সীতারাম (১৯৩৯)/দ্বিতীয় খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ

 অনেক দিন পরে, শ্রী ও জয়ন্তী বিরূপাতীরে, ললিতগিরির উপত্যকায় আসিয়াছে। মহাপুরুষ আসিতে বলিয়াছিলেন, পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে। তাই, দুই জনে আসিয়া উপস্থিত।

 মহাপুরুষ কেবল জয়ন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন—শ্রীর সঙ্গে নহে। জয়ন্তী একা হস্তিগুম্ফামধ্যে প্রবেশ করিল,—শ্রী ততক্ষণে বিরূপাতীরে বেড়াইতে লাগিল। পরে, শিখরদেশে আরোহণ করিয়া, চন্দনবৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া, নিম্নে ভূতলস্থ নদীতীরের এক তালবনের অপূর্ব্ব শোভা দর্শন করিতে লাগিল। পরে জয়ন্তী ফিরিয়া আসিল।

 মহাপুরুষ কি আদেশ করিলেন, জয়ন্তীকে না জিজ্ঞাসা করিয়া, শ্রী বলিল, “কি মিষ্ট পাখীর শব্দ! কাণ ভরিয়া গেল!”

 জয়ন্তী। স্বামীর কণ্ঠস্বরের তুল্য কি?

 শ্রী। এই নদীর তরতর গদগদ শব্দের তুল্য।

 জয়ন্তী। স্বামীর কণ্ঠস্বরের তুল্য কি?

 শ্রী। অনেক দিন স্বামীর কণ্ঠ শুনি নাই—বড় আর মনে নাই।

 হায়! সীতারাম!

 জয়ন্তী তাহা জানিত, মনে করাইবার জন্য সে কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। জয়ন্তী বলিল, “এখন শুনিলে আর তেমন ভাল লাগিবে না কি?”

 শ্রী চুপ করিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে, মুখ তুলিয়া, জয়ন্তীর পানে চাহিয়া, শ্রী জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, ঠাকুর কি আমাকে পতিসন্দর্শনে যাইতে অনুমতি করিয়াছেন?”

 জয়ন্তী। তোমাকে ত যাইতেই হইবে—আমাকেও তোমার সঙ্গে যাইতে বলিয়াছেন।

 শ্রী। কেন?

 জয়ন্তী। তিনি বলেন, শুভ হইবে।

 শ্রী। এখন আর আমার তাহাতে শুভাশুভ, সুখ দুঃখ কি ভগিনি?

 জয়ন্তী। বুঝিতে পারিলে না কি শ্রী? তোমায় আজিও কি এত বুঝাইতে হইবে?

 শ্রী। না—বুঝি নাই।

 জয়ন্তী। তোমার শুভাশুভ উদ্দিষ্ট হইলে, ঠাকুর তোমাকে কোন আদেশ করিতেন না—আপনার স্বার্থ খুঁজিতে তিনি কাহাকেও আদেশ করেন না। ইহাতে তোমার শুভাশুভ কিছুই নাই।

 শ্রী। বুঝিয়াছি—আমি এখন গেলে আমার স্বামীর শুভ হইবার সম্ভাবনা?

 জয়ন্তী। তিনি কিছুই স্পষ্ট বলেন না—অত ভাঙ্গিয়াও বলেন না, আমাদিগের সঙ্গে বেশী কথা কহিতে চাহেন না। তবে তাঁহার কথার এইমাত্র তাৎপর্য্য হইতে পারে, ইহা আমি বুঝি। আর তুমিও আমার কাছে এতদিন যাহা শুনিলে শিখিলে, তাহাতে তুমি বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ।

 শ্রী। তুমি যাইবে কেন?

 জয়ন্তী। তাহা আমাকে কিছুই বলেন নাই। তিনি আজ্ঞা করিয়াছেন, তাই আমি যাইব। না যাইব কেন? তুমি যাইবে?

 শ্রী। তাই ভাবিতেছি।

 জয়ন্তী। ভাবিতেছ কেন? সেই প্রিয়প্রাণহন্ত্রী কথাটা মনে পড়িয়াছে বলিয়া কি?

 শ্রী। না। এখন আর তাহাতে ভীত নই।

 জয়ন্তী। কেন ভীত নও, আমাকে বুঝাও। তা বুঝিয়া তোমার সঙ্গে যাওয়া আমি স্থির করিব।

 শ্রী। কে কাকে মারে বহিন্? মারিবার কর্ত্তা এক জন—যে মরিবে, তিনি তাহাকে মারিয়া রাখিয়াছেন। সকলেই মরে। আমার হাতে হউক, পরের হাতে হউক, তিনি এক দিন মৃত্যুকে পাইবেন। আমি কখন ইচ্ছাপূর্ব্বক তাঁহাকে হত্যা করিব না, ইহা বলাই বাহুল্য; তবে যিনি সর্ব্বকর্ত্তা, তিনি যদি ঠিক করিয়া থাকেন যে, আমারই হাতে তাঁহার সংসারযন্ত্রণা হইতে নিষ্কৃতি ঘটিবে, তবে কাহার সাধ্য অন্যথা করে? আমি বনে বনেই বেড়াই, আর সমুদ্রপারেই যাই, তাঁহার আজ্ঞার বশীভূত হইতেই হইবে। আপনি সাবধান হইয়া ধর্ম্মমত আচরণ করিব—তাহাতে তাঁহার বিপদ্ ঘটে, আমার তাহাতে সুখ দুঃখ কিছুই নাই।

 হো হো সীতারাম! কাহার জন্য ঘুরিয়া বেড়াইতেছ!

 জয়ন্তী মনে মনে বড় খুসী হইল। জয়ন্তী জিজ্ঞাসা করিল, “তবে ভাবিতেছ কেন?”

 শ্রী। ভাবিতেছি, গেলে যদি তিনি আর না ছাড়িয়া দেন?

 জয়ন্তী। যদি কোষ্ঠীর ভয় আর নাই, তবে ছাড়িয়া নাই দিলেন? তুমিই আসিবে কেন?

 শ্রী। আমি কি আর রাজার বামে বসিবার যোগ্য?

 জয়ন্তী। এক হাজার বার। যখন তোমাকে সুবর্ণরেখার ধারে, কি বৈতরণীতীরে প্রথম দেখিয়াছিলাম, তাহার অপেক্ষা তোমার রূপ কত গুণে বাড়িয়াছে, তাহা তুমি কিছুই জান না।

 শ্রী। ছি!

 জয়ন্তী। গুণ কত গুণে বাড়িয়াছে, তাও কি জান না? কোন্ রাজমহিষী গুণে তোমার তুল্যা?

 শ্রী। আমার কথা বুঝিলে কই? কই, তোমার আমার মনের মধ্যে বাঁধা রাস্তা বাঁধিয়াছ কই? আমি কি তাহা বলিতেছিলাম? বলিতেছিলাম যে, যে শ্রীকে ফিরাইবার জন্য তিনি ডাকাডাকি করিয়াছিলেন, সে শ্রী আর নাই—তোমার হাতে তাহার মৃত্যু হইয়াছে। এখন আছে কেবল তোমার শিষ্যা। তোমার শিষ্যাকে নিয়া মহারাজাধিরাজ সীতারাম রায় সুখী হইবেন কি? না তোমার শিষ্যাই মহারাজাধিরাজ লইয়া সুখী হইবে? রাজরাণীগিরি চাকরি তোমার শিষ্যার যোগ্য নহে।

 জয়ন্তী। আমার শিষ্যার আবার সুখ দুঃখ কি? (পরে সহাস্যে) ধিক্ এমন শিষ্যায়!

 শ্রী। আমার সুখ দুঃখ নাই, কিন্তু তাঁহার আছে। যখন দেখিবেন, তাঁহার শ্রী মরিয়া গিয়াছে, তাহার দেহ লইয়া এক জন সন্ন্যাসিনী প্রবঞ্চনা করিয়া বেড়াইতেছে, তখন কি তাঁর দুঃখ হইবে না?

 জয়ন্তী। হইতে পারে, না হইতে পারে। সে সকল কথার বিচারে কোন প্রয়োজন নাই। যে অনন্তসুন্দর কৃষ্ণপাদপদ্মে মন স্থির করিয়াছে, তাহা ছাড়া আর কিছুই তাহার চিত্তে যেন স্থান না পায়—তাহা হইলে সকল দিকেই ঠিক কাজ হইবে; এক্ষণে চল, তোমার স্বামীর হউক, কি যাহারই হউক, যখন শুভ সাধন করিতে হইবে, তখন এখনই যাত্রা করি।

 যতক্ষণ এই কথোপকথন হইতেছিল, ততক্ষণ জয়ন্তীর হাতে দুইটা ত্রিশূল ছিল। শ্রী জিজ্ঞাসা করিল, “ত্রিশূল কেন?”

 “মহাপুরুষ আমাদিগকে ভৈরবীবেশে যাইতে বলিয়া দিয়াছেন। এই দুইটি ত্রিশূল দিয়াছেন। বোধ হয়, ত্রিশূল মন্ত্রপূত।”[]

 তখন দুই জনে ভৈরবীবেশ গ্রহণ করিল এবং উভয়ে পর্ব্বত অবরোহণ করিয়া, বিরূপাতীরবর্ত্তী পথে গঙ্গাভিমুখে চলিল। পথপার্শ্ববর্ত্তী বন হইতে বন্য পুষ্প চয়ন করিয়া উভয়ে তাহার দল কেশর রেণু প্রভৃতি তন্ন তন্ন করিয়া পরীক্ষা করিতে করিতে এবং পুষ্পনির্ম্মাতার অনন্ত কৌশলের অনন্ত মহিমা কীর্ত্তন করিতে করিতে চলিল। সীতারামের নাম আর কেহ একবারও মুখে আনিল না। এ পোড়ারমুখীদিগকে জগদীশ্বর কেন রূপ যৌবন দিয়াছিলেন, তাহা তিনিই জানেন। আর যে গণ্ডমূর্খ সীতারাম, শ্রী! শ্রী! করিয়া পাতি পাতি করিল, সেই বলিতে পারে। পাঠক বোধ হয়, দুইটাকেই ডাকিনী-শ্রেণীমধ্যে গণ্য করিবেন। তাহাতে গ্রন্থকারের সম্পূর্ণ মত আছে।

  1. আধুনিক ভাষায় “magnetized.”