সীতারাম (১৯৩৯)/প্রথম খণ্ড/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

 আবার সেই যুগল সন্ন্যাসিনীমূর্ত্তি উড়িষ্যার রাজপথ আলো করিয়া পুরুষোত্তমাভিমুখে চলিল। উড়িয়ারা পথে সারি দিয়া দাড়াইয়া হাঁ করিয়া দেখিতে লাগিল। কেহ আসিয়া তাহাদের পায়ের কাছে লম্বা হইয়া শুইয়া পড়িয়া বলিল, “মো মুণ্ডেরে চরড় দিবারে হউ।” কেহ কেহ বলিল, “টিকে ঠিয়া হৈকিরি ম দুঃখ শুনিবারে হউ।” সকলকে যথাসম্ভব উত্তরে প্রফুল্ল করিয়া সুন্দরীদ্বয় চলিল।

 চঞ্চলগামিনী শ্রীকে একটু স্থির করিবার জন্য সন্ন্যাসিনী বলিল, “ধীরে যা গো বহিন্! একটু ধীরে যা। ছুটিলে কি অদৃষ্ট ছাড়াইয়া যাইতে পারিবি?”

 স্নেহসম্বোধনে শ্রীর প্রাণ একটু জুড়াইল। দুই দিন সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে থাকিয়া, শ্রী তাহাকে ভাল বাসিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এ দুই দিন, মা! বাছা! বলিয়া কথা হইতেছিল,—কেন না, সন্ন্যাসিনী শ্রীর পূজনীয়া। সন্ন্যাসিনী সে সম্বোধন ছাড়িয়া বহিন্ সম্বোধন করায় শ্রী বুঝিল যে, সেও ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়াছে। শ্রী ধীরে চলিল।

 সন্ন্যাসিনী বলিতে লাগিল, “আর মা বাছা সম্বোধন তোমার সঙ্গে পোষায় না— আমাদের দুজনেরই সমান বয়স, আমরা দুই জনে ভগিনী।”

 শ্রী। তুমিও কি আমার মত দুঃখে সংসার ত্যাগ করিয়াছ?

 সন্ন্যাসিনী। আমার সুখ দুঃখ নাই। তেমন অদৃষ্ট নয়। তোমার দুঃখের কথা শুনিব। সে এখনকার কথা নয়। তোমার নাম এখনও পর্য্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয় নাই—কি বলিয়া তোমায় ডাকিব?

 শ্রী। আমার নাম শ্রী। তোমায় কি বলিয়া ডাকিব?

 সন্ন্যাসিনী। আমার নাম জয়ন্তী। আমাকে তুমি নাম ধরিয়াই ডাকিও। এখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, স্বামী যাহা বলিলেন, তাহা শুনিলে? এখন বোধ হয় তোমার আর ঘরে ফিরিবার ইচ্ছা নাই। দিন কাটাইবারও অন্য উপায় নাই। দিন কাটাইবে কি প্রকারে, কখনও কি ভাবিয়াছ?

 শ্রী। না। ভাবি নাই। কিন্তু এতদিন ত কাটিয়া গেল।

 জয়ন্তী। কিরূপে কাটিল?

 শ্রী। বড় কষ্টে—পৃথিবীতে এমন দুঃখ বুঝি আর নাই।

 জয়ন্তী। ইহার এক উপায় আছে—আর কিছুতে মন দাও।

 শ্রী। কিসে মন দিব?

 জয়ন্তী। এত বড় জগৎ—কিছুই কি মন দিবার নাই?

 শ্রী। পাপে?

 জয়ন্তী। না। পুণ্যে।

 শ্রী। স্ত্রীলোকের একমাত্র পুণ্য স্বামিসেবা। যখন তাই ছাড়িয়া আসিয়াছি—তখন আমার আবার পুণ্য কি আছে?

 জয়ন্তী। স্বামীর এক জন স্বামী আছেন।

 শ্রী। তিনি স্বামীর স্বামী—আমার নন। আমার স্বামীই আমার স্বামী—আর কেহ নহে।

 জয়ন্তী। যিনি তোমার স্বামীর স্বামী, তিনি তোমারও স্বামী—কেন না, তিনি সকলের স্বামী।

 শ্রী। আমি ঈশ্বরও জানি না—স্বামীই জানি।

 জয়ন্তী। জানিবে? জানিলে এত দুঃখ থাকিবে না।

 শ্রী। না। স্বামী ছাড়িয়া আমি ঈশ্বরও চাহি না। আমার স্বামীকে আমি ত্যাগ করিয়াছি বলিয়া আমার যে দুঃখ, আর ঈশ্বর পাইলে আমার যে সুখ, ইহার মধ্যে আমার স্বামিবিরহদুঃখই আমি ভালবাসি।

 জয়ন্তী। যদি এত ভাল বাসিয়াছিলে—তবে ত্যাগ করিলে কেন?

 শ্রী। আমার কোষ্ঠীর ফল শুনিলে না? কোষ্ঠীর ফল শুনিয়াছিলাম।

 জয়ন্তী। এত ভাল বাসিয়াছিলে কিসে?

 শ্রী তখন সংক্ষেপে আপনার পূর্ব্ববিবরণ সকল বলিল। শুনিয়া জয়ন্তীর চক্ষু একটু ছল ছল করিল। জয়ন্তী বলিল, “তোমার সঙ্গে তাঁর ত দেখা সাক্ষাৎ নাই বলিলেও হয়—এত ভাল বাসিলে কিসে? ”

 শ্রী। তুমি ঈশ্বর ভাল বাস—কয় দিন ঈশ্বরের সঙ্গে তোমার দেখা সাক্ষাৎ হইয়াছে?

 জয়ন্তী। আমি ঈশ্বরকে রাত্রি দিন মনে মনে ভাবি।

 শ্রী। যে দিন বালিকা বয়সে তিনি আমায় ত্যাগ করিয়াছিলেন, সে দিন হইতে আমিও তাঁহাকে রাত্রি দিন ভাবিয়াছিলাম।

 জয়ন্তী শুনিয়া রোমাঞ্চ কলেবর হইয়া উঠিল। শ্রী বলিতে লাগিল, “যদি একত্র ঘর সংসার করিতাম, তাহা হইলে বুঝি এমনটা ঘটিত না। মানুষ মাত্রেরই দোষ গুণ আছে। তাঁরও দোষ থাকিতে পারে। না থাকিলেও আমার দোষে আমি তাঁর দোষ দেখিতাম। কখন না কখন, কথান্তর, মন ভার, অকৌশল ঘটিত। তা হইলে, এ আগুন এত জ্বলিত না। কেবল মনে মনে দেবতা গড়িয়া তাঁকে আমি এত বৎসর পূজা করিয়াছি। চন্দন ঘষিয়া, দেয়ালে লেপন করিয়া মনে করিয়াছি, তাঁর অঙ্গে মাখাইলাম। বাগানে বাগানে ফুল চুরি করিয়া তুলিয়া, দিনভোর কাজ কর্ম্ম ফেলিয়া অনেক পরিশ্রমে মনের মত মালা গাঁথিয়া, ফুলভরা গাছের ডালে ঝুলাইয়া মনে করিয়াছি, তাঁর গলায় দিলাম। অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া ভাল খাবার সামগ্রী কিনিয়া পরিপাটি করিয়া রন্ধন করিয়া নদীর জলে ভাসাইয়া দিয়া মনে করিয়াছি, তাঁকে খাইতে দিলাম। ঠাকুর প্রণাম করিতে গিয়া কখনও মনে হয় নাই যে, ঠাকুর প্রণাম করিতেছি—মাথার কাছে তাঁরই পাদপদ্ম দেখিয়াছি। তার পর জয়ন্তী—তাঁকে ছাড়িয়া আসিয়াছি। তিনি ডাকিলেন, তবু ছাড়িয়া আসিয়াছি।”

 শ্রী আর কথা কহিতে পারিল না। মুখে অঞ্চল চাপিয়া প্রাণ ভরিয়া কাঁদিল।

 জয়ন্তীরও চক্ষু ছল ছল করিল। এমন সন্ন্যাসিনী কি সন্ন্যাসিনী?