সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/প্রথম অঙ্ক/দশম গর্ভাঙ্ক

দশম গর্ভাঙ্ক

কলিকাতা—ফোর্ট উইলিয়মস্থ নবাব-দরবার

সিরাজদ্দৌলা, মীরজাফরঃ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ, রাজবল্লভ, মাণিকচাঁদ, মীরণ প্রভৃতি

বন্দী অবস্থায় হলওয়েলকে হইয়া দূতের প্রবেশ

সিরাজ। কি নিমিত্ত মানীলোকের অসম্মান ক’রে সাহেবকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়েছে? শৃঙ্খল-মুক্ত করো। (শৃঙ্খল-মুক্ত হইয়া হল্‌ওয়েলের জানু পাতিয়া অভিবাদন) হল্‌ওয়েল, বোধ হয় এখন বুঝেছ, যে বারবার নবাবের অসম্মান করা তোমাদের পক্ষে যুক্তিসিদ্ধ হয় নাই।
হল। জনাব, আমি পুলিসের অধ্যক্ষ, ড্রেক সাহেব গভর্ণর ছিলেন।
সিরাজ। তিনি স্বয়ং তো জাহাজে পলায়ন করেছেন শুন্‌তে পাই। তোমার বীরত্বে আমি পরম সন্তুষ্ট। আমার ধারণা ছিল, ড্রেক যেরূপ দাম্ভিকতা প্রকাশ করেছে, সে যুদ্ধে প্রাণ দেবে কদাচ পলায়ন কর্‌বে না।
হল। জনাব, he is a brave man, অনুমান হয়, উল্টা বায়ুতে তিনি আসিতে পারেন নাই।
সিরাজ। হল্‌ওয়েল, তোমরা উচ্চজাতি, তার আর সন্দেহ নাই। তোমাদের নিকট জাতীয়তা শিক্ষা করা আমাদের কর্ত্তব্য। ড্রেকের সম্পূর্ণ দোষে বিপদগ্রস্ত হ’য়েও, বন্দী-অবস্থায় তার নিন্দার প্রতিবাদ কচ্ছ; তোমাদের নিকট জাতীয়তা শিক্ষা করা বাঙ্গলার কর্ত্তব্য। আমরা তোমার এই বীরোচিত ব্যবহারে তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। আমি এখন বুঝ্‌লেম্, কি নিমিত্ত অপরাপর পাশ্চাত্য জাতি অপেক্ষা দাক্ষিণাত্যে তোমাদের এত উন্নতি। যারা যারা বন্দী হয়েছে, তাদের জীবনের কোন শঙ্কা নাই। যদি শেষ অবস্থায়ও তোমরা সরলভাবে সন্ধির প্রার্থনা কর্‌তে, এ অবস্থাপন্ন হ’তে না।
হল। জনাব, আমরা সন্ধির প্রার্থনা করিয়া, দুর্গ প্রচীর হইতে চিঠি ফেলিয়া দিলো। একটা লোক চিঠি লইয়া গেল, কিন্তু নবাবী কোন হুকুম হইল না।
সিরাজ। সেনানি মাণিকচাঁদ, এ কথা কি সত্য? আপনার সেনাই তো দুর্গ-প্রাচীর আক্রমণ করেছিল।
মাণিক। জনাব, পত্রের কথা বান্দা কিছুই অবগত নয়।
সিরাজ। এরূপ অনেক পত্র আমাদের গোচর হয় না। এ অনিয়ম অমাত্যবর্গের সংশোধন করা উচিত। (মীরজাফরের প্রতি) মীরজাফর খাঁ বাহাদুর, আপনি এই ফিরিঙ্গি বন্দীর ভার গ্রহণ করুন।
মীরণ। (জনান্তিকে মীরজাফরের প্রতি) আমি ভার গ্রহণ কচ্ছি।
মীরজাঃ। উত্তম।
মীরণ। (দূতের প্রতি) আমার সঙ্গে সাহেবকে নিয়ে এসো। (স্বগত) মেম বেটীদের কোথায় ধরে রেখেছ!
মীরণ, হলওয়েল ও দূতের প্রস্থান
রাজবঃ। (জনান্তিকে রায় দুর্লভের প্রতি) ঐ কৃষ্ণদাসকে নিয়ে আস্‌ছে, আজ আমি পুত্রহীন হ’লেম।
রায়দুঃ। জনান্তিকে) ভগবান্‌কে ডাকুন, নবাবকে কোনরূপ অনুরোধ ক’রুতে তো আমার সাহস হচ্ছে না।
সিরাজ। রাজা রাজবল্লভ, চিন্তা দূর করুণ। নবাবের মার্জ্জনা আছে, তা কি আজও আপনাদের অনুমিত হয় নাই। রাজা রাজবল্লভ আপনাকে জিজ্ঞাসা কচ্ছি।
রাজবল্লভের সেলামকরণ

উমিচাঁদ ও কৃষ্ণদাসকে লইয়া দোস্ত মহম্মদের প্রবেশ ও
উভয়ে দবাবের সম্মুখে জানু পাতিয়া অভিবাদন

কৃষ্ণদাস, উমিচাঁদ, আসন গ্রহণ করো। এঁদের কোথায় দেখা পেলেন?
দোস্ত। জনাব, অন্ধকূপের ন্যায় একটা গৃহে এঁরা বন্দী ছিলেন।
সিরাজ। উমিচাঁদ, নবাবী অধিকার অপেক্ষা কলিকাতা নিতান্ত নিরাপদ স্থান নয়, এতদিনে ধারণা হ’য়ে থাক্‌বে।
উমি। জনাব, জনাব—কারবারের সুবিধার নিমিত্ত কলিকাতায় ছিলেম; সমুচিত দণ্ড হয়েছে, আমার সর্ব্বস্ব গিয়েছে।
সিরাজ। কৃষ্ণদাস, নবাব-চরিত্র তুমি অবগত ছিলে না, সেই নিমিত্ত কলিকাতায় এসে ইংরাজের শরণ নিয়েছিলে। আমরা যৌবনসুলভ অনেক দোষে দোষী স্বীকার করি, কিন্তু কেউ শরণাগত হ’য়ে আশ্রয় পায়নি, বা গুরুতর অপরাধ ক’রে মার্জ্জনা প্রার্থনায় দোষ মাপ হয় নি, বোধ হয় আমাদের শত্রুর মুখেও শুন্‌বে না। বিদেশী আপনার হয়, ইতিহাস-পৃষ্ঠায় এর দৃষ্টান্ত নাই। তুমি তোমার পৈতৃক আশ্রয়দাতা বর্জ্জন ক’রে সমুচিত ফলভোগ ক’রেছ,—ফিরিঙ্গির দুর্ব্বচন সহ্য ক’রেছ,—দোষ অপেক্ষা তোমার দণ্ড অধিক হ’য়েছে।
কৃষ্ণ। জনাব—জনাব, ফিরিঙ্গির দ্বারা পীড়িত হওয়া অপেক্ষা আত্মগ্লানিতে বান্দার অধিক দণ্ড হ’য়েছে।
সিরাজ। যাঁর হৃদয়ে ধারণা, যে স্বদেশী অপেক্ষা বিদেশী আপনার হয়, তাঁর সে ধারণা যে সম্পূর্ণ ভ্রম; এই উমিচাঁদ আর কৃষ্ণদাসের প্রতি বিদেশীর ব্যবহার তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। চখের উপর এই দৃষ্টান্ত দর্শন ক’রে যার ভ্রম দূর না হবে, যে হিন্দুর বা মুসলমান স্বার্থচালিত হ’য়ে স্বদেশের প্রতি ঈর্ষায় বিদেশীর আশ্রয় গ্রহণ কর্‌বে, সে কুলাঙ্গার! মাতৃভূমির কলঙ্ক! তার জীবন ঘৃণিত!! এই দৃষ্টান্তে যদি বঙ্গবাসীর মনে প্রতীতি জন্মায়, যে শত দোষে দোষী হ’লেও স্বদেশী আপনার, বিদেশী চিরদিনই পর, তাহ’লে আমাদের যুদ্ধশ্রম ও রণব্যয় সফল!
সকলে। (জানু পাতিয়া) জনাব স্বরূপ বলেছেন।
সিরাজ। ঈশ্বর—বাঙ্গ্‌লায় এই বিশ্বাস দৃঢ় করুন। রাজা মাণিকচাঁদ, আজ হ’তে কলিকাতায় আপনি আমাদের প্রতিনিধি। কলিকাতার পরিবর্ত্তে এ স্থানের নাম আজ হ’তে আলিনগর। প্রজারা ভয়ে স্থান পরিত্যাগ ক’রেছে। অদ্য রাত্রেই ঘোষণা দেন, কারো কোন ভয় নাই;—সকলেই নিজ নিজ আবাসে প্রত্যাগমন করুক। নগরে শান্তি স্থাপিত হোক।
মাণিক। নবাবের বদান্যতায় দাস বহু সম্মানিত।
সিরাজ। দরবার ভঙ্গ হোক।
সিরাজদ্দৌলা, মাণিকচাঁদ প্রভৃতি কয়েকজনের প্রস্থান
রায়দুঃ। দেখুন—কি অপমান, সামান্য সেনানী মাণিকচাঁদ প্রতিনিধি নিযুক্ত হলো।
করিম। কৃষ্ণদাসেরও বড় অপমান হ’লো,—রাজবল্লভ চাচা কি বলেন?
রায়দুঃ। কিছু বিশ্বাস নাই। “অব্যবস্থিতচিত্তস্য প্রসাদোঽপি ভয়ঙ্কর!” আজ এক ভাব, কাল যে কে অপমানিত হবে তার নিশ্চয়তা নাই।
করিম। তাইতো—এখনতো ইংরেজ কুপোকাৎ হলো। ফরাসী, ওলন্দাজ,—ওদের উদ্বাস্তু ক’রে তেমন কাজ হবে না; আর ওরা ইংরাজের দশা দেখে ঘেড়োবেও না। এখন গিয়ে সকতজঙ্গের ঘাড়ে চাপো,—আর তো উপায় দেখছি নে।
রায়দুঃ। করিম চাচা, তুমি আমার অন্নে পালিত;—তোমার সহিত আমার দূর সম্পর্ক মাত্র। আমার অনুরোধে আমির-ওম্‌রাও সকলে তোমায় ভালবাসে। তোমার কামিনীকান্ত নামের পরিবর্ত্তে আদর ক’রে “করিমচাচা” ব’লে ডাকে। দেখ্‌ছি তুমি নবাবের নিকট ভাঁড়ামি ক’রে তার প্রিয় হ’য়েছ, সেই নিমিত্ত গর্ব্বে যথারীতি সকলকে সম্মান প্রদান করো না। তোমার সকল কথায় কথা কওয়া ভাল নয়।
করিম। কেন বাবা, সভায় থাকলে, একজনকে দিয়ে তো প্রস্তাব করা চাই। আমি সুর ধরিয়ে দিলুম, এখন যে যার আঁতের কথা খোল্‌বার সুবিধা পাবে।
মীরজাঃ। ছিঃ, তুমি বড় বেয়াদব হ’য়েছ।
করিম। চাচা উমিচাঁদ, কিছু বেয়াদবি হয়েছে কি? বেকুব নবাব, নবাবীই জানে না; কারুর গর্দ্দানা নেবার হুকুম দেয় না,—ওকে আগে তক্তা থেকে নাবাও। এমন একজন নবাবকে বসাও, যে হুট্ ব’ল্‌তে জুতো শুদ্ধ লাথি ঝাড়ে, যে কয়েদ ক’রে টাকা আদায় করে! টাকা ভাঙ্গ্‌লে মাপ, শত্রুতা ক’র্‌লে মাপ,—এ ব্যাটা কি নবাব, ছ্যাঃ! জিব শুকুচ্ছে বাবা, চল্‌লেম, পরামর্শ কি আঁট্‌বে আঁটো। ভেব না, যা মুখে এলো, বল্‌লেম, আর পেটে কিছু নাই! আগুন খাও, আঙ্গ্‌রা ছ্যারাবে! আমার কি বাবা! দু’টান চণ্ডু আর দু’পেয়ালা মদ,—তোমাদের পাঁচ জনের কল্যাণে জুট্‌বে! যেতে যেতে বাবা তোমাদের একটা তারিফ দিয়ে যাই। এই যে কৃষ্ণদাসকে ছেড়ে দিলে, তাতে একটা বাহবা দিলে না বাবা!
করিম চাচার প্রস্থান
মীরজাঃ। আজ রাত্রি অধিক হ’য়েছে, নিজ নিজ শিবিরে যাই চলুন।
সকলের প্রস্থান

করিম চাচার পুনঃ প্রবেশ

করিম। মীরণ চাচা চ’লে গেল, চণ্ডুর যোগাড় কে করে। কালাচাঁদ, তোমার প্রেমেই আজ যামিনী যাপন করি। এইটেতে নবাব বসেছিল না? একবার হেলে বসি। (নবাব-সিংহাসনে উপবেশন) উহুঁ—হলো না—এ জায়গা বড় সোজা নয়, এ ফোর্ট উইলিয়াম, এখানে অনেক ব্যাটাকে সেলাম দিতে হবে,—এখানে অনেক মুকুট গড়াগড়ি যাবে। ফোর্ট উইলিয়াম, আমি তোমায় আগে সেলাম দিই বাবা? কিছু ভেবো না—তোমার এ শ্রী থাক্‌বে না, তোমার পুষ্যিপুত্রেরা জাহাজ ক’রে এলো বলে। ও মাণ্‌কে ফাণ্‌কের কাজ নয়, ও মাণ্‌কে ফাণ্‌কের কাজ নয়। রসোনা দু’দিন হুকুম চালাগ, দু’দিনে বাবা “লাড ঈশ্বর গাড ঈশ্বর” ক’রে পালাবে! আমিই “লাড ঈশ্বর গাড ঈশ্বর” ক’রে ভাগি। তাইতো কামিনী, অর্দ্ধযামিনী, একাকিনী কোথায় যাবে! মাঠে হাওয়ায় শয়ন কর্‌বে? আজ আমি একটী অপূর্ব্বা নায়িকা হবো। আকাশ চন্দ্রাতপ, ধরণী শয়ন, আহা বিরহ আর সহ্য হয় না। যদি সুরা-সমুদ্র পেতেম, ঝাঁপ দিতেম। ওঃ এত গোলাগুলি রয়েছে, দুটো চার্‌টে আফিমের ছিটে কেউ দিতো, মনের ব্যথা নাক ডাকিয়ে প্রকাশ কর্‌তেম। মীরজাফর চাচা কি না চণ্ডু টেনে শোবে। চাচা আমার গদীতে বস্‌লে নাকে-কাণে-মুখে নল দিয়ে চণ্ডু টান্‌বে।
প্রস্থান