সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/তৃতীয় অঙ্ক/দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
(পৃ. ১১৫-১২৫)
দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
মুর্শিদাবাদ—জগৎশেঠের বৈঠকখানা
নর্ত্তকীগণের গীত
পঞ্চম স্থানে কোয়েলা।
থর থর জর জর বিরহী অন্তর
সুরথ-কাতরা কুলবালা॥
ব্যঙ্গে রঙ্গে হাসে কুসুম-কলি,
ঢলি ঢলি, মলয় অনিলে,
অলিকুল গুঞ্জন গঞ্জন, দহিতে কামিনী-মন
অরিগণ মিলে;
গরল বাতি, জ্বালে চাঁদিনী রাতি,
লাঞ্ছনা, যাতনা পিরীতি;
ছলনা, কামিনী, কোমল প্রাণ দলনা
আশে ভাসে বিভোলা॥
মীরজাফর, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ রাজবল্লভ, মীরণ ও মাণিকচাঁদের প্রবেশ
জগৎ। তোমরা বিশ্রাম করো।
নর্ত্তকীগণের প্রস্থান
মীরণ, তুমি সতর্ক হ’য়ে দেখো, নবাবের কোন গুপ্তচর এদিক ওদিক না থাকে।মীরণের প্রস্থান
রায়দুঃ। আমরা একত্রিত হয়েছি, এ সংবাদ নবাব অবশ্যই পাবে।
জগৎ। আমি সেই নিমিত্তই রটনা করেছি যে আমার দৌহিত্রের পুত্রের অন্নপ্রাশন।
রাজবঃ। একত্রিত হই আর না হই নবাবের সন্দেহ দূর হবে না। যা হবার তা হয়েছে, অধিক কি হবে। সহসা বল প্রকাশ কর্তে সাহসী হবে না, অধিকাংশ সেনানায়কেরা আমাদের অর্থে বশীভূত।
মাণিক। ও সকল চিন্তার অনেক সময় আছে, শুনুন; সাহেবের মন্তব্য, আমি ক্লাইবের নিকট প্রস্তাব করেছিলেম,—ক্লাইব সম্পূর্ণ সম্মত। এই খস্ড়া পত্র কাশিমবাজারের ওয়াটস্ সাহেবের নিকট পাঠিয়েছে। তিনি বলেন,—“আমরা মীরজাফর খাঁকে সিংহাসন প্রদান কর্লে, তিনি আমাদের কত অর্থ প্রদান কর্বেন? আমরা অর্থহীন বণিক। যুদ্ধে বিস্তর অর্থ ব্যয় হবে, তারপর, জয় পরাজয় কে জানে, আমাদের সমূলে উচ্ছেদ হওয়া সম্ভাবনা;—কিছু প্রত্যাশা না থাক্লে, আমরা এরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত কেন হব? নবাব সন্ধি ভঙ্গে ইচ্ছুক নয়;—বিনা কারণে সন্ধি ভঙ্গ ক’রে, আমরা কেন বিপদ আহ্বান কর্বো? আমরা জয়ী হ’লে মীরজাফর খাঁ সিংহাসন পাবেন, রাজকোষও তাঁর হস্তগত হবে, আমরা সেই অর্থের অংশ প্রার্থী।” এই সন্ধি পত্রের খস্ড়া দেখুন, তাঁর মনোগত ভাব অবগত হবেন।
সন্ধিপত্র মীরজাফরকে প্রদান
মর্ম্ম এই,—ফরাসীদের উচ্ছেদ করা, ইংরাজ যা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তজ্জন্য এককোটী টাকা প্রদান, দেশীয় ও ইংরাজ প্রজার ক্ষতিপূরণে সত্তর লক্ষ টাকা, আর্ম্মাণীগণের ক্ষতিপূরণে পাঁচ লক্ষ টাকা, কলিকাতার বাহিরে কতক জমী ও কলিকাতার দক্ষিণ কুলপি পর্য্যন্ত ইংরাজকে জমিদারী প্রদান।মীরজাঃ। (পাঠান্তে) সন্ধিপত্রের মর্ম্ম, রাজা মাণিকচাদ স্বরূপ বলেছেন। আমরা কি সম্মত হব?
সকলে। নিশ্চয়, এ দৌরাত্ম্য সহ্য হয় না।
করিম চাচার প্রবেশ
মীরজাঃ। এ কি, করিম চাচা এখানে কেন!
করিম। কেন চাচা, সওকতজঙ্গকে গদী দিতে গিয়েছিলে, আমি এক পাশে পড়ে আছি, তাতে ক্ষতি কি? আমার এখানে আসবার বড় দরকার নাই, তবে রায়দুর্লভ চাচার নুন খেয়েছি, উনি গালে হাত দিয়ে, মুখটী চুপ ক’রে বলেছিলেন, “নবাবের ভাবটা কি বলতে পারো,” তাই বল্তে এলুম, ভয় নাই।
রায়দুঃ। চাচা, কিসে জান্লে—কিসে জান্লে?
করিম। নবাব, বুড়ো মাতামহর কথা মনে ক’রে, আর বুড়ী বেগমের অনুরোধে, বার বার মাপ্ করেছে, এবারও মাপ করবে। যখন দরবার বসেছিল, মীরমদন গোলন্দাজ নিয়ে তোয়ের ছিল জেনো; নবাবের একটু ইসারা পেলে, আর কেউ বাড়ী ফিরতে না। তোমরা যত গাঁট পাকাচ্ছ, নবাব তত গাঁট পাকালে অমন তোড়া তোড়া বুলি ঝাড়তো না, আঁধার রেতে তোপের মুখেই কথা কইতো। বাবা, রাগ্লেই তো গর্দ্দানা নিতে চায়, ক’টা গর্দ্দানা নিয়েছে বলো? যদি গর্দ্দানা নিতো, তাহলে এতদিন কন্ধকাটা হ’য়ে পরামর্শ আঁট্তে হতো। চাচা, একটা কথা বলি শোনো;—কাল্কের ছোঁড়া, মাতামহর আদরে আদরেই বেড়িয়েছে, তোমাদের প্রবীণ ছক্কাবাজির মধ্যে এখনো সেঁধোয় নাই। রাগে দু’ কথা বলে, আবার বাড়ী বাড়ী গিয়ে পায়ে ধ’রে সাধে;—এই দু’ নৌকায় পা দিয়েই ছোঁড়া মজ্তে বসেছে। যদি তেরিয়া হ’য়েই চল্তো, যাহোক চোট্ পাট্ একদিক দিয়ে এক রকম হয়ে যেতো। আর যদি নরমের উপর দিয়েই চল্তো, কেউ না কেউ দয়া কর্তো। এ ছোঁড়া পায়ে ধর্লেও পাজী, আর কড়া হ’লে তো পাজীর পাজী।
মাণিক। আহা! কি সদাশয় নবাবই চিনেছ? হোসেনকুলি—ওর শিক্ষক ছিল—তারেই রাস্তায় ধরে কেটে ফেল্লে।
করিম। চাচা, সকলের তোমার মত বরদাস্ত নয়! “আলেফ-বে-তেসে” পড়িয়ে, অন্দরে ঢুকে মা-মাসীর মাঝে গিয়ে বস্বেন, বেকুফ নবাব, বরদাস্ত কর্তে পারে নাই। সকলের তো তোমার মত দেল দরিয়া মেজাজ নয়।
মীরজাঃ। কি বল্ছ করিম! ফৈজি, আহা অবলা স্ত্রীলোক, তারে দেওয়ালে গেঁথে মেরে ফেল্লে! এমন নিষ্ঠুরও জন্মায়!
করিম। চাচা, তোমার কি কোমল প্রাণ! দেখছি তুমি চাচীর পার্শ্বে আর একজন চাচাকে বসিয়ে সেলাম দিতে পারো। আগে যদি জান্তেম, ফৈজি বেটীকে তোমার সঙ্গে নিকে করিয়ে দিতেম। চাচা, একবার চোখ খুলে কথা কও। ছোঁড়া প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছিল। চক্ষের উপর জোড়া-গাথা দেখ্লে, তার উপর ফৈজী বেটী মেছুনীর অধম ‘মা’তুলে গাল দিলে, নবাব বাচ্ছা, অত বেইমানি বরদাস্ত হবে কেন? ও তো ছোঁড়া বয়সে দ্যাল গেঁথে মেরেছে, তুমি হ’লে এই বুড়ো বয়সে টুকরো টুকরো ক’রে কুকুর দিয়ে খাওয়াতে। কাঙ্গালের একটা কথা কানে তোলো, ঠিকঠাক খয়ের খাঁ হ’য়ে ছোঁড়াটাকে চালিয়ে নাও।
রায়দুঃ। তারপর আমাদের হ’য়ে মুণ্ডুটা দেবে কিনা?
করিম। তা তো চাচা, দশমুণ্ড রাবণ হ’লেও পার্তেম না! তোমরা যে ক’জনে জোটপাট করো, দশটা মাথায় আঁট্তো না তো বাবা!
রায়দুঃ। নাও, পাগ্লামো করো না।
করিম। চাচা, তোমার নুন খেয়েছি, কথাটা শুনে নাও;—যে যার সব স্বার্থ তো টেঁকে আছো, আখেরে কতটা টেঁক্বে, তা একবার ভাব্ছ কি? মীরজাফর চাচা তো গদীতে বস্বেন,—নবাবটা উৎসন্ন গেলেই তো রায়দুর্লভ চাচার মনের কাঁটা উঠলো,—মোহনলাল বাঙ্গালী, তার দম্ভ সচ্ছে না,—যখন কটা চোখ রাঙ্গিয়ে গড্ ড্যাম করবে, তখন সইবে তো—দেখো? শেঠ চাচা, নবাবই যেন টাকা চায়, গোরার বাচ্ছা টাকার মুখ দেখে না, কেমন? বাবা সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে টাকা কুড়ুতে এসেছে, নবাবকেই দাব্ড়ি লাগাচ্ছে, এ সব কথা একবার ভেবো।
রায়দুঃ। চুপ করো। (মীরজাফরের প্রতি) খাঁ সাহেব আর বিলম্ব কর্বেন না, ক্লাইব যা বলে, আপনি সম্মত হোন। এ দুরন্ত নবাবের হাতে ত্রাণ কর্তে একমাত্র বলবান ইংরাজই সক্ষম। ইংরাজ ব্যতীত আর আমাদের উপায় নাই।
করিম। ভালো মোর বাপরে-চাচারে—কি পরামর্শই এঁটেছ! তোমাদের হ’য়ে গর্দ্দানা দিক ইংরাজ, তারপর মীরজাফর চাচা নবাবী তক্তায় ব’সে চণ্ডু টানুন, রায়দুর্লভ চাচা মন্ত্রী হোন, রাজবল্লভ চাচা আর একটা ঢাকা খুঁজে নেন, বাগে পান আর একটা ঘসেটী বেগম খাড়া কর্বেন, আর জগৎশেঠ চাচারা টাকা সুদে খাটান! চাচা, বিদেশী বঁধুরে প্রাণ সঁপো না। চাচা, ভাবছো গর্দ্দানা দেবে ইংরেজ, আর নবাবী করবে তোমরা! সাদা চেহারা চেন না, শেষ পস্তাবে; ওরা খুব দাওবাজ, ওদের কাছে কারও দাও চল্বে না। চাচা, তোমরা চাল-চলনে মানুষ চেন না? আলিবর্দ্দী, বর্গির ভয়ে সকল জমীদারদের ফৌজ বাড়াতে বলেছিল, ইংরাজ তোফা কোল্কাতা গের্দ্দো ক’রে নিলে। বল্তে বলে ব্যবসায়ী কুঠি, কিন্তু ওদের কুঠির মত ক’টা নবাবী কেল্লা আছে বল? কত বড় ধড়িবাজ,—উমিচাঁদকে কয়েদ কর্লে, পরিবারবর্গ একগাড়ে গেল, টাকা লুট কর্লে,—আবার তাকেই প্রাণের দোন্ত করে নেছে! তোমরাও পরম দোস্ত ভাবছ। চাচা, চোখ চেয়ে কাজ করো।
মীরজাঃ। আচ্ছা শুনিনা, তোমার কি পরামর্শ?
করিম। কেন চাচা পরামর্শ তো পড়ে রয়েছে। সোজা পথে চলো, নবাবের খয়ের খাঁ হও, মুখে একখানা পেটে একখানা নয়। আর বাঁকা পথে চল্তে চাও, তাও তলে তলে যোগাড় করো। সৈন্য সামন্ত যোগাড় ক’রে, কোমর বেঁধে আপ্নারা লেগে যাও, এক হাত বরাত ঠুকে দেখো। কিন্তু চাচা, ইংরেজের কোটের ল্যাজ ধর্লে, একূল ওকুল দু’কুল যাবে। দুধ দিয়ে ঘরের ভেতর কাল সাপের ঝাঁক পুষো না, সকলে মিলে ওদের আগে উচ্ছেদ করো।
মীরজাঃ। তারপর আমরা কোমর বেঁধে লাগবো। টাকার সরবরাহ কে কর্বে চাচা?
করিম। চাচা, পরিজান সরবরা কর্বে। ঘসেটীবেগম অনেক মাল সরিয়েছে, নবাব জোর সিকি পেয়েছে, সে মাল তোমাদের হাতে লাগ্বে,—জলের মত খরচ ক’রো,—আর ঠেশজি, এক বছরের সুদের মায়া রেখো না। কিন্তু চাচা, ছাতি তোমাদের করতে হবে।
রায়দুঃ। নাও, এখন যাও।
করিম। যাচ্ছি বাবা, আর একটা কথা শোনো।
রায়দুঃ। কি বল্ছ?
করিম। চাচা, মুসলমানেরা তো বরাবর নবাবী নিয়ে আপনা আপনি কাটাকাটি করে, এবারও না হয় কচ্ছে। কিন্তু চাচা, হিন্দুর সুবিধা মত নবাব তো এ নবাব ব্যাটার মত কেউ হয় নি,—সব বড় বড় কাজই হিন্দুর! তা চাচা তোমরা কেন বিরূপ বল দেখি?
রায়দুঃ। চাচা, তুমিও তো দরবারে যাও! নবাবের খামখেয়ালি চেহারা তো দেখেছ। রাজা মাণিকচাঁদের গর্দ্দানা যেতে যেতে র’য়ে গেছে, দশ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়ান পেয়েছেন; শেঠজীও গুরুবলে আজ মাথা বাঁচিয়েছেন। অপমান তো কথায় কথায়, কথায় কথায় কাজে জবাব! ভগবানকে ডেকে দরবারে প্রবেশ কর্তে হয়, আর ভগবানকে ডেকে দরবার থেকে বেরুই,—ভাবি আজকের দিন ভগবান রক্ষা করেছেন। তোমার কি ব’লনা, গাঁজা-গুলি খেয়ে বেশ আছ।
করিম। চাচা, এটা কি নবাবের দোষে না তোমাদের মনের দোষে—এটা একবার ভাল ক’রে দেখেছ কি? কই মোহনলাল প্রভৃতিকে তো অমন দুর্গা নাম জ’পে দরবারে যেতে আস্তে দেখি নি?
জগৎ। নিন, রাত্রি হয়েছে, আর ভাব্ছেন কি? আপনি সম্মত হ’ন। আসুন আমরা সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করি।
মীরজাঃ। বিস্তর টাকা চায়—বিস্তর টাকা চায়!
জগৎ। উপায় নাই। ভাব্বেন না, আপনি গদীতে বস্লে তো টাকা দেবেন? নবাব ভাণ্ডারে টাকার অভাব নাই।
করিম। (স্বগত) চাচা কিছু বুঝ্লে? কি বল্চ বাবা কামিনীকান্ত? চাচা তুমি এমন বেল্লিক কেন? বাঙ্গালীর নাম রাখা চাই নি! কি রকম—কি রকম প্রাণ কামিনী? আর কি রকম কি! বাঙ্গালী আপনার ভালই খুঁজ্বে—এইটে চাচা ভেবেছ! বটে বটে চাঁদকামিনী, একটা চুমো দাও। কি বল—নাম রাখা চাই—কেমন? —হুঁ—জুতো টুতো খাওয়া? চাই বই কি! অন্নাভাবে মরা? বুঝেছি, হৃদয়েশ্বরী হৃদয়ে এসো।
করিমের প্রস্থান
মীরণের প্রবেশ
মীরণ। সতর্ক হোন—সতর্ক হোন! মোহনলাল মীরমদন আস্ছে।
সকলে। কি সর্ব্বনাশ!
রায়দুঃ। দুর্গা দুর্গা! বুঝি গ্রেপ্তার করতে পাঠিয়েছে।
মোহনলাল ও মীরমদনের প্রবেশ
জগৎ। আস্তে আজ্ঞা হয়—আস্তে আজ্ঞা হয়—আমার সৌভাগ্য।
মোহন। মহাশয়, সকলেই উপস্থিত আছেন, আমাদের একটী নিবেদন শুনুন। সকলে নবাবকে মার্জ্জনা করুন।
সকলে। এ কি কথা—এ কি কথা?
মোহন। আমার আবেদন আগে শুনুন। মহারাজ রায়দুর্লভ, লোক পরম্পরায় শুনি, যে নবাব আমার উচ্চপদ প্রদানে আপনি অসন্তুষ্ট।
রায় দুঃ। সে কি রাজা মোহনলাল, আপনি যোগ্য লোক।
মোহন। মহাশয়, আমি বিনীতভাবে নিবেদন কচ্ছি, আপনাদের পদ আপনারা গ্রহণ করুন। স্বরূপ বল্ছি আমরা বাঙ্গলা ছেড়ে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু এইমাত্র আপনারা স্বীকার করুন, যে সকলে নবাবকে রক্ষা কর্বেন। কার্য্যের অনুরোধে যদি আমার কিছু ত্রুটি হ’য়ে থাকে, মার্জ্জনা করুন। আমি দেশত্যাগ ক’রে যেতে প্রস্তুত—এর অধিক কি আর দণ্ড গ্রহণ কর্বো। কিন্তু নবাবকে বিপদ্গ্রস্ত কর্বেন না।
রায়দুঃ। রাজা মোহনলাল, আমরা বিদ্রোহী নই, আমরা রাজভক্ত প্রজা। আপনি অকারণ আমাদের প্রতি দোষারোপ কর্চ্ছেন।
মীরমঃ। মহারাজ, সেইটিই প্রার্থনীয়। বাঙ্গলার নবাব-বল প্রবল হোক, অপর বল খর্ব্ব হোক; আমরা অতি সরলভাবে আপনাদের নিকট উপস্থিত। আমিও মোহনলালের ন্যায় সেনানায়কত্ব পরিত্যাগ কর্তে প্রস্তুত। খাঁ সাহেবের পদ খাঁ সাহেব গ্রহণ করুন। আপনাদের কোন প্রকার দুরভিসন্ধি নাই। আপনারা স্বর্গীয় নবাবের সিংহাসনের স্তম্ভ স্বরূপ। নবাব বিপজ্জালে পতিত হ’য়ে, যৌবন-সুলভ চপলতায়, সর্ব্বদা মতি স্থির রাখতে পারেন না,—কখনো কখনো দুর্ব্বাক্য প্রয়োগ করেন, কিন্তু সে আপনাদের মার্জ্জনীয়।
মোহন। মহারাজগণ, খাঁ সাহেব, শেঠজি,—ইংরাজ দূত সদা সর্ব্বদা আপনাদের নিকট আসে, আপনাদের মন্ত্রণাও আমরা অবগত। কিন্তু ক্ষান্ত হোন। আমরা যদি আপনাদের বিদ্বেষের কারণ হই, স্বরূপ বলছি, এই দণ্ডেই আমরা দেশত্যাগ কর্তে প্রস্তুত। ভূতপূর্ব্ব নবাবের রাজ্য রক্ষার্থে যেরূপ যত্নশীল ছিলেন, সেইরূপ যত্নশীল হোন। কার্য্যস্থলে, আমাদের অপরাধে নবাবকে অপরাধী কর্বেন না; বাঙ্গলার সর্ব্বনাশে প্রবৃত্ত হবেন না।
জগৎ। রাজা মোহনলাল, দেখ্চি আমার নিজ আবাসেও আমার অধিকার নাই, এখানেও আপনাদের অধিকার। আমার গৃহে আমার আমন্ত্রিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে অপমান কর্বার নিমিত্ত উপস্থিত হয়েছেন, আমাদের প্রতি গুরুতর দোষারোপ কচ্ছেন।
মোহন। মহাশয়, দেখছি সরল কথা সরলভারে গ্রহণ কর্তে, আপনারা অক্ষম। ভাব্বেননা, ভয় বশতঃ আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। বাঙ্গ্লার মঙ্গলের জন্য আত্মত্যাগে প্রস্তুত হয়েছিলেম। নবাবের বিরুদ্ধাচরণ কর্তে যদি আপনারা প্রস্তুত থাকেন, জান্বেন, আমরাও নবাবকে রক্ষা কর্তে প্রস্তুত।
মীরমঃ। মহাশয়, কোনও প্রকার ছলনা আমাদের হৃদয়ে নাই। আমাদের অন্তরের ভাব বুঝুন্;—প্রতিপালক, উচ্চপদদাতা, মর্য্যাদাদাতা নবাবের মঙ্গল কামনা একমাত্র আমাদের অভিপ্রায়। আসুন সরলভাবে আমরা কথা কই। যে শপথ কর্তে বলেন, আমরা সেই শপথ কর্তে প্রস্তুত, কি কার্য্যে আমাদের উপর আপনাদের প্রত্যয় জন্মায় বলুন, আমরা সেই কার্য্যে এই মুহূর্ত্তে প্রস্তুত। কেবল নবাবের বিরুদ্ধাচরণ কর্বেন না, এইমাত্র প্রতিশ্রুত হোন। আপনাদের মধ্যে অনেকেই বাল্যকালে নবাবকে ক্রোড়ে ধারণ করেছেন, পূর্ব্বস্নেহ কেন বর্জ্জন কর্চ্ছেন? ইংরাজকে কি নিমিত্ত বন্ধু বিবেচনা কর্চ্ছেন? ইংরাজ বাঙ্গলায় আসায়, বঙ্গভূমির বিশেষ ক্ষতি, তা কি বিবেচনা করেন না? আপনাদের জন্মভূমি হ’তে অর্থোপার্জ্জন ক’রে স্বদেশে প্রেরণ কচ্ছে, রাজার ন্যায় বঙ্গভূমি অধিকার কর্চ্ছে, বাঁটা প্রদান না ক’রে টাকা মুদ্রাঙ্কণ কচ্ছে, শুল্ক প্রদান করে না, ইংরাজের যা লাভ, সমস্তই বঙ্গবাসীর ক্ষতি;—এ সকল কেন বিবেচনা কচ্ছেন না?
মোহন। নবাব যদি দোষী হন, বৃদ্ধা নবাব-বেগমের মুখ চেয়ে ক্ষান্ত হোন। বৃদ্ধ নবাব আপনাদের হস্তে তাঁর পালিত পুত্রকে অর্পণ ক’রে গেছেন; প্রতিপালক বৃদ্ধের মৃত্যু-শয্যার অনুরোধ বিস্তৃত হবেন না।
মীরজাঃ। দেখছি আপনারা উপদেশ প্রদানে যথেষ্ট পটু। বল্ছেন, আপনারা বাঙ্গ্লা পরিত্যাগ ক’রে চলে যাবেন, কিন্তু কার্য্যে আমাদেরই বাঙ্গ্লা পরিত্যাগ কর্তে হবে। কোনরূপ ভদ্রতার আবরণ রেখে আপনারা কথাবার্ত্তা কর্চ্ছেন না, বিদ্রোহী অপবাদ দিয়ে কুবচন বল্ছেন। শেঠজি, আমায় এ স্থান পরিত্যাগ কর্তে হলো।
জগৎ। আমারও আবাস পরিত্যাগ করা শ্রেয়ঃ।
মোহন। বুঝ্লেম, আপনারা কৃতসঙ্কল্প! কিন্তু অত দম্ভ কর্বেন না। ইংরাজের দাসত্ব আপনাদের অভিপ্রেত হয়, হোক্, তাতে রাজভক্ত স্বদেশভক্ত, ক্ষতি বিবেচনা করে না। যদি প্রকাশ্যে শত্রুতা কর্তেন, তা’হলেও আপনাদের কতক মনুষ্যত্ব বুঝ্তেম। আপনারা নিতান্ত মনুষ্যত্ব হীন, বাঙ্গ্লা রাজ্যে উচ্চপদের যোগ্য নন; ফিরিঙ্গির দাসত্বের যোগ্য, দাসত্ব করুনগে।
রায়দুঃ। মীরমদন সাহেব, আপনি কিছু বল্তে প্রস্তুত নন?
মীরমঃ। মহারাজ, এখনো, ইতিপূর্ব্বে যা নিবেদন করেছি, সেই আমার নিবেদন। সরল কথায় আপনারা রুষ্ট হচ্ছেন; আমরা চল্লেম। মহারাজ, আমাদের কিছু ক্ষতি হবে না; বোধ হয় আমাদের সুদিন উপস্থিত। নবাব-কার্য্যে, দেশের কার্য্যে যদি প্রাণত্যাগ কর্বার সুযোগ হয়, সে সুযোগ আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি। নিশ্চয় জান্বেন, বাঙ্গলার দুর্দশা আমরা দেখ্বো না। কিন্তু জান্বেন যেরূপ বীজ বপন কর্চ্ছেন, ফলভোগী সেইরূপ হবেন। এসো মোহনলাল—
উভয়ের প্রস্থান
রায় দুঃ। অহঙ্কার দেখেছেন—অহঙ্কার দেখেছেন—
মীরজাঃ। অসহ্য—
জগৎ। শীঘ্র কার্য্য সম্পন্ন করুন। আর বিলম্ব নয়, আসুন আমরা সকলে স্বাক্ষর ক’রে সন্ধিপত্র প্রেরণ করি।
সকলের প্রস্থান