়েছে,—ভারতবাসীর দৌরাত্ম্যে ইংরাজের বলবৃদ্ধি। বাল-সূর্য্যের কিরণে মধ্যাহ্ণ-তপনের তাপ অনুভব কর্তে পাচ্ছি না। ভারত বিচ্ছিন্ন! ভারতসন্তান পরস্পরের শত্রু! উদ্যমশীল, একতায় আবদ্ধ, উদ্যোগী পুরুষসিংহ—কার সাধ্য তাদের দমন করে!
মীরমঃ। জনাব, তুচ্ছ শত্রুর কেন প্রশংসা কচ্ছেন? বাঙ্গলায় কি বীর-বীর্য্য বিলুপ্ত, আপনার সৈন্য কি অস্ত্র ধারণে অক্ষম? বাঙ্গলার বীরত্ব শত রণে পরীক্ষিত; জনাব, তবে কেন উৎসাহহীন হচ্ছেন? কৃতদাস এখনো জীবিত, এখনো সৈন্য সঞ্চালনে অক্ষম নয়, পিধানে অসি আজ্ঞা-প্রতীক্ষায় বিচঞ্চল। ইষ্টক নির্ম্মিত ফোর্ট উইলিয়াম্, বীর প্রবাহ রোধ কর্তে সক্ষম হবে না। তবে কেন শত্রুর গৌরব বর্দ্ধন ক’রে, সন্ধির প্রস্তাব কচ্ছেন? তবে কেন ইংরাজ অজেয় বিবেচনা কর্চ্ছেন? তবে কেন মাতৃভূমি, ফিরিঙ্গির ভয়ে ভীত প্রচার কচ্ছেন? তবে কেন জন্মভূমির পরাধীনতার আভাস প্রদান কর্চ্ছেন?
সিরাজ। না মীরমদন, জন্মভূমির আশা বিলুপ্ত। যদি কখনো সুদিন হয়, যদি কখনো জন্মভূমির অনুরাগে হিন্দু-মুসলমান ধর্ম্মবিদ্বেষ পরিত্যাগ ক’রে, পরস্পর পরস্পরের মঙ্গল সাধনে প্রবৃত্ত হয়, উচ্চ স্বার্থে চালিত হ’য়ে, সাধারণের মঙ্গল যদি আপন মঙ্গলের সহিত বিজড়িত জ্ঞান করে, যদি ঈর্ষা, বিদ্বেষ, নীচ প্রবৃত্তি দলিত ক’রে স্বদেশবাসীর অপমানে আপনার অপমান জ্ঞান করে, যদি সাধারণ শত্রুর প্রতি একতায় খড়্গহস্ত হয়,—এই দুর্দ্দম ফিরিঙ্গি দমন তখন সম্ভব; নচেৎ অভাগিনী বঙ্গমাতার পরাধীনতা অনিবার্য্য! মীরমদন, আক্ষেপ ত্যাগ করো। জেনো, বাঙ্গ্লায় সকলেই মীরমদন নয়।
উভয়ের প্রস্থান