সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/প্রথম অঙ্ক/একাদশ গর্ভাঙ্ক
(পৃ. ৫১-৫৫)
একাদশ গর্ভাঙ্ক
মুর্শিদাবাদ—সুসজ্জিত তোরণ
নাগরিকগণের গীত
আস্ছে ওই নবাব বাহাদুর।
জঙ্গ্লা কাঙ্গ্লা ফিরিঙ্গি সব বাঙ্গ্লা হ’তে হ’লো দূর॥
গুড়ুম গুড়ুম নবাবী কামান, পাহাড় হয় দু’খান,
কোল্কাতায় নবাবী নিশান;
কার্দানি ছ’রকুটে গেছে, ভেঙ্গেছে বিলাতী ভূর॥
ঘুচেছে হুট মুট গুট, দিয়েছে পাল তুলে ছুট,
নাইকো আর ড্যাম্ ড্যাম্ ড্যাম্—
ফের্কে দু’ঠ্যাং ঠুকে বুক, ফুঁ’কে চুরুট্;
নাই বাগিয়ে ঘুসি চোখ রাঙ্গানি
ঘেউ ঘেউয়ে বুলডগি সুর॥
সকলের প্রস্থান
মোহনলাল ও লছমনসিংহের প্রবেশ
মোহন। এত শীঘ্র রাজ্যে বিদ্রোহের সূচনা! সকতজঙ্গের কর্ম্মচারীরা কার্য্যকুশল বটে। কই—কে—কোন ফকির?
লছমন। আজ্ঞে, এই দিকেই এসেছে।
মোহন। আর যে একজন স্ত্রীলোক বল্লে?
লছমন। আজ্ঞে, সে লোকের অন্দরে প্রবেশ ক’রে ঘরে ঘরে জাঁহাপনার অপবাদ দিচ্ছে, আমার ভগ্নীর নিকট সংবাদ পেলেম।
মোহন। কি বলে?
লছমন। বলে—এইবার নবাব এসে দেশে আর সতী রাখ্বে না। ইংরাজদের ভয় ছিল, তাই এতদিন দৌরাত্ম্য করে নাই। আবার না কি নবাবদূত রাণী ভবানীর কন্যা তারাবাইকে আন্বার জন্য প্রেরিত হয়েছে। আর ফকির ব’লে বেড়াচ্ছে, যতদিন সকতজঙ্গ না বাঙ্গ্লার গদীতে বসে, ততদিন দেশ ছেড়ে সকলে পালাও। নবাব এসে সব কোতল কর্বে, ঘর পোড়াবে, জলে ডোবাবে। যার বাহুতে বল আছে, সে সকতজঙ্গের পক্ষ হও।
মোহন। সেই স্ত্রীলোকের কি বেশ?
লছমন। ফকিরণীর বেশ।
মোহন। আমায় নবাব মুর্শিদাবাদ রক্ষার নিমিত্ত রেখে গিয়ে দেখছি বড় সুযুক্তির কার্য্য করেছেন। বিদ্রোহী সকতজঙ্গের কর্ম্মচারীরা, এরূপ রাজ্যে প্রজার মনে বিদ্বেষ জন্মাবার চেষ্টা কর্বে, আমার ধারণা ছিল না। এই সকল বিদ্রোহীদের দমন করা অতি প্রয়োজন।
লছমন। হ্যাঁ জনাব, অনেক নির্ব্বোধ প্রজার মনে আতঙ্ক জন্মেছে।
মোহন। ফকির অতি দুর্জ্জন! কিরূপ অপবাদ রটনা কচ্ছে দেখো। নবাব এখন প্রকৃত প্রজাপালক। বৃদ্ধ নবাবের মৃত্যুর পর যৌবনসুলভ চপলতা আর নাই; মদ্যপান পরিত্যাগ করেছেন, অসৎসঙ্গীদের বিদায় দিয়েছেন। প্রজার মঙ্গল তাঁর একমাত্র কামনা।
লছমন। ঐ ফকির আস্ছে।
দানসার প্রবেশ
মোহন। ফকিরজি সেলাম!
দানসা। সেলাম তো বটে! আমোদ কত্তিচ, নবাবটা আস্তিছে, হুশ রাখো না। সহরে কোতল হুকুম দিচে, কারো গর্দ্দান থাক্পে না।
মোহন। বটে ফকিরজি বটে!
দান্সা। হঃ—খালি কাট্তি কাট্তি আস্তিচে। জোয়ান মেয়ে ছেলেটা পেলি জাত খাতিচে। প্যাটে পোয়ে দেখ্লেই প্যাট চিরে দেখ্তিচে—প্যাটে ছ্যালেটা কেমন থাহে!
মোহন। বটে ফকির সাহেব বটে!
দানসা। বিশখানা লায়ের মদ্দি আদ্মি ভত্তি করি, দরিয়ার বিচে ডোবাইচে; হাপইয়ে জল খাইয়ে কেমন মরে দেখ্তিচে! ঘরের মদ্দি আদ্মি পুরে তালা লাগাইয়ে, আগুন ধরাইচে; আদ্মিগুলো জ্বালার চোটে চ্যাল্লাচ্চে, শুন্তিচে আর হাস্তিচে!
মোহন। তবে ফকির সাহেব—কি হবে ফকির সাহেব!
দানসা। যাও—মোর সলানী শুনো। বালবাচ্চা নিয়ে পূর্ণিয়া যাও তোমায় জোয়ান দেখতিচি, সকতজঙ্গের ফৌজ হও যাইয়ে। খেলাত পাবা, টাকা পাবা, আর জুয়ান ব্যাটার মত কদরে থাক্বা।
লছমন। আর বুড়োদের কি কচ্ছে?
দানসা। মাটীর মদ্দি আদ গাড়ি কুত্তা খাওয়াচ্চে!
মোহন। কেন বল দেখি ফকিরজি, এত দৌরাত্ম্য কেন কচ্ছে?
দানসা। তবে শোনবা? একটা জিন এসে ওর বেগম হইচে। সে বিটীর নাম লুৎফন্নিসা। হাজার আদ্মির লউ না পিলি তার পিয়াস ছোটে না! এই ছোট ছ্যালের কাবাব বড় পছন্দ করে। তার দু’পাল কোত্তা আচে, সেগুলোন বুরোবুরীর মাস খাবে আর কিচু খাতি চায় না। এই শুন্লে, এখন আপনার লোক যে যেখানে পাও, নিয়ে চলে যাও।
মোহন। তা হ্যাঁ ফকিরজি—তুমি পালাচ্ছ না?
দানসা। আমায় কেডা কি করে? মুই সেই জিন বেগমটারে ধর্বার আইচি। বুরা হইচি, এখন আর চল্তি পারি না। দুকুরি মাইয়া জিন রাখ্চি, এই তারি উপর শোয়ার হ’য়ে চলি। ব্যাগম জিনটা ভারি জবর সোয়ারি; ওরে ধর্বার আইচি।
মোহন। ফকির সাহেব, তাই জিনটাকে ধরে নিয়ে যাও, তা’হলে তো আপদ চুকে যায়, তা’হলেই তো আর আমাদের ভয় নাই?
দানসা। আরে জিন কি একটা পুষ্চে, একটা মরদ জিন পুষ্চে।
মোহন। তার নাম কি ফকিরজি?
দানসা। লালমুহুনে।
মোহন। সে কি খায়?
দানসা। জোয়ান ব্যাটাছেলের মগজের চর্ব্বি খায়।
মোহন। এবার ত বল্তে পার্লে না ফকিরজী, এবার ত বল্তে পার্লে না,—সে কি খায় জানো? ফকিরের ঘাড়ের রক্ত খায়।
দানসা। চালাক কচ্চ—চালাক কচ্চ? ফকিরের সাতি চালাকি? দ্যাখ্বে এনে—দ্যাখ্বে এনে!
মোহন। না ফকিরজী, তুমিই দেখবে এনে। এই দেখ। (বন্ধন)
দানসা। অ্যা ফকিরকে বাদ্চো—ফকিরকে বাদ্চো?
মোহন। বাঁধবো না, আমিই যে লালমুহুনে জিন। তোমার ঘাড়ের রক্ত খাবো।
দানসা। হ্যাদে তুমি এমন লোকটা—তামাসা বোঝো না—তামাসা বোঝো না? তুমি জান না—জান না—কেতাবে লিখ্চে নিন্দি কর্তি হয়, নবাবের পেরমাই বারে।
মোহন। জানি। আর যে নিন্দা করে, তার পরমায়ু কমে। (লছমনের প্রতি) একে কারাগারে নিয়ে যাও।
লছমন। আর কারাগারে কেন? এইখানেই প্রাণবধ করুন, প্রজাদের দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করুন।
মোহন। না—ফকিরবেশধারী, এর প্রাণদণ্ড করা আমার উচিত নয়, নবাব স্বয়ং দণ্ড দেবেন।
দানসা। কই মোহনচাদ, মোরে ছারান দাও, তোমায় পান খাইবার কিছু দিতিচি।
মোহন। ফকিরের কি আছে দেখো, সমস্ত সরকারীতে জমা দিয়ো।
দানসা। কি কর্লাম, কেন সয়তানী বেটীর সলায় ভেজ্লাম।
মোহনলাল ও লছমনের সহিত বন্দীভাবে দান্সার হাঁ করিয়া প্রস্থান