সীতারাম (১৯৩৯)/তৃতীয় খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ
রামচাঁদ ও শ্যামচাঁদ, দুই জন নিরীহ গৃহস্থ লোক, মহম্মদপুরে বাস করে। রামচাঁদের চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া, প্রদোষকালে, নিভৃতে তামাকুর সাহায্যে দুই জন কথোপকথন করিতেছিল। কিয়দংশ পাঠককে শুনিতে হইবে।
রামচাঁদ। ভাল, ভায়া, বলিতে পার, চিত্তবিশ্রামের আসল ব্যাপারটা কি?
শ্যামচাঁদ। কি জান, দাদা, ও সব রাজা রাজড়ার হয়েই থাকে। আমাদের গৃহস্থ ঘরে কারই বা ছাড়া—তার আর রাজা রাজড়ার কথায় কাজ কি? তবে আমাদের মহারাজাকে ভাল বল্তে হবে—মাত্রায় বড় কম। মোটে এই এ একটি।
রাম। হাঁ, তা ত বটেই। তবে কি জান, আমাদের মহারাজা না কি সে রকম নয়, পরম ধার্ম্মিক, তাই কথাটা জিজ্ঞাসা করি। বলি, এত কাল ত এ সব ছিল না।
শ্যাম। রাজাও আর সে রকম নাই, লোকে ত বলে। কি জান, মানুষ চিরকাল এক রকম থাকে না। ঐশ্বর্য্য সম্পদ্ বাড়িলে, মনটাও কিছু এ দিক্ ও দিক্ হয়! আগে আমরা রামরাজ্যে বাস করিতাম—ভূষণা দখল হ’য়ে অবধি কি আর তাই আছে?
রাম। তা বটে। তা আমার যেন বোধ হয় যে, চিত্তবিশ্রামের কাণ্ডটা হয়ে অবধিই যেন বাড়াবাড়ি ঘটেছে। তা মহারাজকে এমন বশ করাও সহজ ব্যাপার নয়। মাগীও ত সামান্যা নয়—কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসিল?
শ্যাম। শুনেছি, সেটা না কি একটা ভৈরবী। কেউ কেউ বলে, সেটা ডাকিনী। ডাকিনীরা নানা মায়া জানে, মায়াতে ভৈরবী বেশ ধ’রে বেড়ায়। আবার কেউ বলে, তার একটা জোড়া আছে, সেটা উড়ে উড়ে বেড়ায়, তাকে বড় কেউ দেখিতে পায় না।
রাম। তবে ত বড় সর্ব্বনাশ! রাজ্য পড়িল ডাকিনীর হাতে। এ রাজ্যের কি আর মঙ্গল আছে?
শ্যাম। গতিকে ত বোধ হয় না। রাজা ত আর কাজ কর্ম্ম দেখেন না। যা করেন তর্কালঙ্কার ঠাকুর। তা তিনি লড়াই ঝকড়ার কি জানেন! এ দিকে না কি নবাবি ফৌজ শীঘ্র আসিবে।
রাম। আসে, মৃণ্ময় আছে।
শ্যাম। তুমিও যেমন দাদা! পরের কি কাজ! যার কর্ম্ম তার সাজে, অন্য লোকের লাঠি বাজে। এই ত দেখ্লে, গঙ্গারাম দাস কি কর্লে? আবার কে জানে, মৃণ্ময় বা কি কর্বে? সে যদি মুসলমানের সঙ্গে মিশে যায়, তবে আমরা দাঁড়াই কোথা? গোষ্ঠী শুদ্ধ জবাই হব দেখতে পাচ্চি।
রাম। তা বটে। তাই একে একে সব সরিতে আরম্ভ করেছে বটে! সে দিন তিলক ঘোষেরা উঠে যশোর গেল, তখন বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম যে, কেন যাও? বলে, এখানে জিনিসপত্র মাগ্যি। এখনই ত আরও কয় ঘর আমাদের পাড়া হইতে উঠিয়া গিয়াছে।
শ্যাম। তা দাদা, তোমার কাছে বল্চি, প্রকাশ করিও না, আমিও শিগ্গির সরবো।
রামচাঁদ। বটে! ত আমিই পড়ে জবাই হই কেন? তবে কি জান, এই সব বাড়ী ঘর দ্বার খরচ পত্র করে করা গেছে, এখন ফেলে ঝেলে যাওয়া গরিব মানুষের বড় দায়।
শ্যাম। তা কি করবে, প্রাণটা আগে, না বাড়ী ঘর আগে? ভাল, রাজ্য বজায় থাকে, আবার আসা যাবে। ঘর দ্বার ত পালাবে না।