সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/প্রথম অঙ্ক/প্রথম গর্ভাঙ্ক

সিরাজদ্দৌলা

প্রথম অঙ্ক

প্রথম গর্ভাঙ্ক

মুর্শিদাবাদ—মতিঝিল-কক্ষ

ঘসেটীবেগম ও রাজা রাজবল্লভ

রাজবঃ। বেগম সাহেব, আমাদের সকল আশা নিষ্ফল! সিরাজ নির্ব্বিঘ্নে সিংহাসন লাভ করেছে। সেনাপতি মীরজাফর, মন্ত্রী রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ প্রভৃতি প্রধান প্রধান অমাত্যবর্গ, মৃত্যু-শয্যায় বৃদ্ধ আলিবর্দ্দীর বিনয়বচনে সিরাজের দুর্নীত আচরণ মার্জ্জনা করেছে।
ঘসেটী। এই সংবাদ দিতে এসেছ? স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক, এই জন্য কি আমি তোমার কথায় সৈন্য সঞ্চয়ের নিমিত্ত জলস্রোতের ন্যায় অর্থ ব্যয় করেছি? ভীরু, কাপুরুষ, তুমি এই সংবাদ দিতে এসেছ?
রাজবঃ। বেগম সাহেব, আমার কোন অপরাধ নাই। আমি সত্য বল্‌চি, রাজকর্ম্মচারীরা সকলেই সিরাজের বিরূপ ছিল, কিন্তু বৃদ্ধ নবাবের অন্তিম বিনয়নম্র বচনে সকলে বশীভূত হয়েছে।
ঘসেটী। রাজবল্লভ, তুমি এত সরলচিত্ত কতদিন হয়েছ? সরল চক্ষে সকলকে দেখ্‌তে কতদিন শিখেছ? বৃদ্ধের বিনয়ে সকলের অন্তর দ্রব হয়েছে—না? তোমার অন্তরও হয়েছে না কি? তোমার পুত্র কৃষ্ণদাস যে নবাবী অর্থ লয়ে কলিকাতায় ইংরাজের শরণাগত হয়েছে, সেই অর্থ প্রত্যর্পণ কর্‌বার নিমিত্ত তারে মুর্শিদাবাদ প্রত্যাগমন করতে পত্র লিখেছ না কি? পিতা-পুত্রে সেই অর্থ নবাবের চরণে অর্পণ ক’রে মার্জ্জনা প্রার্থনা কর্‌বে না কি?
রাজবঃ। বেগম সাহেব, তিরস্কারের সময় নয়, সর্ব্বনাশ উপস্থিত। ধনরত্ন যা পারেন, যতদূর সাধ্য গোপন করুন, সিরাজ-সৈন্য মতিঝিল আক্রমণে অগ্রসর।
ঘসেটী। আমার সৈন্য কোথায়?
রাজবঃ। আপনার সর্ব্বাপেক্ষা বিশ্বাসপাত্র, প্রধান মন্ত্রণাদাতা মীর নজরআলী, আক্রমণ সংবাদ পাবা মাত্র সৈন্য ল’য়ে পলায়ন করেছে। সৈন্যের কর্ত্তৃত্ব ভার তাঁরই উপর ছিল। আমায় বৃথা অপরাধী কচ্ছেন; এক্ষণে আপনি সতর্ক হোন। শীঘ্রই সিরাজ আপন দুর্ব্যবহারে সকল মন্ত্রীকেই প্রকাশ্য শত্রু কর্‌বে। সুযোগ অনুসন্ধানে আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
ঘসেটী। হ্যাঁ—সুযোগ অনুসন্ধান! যে দিন সিরাজ যুবরাজ হ’লো, সেইদিন হ’তে সুযোগ অনুসন্ধান কচ্ছ। দিন গেল, তোমার সুযোগ আর উপস্থিত হলো না! এক্রামদ্দৌলাকে সিংহাসন দেবে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, সে সুযোগ হ’লনা, বাছা কবরশায়ী হ’লো। তোমার স্বার্থপর হৃদয়, তুমি জান না, আমার সেই পালিত পুত্র গর্ভের সন্তান অপেক্ষা প্রিয় ছিল; তুমি জান না, সে কি বজ্রাঘাত আমার বুকে ক’রে গেছে। এখন দেখ্‌ছি তার শিশুসন্তান মোরাদদ্দৌলা কবরশায়ী না হ’লে আর তোমার সুযোগ হবে না। যাও দূর হও। ছিঃ ছিঃ, এই কাপুরুষকে কেন প্রত্যয় ক’রেছিলেম! যাও যাও দূর হও! নবাবকে সেলাম দাওগে!
রাজবঃ। আমার অপরাধ নাই—আমার অপরাধ নাই। ঐ সৈন্য-কলরব শোনা যাচ্ছে। আপনি সতর্ক হোন, আমি চল্লেম।
প্রস্থান
ঘসেটী। কি হলো—কি হবে—সত্যই তো সৈন্য-কোলাহল শুন্‌ছি। কেন মীর নজরআলির কপট প্রেম-বচনে কর্ণপাত করেছিলেম, কেন ভীরু রাজবল্লভকে প্রত্যয় করেছিলেম; কেন আমি ঈর্ষ্যাবশে হোসেনকুলির বধে সম্মত হলেম! এই কাপুরুষ রাজবল্লভের পরিবর্ত্তে সে জীবিত থাকলে, সিরাজ নিদ্বণ্টকে কখনই সিংহাসন পেত না।

জহরার প্রবেশ

জহরা। বেগম সাহেব, পরিচয়ের সময় নাই,—আপাততঃ জানুন, আমি আলিবর্দ্দী-বেগমের পরিচারিকা। আপনার ধন-রত্নের জন্য চিন্তিত হবেন না; ঝিলগর্ভে গুপ্তভাণ্ডার কেউ জান্‌তে পার্‌বে না; আর আপনার জহরৎ প্রভৃতি যা কিছু আছে, আমি সমস্তই সংগ্রহ ক’রে আপনাকে দেবো। নবাব আপনাকে রাজপুরে ল’য়ে যেতে আপনার নিকট আস্‌ছে, প্রতিরোধ কর্‌বেন না। প্রকাশ শত্রুতায় ফল নাই, স্নেহের আবরণে শত্রুতা গোপন করুন। ঐ আপনার মাতা আস্‌ছেন।
প্রস্থান

আলিবর্দ্দী-বেগম ও আমিনার প্রবেশ

আলি-বেগম। মা ঘসেটী, তুমি অভিভাবকহীনা, এই নিমিত্ত সিরাজের ইচ্ছা, তুমি রাজ অন্তঃপুরে তোমার কনিষ্ঠা ভগ্নি আমিনার সঙ্গে বাস করো।
আমিনা। এসো দিদি, বাল্যকালের ন্যায় দুই ভগ্নি একত্রে বাস করি। এখন তো আমরা উভয়ে স্বামীহীনা।
ঘসেটী। মা আমি পতিহীনা, সহায়হীনা, আমার সহিত ছলনার প্রয়োজন কি? সরল ভাষায় বলুন, আমার স্বামীর আবাস হ’তে বন্দী ক’রে নে যেতে এসেছেন। মতিঝিল আমার স্বামী বড় যত্নে নির্ম্মাণ করেছিলেন, আমায় এইস্থানে থাক্‌বার আদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি বন্দী, সে আদেশপালনে সক্ষম নই। নবাবের ইচ্ছা প্রতিরোধ করা আমার শক্তি নাই।

সিরাজদ্দৌলার প্রবেশ

সিরাজ। আপনি বন্দী নন, নবাব-মাতার ন্যায় রাজপুরে আদরে অবস্থান করবেন।
ঘসেটী। নবাব-মাতার তো অনেক বাঁদী আছে, তবে আমার যাবার প্রয়োজন কি?
আমিনা। কেন দিদি, অমন কথা বল্‌ছো,—আমি তোমার ছোট ভঙ্গি, আমি তোমার বাঁদী।
সিরাজ। আপনি অন্যায় বোঝেন, উপায় নাই, এস্থান আপনাকে পরিত্যাগ কর্‌তে হবে।
ঘসেটী। কেন?
সিরাজ। কেন?—আপনি কি সত্যই অবগত নন! সরল ভাষায় শুনুন,—জনশ্রুতি এইরূপ, যে এক্রামদ্দৌলার পুত্রকে সিংহাসন দেবার ষড়যন্ত্র এই লালকুঠিতে হয়। অচিরে সেই শিশু পুত্রের সিংহাসন লাভ হবে, রাজা রাজবল্লভ দেওয়ান হবেন, আমরা রাজ্যচ্যুত হব;—এই সাহসে রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে ইংরাজ কলিকাতায় আশ্রয় দিয়েছে; আর পুনঃ পুনঃ আমাদের আজ্ঞা অমান্য ক’রে তাকে ঢাকার হিসাব-নিকাসের জন্য মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করে নাই এবং অপরাপর আদেশও উপেক্ষা করেছে। আপনি রাজপুরে অবস্থান কর্‌লে, সে জনশ্রুতি থাকবে না। রাজ্যের মঙ্গল হবে, আর ইংরাজ প্রভৃতি রাজ্যের শত্রুরা শাসিত হবে।
ঘসেটী। অযথা জনরব, ইংরাজ আজ্ঞা লঙ্ঘন কচ্ছে, রাজ্যের শত্রুরা নিয়মাধীন নয়,—এর সহিত আমার কি সম্বন্ধ? তুমি নবাব, আমায় বন্দী কর্‌তে এসেছ—এই কথাই তো যথেষ্ট!
সিরাজ। আপনিই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সেই নিমিত্ত সরল ভাষায় আপনাকে বোঝাবার প্রয়াস পেয়েছি। জনরবে রাজ্যের অমঙ্গল; আপনি রাজপুরবাসিনী হ’লে, সে জনরব থাক্‌বে না। সেই নিমিত্তই আপনাকে ল’য়ে যেতে এসেছি। আপনি যেতে প্রস্তুত হোন।
ঘসেটী। রাজ্যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, ইংরাজ নবাবের অবাধ্য, নানা প্রকার জনশ্রুতি,—এইজন্য আমার উচ্ছেদ হবে? এইজন্য আমি আবাসহীনা হবো? এইজন্য, এক্রামদ্দৌলার পুত্র তোমার অন্নদাস হবে? ভাল, হোক! নবাব বাহাদুর, বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার অধিকারী, দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্তা! পতিচীনা, অসহায়া রমণীকে বাসচ্যুত করা তোমার প্রথম নবাবীর পরিচয়। তোমার কূলনারীর সম্পত্তি অপহরণ, তোমার প্রথম রাজকার্য্য। তোমার প্রথম কার্য্যে তোমার কুলনারীর অশ্রু-বিসর্জ্জন;—এই আরম্ভ কিন্তু শেষ নয়। তোমার কূলনারীর অশ্রু, বারিধারার ন্যায় এই বাঙ্গ্‌লায় পতিত হবে, কিন্তু সে অশ্রু-বিসর্জ্জনে বঙ্গভূমি শীতল হবে না। সে অগ্নিময় অশ্রুধারায় নগর দগ্ধ হবে, অট্টালিকা দগ্ধ হবে, রাজ্য ভস্মীভূত হবে, হাহাকার-ধ্বনিতে দিঙ্মণ্ডল পরিপূর্ণ হবে। তোমার কুলনারী আবাসহীনা হওয়া এই প্রথম, শেষ নয়। তোমার কুলনারী আবাসহীনা হবে, পথে পথে ভ্রমণ কর্‌বে, ভিক্ষা-অন্নের জন্য ব্যাকুলা হবে, আকাশ ব্যতীত অপর আচ্ছাদন থাক্‌বে না। মা কোথায় যেতে হবে বলুন, আমি প্রস্তুত।
আলি বেগম। চল মা শিবিকা প্রস্তুত।
ঘসেটী, আলীবর্দ্দী-বেগম ও আমিনার প্রস্থান

জহরার প্রবেশ

সিরাজ। কে তুমি?
জহরা। আমি নবাব-মহিষীর বাঁদী, তাঁহার আজ্ঞায় ঘসেটিবেগমের পরিচ্ছদ নিতে এসেছি।
সিরাজ। তুমি কোথায় থাক?
জহরা। আমি সর্ব্বত্রে থাকি, আমি এক মুহূর্ত্ত স্থির নই। বায়ু যেমন উত্তপ্ত হ’য়ে ঘূর্ণায়মান হয়, আমিও তেমনি অন্তর-তাপে দিবা-রাত্র ঘূর্ণায়মানা! নবাব-দর্শন, দাসীর নিয়তই বাসনা, সেই বাসনা পূর্ণ কর্‌তে এসেছে।
প্রস্থান
সিরাজ। এ পরিচারিকা কি উন্মাদিনী! আমায় দেখ্‌বার বাসনা কেন?

মীরজাফর, জগৎশেঠ, মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ,
মোহনলাল, মীরমদন প্রভৃতির প্রবেশ

সিরাজ। কি সংবাদ?
রায়। জনাব মতিঝিল ভূমিসাৎ কর্‌বার আদেশ প্রদান করেছেন। অতি কঠিন আজ্ঞা। প্রজাবর্গের অসন্তোষের কারণ হবে। প্রজারা আদর ক’রে এই সুরম্য প্রাসাদকে লালকুঠি ব’লে থাকে, মতিঝিল এ প্রদেশের একটি অপূর্ব্ব দৃশ্য।
সিরাজ। বুঝলেম, আপনি নবাবের আদেশ পালনে অক্ষম, অবসর গ্রহণ করুন। মোহনলাল রায়দুর্লভের কার্য্যভার আজ হ’তে তোমার উপর অর্পিত। লালকুঠি ভূমিসাৎ করো।
মোহন। জনাবের আজ্ঞা অচিরে প্রতিপালিত হবে।
প্রস্থান
সিরাজ। (মীরজাফরের প্রতি) সেনাপতি, ধনাগার হস্তগত করেছেন?
মীর জাঃ। জনাবকে সুমন্ত্রণা প্রদান কর্‌তে স্বর্গীয় নবাবের নিকট বান্দা প্রতিশ্রুত। লালকুঠি লুণ্ঠন অবৈধিক। জনাবের মাতৃষ্বসাকে বঞ্চিত করা উচিত নয়।
সিরাজ। আপনিও অবসর গ্রহণ করবেন। মীরমদন, সৈন্যের ভার আজ হ’তে তোমার উপর অর্পিত, সেনাপতি অবসর গ্রহণ কচ্ছেন। তুমি রাজা রাজবল্লভের সঙ্গে গিয়ে ধনাগার হস্তগত করো। বোধ হয় পুরাতন সমস্ত কর্ম্মচারীই কার্য্যে অক্ষম হয়েছেন। তুমি আর মোহনলাল সমস্ত কার্য্যে নিজ নিজ বিশ্বাসী কর্ম্মচারী নিযুক্ত করো। রাজা রাজবল্লভ, সেনাপতিকে ধনাগার প্রদর্শন করো। মীরমদন যাও।
মীর মঃ। নবাবের আজ্ঞা পালনে গোলামের আনন্দ।
রাজবল্লভ ও মীরমদনের প্রস্থান
সিরাজ। লালকুঠি ভঙ্গ হবে, ঘসেটী বেগমের ধনরত্ন রাজকোষে আসবে, এতে আপনারা সকলে অসন্তুষ্ট! মন্ত্রণা স্থান, সৈন্যসঞ্চয়ের অর্থ নষ্ট হচ্ছে! মৃত্যুকালে নবাব বৃথা আয়াস পেয়েছিলেন, রাজকার্য্যে সাহায্য দান কর্‌তে বৃথা অনুনয় করেছিলেন। খলের খলতা বিনয়-বাক্যে মোচন হয় না। বিদ্রোহীর গৃহভঙ্গ, বিদ্রোহীর ধনলুণ্ঠন অন্যায়কার্য্য! কি সুহৃৎবর্গে আমরা পরিবেষ্টিত!
সিরাজের প্রস্থান
রায় দুঃ। আর এ স্থানে নয়, প্রস্থান করুন। ভগবান অর্ব্বাচীন নবাব-হস্তে আজ জীবন রক্ষা করেছেন, এ নিমিত্ত ধন্যবাদ দিন।
স্বরূপ। আলিবর্দ্দীর মধ্যম কন্যা আয়মনা বেগমের পুত্র সকতজঙ্গের নিকট কি পূর্ণিয়ায় দূত প্রেরিত হ’য়েছে?
মীর জাঃ। হ্যাঁ, মীরণ তথায় প্রেরিত হয়েছে। ওঃ এমন অপমান জন্মেও হয় নাই। কি আশ্চর্য্য! ঘৃণিত, নীচবংশোদ্ভব, নবাবের কুৎসিত কার্য্যের সহচর মোহনলাল মন্ত্রীপদে স্থাপিত হলো, পথের কাঙ্গাল মীরমদন সেনাপতি, এদের নিকট আমাদের অবনত মস্তকে থাক্‌তে হবে! রাজকার্য্য এই নীচজন-নির্ব্বাচিত কর্ম্মচারীগণের দ্বারা সম্পন্ন হবে!—জীবনে ঘৃণা হচ্ছে!
রায় দুঃ। হেথায় আর বৃথা আক্ষেপ উচিত নয়
জগৎ। চলুন, নবাব আমাদের আর এখানে একত্র দেখ্‌লে প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা দেবে।সকলের প্রস্থান