সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/কালাচাঁদের ছবি

কালাচাঁদের ছবি।

 কালাচাঁদ নিধিরামকে মারিয়াছে—তাই নিধিরাম হেডমাস্টার মহাশয়ের কাছে নালিশ করিয়াছে। হেডমাস্টার আসিয়া বলিলেন, “কি হে কালাচাঁদ, তুমি নিধিরামকে মেরেছ?” কালাচাঁদ বলিল, “আজ্ঞে না, মারব কেন? কান মলে দিয়েছিলাম, গালে খাম্‌চিয়ে দিয়েছিলাম, আর একটুখানি চুল ধরে ঝাঁকিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলাম।” হেডমাস্টার বলিলেন, “কেন ওরকম করেছিলে?” কালাচাঁদ খানিকটা অম্‌তা-অম্‌তা করিয়া মাথা চুলকাইয়া বলিল, “আজ্ঞে, ও খালি খালি আমায় চটাচ্ছিল।” হেডমাস্টার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমায় মেরেছিল?” “না”। “তোমায় গাল দিয়েছিল?” “না!” “ধমকিয়েছিল?” “না।” “তবে?” “বার বার ঘ্যান্‌ঘ্যান্ করে বোকার মতো কথা বলছিল, তাই আমার রাগ হয়ে গেল।” মাস্টারমহাশয় তাহার কান ধরিয়া বেশ ভালোরকম নাড়াচাড়া দিয়া বলিলেন, “মেজাজটা এখন হইতে একটু সংশোধন করিতে চেষ্টা কর।”

 ছুটির পর আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, “হ্যাঁরে কালাচাঁদ, তুই খামখা ঐ নিধেটাকে মারতে গেলি কেন?” কালাচাঁদ বলিল, “খামখা মারব কেন? কেন মেরেছিলাম ওকেই জিজ্ঞেসা কর-না!” নিধেকে জিজ্ঞাসা করিতে সে বলিল, “খামখা নয়তো কি? তুই বাপু ছবি এঁকেছিস—তার কথা আমায় জিজ্ঞাসা করতে গেলি কেন? আর যদি জিজ্ঞেস করলি, তা হলে তাই নিয়ে আবার মারামারি করতে এলি কেন?” আমরা বলিলাম, “আরে কি হয়েছে খুলেই বল্-না কেন।”

 নিধিরাম বলিল, “কালাচাঁদ একটা ছবি এঁকেছে—ছবির নাম ‘খাণ্ডবদাহন'। সেই ছবিটা আমায় দেখিয়ে ও জিজ্ঞাসা করল, কেমন হয়েছে? আমি বললাম, “এটা কি এঁকেছ? মন্দিরের সামনে শেয়াল ছুটছে? কালাচাঁদ বলল, “না না মন্দির কোথায়? ওটা হল রথ। আর এগুলো তো শেয়াল নয়-রথের ঘোড়া।' আমি বললাম, “সূর্যটাকে কালো করে একেছ কেন? আর তালগাছের উপরে পদ্মফুল ফুটেছে কেন? আর ঐ চামচিকেটা লাঠি নিয়ে ডিগবাজি খাচ্ছে কেন? কালাচাঁদ বলল, “আহা তা কেন? ওটা তো সূর্য নয়, সুদর্শন চক্র! দেখছ না কৃষ্ণের হাতে রয়েছে? আর তালগাছ কোথায় দেখলে? ওটা তো অজুনের পতাকা। আর ঐগুলোকে বুঝি পদ্মফুল বলছ? ওগুলো দেবতা-খুব দূরে আছেন কিনা তাই ওরকম ছোটো-ছোটো দেখাচ্ছে। আর এইটা বুঝি চামচিকে হল—এটা তো গরুড় পাখি। একটা সাপকে তাড়া করেছে। আমি বললাম, “তা হবে। আমি ও-সব বুঝি-টুঝি না। আচ্ছা ঐ কালো কাপড় পরা মেয়েমানুষটি যে ওদের মারতে আসছে ওটি কে? কালাচাঁদ বললে, তুমি তো আচ্ছা মুখ্যু হে! ওটা গাছে আগুন লেগে ধোঁয়া বেরুচ্ছে বুঝতে পাচ্ছ না? অবাক করলে যে!'

 “তখন আমি বললাম, “অচ্ছিা এক কাজ কর-না কেন ভাই, ওটাকে খাণ্ডবদাহন না করে সীতার অগ্নিপরীক্ষা কর-না কেন? ঐ গাছটাকে শাড়ি পরিয়ে সীতা করে দাও। ঐ রথটার মাথায় জটা-টটা দিয়ে ওকে অগ্নিদেব বানাও। কৃষ্ণ অর্জুন আছেন, তারা হবেন রাম লক্ষণ। আর ঐ সুদর্শন চক্রে নাক হাত পা জুড়ে দিলেই ঠিক বিভীষণ হয়ে যাবে। তার পর চামচিকের পিছনে একটা লম্বা ল্যাজ দিয়ে তার ডানাদুটো মুছে দাও—এটা হনুমান হবে এখন।' কালাচাঁদ বলল, 'হনুমানও হতে পারে, নিধিরামও হতে পারে।'

 “আমি বললাম, 'তা হলে ভাই আর-এক কাজ কর। ওটাকে শিশুপাল বধ করে দাও। তা হলে কৃষ্ণকে বদলাতে হবে না। চক্র তুলে শিশুপালকে মারতে যাচ্ছে! অর্জুনের মুখে পাকা গোঁফদাড়ি দিয়ে খুব সহজেই ভীষ্ম করে দেওয়া যাবে। আর রথটা হবে সিংহাসন, তার উপর যুধিষ্ঠিরকে বসিয়ে দিয়ো। আর ঐ যে গরুড় আর সাপ, ঐটে একটু বদলিয়ে দিলেই গদা হাতে ভীম হয়ে যাবে। আর শিশুপাল তো আছেই।—ঐ গাছটাতে একটু নাক মুখ ফুটিয়ে দিলেই হবে। তার পর রাজসূয় যজ্ঞের কয়েকটা রাজাকে দেখালেই- ব্যস!' কথাটা কালাচাঁদের পছন্দ হল না, তাই আমি অনেক ভেবেচিন্তে আবার বললাম, 'তা হলে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ করনা কেন? ঐ রথটা হবে জনমেজয় আর কৃষ্ণকে জটা দাড়ি দিয়ে পুরুতঠাকুর বানিয়ে দাও। সুদর্শন চক্রটা হবে ঘিয়ের ভাঁড়। যজ্ঞের আগুনের মধ্যে তিনি ঘি ঢালছেন। ঐ ধোঁয়াগুলো মনে কর যজ্ঞেরই ধোঁয়া। একটা সাপ আছে, আরো কয়েকটা একে দিও। আর অর্জুনকে কর আস্তীক—সে হাত তুলে তক্ষককে বলছে, ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ!' আর ঐ চামচিকেটা-মানে গরুড়টা-ওটাকে মুনিটুনি কিছু একটা বানিয়ে দিয়ো।' পতাকাটাকে কিরকম করতে হবে সেইটা বলতে যাচ্ছি, এমন সময় কালাচাঁদ আমায় এক ধাক্কা দিয়ে বলল, 'থাক থাক আর তোমার বিদ্যে জাহির করে কাজ নেই। সর দেখি!'

 “আমি বললাম, ‘তা অত রাগ কর কেন ভাই? আমি তো আর বলছি না যে আমার পরামর্শমতো তোমাকে চলতেই হবে। পছন্দ হয় কোরো, না হয় কোরো না-ব্যস্। এর মধ্যে আবার রাগারাগি কর কেন? আমার কথামতো না করে অন্য-একটা কিছু কর-না। মনে কর, ওটাকে সমুদ্রমন্থন করে দিলেও তো হয়। ঐ ধোঁয়াওয়ালা বড়ো গাছটা মন্দরপর্বত, রথটা ধন্বন্তরী কিম্বা লক্ষী-মন্থন থেকে উঠে এসেছেন। ওদিকে সুদর্শন চক্রটা চাঁদ হতে পারবে। অর্জুনের পেছনে কতগুলো দেবতা এঁকে দাও আর এদিকে কৃষ্ণ আর চামচিকের দিকে কতগুলী অসুর- কথাটা ভালো করে বলতে না বলতেই কালার্টাদ আমার কান ধরে মারতে লাগল। আচ্ছা দেখ দেখি কি অন্যায়। আমি বন্ধুভাবে দুটো পরামর্শ দিতে গেলাম—তা তোমার পছন্দ হয় নি বলেই আমায় মারবে? যা বলেছি সব শুনলে তো, এর মধ্যে এত রাগ করবার কি হল বাপু?”

 বাস্তবিক, কালাচাঁদের এ বড়ো অন্যায়-সে রাগ করিল কিসের জন্য। নিধিরাম তাহাকে মারে নাই, ধরে নাই, বকে নাই, গাল দেয় নাই, চোখ রাঙায় নাই, মুখ ভ্যাংচায় নাই—তবে তার রাগ করিবার কারণটা কি?

 ব্যাপারটা কি বোঝা গেল না, তাই সন্ধ্যায় সবাই মিলিয়া কালাচাঁদের বাড়িতে গেলাম। আমি বলিলাম, “ভাই কালাচাঁদ, আমরা তোমার সেই ছবিটা দেখতে চাই। সেই যে সমুদ্র লঙ্ঘন না কি যেন?” রমাপ্রসাদ বলিল, “দ্যুৎ, সমুদ্র লঙ্ঘন কিসের? অগ্নি পরীক্ষা।” আর একজন কে যেন বলিল, “না না কি একটা বধ।” কেন জানি না, কালাচাঁদ হাঁ হাঁ করিয়া একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিল। “যাও যাও ইয়ার্কি করতে হবে না” বলিয়া সে তাহার ছবির খাতাখানি ফড়্‌ফড়্ করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল—আর রাগে গজরাইতে লাগিল। আমরা হতভম্ব হইয়া রহিলাম। সকলেই বলিলাম, “কালাচাঁদের মাথায় বোধ হয় একটু পাগলামির ছিট আছে। নইলে সে খামখা এত রাগ করে কেন?”

সন্দশ-আষাঢ়, ১৩২৫