সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/প্রথম অঙ্ক/দ্বাদশ গর্ভাঙ্ক
(পৃ. ৫৫-৬৪)
দ্বাদশ গর্ভাঙ্ক
মুর্শিদাবাদ—নবাব-দরবার
সিরাজদ্দৌলা, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ, স্বরূপচাঁদ, রাজবল্লভ, রাসবিহারী প্রভৃতি
সিরাজ। (অমাত্যবর্গের প্রতি) আমার জিজ্ঞাস্য, যে কি নিমিত্ত হলওয়েল কারারুদ্ধ ছিল? নবাবী আদেশ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। হলওয়েলকে মুক্তিদান ক’রে, ওলন্দাজদিগের হস্তে প্রত্যর্পণ করাই নবাবী আদেশ ছিল। কিন্তু নবাব-আদেশের বিপরীত কার্য্য কি নিমিত্ত হয়েছে? এর উত্তর আমার সেনাপতি মীরজাফর সাহেবের নিকট পাবার ইচ্ছা করি, কারণ কলিকাতায় তাঁহার হস্তেই হলওয়েল প্রভৃতি অর্পিত হয়েছিল।
মীরজাঃ। কর্ম্মচারীদের ভুলক্রমেই এরূপ হয়েছিল। এখন হলওয়েল মুক্তিলাভ করেছে।
সিরাজ। সে কর্ম্মচারীদের ভুল সংশোধন দ্বারা হয় নাই। আমরা তাদের কারারুদ্ধ হওয়ার অবস্থা, মাতামহী বেগম-মহিষীর নিকট অবগত হ’য়ে, অমাত্য মীরমদন দ্বারা তাদের মুক্তির আজ্ঞা প্রেরণ করি। হলওয়েল একটা লোমহর্ষণ সংবাদ প্রদান কর্লে। ঈশ্বর করুন তার সংবাদ মিথ্যা। সংবাদ সত্য হ’লে, নবাবীরাজ্যের চিরকলঙ্ক স্বরূপ তাহা জগতে ঘোষিত হবে। সংবাদ এই যে, “ব্ল্যাকহোল্” নামে ইংরাজ দুর্গস্থিত একটী ক্ষুদ্রায়তন কারাগারে, ১৪৬ জন ইংরাজ বন্দী ক’রে রাখা হয়। সেই কারাগারের একটী ক্ষুদ্র গবাক্ষ মাত্র ছিল, অপর বায়ু প্রবেশের পথ ছিল না। সেই নিমিত্ত অশেষ যন্ত্রণায় অধিকাংশ হতভাগ্য ইংরাজের প্রাণ নষ্ট হয়। এ প্রাণনাশের দায়িত্ব আমারই মস্তকে স্থাপিত হবে। আপনার উপর যদিচ ভার অর্পিত হয়েছিল, তাহা সাধারণের বিদিত হবে না। যাহা হবার হয়েছে, কিন্তু এ কার্য্যে রাজ্য কলঙ্কিত!
মীরজাঃ। জনাব, এ মিথ্যা রটনা।
সিরাজ। ঈশ্বর করুন, মিথ্যাই হোক।
মোহনলালের প্রবেশ
মোহন। জনাব, জয় সংবাদ মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হ’লে, নগরে মহোৎসব হয়, প্রজাবর্গ পরমানন্দে মত্ত থাকে। সেই সময় দানসা নামে একজন ফকির, জনাবের নামে কলঙ্ক রটনা এবং পূর্ণিয়ার সকতজঙ্গ বাহাদুরের প্রশংসা ক’রে, প্রজাবর্গকে বিদ্রোহী হ’তে উৎসাহিত করেছিলো। বান্দা তারে কারারুদ্ধ করেছে, আজ্ঞা হ’লে দরবারে উপস্থিত করি।
সিরাজ। উপস্থিত করা হোক।
মোহন। (দানসাকে আনিবার জন্য দূতকে ইঙ্গিতকরণ ও দূতের প্রস্থান) আরও জনাবের জমাদার লছমনসিংহের মুখে সংবাদ পেলেম, যে এক ফকিরবেশিনী স্ত্রীলোক ঐরূপ কুৎসা ক’রে, অট্টালিকা হ’তে কুটীর পর্য্যন্ত গমনাগমন করে;—নবাব-অন্দরেও কখনো কখনো প্রবেশ করে, অবগত হ’লেম। সে স্ত্রীলোক বহুরূপধারিণী, বহু অনুসন্ধানে নগর-রক্ষক এ পর্য্যন্ত তারে ধৃত করতে পারে নাই। সে রমণী নবাবের অন্দরে প্রবেশ করে, যদি সত্য হয়, কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের বিষয়! সে দুশ্চরিত্রা ঘরে ধরে রটনা করেছে, যে নবাব রণজয় ক’রে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হ’য়েই অতি হীন আজ্ঞা প্রচার ক’র্বেন; এবং রাণী ভবানীর কন্যা তারাবাইকে বলপূর্ব্বক আনয়ন করা হবে। সেই তারাবাইয়ের প্রতিমূর্ত্তি নবাবের শয়নগৃহে আদরে স্থাপিত হয়েছে।
সিরাজ। (স্বগত) ও বুঝ্লেম, সেই তসবিরবাহিকা। (প্রকাশ্যে) সে স্ত্রীলোককে বন্দী কর্বার জন্য বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করা হোক।
দানসাকে লইয়া প্রহরীর প্রবেশ
দানসা। দই জনাব—দই জনাব—মোর কসুর নাই—মোর কসুর নাই। একটা মন্দিরির পাশ দিয়ে আস্তিছিলাম, একটা হদুর ভূত আমার ঘারে চাপ্ছিলো, তাই আবল তাবল বক্তিছিলাম। দই জনাব—জনাবের দোওয়া করি! মুই ফকির, রোজার দিন ছেপ্ গিলছিলাম, তাই হদুর ভূতটা ঘারে চাপ্ছিলো।
সিরাজ। আমরা মুসলমান। তোমার অঙ্গে মুসলমান ফকিরের পরিচ্ছদ, এই জন্য রাজবিদ্রোহী অপরাধেও তোমার প্রাণদণ্ড হলো না। এর নাসা-কর্ণ ছেদ ক’রে, গর্দ্দভের পৃষ্ঠে এরে নগর ভ্রমণ করাও, আর নগরে ঢ্যাঁড্রা দেওয়া হয় যে ফকির রাজদ্রোহী; যদিচ ফকির—এই অনুরোধে সামান্য দণ্ড হ’য়েছে, যে ব্যক্তি রাজদ্রোহী হবে, তার প্রতি শূলদণ্ডের আদেশ।
দানসা। দই জনাবের—দই জনাবের!—হদুর ভূত ঘারে চাপ্ছিলো, হদুর ভূত ধারে চাপ্ছিলো!
দানসাকে লইয়া প্রহরীর প্রস্থান
সিরাজ। সকতজঙ্গের সংবাদ রাসবিহারী এনেছে। বোধ হয় সকলেই অবগত, যে রাসবিহারী, ফৌজদার নির্ব্বাচিত হ’য়ে, আমাদের হুকুমনামা সকতজঙ্গের নিকট ল’য়ে যায়। সকতজঙ্গের উত্তর শুনুন। (রাসবিহারীর প্রতি) রানবিহারী, পত্র পাঠ করো।
রাস।
(পত্র পাঠ)
“সিরাজ, পত্র পাঠ মাত্র মীরজাফর, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ, রায়দুর্লভ প্রভৃতি আমার কর্ম্মচারীদিগকে নবাবী সম্পত্তি বুঝাইয়া দিয়া, সপরিবারে ঢাকা প্রদেশে যাইয়া অবস্থান করিবে। তুমি আমার ভ্রাতা, খুল্লতাতপুত্র, তোমার প্রতি অন্যায় ব্যবহার করা হইবে না; তোমার ভরণপোষণের নিমিত্ত বন্দোবস্ত করা যাইবে। অবাধ্য হইলে তোমার মঙ্গল নাই। আমি রেকাবে পা দিয়া রহিয়াছি। অবাধ্য হইলে অবিলম্বে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইয়া, তোমার প্রতি দণ্ডবিধান করিব। ইতি দিল্লী-সম্রাটের ফার্মান্ অনুসারে বাঙ্গালা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সকতজঙ্গ।”
সিরাজ। এ পত্রের কি বিধান?
জগৎ। উন্মাদ!
রায়দুঃ। দণ্ড বিধান কর্ত্তব্য।
মীরজাঃ। এখন বর্ষাকাল উপস্থিত। ইংরাজ-যুদ্ধে সৈন্যেরা ক্লান্ত। এখন সৈন্য পরিচালনার বিশেষ অসুবিধা।
সিরাজ। শেঠজীর অনুমান সকতজঙ্গ, “উন্মাদ”! কিন্তু দিল্লীর সনন্দের কথা কি? আর আমাদের অমাত্যদিগকে বা সকতজঙ্গ কি নিমিত্ত তার নিজের কর্ম্মচারী ব’লে উল্লেখ ক’রেছে?
জগৎ। জনাব, মদ্যপায়ীর প্রলাপ—প্রলাপ!
সিরাজ। প্রলাপ? সনন্দ প্রলাপ?
জগৎ। জনাব, প্রলাপ ব্যতীত আর কি হ’তে পারে?
সিরাজ। ভাল, রীতি আছে যে শেঠ বংশধরগণ, বাঙ্গ্লার নবাবের জন্য দিল্লী হ’তে ফার্মান আনয়ন করেন। সুতরাং আমাদের নিমিত্ত ফার্মান আনা আপনার উপর ভার, সে ফার্মান কি আনা হ’য়েছে?
জগৎ। অর্থের অভাবে আনা হয় নাই।
সিরাজ। রাজকোষে অর্থের অভাব বা শ্রেষ্ঠিবরের অর্থের অভাব? শ্রেষ্টিগণ নিজ অর্থব্যয়ে পূর্ব্বে পূর্ব্বে ফার্মান আনয়ন করেছেন, পরে রাজ-অর্থে আপনার অর্থ পরিশোধ করে ল’য়েছেন। এস্থলে সে কার্য্য কেন হয় নাই?
জগৎ। অর্থের অভাব—অর্থের অভাব।
সিরাজ। বার বার ঐ কথাই বলছ? অপব্যয়ী সকতজঙ্গের অর্থের অভাব হয় নাই, নবাবী অর্থেরই অভাব হ’য়েছে?
জগৎ। রণব্যয়ে রাজকোষ শূন্য।
সিরাজ। কিন্তু রাজ্য প্রজাশূন্য নয়। এ কথা নবাব-দরবারে কেন জ্ঞাপিত হয় নাই? প্রজার দ্বারা অনায়াসে অর্থের সঙ্কুলান হ’তো।
জগৎ। তা’হলে প্রজা পীড়িত হ’তো
সিরাজ। দয়ার্দ্রহৃদয়! সেই নিমিত্ত অর্থ সংগ্রহ করো নাই? নবাব-দরবারে সাবধানে কথা কও, নচেৎ এখনি বেকুবির দণ্ড হবে। কি বল্বার আছে? তোমার দোষখণ্ডনের কি কথা আছে? কৃতঘ্ন! বারবার মার্জ্জনার এই ফল! নবাব-অন্নে প্রতিপালিত হ’য়ে নবাব-বিরুদ্ধ আচরণ! দুষ্ট, খল, বিশ্বাসঘাতক—এই দণ্ডে তিন কোটী মুদ্রা নবাব-দরবারে উপস্থিত করো, নচেৎ তোমার নিস্তার নাই।
জগৎ। জনাব, বাঙ্গ্লার সিংহাসন তো স্বাধীন, বাঙ্গ্লার নবার দিল্লীর সুবেদার নাম মাত্র। স্বর্গীয় আলিবর্দ্দীর আমল হ’তে তো কর প্রেরিত হয় নাই।
সিরাজ। বিশ্বাসঘাতক, এইমাত্র দরবারে বল্লে, অর্থাভাবে সনন্দ আনা হয় নাই, পরক্ষণেই অন্যপ্রকারে দোষ স্খালনের চেষ্টা পাচ্ছ! রাজদ্রোহী, ধূর্ত্ত, শঠ, এই মুহূর্ত্তে অর্থ উপস্থিত না হ’লে, তোমার প্রতি গুরুতর দণ্ডাজ্ঞা হবে।
জগৎ। তিনকোটী মুদ্রা কোথা পাবো?
সিরাজ। এখনো নবাব সমীপে প্রতারণা? বেইমান! (জগৎশেঠকে চপেটাঘাত) কে আছিস, রাজদ্রোহীকে কারাগারে নিয়ে যা!
জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদকে লইয়া প্রহরীর প্রস্থান
দুষ্ট অমাত্যগণ। (জানু পাতিয়া) জনাব—জনাব—মানী ব্যক্তির অপমান ক’র্বেন না।
সিরাজ। মানী ব্যক্তি কে—শত্রু! নিজ অর্থব্যয়ে দিল্লী হ’তে সকতজঙ্গের নিমিত্ত ফার্মান এনেছে। আমরা চক্ষুহীন নই, কুমন্ত্রণা আমাদের নিকট গোপন নাই। রাজদ্রোহীর সম্পূর্ণ শাস্তি আমরা দিই নাই। এস্থলে কাহারো কোন অনুরোধের আবশ্যক নাই।
মীরজাঃ। জনাব, আমাদের রাজদ্রোহী হবার ইচ্ছা নাই, দিল্লীর ফার্মান যাঁর নিকট, তিনিই নবাব, তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ কর্বো না। আপনার অস্ত্র আপনাকে প্রত্যর্পণ কচ্চি। (অস্ত্রক্ষেপণ)
দুষ্ট অমাত্যগণ। আমরাও দিল্লীর ফার্মান বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে অসমর্থ।(সকলের অস্ত্র নিক্ষেপ)
সিরাজ। বিদ্রোহী—বিদ্রোহী—
মোহন। বিদ্রোহীদের প্রতি কারাগার আজ্ঞা প্রদান হোক।
মীরজাঃ। মোহনলাল, মন্ত্রীর পদ পেয়েছ, তুমি সুমন্ত্রী। নীচ ব্যক্তির উচ্চপদ প্রাপ্তির সফলতা তোমার দ্বারা হবে।
সিরাজ। কি—কি? আপনারা আমায় পরিত্যাগ কর্তে চাচ্ছেন?
মীরজাঃ। জীবন তুচ্ছ!—অপমানিত হবার ইচ্ছা নাই।
মীরমদন। জনাব, আজ্ঞা দেন।
রায়দুঃ। মীরমদন, অকারণ অসিতে হস্তার্পণ কি নিমিত্ত? যদি আমাদের প্রতি বল প্রকাশ হয়, আমরা তো বাধা দিতে প্রস্তুত নই।
সিরাজ। একি—বিষম ষড়যন্ত্র—বিষম ষড়যন্ত্র! মাতামহ কালসর্প পোষণ করেছেন!
বেগে আলীবর্দ্দী-বেগমের প্রবেশ
বেগম। কি করেন—কি করেন? অমাত্যবর্গ—কি করেন? স্বর্গীয় নবাব মৃত্যুকালে, বালক সিরাজকে আপনাদের করে অর্পণ ক’রেছিলেন। মুমূর্ষের শয্যা স্পর্শ ক’রে, ঈশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে সিরাজকে রক্ষা ক’র্বেন। আপনাদের উপর সিরাজের ভার অর্পণ ক’রে, বৃদ্ধ নিশ্চিন্ত হয়ে প্রাণবায়ু পরিত্যাগ করেছেন। বৃদ্ধের নিকট আপনারা সকলেই প্রতিশ্রুত, সে প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হবেন না। সিরাজ বালক, আপনাদের অনেকের ক্রোড়ে বর্দ্ধিত হ’য়েছে। রাজ্যে বিদ্রোহ উপস্থিত। এ সঙ্কট সময়ে এ বালককে পরিত্যাগ ক’র্বেন না। ঘোর বিপদ হ’তে বালককে উদ্ধার করুন। সিরাজ যদি অমর্য্যাদাসূচক কথা ব’লে থাকে, আমি নবাব-মহিষী, সিরাজের পক্ষে আমি মার্জ্জনা প্রার্থনা ক’চ্ছি। বালকের অপরাধ বিস্মৃত হোন। অস্ত্র গ্রহণ করুন—আমি হাতে তুলে দিচ্ছি।
মীরজাঃ। অধিক বলবেন না—অধিক বলবেন না, এই আমি সেলাম ক’রে, নবাবী তরবারী গ্রহণ ক’চ্ছি।
সকলে। আমরা সকলেই নবাবের নিমিত্ত প্রাণদানে প্রস্তুত। এই অস্ত্র গ্রহণ ক’র্লেম।
বেগম। সিরাজ, শ্রেষ্টিবরকে আবার নিমিত্ত আজ্ঞা দাও।
সিরাজ। (মীরমদনকে ইঙ্গিতকরণ ও মীরমদনের প্রস্থান)
বেগম। সিরাজ, স্বর্গীয় নবাবের মৃত্যু-শয্যার পার্শ্বে, কোরাণ স্পর্শ ক’রে, তোমার প্রতিজ্ঞা কি বিস্মৃত হ’য়েছ, মানীর অসম্মান করো? শ্রেষ্ঠিবর আস্ছেন, যথাযোগ্য বিনয়ে তাঁর তুষ্টি সাধন করো। তুমি জনসমাজে নবাব, কিন্তু আমার বালক, আমার আজ্ঞা লঙ্ঘন ক’রো না। তুমি কি বিবেচনাশূন্য হ’য়েছ? যাঁদের অস্ত্রবলে তুমি দুর্দ্দম ইংরাজকে অনায়াসে দমন ক’রেছ, যাঁদের প্রভাবে শত শত্রুর বিরুদ্ধাচরণেও তুমি সিংহাসনে স্থাপিত, সেই সকল অমাত্যের প্রতি অনুচিত ব্যবহার নবাবের উপযুক্ত নয়।
সিরাজ। মাতামহী—মাতামহী, আমায় নবাব কি নিমিত্ত বলো? আমার নবাবী প্রয়োজন নাই; এ স্বর্ণ মুকুট নয়—এ কণ্টক মুকুট! এ রাজদণ্ড নয়—আমারই যমদণ্ড! সিংহাসন আরোহণ অবধি শয়নে-স্বপনে এক মুহূর্ত্তের জন্য আমি নিশ্চিন্ত নই! হায় পূর্ব্বে যদি জান্তেম, জানু পেতে মাতামহকে অনুরোধ ক’র্তেম, যে এ কণ্টকপূর্ণ আসন আমায় দেবেন না, আপনার অপর আত্মীয় আছে, তাদের দেন। মহাশয়, আপনাদের সকলের যদি অভিপ্রেত হয়, যে আমি অযোগ্য, যোগ্য ব্যক্তিকে নির্ব্বাচন ক’রে বাঙ্গলার গদীতে স্থাপন করুন।
মীরজাঃ। জনাব, সমস্ত বিস্মৃত হোন, আমরা রাজভৃত্য।
জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদকে লইয়া মীরমদনের প্রবেশ
বেগম। শ্রেষ্ঠিবর, আমি নবাব-মহিষী!
জগৎ। কেন মা—আপনি হেথায় কেন?
বেগম। আমার বালক সন্তানের রক্ষার্থে! আপনার নিকট অপরাধ স্বীকার কর্বার নিমিত্ত! বৃদ্ধ মৃত্যুকালে আপনাদের হস্তে সিরাজকে অর্পণ করেছিলেন, আমিও অন্তঃপুর পরিত্যাগ ক’রে দরবারে উপস্থিত হ’য়ে, সিরাজকে আপনাদের হস্তে সমর্পণ কচ্ছি। বিপদের সময় সিরাজকে ত্যাগ কর্বেন না। সকতজঙ্গ সজ্জিত, আপনারা সকলে আমার সিরাজকে রক্ষা করুন। সিরাজ, শ্রেষ্ঠিবরের সম্মান করো।
সিরাজ। শ্রেষ্ঠিবর, ক্রোধ চণ্ডাল, নবাবও চণ্ডালগ্রস্ত হয়। আপনি বিজ্ঞ এ কথা আপনার অবিদিত নাই।
সকলে। বাঙ্গলা-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতিকে আমরা সকলে অভিবাদন করি। আমরা রাজভৃত্য।
সিরাজ। কুক্ষণে দরবার সন্নিবেশিত হয়েছে, অদ্যকার সভা ভঙ্গ হোক।
মীরজাঃ। দরবার ভঙ্গ হোক, কিন্তু সকতজঙ্গ-বিরুদ্ধে যুদ্ধ-আজ্ঞা প্রদান অচিরে আবশ্যক।
সিরাজ। উচিত বিধান আপনারা করুন।
সকলের প্রস্থান