সীতারাম (১৯৩৯)/দ্বিতীয় খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
গঙ্গারাম নগররক্ষক। এ সময়ে রাত্রিতে নগর পরিভ্রমণে তিনি বিশেষ মনোযোগী। যে দিনের কথা বলিলাম, সেই রাত্রিতে, তিনি নগরের অবস্থা জানিবার জন্য, পদব্রজে, সামান্য বেশে, গোপনে, একা নগর পরিভ্রমণ করিতেছিলেন। রাত্রি তৃতীয় প্রহরে, ক্লান্ত হইয়া, তিনি গৃহে প্রত্যাগমন করিবার বাসনায়, গৃহাভিমুখী হইতেছিলেন, এমন সময়ে কে আসিয়া পশ্চাৎ হইতে তাঁহার কাপড় ধরিয়া টানিল।
গঙ্গারাম পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, এক জন স্ত্রীলোক। রাত্রি অন্ধকার, রাজপথে আর কেহ নাই—কেবল একাকিনী সেই স্ত্রীলোক। অন্ধকারে স্ত্রীলোকের আকার, স্ত্রীলোকের বেশ, ইহা জানা গেল—কিন্তু আর কিছুই বুঝা গেল না। গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?
স্ত্রীলোক বলিল, “আমি যে হই, তাতে আপনার কিছু প্রয়োজন নাই। আমাকে বরং জিজ্ঞাসা করুন যে, আমি কি চাই।”
কথার স্বরে বোধ হইল যে, এই স্ত্রীলোকের বয়স বড় বেশী নয়। তবে কথাগুলা জোর জোর বটে। গঙ্গারাম বলিল, “সে কথা পরে হইবে। আগে বল দেখি, তুমি স্ত্রীলোক, এত রাত্রে একাকিনী রাজপথে কেন বেড়াইতেছ? আজকাল কিরূপ সময় পড়িয়াছে, তাহা কি জান না?”
স্ত্রীলোক বলিল, “এত রাত্রে একাকিনী আমি এই রাজপথে, আর কিছু করিতেছি না—কেবল আপনারই সন্ধান করিতেছি।”
গঙ্গারাম। মিছা কথা। প্রথমতঃ তুমি চেনই না যে, আমি কে?
স্ত্রীলোক। আমি চিনি যে, আপনি দাস মহাশয়, নগররক্ষক।
গঙ্গারাম। ভাল, চেন দেখিতেছি। কিন্তু আমাকে এখানে পাইবার সম্ভাবনা, ইহা তুমি জানিবার সম্ভাবনা নাই; কেন না, আমিই জানিতাম না যে, আমি এখন এ পথে আসিব।
স্ত্রীলোক। আমি অনেকক্ষণ ধরিয়া আপনাকে গলিতে গলিতে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি। আপনার বাড়িতেও সন্ধান লইয়াছি।
গঙ্গারাম। কেন?
স্ত্রীলোক। সেই কথাই আপনার আগে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। আপনি একটা দুঃসাহসিক কাজ করিতে পারিবেন?
গঙ্গা। কি?
স্ত্রীলোক। আমি আপনাকে যেখানে লইয়া যাইব, সেইখানে এখনই যাইতে পারিবেন?
গঙ্গা। কোথায় যাইতে হইবে?
স্ত্রীলোক। তাহা আমি আপনাকে বলিব না। আপনি তাহা জিজ্ঞাসা করিতে পারিবেন না। সাহস হয় কি?
গঙ্গা। আচ্ছা, তা না বল, আর দুই একটা কথা বল। তোমার নাম কি? তুমি কে? কি কর? আমাকেই বা কি করিতে হইবে?
স্ত্রীলোক। আমার নাম মুরলা, ইহা ছাড়া আর কিছুই বলিব না। আপনি আসিতে সাহস না করেন, আসিবেন না। কিন্তু যদি এই সাহস না থাকে, তবে মুসলমানের হাত হইতে নগর রক্ষা করিবেন কি প্রকারে? আমি স্ত্রীলোক যেখানে যাইতে পারি, আপনি নগররক্ষক হইয়া সেখানে এত কথা নহিলে যাইতে পারিবেন না?
কাজেই গঙ্গারামকে মুরলার সঙ্গে যাইতে হইল। মুরলা আগে আগে চলিল, গঙ্গারাম পাছু পাছু। কিছু দূর গিয়া গঙ্গারাম দেখিলেন, সম্মুখে উচ্চ অট্টালিকা। চিনিয়া বলিলেন, “এ যে রাজবাড়ী যাইতেছ?”
মুরলা। তাতে দোষ কি?
গঙ্গারাম। সিং-দরজা দিয়া গেলে দোষ ছিল না। এ যে খিড়কী। অন্তঃপুরে যাইতে হইবে না কি?
মুরলা। সাহস হয় না?
গঙ্গা। না—আমার সে সাহস হয় না, এ আমার প্রভুর অন্তঃপুর! বিনা হুকুমে যাইতে পারি না।
মুরলা। কার হুকুম চাই?
গঙ্গা। রাজার হুকুম
মুরলা। তিনি ত দেশে নাই। রাণীর হুকুম হইলে চলিবে?
গঙ্গা। চলিবে।
মুরলা। আসুন, আমি রাণীর হুকুম আপনাকে শুনাইব।
গঙ্গা। কিন্তু পাহারাওয়ালা তোমাকে যাইতে দিবে?
মুরলা। দিবে।
গঙ্গা। কিন্তু আমাকে না চিনিলে ছাড়িয়া দিবে না। এ অবস্থায় পরিচয় দিবার আমার ইচ্ছা নাই।
মুরলা। পরিচয় দিবারও প্রয়োজন নাই। আমি আপনাকে লইয়া যাইতেছি।
দ্বারে প্রহরী দণ্ডায়মান। মুরলা তাহার নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন পাঁড়ে ঠাকুর, দ্বার খোলা রাখিয়াছ ত?”
পাঁড়ে ঠাকুর বলিলেন, “হাঁ, রাখিয়েসে। এ কোন্?”
প্রহরী গঙ্গারামের প্রতি দৃষ্টি করিয়া এই কথা বলিল। মুরলা বলিল, “এ আমার ভাই।”
পাঁড়ে। মরদ্ যাতে পার্বে না। হুকুম নেহি।
মুরলা তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া বলিল, “ইঃ, কার হুকুম রে? তোর আবার কার হুকুম চাই? আমার হুকুম ছাড়া তুই কার হুকুম খুঁজিস্? খ্যাংরা মেরে দাড়ি মুড়িয়ে দেব জানিস্ না?”
প্রহরী জড়সড় হইল, আর কিছু বলিল না। মুরলা গঙ্গারামকে লইয়া নির্ব্বিঘ্নে অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিল। এবং অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দোতালায় উঠিল। সে একটি কুঠারি দেখাইয়া দিয়া বলিল, “ইহার ভিতর প্রবেশ করুন। আমি নিকটেই রহিলাম, কিন্তু ভিতরে যাইব না।”
গঙ্গারাম কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া কুঠারির ভিতর প্রবেশ করিলেন। মহামূল্য দ্রব্যাদিতে সুসজ্জিত গৃহ, রজতপালঙ্কে বসিয়া একটি স্ত্রীলোক—উজ্জ্বল দীপাবলির স্নিগ্ধ রশ্মি তাহার মুখের উপর পড়িয়াছে, সে অধোবদনে চিন্তা করিতেছে। আর কেহ নাই। গঙ্গারাম মনে করিলেন, এমন সুন্দরী পৃথিবীতে আর জন্মে নাই। সে রমা।