সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/অন্যান্য গল্প/ব্যাঙের সমুদ্র দেখা
(পৃ. ৩৭০-৩৭১)
গ্রামের ধারে কবেকার পুরানো এক পাতকুয়োর ফাটলের মধ্যে কোলাব্যাঙ তার পরিবার নিয়ে থাকত! গ্রামের মেয়েরা সেখানে জল তুলতে এসে যে-সব কথাবার্তা বলত কোলাব্যাঙ তার ছেলেদের সেই-সব কথা বুঝিয়ে দিত-আর ছেলেরা ভাবত, ‘ইস্! বাবা কত জানে!'
একদিন সেই মেয়েরা সমুদ্রের কথা বলতে লাগল। ব্যাঙের ছানার জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁ বাবা! সমুদ্র কাকে বলে?” ব্যাঙ খানিক ভেবে বলল, “সমুদ্র? সে একরকম জন্তুর নাম।” তখন একটা ছানা বলল, “ওরা যে বলছিল সমুদ্র খুব ভয়ানক বড়ো হয়, আর তার মধ্যে অনেক অনেক জল থাকে-আর লোকেরা সাঁতার কেটে তা পার হতে পারে না।” তখন কোলাব্যাঙ মুশকিলে পড়ল। সে গাছপালা দেখেছে, বাড়িঘর দেখেছে, মানুষ কুকুর ঘটিবাটি নানারকম জিনিসপত্র সব দেখেছে, আর ছেলেবেলায় অনেকরকম জিনিসের গল্প শুনেছে। কিন্তু সমুদ্রের কথা তো কখনো শোনে নি! তখন সে ভাবল, সমুদ্রের কথা একটু, খোঁজ করে দেখতে হবে।
পরদিন সকালে উঠেই কোলাব্যাঙ তার ছাতা পোঁটলা নিয়ে বলল, “আমি সমুদ্রের সন্ধান করতে যাচ্ছি।” তার গিন্নী কত কাঁদল, ছেলেরা নানারকম সুর করে তাকে বারণ করল কিন্তু কোলব্যাঙ বলল, 'না, এতে আমার জ্ঞানলাভ হবে-তোমরা বাধা দিয়ো না।” এই বলে সে পতিকুয়ো থেকে উঠে একটা মাঠের দিকে চলল। ব্যাঙ বাইরে এসেই দেখল মানুষ কুকুর গোরু তারা কেউ তার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলে না-তাই দেখে সে ভাবল, 'লাফিয়ে চললে সবাই আমায় বেকুব ভাববে।' এই ভেবে সে হেঁটে হেঁটে চলতে লাগল। কিন্তু অমন করে চলে তো তার অভ্যাস নেই-খানিক দূর গিয়েই তার ভারি পরিশ্রম বোধ হল।
মাঠের ওপারে আর-এক গ্রামের কাছে এক গর্তের মধ্যে মেটে ব্যাঙদের বাসা ছিল। মেটে ব্যাঙেরাও সমুদ্রের কথা শুনেছে, তাই তাদের মধ্যে একজন বেরিয়েছে সমুদ্রটা দেখতে। মাঝপথে দুই ব্যাঙের দেখা হল। কোলাব্যাঙ বলল, “আমি ফাটলকুয়োর কোলাব্যাঙ, যাচ্ছি সমুদ্রে।” মেটে ব্যাঙ বলল, “আমি মেঠো-মাটির মেটে ব্যাঙ, আমিও যাচ্ছি সমুদ্রে।” তখন তাদের ভারি ফুর্তি হল।
কিন্তু সমুদ্রে যাবার পথ তো তারা জানে না। মাঠের মধ্যে একটা মস্তু টিপি ছিল; মেটে ব্যাঙ বলল, “ওর উপরে উঠে দেখি তো কিছু দেখা যায় কি না।”
এ ই বলে তারা আনেক কষ্টে সেই টিপির উপর চড়ে সেখান থেকে একটা গ্রাম দেখতে পেল। মেটে ব্যাঙ বলল, “আরে দুর ছাই! এরকম তো ঢের দেখেছি। আমার বাড়ির কাছেই তো অমন আছে।” কোলাব্যাঙ বলল, “তাই তো। আমিও ছেলেবেলা থেকে ওরকম কত দেখেছি। সব জায়গাই দেখছি একরকম। মিছামিছি আমরা হেঁটে মরলাম।”
তখন তারা ভারি বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেল। কোলাব্যাঙ তার ছানাদের বলল, “সমুদ্র-টমুদ্র কিছু নেই—ও-সব মিছে কথা!”