সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/চীনে পটকা
(পৃ. ১১০-১১২)
আমাদের রামপদ একদিন এক হাঁড়ি, মিহিদানা লইয়া স্কুলে আসিল! টিফিনের ছুটি হওয়ামাত্র আমরা সকলেই মহা উৎসাহে সেগুলি ভাগ করিয়া খাইলাম। খাইল না কেবল ‘পাগলা দাশু'।
পাগলা দাশু যে মিহিদানা খাইতে ভালোবাসে না, তা নয়। কিন্তু, রামপদকে সে একেবারেই পছন্দ করিত না-দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া চলিত! আমরা রামপদকে বলিলাম, “দাশুকে কিছু দে!” রামপদ বলিল, “কি রে দাশু, খাবি নাকি? দেখিস, খাবার লোভ হয়ে থাকে তো বল আর আমার সঙ্গে কোনোদিন লাগতে আসবি নে-তা হলে মিহিদানা পাবি।” এমন করিয়া বলিলে তো রাগ হইবারই কথা, কিন্তু দাশু কিছু, না বলিয়া গম্ভীরভাবে হাত পাতিয়া মিহিদানা লইল, তার পর দরোয়ানের কুকুরটাকে ডাকিয়া সকলের সামনে তাহাকে সেই মিহিদানা খাওয়াইল! তার পর খানিকক্ষণ হাঁড়িটার দিকে তাকাইয়া কি যেন ভাবিয়া মুচকি মুচকি হাসিতে হাসিতে স্কুলের বাহিরে চলিয়া গেল। এদিকে হাঁড়িটাকে শেষ করিয়া আমরা সকলে খেলায় মাতিয়া গেলাম—দাশুর কথা কেউ আর ভাবিবার সময় পাই নাই।
টিফিনের পর ক্লাশে আসিয়া দেখি দাশু অত্যন্ত শান্তশিষ্টভাবে এককোণে বসিয়া আপন মনে অঙ্ক কষিতেছে। তখনই আমাদের কেমন সন্দেহ হইয়াছিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি রে দাশু, কিছু করেছিস নাকি?” দাশু নিতান্ত ভালোমানুষের মতো বলিল, “হ্যাঁ, দুটো জি-সি-এম করে ফেলেছি।” আমরা বলিলাম, “দুৎ! সে কথা কে বলছে? কিছু দুষ্টুমির মতলব করিস নি তো?” এ কথায় দাশু ভয়ানক চটিয়া গেল। তখন পণ্ডিতমহাশয় ক্লাশে আসিতেছিলেন, দাশু তাহার কাছে নালিশ করে আর কি! আমরা অনেক কষ্টে তাহাকে ঠাণ্ডা করিয়া বসাইয়া রাখিলাম।
এই পণ্ডিতমহাশয় মানুষটি মন্দ নহেন। পড়ার জন্য কোনোদিনই তাড়াহুড়া করেন না। কেবল মাঝে মাঝে একটু বেশি গোল করিলে হঠাৎ সাংঘাতিকরকম চটিয়া যান। সে সময়ে তাঁর মেজাজটি আশ্চর্যরকম ধারালো হইয়া উঠে। পণ্ডিতমহাশয় চেয়ারে বসিয়াই, “নদী শব্দের রূপ কর” বলিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন। আমরা বই খুলিয়া, হড়্ বড়্, করিয়া যা তা খানিকটা বলিয়া গেলাম-এবং তাহার উত্তরে পণ্ডিতমহাশয়ের নাকের ভিতর হইতে অতি সুন্দর ঘড়্ঘড়্ শব্দ শুনিয়া বুঝিলাম নিদ্রা বেশ গভীর হইয়াছে। কাজেই আমরাও শ্লেট লইয়া ‘টুকটাক্’ আর ‘দশ-পঁচিশ’ খেলা শুরু করিলাম। কেবল মাঝে মাঝে যখন ঘড় ঘড়ানি কমিয়া আসিত-তখন সবাই মিলিয়া সুর করিয়া নদী নদ্যৌ নদ্যঃ' ইত্যাদি আওড়াইতাম। দেখিতাম, তাহাতে, ঘুমপাড়ানি গানের ফল খুব আশ্চর্যরকম পাওয়া যায়।
সকলে খেলায় মত্ত, কেবল দাশু এককোনায় বসিয়া কি যেন করিতেছে— সেদিকে আমাদের কোনো খেয়াল নাই। একটু বাদে পণ্ডিতমহাশয়ের চেয়ারের তলায় তক্তার নীচ হইতে ‘ফট্’ করিয়া কি একটা আওয়াজ হইল। পণ্ডিতমহাশয় ঘুমের ঘোরে ভ্রূকুটি করিয়া সবেমাত্র ‘উঁঃ’ বলিয়া কি যেন একটা ধমক দিতে যাইবেন, এমন সময়ে ফুট্ফাট্, দুম্দাম্, ধুপ্ধাপ্ শব্দে তাণ্ডব কোলাহল উঠিয়া সমস্ত স্কুলটিকে একেবারে কাঁপাইয়া তুলিল। মনে হইল যেন যত রাজ্যের মিস্ত্রি-মজুর সবাই একজোটে বিকট তালে ছাত পিটাইতে লাগিয়াছে—দুনিয়ার যত কাঁসারি আর লাঠিয়াল সবাই যেন পাল্লা দিয়া হাতুড়ি আর লাঠি ঠুকিতেছে। খানিকক্ষণ পর্যন্ত আমরা, যাহাকে পড়ার বইয়ে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ বলে, তেমনি হইয়া হাঁ করিয়া রহিলাম। পণ্ডিতমহাশয় একবারমাত্র বিকট শব্দ করিয়া তার পর হঠাৎ হাত-পা ছুঁড়িয়া একলাফে টেবিল ডিঙাইয়া একেবারে ক্লাশের মাঝখানে ধড়ফড় করিয়া পড়িয়া গেলেন। সরকারি কলেজের নবীন পাল বরাবর ‘হাইজাম্পে’ ফার্স্ট প্রাইজ পায়; তাহাকেও আমরা এরকম সাংঘাতিক লাফাইতে দেখি নাই। পাশের ঘরে নীচের ক্লাশের ছেলেরা চীৎকার করিয়া ‘কড়াকিয়া’ মুখস্থ আওড়াইতেছিল— গোলমালে তারাও হঠাৎ আড়ষ্ট হইয়া থামিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে স্কুলময় হুলস্থুল পড়িয়া গেল— দরোয়ানের কুকুরটা পর্যন্ত যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া বিকট কেঁউ কেঁউ শব্দে গোলমালের মাত্রা ভীষণরকম বাড়াইয়া তুলিল।
পাঁচ মিনিট ভয়ানক আওয়াজের পর যখন সব ঠাণ্ডা হইয়া আসিল, তখন পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “কিসের শব্দ হইয়াছিল দেখ।” দরোয়ানজি একটা লম্বা বাঁশ দিয়া অতি সাবধানে, আস্তে আস্তে তক্তার নীচ হইতে একটা হাঁড়ি ঠেলিয়া বাহির করিল-রামপদর সেই হাঁড়িটা। তখনো তার মুখের কাছে একটুখানি মিহিদানা লাগিয়াছিল। পণ্ডিতমহাশয় ভয়ানক ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, “এ হাঁড়ি কার?” রামপদ বলিল, “আজ্ঞে, আমার।” আর কোথা যায়-অমনি দুই কানে দুই পাক! “হাঁড়িতে কি রেখেছিলি?” রামপদ তখন বুঝিতে পারিল যে গোলমালের জন্য সমস্ত দোষ তাহারই ঘাড়ে আসিয়া পড়িতেছে। সে বেচারা তাড়াতাড়ি বুঝাইতে গেল, “আ:জ্ঞ, ওর মধ্যে করে মিহিদানা এনেছিলাম, তার পর”—মুখের কথা শেষ না হইতেই পডিতমহাশয় বলিলেন, “তার পর মিহিদানাগুলো চীনে পটকা হয়ে ফুটতে লাগল-না?” বনিয়াই ঠাস ঠাস করিয়া দুই চড়।
অন্যান্য মাস্টাররাও ক্লাশে আসিয়া জড়ো হইয়াছিলেন; তাহারও একবাক্যে হাঁ হাঁ করিয়া রুখিয়া আসিলেন। আমরা দেখিলাম বেগতিক। বিনা দোষে রামপদ বেচারী মার খায় বুঝি। এমন সময়ে দাশু আমার শ্লেটখানা লইয়া পণ্ডিতমহাশয়কে দেখাইয়া বলিল, “এই দেখুন। আপনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন, তখন ওরা শ্লেট নিয়ে খেলা কচ্ছিল এই দেখুন, টুকটাকের ঘর কাটা।” শ্লেটের উপর আমার নাম লেখা-পণ্ডিতমহাশয় আমার উপর প্রচণ্ড এক চড় তুলিয়াই হঠাৎ কেমন থতমত খাইয়া গেলেন। তাহার পর দাশুর দিকে কটমট করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, “চোপ্রও, কে বলেছে আমি ঘুমুচ্ছিলাম?” দাশু খানিকক্ষণ হাঁ করিয়া বলিল, “তবে যে আপনার নাক ডাকছিল?” পণ্ডিতমহাশয় তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরাইয়া বলিলেন, “বটে? ওরা সব খেলা কচ্ছিল? অরি তুমি কি কচ্ছিলে?” দাশু অম্লানবদনে বলিল, “আমি তো পটকায় আগুন দিচ্ছিলাম।” শুনিয়াই তো সকলের চক্ষুস্থির। ছোকরা বলে কি?
প্রায় আধমিনিটখানেক কাহারো মুখে আর কথা নাই। তার পর পণ্ডিতমহাশয় ঘাড় বাঁকাইয়া গভীর গলায় হুংকার দিয়া বলিলেন, “কেন পটকায় আগুন দিচ্ছিলে?” দাশু ভয় পাইবার ছেলেই নয়, সে রামদপকে দেখাইয়া বলিল, “ও কেন আমায় মিহিদানা দিতে চাচ্ছিল না?” এরূপ অদ্ভুত যুক্তি শুনিয়া রামপদ বলিল, “আমার মিহিদানা আমি যা ইচ্ছা তাই করব।” দাশু তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, “তা হলে, আমার পটকা, আমিও যা ইচ্ছা তাই করব।” এরূপ পাগলের সঙ্গে আর তর্ক করা চলে না। কাজেই মাস্টারেরা সকলেই কিছু কিছু ধমকধামক করিয়া যে যার ক্লাশে চলিয়া গেলেন। সে ‘পাগলা’ বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না।
ছুটির পর আমরা সবাই মিলিয়া কত চেষ্টা করিয়া তাহাকে তাহার দোষ বুঝাইতে পারিলাম না। সে বলিল, “আমার পটকা রামপদর হাঁড়ি। যদি আমার দোষ হয়, তা হলে রামপদরও দোষ হয়েছে। বাস্। ওর মার খাওয়াই উচিত।”