সীতারাম (১৯৩৯)
সীতারাম
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
[১২৯৩ সালে প্রথম প্রকাশিত]
সম্পাদকঃ
শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রীসজনীকান্ত দাস
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ
২৪৩/১, অপার সারকুলার রোড
কলিকাতা
বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ হইতে
শ্রীমন্মথমোহন বসু কর্ত্তৃক
প্রকাশিত
শনিরঞ্জন প্রেস
২৫।২ মোহনবাগান রো
কলিকাতা হইতে
শ্রীপ্রবোধ নান কর্ত্তৃক
মুদ্রিত
ভূমিকা
‘সীতারামে’র বিজ্ঞাপনে বঙ্কিমচন্দ্র সীতারামকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি স্বীকার করিয়াও তাঁহার উপন্যাসের সীতারামের অনৈতিহাসিকতা মানিয়া লইয়াছেন; কারণ, তিনি স্পষ্টই বলিয়াছেন, গ্রন্থের উদ্দেশ্য অন্য। প্রারম্ভে উদ্ধৃত শ্রীমদ্ভগবদগীতার শ্লোক কয়টির মধ্যে সেই উদ্দেশ্যের আভাস আছে। এতৎসত্ত্বেও ইতিহাসবিষয়ে কৌতুহলী পাঠকের উপর তিনি “Westland সাহেবের কৃত যশোহরের বৃত্তান্ত এবং Stewart সাহেবের কৃত বাঙ্গালার ইতিহাস পাঠ”-এর বরাদ্দ করিয়াছেন। কিন্তু তাহাতেই ইতিহাসের ছাত্রের বিশেষ সুবিধা হইবে বলিয়া মনে হয় না, দুইটি বৃত্তান্ত পরস্পরবিরোধী। ঐতিহাসিক সীতারামকে লইয়া সৰ্ব্বপ্রথম বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন—ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়, ১৩০২ বঙ্গাব্দের ‘সাহিত্য’ পত্রিকার কাৰ্ত্তিক হইতে চৈত্র পর্য্যন্ত ছয় সংখ্যায়। ঐতিহাসিক সীতারামের বীরত্ব ও শৌর্য্যের কথা স্মরণ করিয়া মৈত্রেয় মহাশয় বঙ্কিম-বর্ণিত সীতারামের অপদার্থতায় অত্যন্ত পীড়া বোধ করিয়াছেন। ১৩২৩ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের সাহিত্যে শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ “সীতারাম-প্রসঙ্গ” লেখেন। ১৩৩১ সালের আষাঢ়-শ্রাবণ সংখ্যা ‘মানসী’তে র্তাহার “বঙ্কিমচন্দ্র ও বাঙ্গালার ইতিহাস” প্রবন্ধেও কিছু আলোচনা আছে। ১৩২৭ সালে প্রকাশিত শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত কবিরত্ন মহাশয়ের বঙ্কিমচন্দ্র পুস্তকের চতুর্দশ পরিচ্ছেদে ‘সীতারামে’র ঐতিহাসিকতা আলোচিত হইয়াছে। ১৩৩০ সালের ‘মানসী ও মৰ্ম্মবাণী’ পত্রিকার মাঘ ও ফাঙ্কন সংখ্যায় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অযোধ্যানাথ বিদ্যাবিনোদ ও কাজী মোহাম্মদ বক্স্ সীতারামের ঐতিহাসিকত্ব বিচার করিয়াছেন। W.W. Hunter-প্রণীত A Statistical Account of Bengal পুস্তকের ৭ম খণ্ডেও কিছু বিবরণী আছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক এগুলি হইতে ‘সীতারামে’র ঐতিহাসিক পরিচয় সংগ্ৰহ করিবেন।
‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’র ভূমিকায় আমরা দেখাইয়াছি যে, শেষ জীবনে, অর্থাৎ ১৮৮০ খ্ৰীষ্টাব্দের পর হইতেই কতকগুলি কারণে ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে, শুধু উপন্যাস রচনার খেয়ালেই উপন্যাস রচনা হইতে তিনি বিরত হন। এই কালে ‘অনুশীলনতত্ত্ব’ লইয়া তিনি বিশেষভাবে আলোচনা করিতেছিলেন এবং এই তত্ত্বের সহজ প্রচারের জন্যই শেষ তিনটি উপন্যাসের আশ্রয় লন। ‘সীতারাম’ —‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’রও পরের রচনা; ইহাই তাঁহার শেষ উপন্যাস।
১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর-নবেম্বর মাসে শোভাবাজার রাজবাটীর একটি শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করিয়া পাদ্রি হেস্টি ‘স্টেট্স্ম্যান’ পত্রিকায় হিন্দুধর্ম্মের উপর যে আক্রমণ চালাইয়াছিলেন, “রামচন্দ্র” এই বেনামে তাহার জবাব দিতে গিয়া হিন্দুধর্ম্মের মূল তত্ত্বগুলি সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। ইহা ‘আনন্দমঠ’ প্রকাশের অব্যবহিত পরের ঘটনা। ফলে তৎকালীন প্রসিদ্ধ দার্শনিক পণ্ডিত যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষকে লিখিত Letters on Hinduism। এই অসম্পূর্ণ পত্রগুলিতে হিন্দুধর্ম্মের মূল তত্ত্বের ব্যাখ্যার একটা প্রয়াস আছে। ইহার পরেই ‘দেবী চৌধুরাণী’—ইহার দ্বিতীয় খণ্ড পর্য্যন্ত প্রকাশ করিয়া ‘বঙ্গদর্শন’ বিলুপ্ত হয়; সম্পূর্ণ পুস্তক প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের গোড়াতেই। ঐ সালের জুলাই মাস (শ্রাবণ, ১২৯১) হইতে বঙ্কিমচন্দ্র-পরিচালিত ‘প্রচার’ পত্রিকার আবির্ভাব ঘটে। ঐ শ্রাবণ মাসেই অক্ষয়চন্দ্র সরকার-সম্পাদিত ‘নবজীবন’ও আত্মপ্রকাশ করে। এই দুইটি সাময়িক-পত্রের সহায়তায় বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দুধর্ম্ম সম্বন্ধে তাঁহার নূতন ধারণা প্রচার করিতে থাকেন। এই প্রচারে ‘সীতারাম’ অন্যতম “কল” মাত্র। প্রথম সংখ্যা হইতেই ইহা প্রকাশিত হইতে থাকে; ১২৯৩ সালের মাঘ পর্য্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইহা প্রকাশিত হয়, মধ্যে কয়েক মাস বন্ধ ছিল।
‘প্রচারে’র প্রথম সংখ্যাতেই (শ্রাবণ, ১২৯১) বঙ্কিমচন্দ্র পর পর দুইটি প্রবন্ধ লেখেন—“বাঙ্গালার কলঙ্ক” ও “হিন্দুধর্ম্ম”। এই দুইটি রচনায় ‘সীতারাম’ উপন্যাসের প্রতিপাদ্য তত্ত্ব অতি স্পষ্ট ভাষায় লিখিত আছে। নিম্নে প্রবন্ধ দুইটি হইতে আমাদের প্রয়োজনীয় অংশ উদ্ধৃত করিতেছি।—
...কদাচিৎ অন্যান্য ভারতবাসীর বাহুবলের প্রশংসা শুনা যায়, কিন্তু বাঙ্গালীর বাহুবলের প্রশংসা কেহ কখন শুনে নাই। সকলেরই বিশ্বাস, বাঙ্গালী চিরকাল দুর্ব্বল, চিরকাল ভীরু, চিরকাল স্ত্রীস্বভাব, চিরকাল ঘুসি দেখিলেই পলাইয়া যায়। মেকলে বাঙ্গালীর চরিত্রসম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, এরূপ জাতীয় নিন্দা কখন কোন লেখক কোন জাতি সম্বন্ধে কলমবন্দ করে নাই। ভিন্নদেশীয় মাত্রেরই বিশ্বাস যে, সে সকল কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ভিন্নজাতীয়ের কথা দূরে থাকুক, অধিকাংশ বাঙ্গালীরও এইরূপ বিশ্বাস। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালীর চরিত্র সমালোচনা করিলে, কথাটা কতকটা যদি সত্য বোধ হয়, তবে বলা যাইতে পারে, বাঙ্গালীর এখন এ দুর্দ্দশা হইবার অনেক কারণ আছে। মানুষকে মারিয়া ফেলিয়া তাহাকে মরা বলিলে মিথ্যা কথা বলা হয় না। কিন্তু যে বলে যে, বাঙ্গালীর চিরকাল এই চরিত্র, চিরকাল দুর্ব্বল, চিরকাল ভীরু, স্ত্রীস্বভাব, তাহার মাথায় বজ্রাঘাত হউক, তাহার কথা মিথ্যা।...
বাঙ্গালীর চিরদুর্ব্বলতা এবং চিরভীরুতার আমরা কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাই নাই। কিন্তু বাঙ্গালী যে পূর্ব্বকালে বাহুবলশালী, তেজস্বী, বিজয়ী ছিল, তাহার অনেক প্রমাণ পাই।...
—“বাঙ্গালার কলঙ্ক"—‘প্রচার’, শ্রাবণ ১২৯১, পৃ. ৬-৮[১]
এই প্রমাণের উপরেই বঙ্কিমচন্দ্র সীতারাম-চরিত্রের পরিকল্পনা করিয়াছেন; মেনাহাতীও নিতান্ত তাঁহার মানস পুত্র নন।
এই গেল এক দিক্। অন্য দিকে “হিন্দুধর্ম্ম”। প্রথম সংখ্যা ‘প্রচারে’র এই দ্বিতীয় প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র লিখিলেন—
...জাতীয় ধর্ম্মের পুনর্জ্জীবন ব্যতীত ভারতবর্ষের মঙ্গল নাই, ইহা আমাদিগের দৃঢ় বিশ্বাস।...এক্ষণে আমাদিগের কি করা কর্ত্তব্য? দুইটি মাত্র পথ আছে। এক, হিন্দুধর্ম্ম একেবারে পরিত্যাগ করা, আর এক হিন্দুধর্ম্মের সার ভাগ অর্থাৎ যেটুকু লইয়া সমাজ চলিতে পারে, এবং চলিলে সমাজ উন্নত হইতে পারে, তাহাই অবলম্বন করা। হিন্দুধর্ম্ম একেবারে পরিত্যাগ করা আমরা ঘোরতর অনিষ্টকর মনে করি। ...যে সমাজ ধর্ম্মশূন্য, তাহার উন্নতি দূরে থাকুক, বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। আর তাঁহারা যদি বলেন যে, হিন্দুধর্ম্মের পরিবর্ত্তে ধর্ম্মান্তরকে সমাজ আশ্রয় করুক, তাহা হইলে আমরা জিজ্ঞাসা করি যে, কোন ধর্ম্মকে আশ্রয় করিতে হইবে? পৃথিবীতে আর যে কয়টি শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম আছে, বৌদ্ধ ধর্ম্ম, ইসলাম ধর্ম্ম এবং খৃষ্ট ধর্ম্ম, এই তিন ধর্ম্মই ভারতবর্ষে... হিন্দুধর্ম্মকে স্থানচ্যুত করিতে পারে নাই।..কতকগুলা বন্যজাতি এবং হিন্দুনামধারী কতকগুলা অনার্য্য জাতিকে অধিকৃত করিয়াছে বটে, কিন্তু ভারতীয় প্রকৃত আর্য্যসমাজের কোন অংশ বিচলিত করিতে পারে নাই।..
যখন ধর্ম্মশূন্য সমাজের বিনাশ নিশ্চিত, যদি হিন্দুধর্ম্মের স্থান অধিকার করিবার শক্তি আর কোন ধর্ম্মেরই নাই, তখন হিন্দুধর্ম্ম রক্ষা ভিন্ন হিন্দু সমাজের আর কি গতি আছে?...
...যাহাতে মনুষ্যের যথার্থ উন্নতি, শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সর্ব্ববিধ উন্নতি হয়; তাহাই ধর্ম্ম। ...এইরূপ উন্নতিকর তত্ত্ব সকল, সকল ধর্ম্মাপেক্ষ হিন্দুধর্ম্মেই প্রবল। হিন্দুধর্ম্মেই তাহার প্রকৃত সম্পূর্ণতা আছে।...
“হিন্দুধর্ম্ম”—‘প্রচার’, শ্রাবণ ১২৯১, পৃ. ১৫-২২
হিন্দুধর্ম্মের প্রতি এই বিশ্বাস এবং আস্থা লইয়া ‘সীতারামে’র সূত্রপাত। “হিন্দুধর্ম্ম রক্ষা ভিন্ন হিন্দু সমাজের আর কি গতি আছে?” এই মন্তব্য সপ্রমাণ করিবার জন্যই যেন গঙ্গারাম ও ফকিরের কথা দিয়া উপন্যাস আরম্ভ করা হইয়াছে। গ্রন্থশেষে “পাঠভেদ” অংশে কয়েকটি পরিত্যক্ত পরিচ্ছেদের সহিত ‘প্রচারে’ প্রকাশিত উক্ত অংশ মিলাইয়া দেখিলেই দেখা যাইবে, বঙ্কিমচন্দ্র সীতারামকে দিয়া “হিন্দু-সাম্রাজ্য স্থাপনে”র স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই সেই স্বপ্ন ভাঙিয়া-চুরিয়া ছারখার হইয়াছে। এই কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির মধ্যে ট্র্যাজেডি হিসাবে ‘সীতারাম’ই সর্ব্বাপেক্ষা শোচনীয় এবং ভয়াবহ। ‘সীতারাম’ উপন্যাসে হিন্দুধর্ম্ম অভ্যুদয়ের সূচনা আছে, কিন্তু পরিণতি নাই। সূচনার মুখেই তাহা ধ্বংস হইয়াছে।
১২৯৩ বঙ্গাব্দে ১৭ই ফাল্গুন (মার্চ, ১৮৮৭) ‘সীতারাম’ প্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়, পৃষ্ঠা-সংখ্যা ছিল ৪১৯। ইহা ‘প্রচারে’রই প্রায় পুনর্মুদ্রণ। ১২৯৫ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে (পৃ. ৩০০) বহুল পরিবর্ত্তন সাধিত হয়, অনেকগুলি পরিচ্ছেদ ইহাতে পরিত্যক্ত হয়। তৃতীয় সংস্করণ বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালে মুদ্রিত হইলেও প্রকাশিত হইয়াছিল ১৩০১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে, তাঁহার মৃত্যুর কয়েক দিন পরে।
বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ তিনখানি উপন্যাস “ত্রয়ী” নামে খ্যাত। এই “ত্রয়ী” লইয়া অনেকে অনেক আলোচনা করিয়াছেন। ‘বঙ্গবাণী’ মাসিক পত্রিকায়, বিপিনচন্দ্র পাল ও ‘নারায়ণে’ পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই উপন্যাসগুলির মূল তত্ত্ব লইয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনীকারেরাও সংক্ষেপে এই “ত্রয়ী”-কথা বিবৃত করিয়াছেন। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে গিরিজাপ্রসন্ন রায় চৌধুরী-প্রণীত ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ পুস্তকের তৃতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। ইহাতে ‘সীতারামে’র নানা চরিত্র লইয়া বিস্তৃত আলোচনা আছে। ১৩২২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের “বঙ্কিমচন্দ্রের ত্রয়ী” প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য। আমরা ‘দেবী চৌধুরাণী’র ভূমিকায় এই প্রবন্ধের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করিয়াছি। বিশেষভাবে ‘সীতারাম’ সম্বন্ধে তাঁহার বক্তব্য নিম্নে উদ্ধৃত হইল।—
সীতারাম উপন্যাসে যেন দেবীচৌধুরাণীর obverse proposition solve বা কতকটা বিরোধী ভাবের ব্যঞ্জনা দেখান হইয়াছে। এখানে পুরুষ প্রকট; সীতারাম রায় কর্ম্মী ও তেজস্বী পুরুষ। তাঁহার তিন স্ত্রী—শ্রী, নন্দা এবং রমা। শ্রী যেন ঐশ্বর্য্য, নন্দা যেন হ্লাদিনী, রমা যেন হ্রী বা মোদিনী। রাজার রাণী যেমন হইতে হয়, ঘরণী-গৃহিণী যেমন হইতে হয়, নন্দা তেমনই।····রমা যেন মোমের পুতুল, সোহাগের খুঁচি, যেন আদিরসের মঞ্জুষা; ····কিন্তু শ্রী— সে কেমন নারী!····শ্রী একটা প্রহেলিকা; সন্ন্যাসিনী ভৈরবী বটে, কিন্তু জগন্নাথের রথের দড়ীর টানের মত তাহার হৃদয়ে স্বামী-ঘর করিবার সাধটুকু বেশ জাগিতেছে। অথচ যখন সীতারাম তাহার দ্বারস্থ, তাহার জন্য পাগল, সে পাগলামীর ফলে রাজ্য যায়, স্বাধীনতা যায়, তখন শ্রী পাষাণী। এই পাষাণ ভাবটাই সীতারামের পুরুষকারের তাসের ঘর শেষে ভাঙ্গিয়া দিল। শ্রীকে allegory বলিতে পারি না; কারণ allegoryর হিসাবে স্ত্রীর চরিত্রোন্মেষ ঘটান হয় নাই। শ্রী একটা abstractionও নহে; কারণ অমন ভাবে abstraction ফুটিয়া উঠে না।···· সাধনশাস্ত্রের মাপকাঠিতে ইহা বুঝি না, আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনশাস্ত্রের মাপকাঠি লইয়া ইহার পরিমাণ করিতে পারি না।····
সীতারামের শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-কৃত ইংরেজী অনুবাদ ১৯০৩ সালে কলিকাতা হইতে প্রকাশিত হয়। ১৯০১ সালে বি. বেঙ্কাটাচার্য্য মহীশূর হইতে ইহার কানাড়ী অনুবাদ ও ১৯১০ সালে এস. টি. পিলাই মাদ্রাজ হইতে তামিল অনুবাদ প্রকাশ করেন।
‘সীতারাম’ রচনার সময় বঙ্কিমচন্দ্র প্রধানতঃ কলিকাতাতেই (হাবড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে) বাস করিয়াছিলেন। ইহার অব্যবহিত পূর্ব্বে জাজপুর(কটক)-প্রবাসের স্মৃতি ‘সীতারাম’ রচনায় তাঁহাকে কিছু সাহায্য করিয়াছিল।
- ↑ বিবিধ প্রবন্ধ—দ্বিতীয় ভাগ, পরিষৎ সংস্করণ, পৃ. ৩১৪-১৫
সূচীপত্র
এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৫ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।