সীতারাম (১৯৩৯)/প্রথম খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
এমন সময়ে একটা গোল উঠিল যে, কামান, বন্দুক, গোলা গুলি লইয়া, সসৈন্য ফৌজদার বিদ্রোহীদিগের দমনার্থ আসিতেছেন। গোলা গুলির কাছে ঢাল শড়কী কি করিবে? বলা বাহুল্য যে, নিমেষমধ্যে সেই যোয়ানের দল অদৃশ্য হইল। যে নিরস্ত্র বীরপুরুষেরা তাঁহাদের আশ্রয়ে থাকিয়া লড়াই ফতে করিতেছি বলিয়া কোলাহল করিতেছিলেন, তাঁহারা বলিলেন, “আমরা ত বারণ করিয়াছিলাম!” এই বলিয়া আর পশ্চাদ্দৃষ্টি না করিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে গৃহাভিমুখে ধাবিত হইলেন। যাহারা দাঙ্গার কোন সংস্রবে ছিল না, তাহারা ‘চোরা গোরুর অপরাধে কপিলার বন্ধন’ সম্ভাবনা দেখিয়া সীতারাম গঙ্গারামকে নানাবিধ গালিগালাজ করিয়া আর্ত্তনাদপূর্ব্বক পলাইতে লাগিল। অতি অল্পকালমধ্যে সেই লোকারণ্য অন্তর্হিত হইল। প্রান্তর যেমন জনশূন্য ছিল, তেমনই জনশূন্য হইল। লোকজনের মধ্যে কেবল সেই বৃক্ষতলে চন্দ্রচূড়, সীতারাম, গঙ্গারাম, আর মূর্চ্ছিতা, ভূতলস্থা শ্রী।
সীতারাম গঙ্গারামকে বলিলেন, “তুমি যে আমার ঘোড়া চুরি করিয়া পলাইয়াছিলে, সে ঘোড়া কি করিলে? বেচিয়া খাইয়াছ?”
গঙ্গারাম হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞে না। ঘোড়া মাঠে ছাড়িয়া দিয়াছি—ধরিয়া দিতেছি।”
সীতা। ধরিয়া, তাহার উপর আর একবার চড়িয়া, পলায়ন কর।
গঙ্গা। আপনাদের ছাড়িয়া?
সীতা। তোমার ভগিনীর জন্য ভাবিও না।
গঙ্গা। আপনাকে ত্যাগ করিয়া আমি যাইব না।
সীতা। তুমি বড় নদী পার হইয়া যাও। শ্যামপুর চেন ত?
গঙ্গা। তা চিনি না?
সীতা। সেইখানে অতি দ্রুতগতি যাও। সেইখানে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে; নচেৎ তোমার নিস্তার নাই।
গঙ্গা। আমি আপনাকে ত্যাগ করিয়া যাইব না।
সীতারাম ভ্রূকুটি করিলেন।
গঙ্গারাম সীতারামের ভ্রূকুটি দেখিয়া নিস্তব্ধ হইল; এবং সীতারাম কিছু ধমক চমক করায় ভীত হইয়া অশ্বের সন্ধানে গেল।
চন্দ্রচূড় ঠাকুর সীতারামের ইঙ্গিত পাইয়া তাহার অনুবর্ত্তী হইলেন। শ্রী এদিকে চেতনাযুক্ত হইয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিয়া মাথার ঘোমটা টানিয়া দিল। তার পর এদিকে ওদিকে চাহিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইল।