সুকথা/সূর্য্য স্থপতি
সূর্য্য স্থপতি
প্রাচীন হিন্দুগণের পার্থিব কীর্ত্তিগুলি লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। আমরা লঙ্কার বৈভব ও ইন্দ্রপ্রস্থের সমৃদ্ধির কথা অনেকটা উপকথা বলিয়াই মনে করি। পরকীয় আক্রমণে ও রাষ্ট্রবিপ্লবে হিন্দুসভ্যতার বাহ্য সম্পদের কিছু নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না—কেবল মাত্র এলিফেণ্টা-গুহার নিভৃত নিকেতনে বিরাট্ প্রাচীন শিল্প অস্তমিত গৌরবের শেষ চিহ্ন লুকাইয়া রাখিয়াছে—কেবল মাত্র ভারতসাগরে ঊর্ম্মিবিধৌত সুদূর যবদ্বীপে বিশাল “বড়-বদর” মন্দির অগণিত দেববিগ্রহ বক্ষে ধারণ করিয়া ভাস্কর ও স্থাপত্যবিদ্যার তৎকালীন উৎকর্ষ নীরবে ঘোষণা করিতেছে। ওলন্দাজ-সরকারকর্ত্তৃক প্রকাশিত সেই সকল কীর্ত্তির ছবি দেখিয়া আমরা বিস্মিত হইয়া যাই। উড়িষ্যার নীলগিরিতে সুপ্রসিদ্ধ কোণার্ক মন্দির অতীতকীর্ত্তির অর্দ্ধ-ভগ্ন স্তূপমালা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু এই সমস্ত ধ্বংসাবশেষ একত্র করিলে আমরা যাহা পাই, তাহা প্রাচীন সমৃদ্ধির অতি নগণ্য অংশ।
যে সকল শিল্পী, ভাস্কর ও স্থপতিবিদ্যা-বিশারদ এদেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের নাম কোন ইতিহাসে লিপিবদ্ধ নাই। কখনও কোন শিল্পী কোন তাম্রফলকের নিম্নে বা প্রস্তরনির্ম্মিত বাসুদেব বিগ্রহের পশ্চাতে স্বীয় নামাঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই চিহ্ন তাঁহাদিগকে পরিচিত করিতে পারে। নাই, তাহা সময়-স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে।
কিন্তু একজন অতি দক্ষ শিল্পীর বিবরণ আমরা কাশ্মীরের ইতিহাসে দেখিতে পাই, তিনি যে কীর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, তাহা খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত বিদ্যমান ছিল,—এখনও কিছু আছে কিনা বলিতে পারি না।
এই শিল্পীর নাম সূর্য্য। ইনি প্রাচীন কালের অতি প্রসিদ্ধ স্থপতি। খৃষ্টীয় ৮৫৫ অব্দে কাশ্মীর-রাজসিংহাসনে অবন্তীরাজ অধিষ্ঠিত ছিলেন, ইনি ২৮ বৎসর রাজত্ব করেন, ইঁহারই রাজত্বকালে শিল্পি-শ্রেষ্ঠ সূর্য্য তাঁহার অসাধারণ প্রতিভা-বলে কাশ্মীররাজ্যের বিচিত্র ইষ্টসাধন করেন।
কাশ্মীররাজ্য বহু নদী ও হ্রদে পরিপূর্ণ, উহা কোন কালেই খুব উর্ব্বর দেশ বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিতে পারে নাই। মহারাজ ললিতাদিত্যের সময় জলনিঃসরণের বিশেষ ব্যবস্থা হওয়াতে কাশ্মীরের কোন কোন স্থান কথঞ্চিৎ উর্ব্বরতা লাভ করে। কিন্তু পরবর্ত্তী নৃপতিবর্গ ভূমির উৎকর্ষসাধনে কোন মনোযোগ প্রদান করেন নাই। সুতরাং ক্রমাগত বন্যার জল অপ্রতিরুদ্ধ গতিতে সমস্ত দেশ প্লাবিত করিতে থাকে, এই কারণে কাশ্মীর দুর্ভিক্ষের উৎপাতে প্রায় জনমানবশূন্য হইয়া পড়িল। প্রতি খাড়ি (১০ মণ, ১২ সের) ধান্যের মূল্য ১০৫০ দীনার হইয়া দাঁড়াইল। মনুষ্য ও গৃহপালিত পশুগণের যেরূপ অবস্থা হইল, তাহা বর্ণন করা যায় না।
চণ্ডালগৃহে পালিত সূর্য্য এই সময় রাজসকাশে উপস্থিত হইয়া জানাইলেন যে, যদি রাজা তাঁহাকে মুক্ত হস্তে ধন প্রদান করিতে কুণ্ঠিত না হন, তাহা হইলে তিনি এই দেশময় দুর্ভিক্ষ ও জলপ্লাবন হইতে প্রকৃতিপুঞ্জকে রক্ষা করিতে পারেন।
রাজসভা উপহাসের অট্টহাস্যে মুখরিত হইয়া উঠিল, দেশের সমস্ত গণ্যমান্য লোক এই বিপদের উদ্ধার করিতে পারিতেছেন না, আর চণ্ডাল যুবক কোথা হইতে ধৃষ্টতাপ্রকাশ করিতে আসিয়াছে, ইহার কি আশ্চর্য্য সাহস!
সূর্য্যের প্রতিভাদীপ্ত চক্ষু ও কথা বলিবার ভঙ্গীতে অবন্তীবর্ম্মার মনে অন্যরূপ ধারণা হইল, তিনি এই চণ্ডালযুবকের জন্য রাজকোষ মুক্ত করিয়া দিলেন।
সূর্য্য বিতস্তা নদীর তীরস্থিত নন্দক গ্রামে উপস্থিত হইলেন, এই পল্লী জলমগ্ন ছিল, সেই জলপ্লাবিত স্থানে উন্মত্তের ন্যায় সূর্য্য থলিয়াপূর্ণ দীনার নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এই সংবাদ পাইয়া মন্ত্রীর দল রাজার কাছে সূর্য্যকে উপহাস করিয়া অনেক কথা বলিলেন, রাজা আরও কিছুকাল প্রতীক্ষা করিয়া ফলাফল জানিতে উৎসুক রহিলেন। ক্রমে রাজ্যের অন্তর্গত জলপ্লাবিত যক্ষোদর নগরেও সূর্য্য এইভাবে জলনিম্নে দীনার বৃষ্টি করিতে লাগিলেন, চারিদিক্ হইতে লোকেরা হাসিতে লাগিল। এই স্থানে দুই দিকের পাহাড় হইতে বড় বড় প্রস্তর ধসিয়া পড়িয়া বিতস্তার গতিরোধ করিয়াছিল, বিতস্তার জল এইজন্য চারিপার্শ্বের পল্লীগুলি গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছিল। জলনিক্ষিপ্ত দীনারলোভে শত শত লোক ডুব মারিয়া প্রস্তর সরাইয়া ফেলিতে লাগিল, অসংখ্য লোকের প্রাণান্ত চেষ্টায় সেই প্রস্তরসমূহ স্থানচ্যুত হইয়া গেল ও বিতস্তার জল বন্ধনমুক্ত হইয়া বহির্গত হইল। জল নিঃশেষ হওয়া মাত্র সূর্য্য বিতস্তার মুখে সাত দিনের মধ্যে একটা প্রস্তরের বাঁধ প্রস্তুত করিলেন এবং নদীর নিম্নতল হইতে আবর্জ্জনা পরিষ্কার করিয়া বাঁধটি ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন। তখন নদী পুনরায় যেন নবজীবন লাভ করিয়া সাগরসঙ্গমে ছুটিল এবং সমস্ত জল নদীপ্রবাহে আবদ্ধ থাকিয়া তীরগুলি জাগাইয়া তুলিল, জলমগ্ন দেশ যেন সহসা জল হইতে গাত্রোত্থান করিয়া স্নানান্তে অঙ্গনার ন্যায় ধীরে ধীরে শস্যের শ্যামাঞ্চল খানিতে অঙ্গে জড়াইয়া ফেলিল।
অপর যে সকল স্থানে বিতস্তার গতি প্রতিরুদ্ধ হইয়াছিল, সূর্য্য সেই সেই স্থানে খাল কাটিয়া প্রবাহ মুক্ত করিয়া দিলেন। এইরূপ বহুসংখ্যক খাল তাঁহার আদেশে খনিত হইয়াছিল। বামদিকে সিন্ধু ও দক্ষিণে বিতস্তা প্রবাহিত ছিল; সূর্য্য এই দুই প্রবাহকে বন্যস্বামী নামক স্থানে সম্মিলিত করিয়া দিয়াছিলেন। কাশ্মীরের ইতিহাসলেখক কহ্লণ পণ্ডিতের সময় দ্বাদশ শতাব্দীতে এই সঙ্গম বিদ্যমান ছিল,—সূর্য্য ত্রিগ্রাম হইতে সিন্ধুনদের প্রবাহ ফিরাইয়া আনিয়া বিতস্তার সঙ্গে মিলাইয়া দিয়াছিলেন, এই কার্য্য কি প্রকার দুরূহ ও বিরাট্ ছিল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না,—পূর্ব্বে সিন্ধুনদের প্রবাহ যে দিকে ছিল, কহ্লণ পণ্ডিত তাহার চিহ্ন দেখিয়া ঠিক করিতে পারিয়াছিলেন,—বড় বড় গাছের নিম্নে নৌকা বাঁধিবার দড়ির চিহ্ন উক্ত প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিকের সময়ও বিদ্যমান ছিল। সূর্য্য মহাপদ্মহ্রদের জলের প্রবাহ রুদ্ধ করিবার জন্য ৫৬ মাইল ব্যাপক একটি প্রস্তরের বাঁধ প্রস্তুত করিয়াছিলেন এবং এই দের সঙ্গে বিতস্তাকে আনিয়া মিশাইয়াছিলেন।
অনেক নিম্নভূমি তাঁহার অপূর্ব্ব প্রতিভাবলে বন্যার জল হইতে রক্ষা পাইয়াছিল,—সেই সকল স্থান অত্যন্ত উর্ধ্বর হইয়াছিল। বহু স্থান ঘিরিয়া তৎকৃত প্রস্তরের বাঁধ অবস্থিত ছিল, সেই সকল স্থান “কুণ্ডল” আখ্যায় অভিহিত হইত। কহ্লণ পণ্ডিতের সময় পর্য্যন্ত কাশ্মীরের অনেক নদী শরৎকালে শীর্ণ হইয়া পড়িলে তন্মধ্যস্থিত সূর্য্যনির্ম্মিত প্রস্তরস্তম্ভের শীর্ষ দেখা যাইত। কথিত আছে, নন্দক গ্রাম বন্যামুক্ত হইলে তন্মধ্যে সূর্য্য-নিক্ষিপ্ত দীনারপূর্ণ থলিয়াগুলির অনেকটা পাওয়া গিয়াছিল। মহাপদ্মহ্রদের সঙ্গে বিতস্তার যে স্থলে মিলন হইয়াছিল, তাহার উপকূলে তিনি একটি সমৃদ্ধিশালী নগর স্থাপিত করিয়াছিলেন।
“সূর্য্যকুণ্ডল” নামক স্বপ্রতিষ্ঠিত একটি বৃহৎ পল্লী তিনি ব্রাহ্মণদিগকে দান করিয়াছিলেন। তাঁহার অন্যতম কীর্ত্তি “সূর্য্যসেতু” বহুদিন বিদ্যমান ছিল। বহু গ্রাম তিনি কৃত্রিম খাল কাটিয়া উর্ব্বর করিয়াছিলেন, তিনি কাশ্মীর রাজ্যের যে সকল কল্যাণ সাধন করিয়াছিলেন, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। তাঁহার পূর্ব্বে কাশ্মীরে খুব উৎকৃষ্ট ফসল হইলেও এক খাড়ি ধান্যের দাম কোন কালেই ২০০ দীনারের কম হয় নাই, কিন্তু তাঁহার সময় প্রতি খাড়ি ৩৬ দীনার হইয়াছিল। তাঁহার যত্নে বন্যামুক্ত কাশ্মীরদেশের বহু স্থানে পরবর্ত্তী রাজন্যবর্গ শত শত নগরী নির্ম্মাণ করিতে পারিয়াছিলেন। এই সমস্ত বিবরণ রাজতরঙ্গিণী হইতে সংগৃহীত হইল। ইহার সকল অংশ ঠিক ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায় কি না বলা যায় না—কিন্তু এই সকল বিবরণের অনেকাংশই যে সত্য এবং সূর্য্যের অসাধারণ প্রতিভার পরিচায়ক, তৎসম্বন্ধে সন্দেহ নাই।
এদেশে কোন নিম্নশ্রেণীর লোক আশ্চর্য্য প্রতিভা দেখাইলে তাহার উচ্চজাতিত্ব প্রতিপাদন করিবার জন্য অনেক প্রবাদ ও জনশ্রুতির সংঘটন হইয়া থাকে। “সূর্য্য” শুধু চণ্ডালগৃহে চণ্ডালী-কর্ত্তৃক পালিত হইয়াছিলেন, বস্তুতঃ তিনি ভদ্রঘরের সন্তান, তাঁহাকে তাঁহার পিতামাতা হাঁড়ির ভিতর পূরিয়া পথে ফেলিয়া গিয়াছিলেন—চণ্ডালী কুড়াইয়া পাইয়াছিল, ইত্যাদি অনেক কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হইয়াছে, উহা কতদূর বিশ্বাস্য তাহা বলিতে পারি না।
আমাদের দেশে খালখনন যে এক সময়ে অতি বৃহৎ ও বিরাট্ চেষ্টায় সমাহিত হইত, তাহার ইঙ্গিত প্রাচীন গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। এমন কি ঐতিহাসিক কালের পূর্ব্বে ভগীরথের গঙ্গা আনিবার কথা, সগর-রাজের সমুদ্র সম্বন্ধে ও অগস্ত্য-মুনির বিন্ধ্যপর্ব্বত সম্পর্কীয় উপকথার ভিতরে কোন নিগূঢ় ঐতিহাসিক সত্য কাব্যমগ্ন হইয়া আছে কিনা কে বলিবে? কহ্লণ পণ্ডিত সূর্য্যকে বলদেব ও কশ্যপ হইতেও ভূমির উৎকর্ষ সাধনে অধিকতর কৃতকার্য্য বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। বলদেবের বিশ্ববিশ্রুত হলের কথা অবশ্য শুনিয়াছি, কিন্তু কশ্যপ কি করিয়াছিলেন?
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |