সীতারাম (১৯৩৯)/দ্বিতীয় খণ্ড/একাদশ পরিচ্ছেদ

একাদশ পরিচ্ছেদ

 সন্ধ্যার পর গুপ্তচর আসিয়া চন্দ্রচূড়কে সংবাদ দিল যে, ফৌজদারী সৈন্য দক্ষিণ পথে মহম্মদপুর আক্রমণে আসিতেছে।

 চন্দ্রচূড় তখন মৃণ্ময় ও গঙ্গারামকে ডাকাইয়া, পরামর্শ করিতে লাগিলেন। পরামর্শ এই স্থির হইল যে, মৃণ্ময় সৈন্য লইয়া সেই রাত্রিতে দক্ষিণ পথে যাত্রা করিবেন—যাহাতে যবনসেনা নদী পার হইতে না পারে, এমন ব্যবস্থা করিবেন।

 এদিকে রণসজ্জার ধূম পড়িয়া গেল। মৃণ্ময় পূর্ব্ব হইতেই প্রস্তুত ছিলেন, তিনি সৈন্য লইয়া রাত্রিতেই দক্ষিণ পথে যাত্রা করিলেন। গড় রক্ষার্থ অল্প মাত্র সিপাহী রাখিয়া গেলেন। তাহারা গঙ্গারামের আজ্ঞাধীনে রহিল।

 এই সকল গোলমালের সময়ে পাঠকের কি গরিব রমাকে মনে পড়ে? সকলের কাছে মুসলমানের সৈন্যাগমনবার্ত্তা যেমন পৌঁছিল, রমার কাছেও সেইরূপ পৌঁছিল। মুরলা বলিল, “মহারাণী, এখন বাপের বাড়ী যাওয়ার উদ্যোগ কর।”

 রমা বলিল, “মরিতে হয় এইখানেই মরিব। কলঙ্কের পথে যাইব না। কিন্তু তুমি একবার গঙ্গারামের কাছে যাও। আমি মরি, এইখানেই মরিব, কিন্তু আমার ছেলেকে রক্ষা করিতে তিনি স্বীকৃত আছেন, তাহা স্মরণ করিয়া দিও। সময়ে আসিয়া যেন রক্ষা করেন। আমার সঙ্গে কিছুতেই আর সাক্ষাৎ হইবে না, তাহাও বলিও।”

 রমা মনস্থির করিবার জন্য নন্দার কাছে গিয়া বসিয়া রহিল। পুরীমধ্যে কেহই সে রাত্রিতে ঘুমাইল না।

 মুরলা আজ্ঞা পাইয়া গঙ্গারামের কাছে চলিল। গঙ্গারাম নিশীথকালে গৃহমধ্যে একাকী বসিয়া গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। রত্ন আশায় সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে তিনি প্রবৃত্ত—সাঁতার দিয়া আবার কূল পাইবেন কি? গঙ্গারাম সাহসে ভর করিয়াও এ কথার কিছু মীমাংসা করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। যে ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছু স্থির করিতে না পারে, তাহার শেষ ভরসা জগদীশ্বর। সে বলে, “জগদীশ্বর যা করেন।” কিন্তু গঙ্গারাম তাহাও বলিতে পারিতেছিলেন না—যে পাপকর্ম্মে প্রবৃত্ত, সে জানে যে, জগদীশ্বর তার বিরুদ্ধ—জগতের বন্ধু তাহার শত্রু। অতএব গঙ্গারাম বড় বিষণ্ণ হইয়া চিন্তামগ্ন ছিলেন।

 এমন সময়ে মুরলা আসিয়া দেখা দিল। রমার প্রেরিত সংবাদ তাঁহাকে বলিল।

 গঙ্গারাম বলিল, “বলেন ত এখন গিয়া ছেলে নিয়া আসি।”

 মুরলা। তাহা হইবে না। যখন মুসলমান পুরীতে প্রবেশ করিবে, আপনি তখন গিয়া রক্ষা করিবেন, ইহাই রাণীর অভিপ্রায়।

 গঙ্গা। তখন কি হইবে, কে বলিতে পারে? যদি রক্ষার অভিপ্রায় থাকে, তবে এই বেলা বালকটিকে আমাকে দিন।

 মুরলা। আমি তাহাকে লইয়া আসিব?

 গঙ্গা। না। আমার অনেক কথা আছে।

 মুরলা। আচ্ছা—পৌষ মাসে।

 এই বলিয়া, মুরলা হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। কিন্তু গঙ্গারামের গৃহ হইতে বাহির হইয়া রাজপথে উঠিতে না উঠিতে মুরলার সে হাসি হঠাৎ নিবিয়া গেল—ভয়ে মুখ কালি হইয়া উঠিল। দেখিল, সম্মুখে রাজপথে, প্রভাতশুক্রতারাবৎ সমুজ্জ্বলা ত্রিশূলধারিণী যুগল-ভৈরবীমূর্ত্তি! মুরলা তাহাদিগকে শঙ্করীর অনুচারিণী ভাবিয়া ভূমিতে পড়িয়া প্রণাম করিয়া, যোড়হাত করিয়া দাঁড়াইল।

 এক জন ভৈরবী বলিল, “তুই কে?”

 মুরলা কাতরস্বরে বলিল, “আমি মুরলা।”

 ভৈরবী। মুরলা কে?

 মুরলা। আমি ছোট রাণীর দাসী।

 ভৈরবী। নগরপালের ঘরে এত রাত্রিতে কি করিতে আসিয়াছিলি?

 মুরলা। মহারাণী পাঠাইয়াছিলেন।

 ভৈরবী। সম্মুখে এই দেবমন্দির দেখিতেছিস্?

 মুরলা। আজ্ঞা হাঁ।

 ভৈরবী। আমাদের সঙ্গে উহার উপরে আয়।

 মুরলা। যে আজ্ঞা।

 তখন দুই জনে, মুরলাকে দুই ত্রিশূলাগ্রমধ্যবর্ত্তিনী করিয়া মন্দিরমধ্যে লইয়া গেলেন।