সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/ভোলানাথের সর্দারি
(পৃ. ১৩৫-১৩৭)
সকল বিষয়েই সর্দারি করিতে যাওয়া ভোলানাথের ভারি একটা বদঅভ্যাস। যেখানে তাহার কিছু বলিবার দরকার নাই সেখানে সে বিজ্ঞের মতো উপদেশ দিতে যায়। যে কাজের সে কিছুমাত্র বোঝে না, সেই কাজেও সে চটপট হাত লাগাইতে ছাড়ে না। এইজন্য গুরুজনেরা তাহাকে বলেন ‘জ্যাঠা’-আর সমবয়সীরা বলে ‘ফড়্ ফড়িরম'। কিন্তু তাহাতে তাহার কোনো দুঃখ নাই, বিশেষ লজ্জাও নাই। সেদিন তাহার তিন ক্লাশ উপরের বড়ো-বড়ো ছেলেরা যখন নিজেদের পড়াশুনা লইয়া আলোচনা করিতেছিল, তখন ভোলানাথ মুরুব্বির মতো গম্ভীর হইয়া বলিল, “ওয়েবস্টারের ডিকশনারি সবচাইতে ভালো। আমার বড়্ দাদা যে দু-ভলুম। ওয়েবস্টারের ডিকশনারি কিনেছেন, তার এক-একখানা বই এ-ত্তোখানি বড়ো আর এ-ম্-নি মোটা! আর লাল চামড়া দিয়ে বাঁধানো!” উঁচু ক্লাশের একজন ছাত্র আচ্ছা করিয়া তাহার কান মলিয়া বলিল, “কিরকম লাল হে? তোমার এই কানের মতো?” কিন্তু তবু, ভোলানাথ এমন বেহায়া, সে তার পরদিনই সেই তাহাদেরই কাছে ফুটবল সম্বন্ধে কি যেন মতামত দিতে গিয়া এক চড় খাইয়া আসিল।
বিশুদের একটা ইঁদুর ধরিবার কল ছিল। ভোলানাথ হঠাৎ একদিন, “এটা কিসের কল ভাই” বলিয়া খামখা সেটাকে নাড়িয়া চাড়িয়া কলকব্জা এমন বিগড়াইয়া দিল যে কলটা একেবারেই নষ্ট হইয়া গেল। বিশু বলিল, “না জেনেশুনে কেন টানাটানি করতে গেলি?” ভোলানাথ কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হইয়া বলিল, “আমার দোষ হল বুঝি? দেখ তো, হাতলটা কিরকম বিচ্ছিরি বানিয়েছে। ওটা আরো অনেক মজবুত করা উচিত ছিল। কলওয়ালা ভয়ানক ঠকিয়েছে।”
ভোলানাথ পড়াশুনায় যে খুব ভালো ছিল তাহা নয়, কিন্তু তবু, মাস্টারমহাশয় যখন কঠিন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেন, তখন সে জানুক আর না জানুক, সাততাড়াতাড়ি সকলের আগে জবাব দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিত। জবাবটা অনেক সময়েই বোকার মতো হইত, শুনিয়া মাস্টারমহাশয় ঠাট্টা করিতেন, ছেলেরা হাসিত, কিন্তু ভোলানাথের উৎসাহ তাহাতে কমিত না।
সেই যেবারে ইস্কুলে বই চুরির হাঙ্গামা হয় সেবারও সে এইরকম সর্দারি করিতে গিয়া খুব জব্দ হয়। হেডমাস্টার মহাশয় ক্রমাগত বই চুরির নালিশে বিরক্ত হইয়া একদিন প্রত্যেক ক্লাশে ক্লাশে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে চুরি করিতেছে তোমরা কেউ কিছু জান?” ভোলানাথের ক্লাশে এই প্রশ্ন করিবামাত্র ভোলানাথ তড়াক করিয়া লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, “আতে, আমার বোধ হয় হরিদাস চুরি করে!” জবাব শুনিয়া আমরা সবাই অবাক হইয়া গেলাম, হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কি করে জানলে যে হরিদাস চুরি করে?” ভোলানাথ অম্লাবদনে বলিল, না, জানি নে-কিন্তু আমার মনে হয়।” মাস্টারমহাশয় ধমক দিয়া বলিলেন, “জান না, তবে অমন কথা বললে কেন? ওরকম মনে করবার তোমার কি কারণ আছে।” ভোলানাথ আবার বলিল, “আমার মনে হচ্ছিল, বোধ হয় ও নেয়—তাই তো বললাম। আর তো কিছু আমি বলি নি।” মাস্টারমহাশয় গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “যাও, হরিদাসের কাছে ক্ষমা চাও।” তখনই ভোলানাথের কান ধরিয়া হরিদাসের কাছে ক্ষমা চাওয়ানো হইল। কিন্তু তবু কি তাহার চেতনা হয়?
ভোলানাথ সাঁতার জানে না, কিন্তু তবু সে বাহাদুরি করিয়া হরিশের ভাইকে সাঁতার শিখাইতে গেল। রামবাবু হঠাৎ ঘাটে আসিয়া পড়েন তাই রক্ষা। তা না হইলে দুজনকেই সেদিন ঘোষ পুকুরে ডুবিয়া মরিতে হইত। কলিকাতায় মামার নিষেধ না শুনিয়া চলতি ট্রাম হইতে নামিতে গিয়া ভোলানাথ কাদার উপর যে আছাড় খাইয়াছিল, তিনমাস পর্যন্ত তাহার আঁচড়ের দাগ তাহার নাকের উপর ছিল। আর বেদেরা শেয়াল ধরিবার জন্য যেবার ফাঁদ পাতিয়া রাখে, সেবার সেই ফাঁদ ঘাঁটিতে গিয়া ভোলানাথ কিরকম আটকা পড়িয়াছিল, সে কথা ভাবিলে আজও আমাদের হাসি পায়। কিন্তু সবচাইতে যেবার সে জব্দ হইয়াছিল সেবারের কথা বলি শোন।
আমাদের স্কুলে আসিতে হইলে কলেজবাড়ির পাশ দিয়া আসিতে হয়। সেখানে একটা ঘর আছে তাহাকে বলে লেবরেটরি। সে ঘরে নানারকম অদ্ভুত কলকারখানা থাকিত। ভোলানাথের সবটাতেই বাড়াবাড়ি, সে একদিন একেবারে কলেজের ভিতরে গিয়া দেখিল, একটা কলের চাকা ঘুরানো হইতেছে আর কলের একদিকে চড়াক্ চড়াক্ করিয়া বিদ্যুতের মতো ঝিলিক জ্বলিতেছে। দেখিয়া ভোলানাথের ভারি শখ হইল, সেও একবার কল ঘুরাইয়া দেখে! কিন্তু কলের কাছে যাওয়ামাত্র কে একজন তাহাকে এমন ধমক দিয়া উঠিল, যে ভয়ে এক দৌড়ে সে ইস্কুলে আসিয়া হাঁপাইতে লাগিল। কিন্তু কলটা একবার নাড়িয়া দেখিবার ইচ্ছাটা তাহার কিছুতেই গেল না।
একদিন বিকালে যখন সকলে বাড়ি যাইতেছি, তখন ভোলানাথ যে কোন সময়ে কলেজবাড়িতে ঢুকিল তাহা আমরা বুঝিতে পারি নাই: সে চপিচুপি কলেজবাড়ির লেবরেটরি বা যন্ত্রখানায় ঢুকিয়া অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখে ঘরে কেউ নাই, তখনই ভরসা করিয়া ভিতরে ঢুকিয়া সে কলকব্জা দেখিতে লাগিল। সেইদিনের সেই কলটা আলমারির আড়ালে উঁচু তাকের উপর তোলা রহিয়াছে, সেখানে তাহার হাত যায় না। অনেক কষ্টে সে টেবিলের পিছন হইতে একখান বড়ো চৌকি লইয়া আসিল। এদিকে কখন যে কলেজের কর্মচারী চাবি দিয়া ঘরের তালা আঁটিয়া চলিয়া গেল, সেও ভোলানাথকে দেখে নাই, ভোলানাথেরও সেদিকে চোখ নাই। চৌকির উপর দাঁড়াইয়া ভোলানাথ দেখিল কলটার কাছে একটা অদ্ভুত বোতল। সেটা যে বিদ্যুতের বোতল ভোলানাথ তাহা জানে না। সে বোতলটাকে ধরিয়া সরাইয়া রাখিতে গেল। অমনি বোতলের বিদ্যুৎ হঠাৎ তাহার শরীরের ভিতর দিয়া ছুটিয়া গেল, মনে হইল যেন তাহার হাড়ের ভিতর পর্যন্ত কিসের একটা ধাক্কা বাজিয়া উঠিল, সে মাথা ঘুরিয়া চৌকি হইতে পড়িয়া গেল।
বিদ্যুতের ধাক্কা খাইয়া ভোলানাথ খানিকক্ষণ হতভম্ব হইয়া রহিল! তার পর ব্যস্ত হইয়া পলাইতে গিয়া দেখে দরজা বন্ধ। অনেকক্ষণ দরজায় ধাক্কা দিয়া, কিল, ঘুষি, লাথি, মারিয়াও দরজা খুলিল না। জানলাগুলি অনেক উঁচুতে, আর বাহির হইতে বন্ধ করা-চৌকিতে উঠিয়াও নাগাল পাওয়া গেল না। ভোলানাথের কপালে দরদর করিয়া ঘাম ঝরিতে লাগিল। সে ভাবিল প্রাণপণে চীৎকার করা যাক—যদি কেউ শুনতে পায়। কিন্তু তাহার গলার স্বর এমন বিকৃত শুনাইল আর মস্ত ঘরটাতে এমন অদ্ভুত প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল, যে নিজের আওয়াজে নিজেই সে ভয় পাইয়া গেল। ওদিকে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। কলেজের বটগাছটির উপর হইতে একটা প্যাঁচা হঠাৎ ‘ভূত-ভূতুমভূত’ বলিয়া বিকটশব্দে ডাকিয়া উঠিল। সেই শব্দে একেবারে দাঁতে দাঁত লাগিয়া ভোলানাথ এক চীৎকারেই অজ্ঞান।
কলেজের দরোয়ান তখন আমাদের ইস্কুলের পাঁড়েজি আর দু-চারটি দেশভাইয়ের সঙ্গে জুঠিয়া মহা উৎসাহে, ‘হাঁ হাঁ রে কাঁহা গয়ো রাম’ বলিয়া ঢোল করতাল পিটাইতে ছিল, কোনোরূপ চীৎকার শুনিতে পায় নাই। রাত-দুপুর পর্যন্ত তাহাদের কীর্তনের হল্লা চলিল। সুতরাং জ্ঞান হইবার পর ভোলানাথ যখন দরজায় দুম্দুম্ লাথি মারিয়া চেঁচাইতেছিল, তখন সে শব্দ গানের ফাঁকে ফাঁকে তাহাদের কানে একটু আধটু আসিলেও তাহারা গ্রাহ্য করে নাই। পাঁড়েজি একবার খালি বলিয়াছিল, কিসের শব্দ একবার খোঁজ লওয়া যাক—তখন অন্যেরা বাধা দিয়া বলিয়াছিল, “আরে, চিল্লানে দেও।” এমনি করিয়া রাত বারোটার সময় যখন তাহাদের উৎসাহ ঝিমাইয়া আসিল, তখন ভোলানাথের বাড়ির লোকেরা লণ্ঠন হাতে হাজির হইল। তাহারা বাড়ি-বাড়ি ঘুরিয়া কোথাও তাহাকে আর খুঁজিতে বাকি রাখে নাই। দরোয়ানদের জিজ্ঞাসা করায় তাহারা একবাক্যে বলিল, ‘ইস্কুলবাবুদের’ কাহাকেও তাহারা দেখে নাই। এমন সময় সেই দুম্দুম্ শব্দ আর চীৎকার আবার শোনা গেল।
তার পর ভোলানাথের সন্ধান পাইতে আর বেশি দেরি হইল না! কিন্তু তখনো উদ্ধার নাই—দরজা বন্ধ, চাবি গোপালবাবুর কাছে, গোপালবাবু বাসায় নাই, ভাইঝির বিবাহে গিয়াছেন, সোমবার আসিবেন। তখন অগত্যা মই আনাইয়া, জানলা খুলিয়া, শার্শীর কাঁচ ভাঙিয়া, অনেক হাঙ্গামার পর ভয়ে মৃতপ্রায় ভোলানাথকে বাহির করা হইল। সে ওখানে কি করিতেছিল, কেন আসিয়াছিল, কেমন করিয়া আটকা পড়িল, ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করিবার জন্য তাহার বাবা প্রকাণ্ড একচড় তুলিতেছিলেন, কিন্তু ভোলানাথের ফ্যাকাশে মুখখানা দেখিবার পর সে চড় আর তাহার গালে নামে নাই। নানাজনে জেরা করিয়া তাহার কাছে যে-সমস্ত কথা আদায় করিয়াছেন, তাহা শুনিয়াই আমরা তাহার আটকা পড়িবার বর্ণনাটা দিলাম। সে কিন্তু আমাদের কাছে এত কথা কবুল করে নাই। আমাদের সে আরো উলটা বুঝাইতে চাহিয়াছিল যে, সে ইচ্ছা করিয়াই বাহাদুরির জন্য কলেজবাড়িতে রাত কাটাইবার চেষ্টায় ছিল। যখন সে দেখিল যে তাহার সে কথা কেহ বিশ্বাস করে না, বরং আসল কথাটা ক্রমেই ফাঁস হইয়া পড়িতেছে, তখন সে এমন মুষড়াইয়া গেল যে অন্তত মাস তিনেকের জন্য তাহার সর্দারির অভ্যাসটা বেশ একটু দমিয়া পড়িয়াছিল।