সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/তৃতীয় অঙ্ক/প্রথম গর্ভাঙ্ক

তৃতীয় অঙ্ক

——):•:(——

প্রথম গর্ভাঙ্ক

মুর্শিদাবাদ—নবাব-দরবার

সিরাজদ্দৌলা, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ, মাণিকচাঁদ, মুঁসালা ও দূত

সিরাজ। (পত্র পাঠ ও পত্র খণ্ড খণ্ড করিয়া) ওয়াট্‌সকে তলপ দাও, ইংরাজ উকীলকে তলপ দাও।
দূত। জনাব, তাঁরা দু’জনেই আজ্ঞা-প্রতীক্ষার অপেক্ষা কচ্ছেন।
সিরাজ। ল’য়ে এসো।
দূতের প্রস্থান
দেখুন ইংরাজের স্পর্দ্ধা।

ওয়াট্‌স ও ইংরাজ-উকীলের প্রবেশ

ওয়াট্‌স্, তোমাদের বড় দম্ভ! বাঙ্গলার নবাবকে ভয় প্রদর্শন করো? তোমরা কে? এই ফরাসী মুঁসালা আমার আশ্রিত, এর সমভিব্যাহারী অপরাপর ফরাসীরাও আমার আশ্রিত। তোমরা বিনা অনুমতিতে চন্দননগর অধিকার কর্‌বার পর এরা আমার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। অপ্রিয় পরিত্যাগ না করলে সন্ধি ভঙ্গ হবে? হোক,—এই মুহূর্ত্তে সন্ধিভঙ্গ হোক। তোমার শূলদণ্ড আজ্ঞা হবে। উকীল, তুমি এই মুহূর্তে নবাব-দরবার পরিত্যাগ করো আমার দরবার হ’তে দূর হও।
উকীলের প্রস্থান

ওয়াট্‌স্, তোমাদের অপরাধ জানো? নবাবের অনুমতি ব্যতীত চন্দননগর আক্রমণ করেছ, এখন নবাবকে যুদ্ধভয় প্রদর্শন করছ? ভেবেছ আফগান আহম্মদ সাহ আবদালিকে দমন কর্‌তে, আমাদের বেহার প্রদেশে যাত্রা করতে হবে, যুদ্ধার্থে প্রস্তুত নই, তাই ক্লাইব দম্ভ ক’রে পত্র লিখেছে! ক্লাইবকে লিখো,—বিনাযুদ্ধে আফ্‌গান ভঙ্গ দিয়েছে,—আমরা যুদ্ধার্থে প্রস্তুত। কলিকাতায় সত্বর উপস্থিত হবো। যাও, যাও—আর তিলমাত্র বিলম্ব করো না।

ওয়াট্‌সের প্রস্থান
মাণিকচাঁদ, তোমার এত বড় স্পর্দ্ধা, তুমি কলিকাতা-লুণ্ঠনের দ্রব্য সামগ্রী, নবাব সরকারে প্রদান না ক’রে আত্মসাৎ করেছ? তার খেসারৎ ক্লাইব আমাদের উপর দাবী করে। আলিনগরের সন্ধিপত্রে আমরা সেই ক্ষতিপূরণে স্বীকৃত। ধূর্ত্ত, প্রবঞ্চক—তোমার উপযুক্ত শান্তি এই দণ্ডে প্রদান করবো।
মাণিক। জনাব, বান্দার কি সাধ্য, যে নবাবী দ্রব্য আত্মসাৎ করে।
সিরাজ। কে আছ,—শঠ, ধূর্ত্ত, প্রবঞ্চক, অর্থপিশাচকে কারাগারে ল’য়ে যাও। কাল প্রাতে শিরচ্ছেদ হবে।
দুই জন প্রহরীর প্রবেশ ও মাণিকচাঁদকে লইয়া প্রস্থান
মীরজাঃ। জনাব, নবাবের বদান্যতার উপর নির্ভর ক’রে নবাব-ভৃত্য নবাবী দ্রব্য আত্মসাৎ করেছে। ভৃত্যের এরূপ কার্য্য বরাবরই মার্জ্জনা হয়েছে। অর্থদণ্ড ক’রে প্রাণবধের হুকুম মকুব করুন।
সিরাজ। কত অর্থ দিতে প্রস্তুত?
রাজবঃ। নবাবের যেরূপ আজ্ঞা।
সিরাজ। ভাল, তারে দরবারে আনয়ন করা হোক।
রাজবল্লভের প্রস্থান
মুঁসালা সাহেব, তোমার কি মত?
মুঁসালা। নবাবের বিবেচনার উপর বাক্য কহিব, এমন সাহস রাখেনা।

মাণিকচাঁদকে লইয়া রাজবল্লভের পুনঃ প্রবেশ

মীরজাঃ। রাজা মাণিকচাঁদ, নবাব অনুগ্রহপূর্ব্বক আমাদের কথা রক্ষা করেছেন। আমরা অনুরোধ করায়, আপনার প্রাণদণ্ড মার্জ্জনা হয়েছে। কিন্তু কলিকাতা লুণ্ঠন দ্রব্যের কোন হিসাব পাওয়া যায় না। সে ক্ষতিপূরণের নিমিত্ত আপনি কত অর্থ দণ্ড দিতে প্রস্তুত?
মাণিক। আজ্ঞে এখনিই প্রস্তুত, এখনই প্রস্তুত। পঞ্চাশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে এখনই প্রস্তুত।
করিম। চাচা, তোমার মাথাটার দাম কি লাখ্ টাকাও নয়?
মাণিক। এত টাকার আমার সঙ্গতি কোথায়?
রায়দুঃ। নবাব যা অর্থদণ্ড করেন, তা দিতে প্রস্তুত হোন, আপনার মঙ্গলের নিমিত্তই বলা হচ্ছে। জনাবের আজ্ঞা হোক।
সিরাজ। দশ লক্ষ টাকা দিতে প্রস্তুত হও। মন্ত্রীবর্গের অনুরোধে তোমার দোষের অতি সামান্য দণ্ড প্রদান করুলেম।
মাণিক। এত টাকা কোথায় পাবো—এর চেয়ে আমার প্রাণদণ্ড ভাল ছিল।
মীরজাঃ। রাজা, অবুঝ হবেন না। যদি সম্মত না হ’ন, আপনার সম্পত্তি নবাব গ্রহণ কর্‌বেন, প্রাণদণ্ডও মার্জ্জনা হবে না।
রাজবঃ। জনাব, আদেশ পেলে, আমি এই দশ লক্ষ টাকা আদায়ের ভার গ্রহণ কর্‌তে প্রস্তুত।
সিরাজ। যান, অর্থপিশাচকে ল’য়ে যান।
মাণিকচাঁদকে লইয়া রাজবল্লভের প্রস্থান
সিরাজ। ইংরাজের স্পর্দ্ধার কথা শুনেছেন, এখন কি কর্ত্তব্য?
মীরজাঃ। জনাব, যখন রাজ্যের মঙ্গলার্থে সন্ধি স্থাপন হয়েছে, এ সময়ে সামান্য কারণে ইংরাজের সহিত বিবাদ উচিত নয়।
সিরাজ। কি, সামান্য কারণ! রাজা শরণাগতকে রক্ষা কর্‌বেন না?
মীরজাঃ। জনাব, যথাজ্ঞানে নিবেদন করেছি। আফগান আহম্মদ সাহ আবদালী দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেছে সত্য, এক্ষণে ইংরাজের সহিত বিবাদ শ্রবণে প্রত্যাগমন কর্‌তে পারে;—এক কালে দুই শত্রু করা যুক্তিযুক্ত নয। বোধ হয় সমস্ত অমাত্যবর্গ আমার মতের অনুমোদন কর্‌বেন।
স্বরূপ। জনাব, খাঁ সাহেবের পরামর্শ যুক্তিযুক্ত।
রায়দুঃ। অনর্থক ইংরাজের সহিত যুদ্ধ-বিগ্রহে প্রজার গুরুতর অমঙ্গল। জনাব প্রজারক্ষক, বিস্তর ক্ষতি স্বীকার ক’রে, প্রজার নিমিত্ত নিশাযুদ্ধের পর আলিনগরের সন্ধি সংস্থাপন করেছেন। সে সন্ধি ভঙ্গ এ পক্ষ হ’তে না হয়। সন্ধিভঙ্গ ইংরাজের দ্বারাই হোক, আফগান সৈন্যও দিল্লীতে প্রত্যাগমন করুক। দেখা যাক—ইংরাজের কতদূর বৃদ্ধি!
সিরাজ। আপনারা দরবার পরিত্যাগ ক’রে ক্ষণকাল কক্ষান্তরে অপেক্ষা করুন। (মুঁসালার প্রতি) মুঁসালা, যাবেন না, আপনার সঙ্গে পরামর্শ আছে।
সিরাজ, মুঁসালা ও করিম ব্যতীত সকলের প্রস্থান
মুঁসালা। (করিম চাচাকে লক্ষ্য করিয়া) জনাব, এঁর দরবারে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন অনুমান হয়?
সিরাজ। ইনি আপনাদের বন্ধু। মুঁসালা, আপনি অতি ন্যায্য কথাই বলেছিলেন। আপনার কথামত ক্লাইবকে পত্র লেখা হয়, যে নানাজাতি লোক নবাবের কার্য্যে নিযুক্ত আছে,—কয়েকজন ফরাসী নবাব-কার্য্যে নিযুক্ত থাকায় সন্ধি ভঙ্গ হয় না। তাতে দুষ্ট ক্লাইব উত্তর দিয়েছে, যে যারা ইংরাজের শত্রু তারা নবাবের শত্রু হওয়া উচিত। ইংরাজের শত্রুকে যে আশ্রয় দেবে, সে ইংরাজের শত্রু। দরবারেও সকলের মত শ্রবণ কর্‌লেন।
মুঁসালা। জনাব, বান্দা শুন্‌লে, লেকেন জনাবের দরবারে সব জনাবের দুশমন, ইংরাজের সহিত সলা করিতেছে, এ কথা আমি প্রমাণ করিতে প্রস্তুত। আমরা নবাবী কার্য্যে থাকিলে, নবাবী ফৌজকে যুদ্ধ শিখাইলে, নবাবের পক্ষে লড়িলে, ইংরাজ হারিয়া যাইবে,—সেই জন্য হামাদিগকে তাড়াইতে চায়, হাল এই:—জনাব যাহা ভাল বুঝিবেন করিবেন। ভাবিয়া দেখুন, কেহই নবাবী আজ্ঞা পালন করে না। নন্দকুমারকে হামাদের চন্দননগর রক্ষার্থে হুকুম দেন, মাণিকচাঁদকে বি পাঠান, কিন্তু উমিচাঁদ ইংরাজ পক্ষ হইতে আসিয়া সব খারাপি করিয়া দিল, কেউ আমাদের ওয়াস্তে অঙ্গুলি তুলিল না। যদ্যপি ফরাসী রাজ্যে কেহ এরূপ অবাধ্য হইত, তাহা হইলে তোপে উড়াইয়া দেওয়া হইত।
করিম। সাহেব এইটুকু যদি বুঝ্‌তে, তা’হলে পল্‌তায় ইংরাজের রসদ জোগাতে কি?
মুঁসালা। হাঁ সাহেব চুক হইল। ইউরোপে ইংরাজ আমাদের পড়সি, এক ধর্ম্ম মানে, তাহারা খানা বেগর মরে, দেখিতে পারিল না।
করিম। সাহেব, তোম্‌রা রং করেছ, না তোমাদের ঐ রকম সাদা রং?
মুঁসালা। এ কিরূপ প্রশ্ন?
করিম। কেন সাহেব, এই ক’বছর ধ’রে তোমাদের মত সাদা রঙ্গের ইংরেজ দেখে আস্‌ছি। তাদের এক জনের মুখেও তো শুনি নাই, যে তোমরা পড়সি, তোমাদের এক ধর্ম্ম;—তোমাদের রং তো সমান দেখ্‌ছি, ব্যাভারটা এমন হলো কেন?
সিরাজ। দেখুন মুঁসা লা, মন্ত্রীদের মন্ত্রণা আমরা সম্পূর্ণ অবগত। সেই নিমিত্তই বিবেচনা কচ্ছি, ইংরাজের সহিত সন্ধি ভঙ্গ না ক'রে কপট মন্ত্রীদের অগ্রে দমন করা যাক।
মুঁসালা। জনাব, এখনি দমন করিয়া দেন, ইংরাজ ভয় পাইয়া যাইবে। ইহাদের দমন করিলে, আর কেহ ইংরাজের সাহায্য করিতে আগু হইবে না।
সিরাজ। মুঁসালা, অমাত্যেরা সকলে সম্ভ্রান্ত, এদের কৌশলে দমন করা প্রয়োজন;—নচেৎ একটা বিদ্রোহ উপস্থিত হবে।
মুঁসালা। জনাব, গোস্তাকি মাপ হয়,—কৌশল উহাদের সহিত চলিবে না। যতই কৌশল করিবেন, তলে তলে উহারা যাস্তি কৌশল করিবে।
করিম। সাহেব রং মেখেছ,—সাদা মুখে ওমন সরল কথা বেরোয় না! তোমরা ইংরাজের সঙ্গে মিটিয়ে ফেলো, ওদের পারবে না। এক হাত গলায় আর এক হাত পায়ে দেওয়া, তোমাদের কর্ম্ম নয়।
মুঁসালা। সাহেব, আপনি অতি বিজ্ঞ। ইংরাজ-চরিত্র সম্পূর্ণ বুঝিয়াছেন। যদি আপনার মত নবাবী কার্য্যে দুই চারি আদ্‌মি থাকিত, আলিনগরের সন্ধি হইত না, ইংরাজ কলিকাতায় থাকিত না।
করিম। সাহেব, তাহ’লে তোমাদেরও একটু প্যাঁচ পড়তো, চন্দননগর হ’তে রসদ বেচ্‌তেও পার্‌তে না। কিন্তু দেখ্‌লেম খালি রসদই বেচ’—প্যাঁচোয়া চাল তোমাদের আসে না;—তাহ’লে বল্‌তে—‘এই আমাদের ফৌজ এলো বলে, এই আমরা কোলকাতা উড়িয়ে দেবো।’ নবাবী আম্‌লাদের টাকা দিয়ে—থুড়ি, কতক দিয়ে কতক কব্‌লে হাত কর্‌তে নবাবকেও একটু আধটু শাসাতে।
মুঁসালা। ও ইংরেজ পারে, আমরা লোক পারি না! আপনি ঠিক রাজমন্ত্রীর যোগ্য।
করিম। ঠিক বলেছ, আমি মন্ত্রী হ’লে যেমন ক’রে পারি, আগেই নবাবকে ফের মদ ধরাতুম।
মুঁসালা। না, না, ম’শায় আপনাকে আপনি খাটো করিতেছেন, আপনা হইতে এরূপ বুরা কাজ হইত না।
করিম। সাহেব বুরা কাজ কি? তুমি বুঝ্‌তে পাচ্ছ না। বুড়ো আলিবর্দ্দীর আমলে মারহাট্টারা চারিদিকে ঘিরে ফেল্‌লে, সকলে শশব্যস্ত কি হয় কি হয়। আমাদের নবাব বাহাদুর দু’পেয়ালা মদ টেনে, ঘোড়ায় চড়ে ধাঁ ক’রে লড়াইয়ে লেগে গেলেন, মারহাট্টাগুলো পালাবার পথ পেলে না, এবারও ক্লাইব, রাত্রে আক্রমণ ক’রেছিল; জনাবকে যদি দু’ পেয়ালা মদ খাইয়ে দিতে পার্‌তুম, তা’হলে কি আর আলিগরের সন্ধি হয়? জনাব দু’টী চোখ লাল ক’রে হুকুম ঝাড়্‌তেন, ফোর্ট উইলিয়ম ওড়াও, কোলকাতাটা আস্‌মানে হরিশ্চন্দ্রের রাজ্যে গিয়ে উঠ্‌তো। নবাব মদ ছেড়ে খালি ভাবছেন এ করি কি ও করি! এই দু’নৌকোয় পা দিয়েই প্যাঁচ প’ড়েছে।
মুঁসালা। সাহেব, মদ খাইলে বিবেচনাশূন্য হইতে হয়।
করিম। এঃ, তাইতে চন্দননগর খুইয়েছ। বিবেচনা করে কবে, পৃথিবীতে কোন্ বড় কাজটা হয়েছে? তোমাদের ইতিহাসে শুনি, সিজার ঝড় তুফানে রুবিকান পার হয়েছিল, সেকেন্দর সা শত্রুর মাঝখানে ঝাঁপিয়ে গে পড়্‌তো, হানিবল্ না কে ছিলো, শুনতে পাই হিমালয় পর্ব্বতের ন্যায় আল্‌পস্ পর্ব্বত পেরিয়ে শত্রু জয় করেছিল,— আর চক্ষের উপর দেখ্‌লেম, ক্লাইব ছ’শো সৈন্য নিয়ে লাখ নবাবী সৈন্য ভেকো ক’রে ছেড়ে দিলে; এর কোন কাজটা বিবেচনার কাজ? আমাদের জনাব বিবেচনা কচ্ছেন, আর ভেতরে ভেতরে ইংরেজ ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। তত বিবেচনা না ক’রে হুকুম ঝাড়্‌লে, আর এক রকম হ’য়ে যেতো। সব দাঁতভাঙ্গা কেউটে গর্ত্তে সেঁধোতো।
সিরাজ। নাও, থামো করিম চাচা।
করিম। থাম্‌চি জনাব, পেটের কথা রাখ্‌তে পারিনে, মাপ হুকুম হয়। আলিবর্দ্দী সিংহাসনটী দিয়ে গেলেন, আর দিব্যি দিয়ে মদ ছাড়িয়ে, নবাবী রোকটী কেড়ে নিলেন। শত্রু যত বাড়্‌ছে, নবাবও তত জবুথবু হ’য়ে বিবেচনা কর্চ্ছেন। রোক ক’রে হুকুম ঝাড়্‌লে ধরপ্যাচ ওয়ার, যা হবার একটা হয়ে যেতো। মুঁসালা, কি বল্‌ছিলে বলো।
মুঁসালা। নবাব বাহাদুর, ইংরাজ সন্ধি রাখিবে না, নিশ্চয় জানিবেন। আমাদের ভয়ে একেবারে লড়াই করিতে তৈয়ারি হইতেছে না। আমাদের দূর করিতে পারিলে, সন্ধির কাগজটা ছোঁড়া কাগজের ধামায় রাখিয়া দিবে।
সিরাজ। আপ্‌নাদের পরিত্যাগ কর্‌বো না, আপনারা কিয়দ্দিনের নিমিত্ত আজিমাবাদে গমন করুন। তথায় আপনাদের বন্দোবস্তের কোনরূপ ত্রুটি হবে না। দেখি ইংরাজ কিরূপ ব্যবহার করে; যে মুহূর্ত্তে মন্দ অভিসন্ধি বুঝবো, আপনাদের স্মরণ কর্‌বো
মুঁসালা। জনাব আমাদের আশ্রয়দাতা। ভাবিয়াছিলাম, জনাবের নিমিত্ত প্রাণপণ করিব;—আশা বিফল হইল। জনাবের আজ্ঞা মাথায় নিলাম, আজিমাবাদ যাইব। কিন্তু বান্দার একটী বাৎ স্মরণ রাখিবেন; বলিতেছেন সময়ে খবর দিবেন, কিন্তু সে সময় দূর নয়;—আমরা বিদায় হইলেই, ইংরাজের তোপ মুর্শিদাবাদে বজ্র আওয়াজ করিবে, বিশ্বাসঘাতক কর্ম্মচারীরা ইংরাজপক্ষে দাঁড়াইবে। জনাব, আর আমাদের সহিত সাক্ষাৎ হইবে না! সেলাম।
মুঁসালার প্রস্থান
সিরাজ। করিম চাচা, ওয়াট্‌স্ আর ইংরাজের উকীলকে দরবারে নিয়ে আস্‌তে বলো, অমাত্যবর্গকে পাঠিয়ে দাও।
করিমের প্রস্থান
কৌশলে কৌশলে দমন করা উচিত। ক্রোধের বশীভূত হ’য়ে ওয়াটস্‌কে অপমান করেছি, উঃরাজ উকীলকে বিদায় দিয়েছি। মাতামহ, কেন ক্রোধ দমন কর্‌তে শিক্ষা দাও নাই! এই ক্রোধই আমার মনোভাব ব্যক্ত করে!

মীরজাফর প্রভৃতি অমাত্যগণের পুনঃ প্রবেশ

ফরাসীদের বিদায় দিলেম।
মীর জাঃ। অতি সৎযুক্তির কার্য্য হয়েছে।

করিম, ইংরাজউকীল ও ওয়াট্‌সের পুনঃ প্রবেশ

সিরাজ। আপনারা কি এই স্থানেই উপস্থিত ছিলেন?
উকীল। হাঁ জনাব,—নবারের উচ্চ মেজাজ আমরা সম্পূর্ণ অবগত ইংরাজের কসুরের জন্য মার্জ্জনা প্রার্থনা করিব, নবাব দয়াবান, মার্জ্জনা করিবেন—এই ভরসায় রাজগৃহ পরিত্যাগ করি নাই।
সিরাজ। উকীল সাহেব, আপনি নবাব-চরিত্র স্বরূপ অবগত। ওয়াট্‌স সাহেব, কর্ণেল ক্লাইবের উদ্ধৃত পত্রপাঠে আমাদের ক্রোধের সঞ্চার হয়েছিল, সেই নিমিত্তই আপনাদের প্রতি সূচক বাক্য প্রয়োগ করি। বিবেচনা করুন, ক্লাইব সাহেবের পত্রও সম্মানসূচক নয়।
উকীল। কদাচ নয়, কদাচ নয়! আমরা পরস্পরও এইরূপ বলাবলি করিতেছিলাম।
সিরাজ। আমাদের সন্ধি ভঙ্গ কর্‌বার কোনরূপে ইচ্ছা নয়। পত্রের মর্ম্মানুসারে ফরাসীদিগকে বিদায় দিলাম;—ওয়াটস্ সাহেব, এই সংবাদ কলিকাতায় প্রেরণ করুন। কিন্তু যদি আপনারা সন্ধিভঙ্গ করেন, আমাদের্ অনন্যোপায় হ’য়ে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হ’তে হবে।
ওয়াটস্। জনাব, এখনি যাইয়া পত্র লিখিব—এখনি যাইয়া পত্র লিখিব। আমরা বণিক, আমরা সন্ধিভঙ্গ করিব, এরূপ বিবেচনা কখনই করিবেন না।
সিরাজ। রাজা রাজবল্লভ, দাওয়ানখানায় আজ্ঞা দাও,—ওয়াটস্ সাহেবের উপযুক্ত খেলাৎ কাশিমবাজারে প্রেরিত হোক। আপনারা আসুন,—ইংরাজের সহিত সৌহার্দ্দ রাখা আমাদের সম্পূর্ণ ইচ্ছা।
ওয়াটস্। অবশ্য —অবশ্য, জনাবের আমরা অনুগ্রহ ব্যতীত একদণ্ডও বাংলায় থাকিতে পারিতাম না। (স্বগত) Dastardly villain!
ইংরাজদ্বয়ের প্রস্থান
সিরাজ। জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ, ফরাসীদিগের বিতাড়িত কর্‌বার নিমিত্ত, ইংরাজ কত অর্থ দিতে সম্মত হয়েছে?
জগৎ। জনাব, ফরাসী সম্বন্ধে তো আমার মতামত কখন শোনেন নাই, তবে কি নিমিত্ত এরূপ আজ্ঞা কর্চ্ছেন?
সিরাজ। না স্বয়ং মতামত প্রকাশ করেন নাই, এই সব উকীলের দ্বারায় প্রকাশ করেছেন।
জগৎ। জনাব, বান্দার প্রতি অন্যায় ব্যবহার হচ্ছে।
সিরাজ। অন্যায় ব্যবহার! বৃদ্ধ সয়তান, তোমাদের মন্তব্য কি আমরা অবগত নই বিবেচনা করো? একবার তোমার শিরশ্ছেদের আজ্ঞা হয়েছিল, বোধ হয় পুনর্ব্বার সে আজ্ঞা প্রদান ক’র্‌তে বাধ্য হব।
মীর জাঃ। জনাব, রাজমন্ত্রীরা সুমন্ত্রণা প্রদান করে! এ দরবারে মন্ত্রণা প্রদান অতি কঠিন কার্য্য।
সিরাজ। তবে অবসর গ্রহণ করুন। যার যার কঠিন বিবেচনা হয়, অবসর গ্রহণ করুন। এখন আর সকতজঙ্গ সজ্জিত নয়, যে অস্ত্র পরিত্যাগ ক’রে নবাবকে দমিত কর্‌বেন। ইংরেজের সহিত সন্ধি স্থাপনা আপনাদের মন্তব্য প্রত্যক্ষ দেখ্‌লেম;—মন্তব্য মত কার্য্য হলো! এ পর্য্যন্ত বরাবর সুমন্ত্রণা প্রদান কর্চ্ছেন। যুদ্ধে উৎসাহ দিয়ে কলিকাতায় র’য়ে গেলেন। আপনি সেনাপতি ছিলেন, একবারও তত্ত্ব লন নাই, যে নবাব কোথায়! রজনীতে প্রান্তরে বৃক্ষতলায় অবস্থান করি। বল্‌তে পারেন, ক্ষুদ্র ছয়শত নাবিক সৈয় ল’য়ে কি সাহসে ক্লাইব নিশাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হ’লো? বাক্—বাক্যব্যয়ে প্রয়োজন নাই, অবসর গ্রহণের ইচ্ছা অবসর গ্রহণ করুন। অন্তরের ছুরী কাহারো লুক্কায়িত নাই। আমার নিজ সহিষ্ণুতায় আশ্চর্য্য হ’চ্ছি। অনেক সহ্য করেছি, এর পর কি হয় জানি না! সকলে স্বস্থানে গমন করুন।
করিম ব্যতীত সকলের প্রস্থান
সিরাজ। শঠ মন্ত্রীগণকে আর প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয় দণ্ড দেওয়া অবশ্য কর্ত্তব্য। যাই হোক সকলকে কারারুদ্ধ কর্‌বো, আর মাতামহীর অনুরোধ রক্ষা ক’র্‌বো না। করিম, মীরমদন-মোহনলালকে প্রেরণ করো। কৌশলে কার্য্য সম্পন্ন করাই উচিত ছিল, একে একে দণ্ড দেওয়া কর্ত্তব্য।
করিম। জনাব, ঐ যে বেগম-মহিষী আস্‌ছেন। বুঝি জনাবকে মীরজাফরের হাতে হাতে সঁপ্‌বেন। আহা আম্‌লারা যে চ’লে গেল, তা না হ’লে একে একে সকলের হাতে হাতে সঁপ্‌তেন।
করিমের প্রস্থান

আলিবর্দ্দী-বেগমের প্রবেশ

বেগম। সিরাজ কি কর্‌লে? পুরাতন অমাত্যসকলকে এককালে শত্রু ক’র্‌লে? ক্রোধান্বিত হ’লে তুমি হিতাহিত বিবেচনাশূন্য হও!
সিরাজ। মাতামহী, বিশ্বাসঘাতকের ছুরী আমার বক্ষঃস্থলে প্রবেশ না ক’র্‌লে কি শঠ অমাত্যগণের পরিচয় পাবেন না! আপনার অনুরোধে মীরজাফরকে সেনাপতি ক’রে কলিকাতায় যুদ্ধে গমন করি। যদি মীরমদন সে যুদ্ধে উপস্থিত না থাক্‌তো, বোধ হয় ইংরাজ-দুর্গে তোমার দৌহিত্র বন্দীভাবে অবস্থান ক’র্‌তো। ইংরাজের দূত, নিত্য নবাব-অমাত্যের সহিত মুর্শিদাবাদে এসে পরামর্শ করে—কিসে সিংহাসনচ্যুত হই—দিবারাত্র এই পরামর্শ! এখনো কি আপনার ইচ্ছা যে এই সকল শঠ মন্ত্রীকে প্রশ্রয় দিই! ইংরাজ বিতাড়িত হয়েছিল; কার উৎসাহে তারা পুনর্ব্বার বাঙ্গলায় উপস্থিত হয়েছে? কাদের উপদেশে মাণিকচাঁদ ইংরাজকে দুর্গ অর্পণ ক’রে মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছিল? কার পরামর্শে নবাবী আজ্ঞা লঙ্ঘন ক’রে, নন্দকুমার ফরাসীর সাহায্যে প্রেরিত হ’য়ে ইংরাজ বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে নাই? কোনু সাহসে বাণিজ্যোপজীবী, কোর্ত্তাটুপি মাত্র সম্বল ল’য়ে, পুনঃ পুনঃ নবাবকে ভয় প্রদর্শন করে,—পুনঃ পুনঃ সন্ধিভঙ্গের সুযোগ অনুসন্ধান করে? এখনো কি বোঝেন নাই, শঠ কর্ম্মচারীরা সকল অনিষ্টের মূল! আপনি বার বার তিরস্কার করেন, যে নীচ ব্যক্তিদের আমি উচ্চপদে স্থাপন করেছি। যে সকল মহৎ কর্ম্মচারীদের উপর কার্য্যভার অর্পিত, তাদের বিশেষ যত্নেই আমার প্রধান শত্রু ইংরাজ প্রবল;—সওকতজঙ্গকেও এই সকল মন্ত্রী উৎসাহ প্রদান করেছিল। কিন্তু নীচ কর্ম্মচারী মোহনলালের ব্যবহার শুনুন। যখন মোহনলালকে পূর্ণিয়ার আধিপত্য প্রদান করি, সে বিনীতভাবে আমার নিকট নিবেদন করে,—পূর্ণিয়ার অধিকার অপরকে প্রদান করুন—আমায় বাঙ্গ্‌লায় স্থান দেন, নচেৎ অমঙ্গল ঘটবার সম্ভাবনা। কার্য্যে তাহা সম্পূর্ণ ফলবতী হয়েছে! এখন মোহনলালের ন্যায় বন্ধু পরিত্যাগ ক’রে, এই সকল কপটাচারীকে কি রাজকার্য্যে স্থান দিতে আজ্ঞা করেন?
বেগম। বৎস, সকল কর্ম্মচারীরা অর্থবল জনবল সম্পন্ন। স্বর্গীয় নবাব বিনয়ে এদের বশীভূত রেখেছিলেন। তোমারও সেই উপায় অবলম্বন করা উচিত ছিল। যেরূপ সঙ্গত বিবেচনা হয় করো। বার বার রাজকার্য্যে হস্তক্ষেপ করা আমার উচিত নয়। আমার এইমাত্র ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা, নিরাপদে রাজ-সিংহাসন ভোগ করো;—আমি তোমায় নিরাপদ দেখে, বৃদ্ধের পার্শ্বে কবরশায়িনী হই।
সিরাজ। মাতামহী, নিরাপদ! বাঙ্গলায় রাজমুকুট ধারণ ক’রে নিরাপদ? শঠ মন্ত্রী পরিবেষ্টিত হয়ে নিরাপদ? সে আশা আর আমার নাই! কণ্টকপূর্ণ সিংহাসনে উপবেশন করা অবধি, আমি বিপদসাগরে নিমগ্ন!

লুৎফউন্নিসার প্রবেশ

লুৎফ। জনাব—জনাব—চলো, রাজ্যে প্রয়োজন নাই। চলো, কোন নির্জ্জন কুটীরে গিয়ে আমরা অবস্থান করি। সেইখানে তোমায় হৃদয়ের নবাব ক’রে পূজা কর্‌বো। বাঙ্গলার সিংহাসন পরিত্যাগ করো, চলো। আমরা প্রেমের রাজ্য স্থাপন করি;—এ কুটীল রাজ্য পরিত্যাগ করো, তোমার সরল হৃদয় কুটীরের সংঘর্ষে দিন দিন মলিন হচ্ছে। দাসীর অনুরোধ রক্ষা করো, রাজ্যে প্রয়োজন নাই!
সিরাজ। কি প্রয়োজন নাই লুৎফউন্নিসা! যদি সুখ-ইচ্ছায় রাজ্যভার গ্রহণ কর্‌তেম, তা হ’লে ছার রাজ্য পরিত্যাগ ক’রে তোমার সহিত নির্জ্জনে বাস কর্‌তেম। কিন্তু রাজ্যের সহিত আমার উপর গুরুভার স্থাপিত। মাতামহ মৃত্যুশয্যায় আমার মস্তকে গুরুভার অর্পণ করেছেন;—প্রজার মঙ্গল সাধন ভার আমার উপর, নবাববংশের মর্য্যাদা রক্ষার ভার আমার উপর, বাঙ্গলার ভবিষ্যৎ শান্তি স্থাপনের ভার আমার উপর, বিদেশী দস্যুর হস্ত হ’তে প্রজারক্ষা করার ভার আমার উপর, এ সমস্ত ভার তাঁর মৃত্যুশয্যায় আমি গ্রহণ করেছি, এখন কিরূপে পরিত্যাগ কর্‌বো? তুমি আমার সেই গুরুভারের অংশী, সহাস্যবদনে আমায় উৎসাহ প্রদান করো;—নচেৎ আমি রাজকার্য্য বিস্মৃত হবো। অন্তঃপুরে চলো, কুটীল রাজ-দরবার তোমাদের স্থান নয়।
বেগম, লুৎফউন্নিসা ও সিরাজদ্দৌলার প্রস্থান