সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/চালিয়াৎ
(পৃ. ১১৩-১১৬)
শ্যামচাঁদ আমাদের নীচের ক্লাশে পড়িত, কিন্তু তার দেমাকের দৌরাত্ম্যে সমস্ত স্কুলসুদ্ধ ছেলে অস্থির হইয়া থাকিত। শ্যামচাঁদের বাবা কোন একটা সাহেব অফিসে বড়ো কাজ করিতেন, তাই শ্যামাদের পোশাক-পরিচ্ছদে রকম-সকমে কায়দার আর অন্ত ছিল না। সে যখন দেড় বিঘৎ চওড়া 'কলার’ আঁটিয়া রঙিন ছাতা মাথায় দিয়া নূতন জুতার মচ্মচ্ শব্দে গম্ভীর চালে ঘাড় উঁচাইয়া স্কুলে আসিত—তাহার সঙ্গে পাগড়িবাঁধা তকমাআঁটা চাপরাশি এক রাজ্যের বই ও টিফিনের বাক্স বহিয়া আনিত–তখন তাহাকে দেখাইত ঠিক যেন পেখমধরা ময়ূরটির মতো। স্কুলের ছোটো-ছোটো ছেলেরা হাঁ করিয়া অবাক হইয়া থাকিত, কিন্তু আমরা সবাই একবাক্যে বলিতাম—‘চালিয়াৎ'।
বয়সের হিসেবে শ্যামচাঁদ একটু বেঁটে ছিল। পাছে কেহ তাহাকে ছেলেমানুষ ভাবে এবং যথোপযুক্ত খাতির না করে, এইজন্য সর্বদাই সে অনাবশ্যকরকম গম্ভীর হইয়া থাকিত এবং কথাবার্তায় ধরনে-ধারণে ইংরাজি বোলচাল দিয়া এমন বিজ্ঞের মতো ভাবপ্রকাশ করিত, যে স্কুলের দরোয়ান হইতে নীচের ক্লাশের ছাত্র পর্যন্ত সকলেরই তাক লাগিয়া যাইত। সকলেই ভাবিত, ‘নাঃ, লোকটা কিছু জানে!' শ্যামচাঁদ প্রথম যেবার ঘড়ি-চেইন আঁটিয়া স্কুলে আসিল, তখন তাহার কাণ্ড যদি দেখিতে! পাঁচমিনিট অন্তর ঘড়িটাকে বাহির করিয়া সে কানে দিয়া শুনিত ঘড়িটা চলে কি না! স্কুলের যেখানে যত ঘড়ি আছে সব কটার ভুল তাহার দেখানো চাইই চাই! পাঁড়েজি দরোয়ানকে সে একদিন রীতিমতো ধমক লাগাইয়া বসিল-“এই! স্কুলের ক্লকটাতে যখন চাবি দাও তখন সেটাকে রেগুলেট কর না কেন? ওটাকে অয়েল করতে হবে—ক্রমাগতই স্লো চলছে।” পাঁড়েজির চৌদ্দপুরুষে কেউ কখনো ঘড়ি ‘অয়েল' বা ‘রেগুলেট’ করে নাই। সে যে সপ্তাহে একদিন করিয়া চাবি ঘুরাইতে শিখিয়াছে, ইহাতেই তাহার দেশের লোকের বিস্ময়ের সীমা নাই। কিন্তু দেশভাইদের কাছে মানরক্ষা করিবার জন্য সে ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “হাঁ, হাঁ, আভি হাম রেংলিট করবে।” পাঁড়েজির উপর এক চাল চালিয়া শ্যামাচাঁদ ক্লাশে ফিরিতেই কতগুলা ছোটো ছেলে তাহাকে ঘিরিয়া ফেলিল-শ্যামচাঁদ তাহাদের কাছে মহা আড়ম্বর করিয়া স্লো, ফাস্ট, মেইন স্প্রিং, রেগুলেট প্রভৃতি ঘড়ির সমস্ত রহস্য ব্যাখ্যা করিতে লাগিল। ব্যাপার দেখিয়া আমরা সবাই বলিলাম, “চালিয়াৎ!”
একবার আমাদের একটি নূতন মাস্টার আসিয়াছিলেন, তিনি শ্যামচাঁদকে বেজায় অপ্রস্তুত করিয়াছিলেন। প্রথমত তিনি ক্লাশে আসিয়াই শ্যামচাঁদকে 'খোকা' বলিয়া সম্বোধন করিলেন। লজ্জায় ও অপমানে শ্যামচাঁদের মুখ কান একেবারে লাল হইয়া উঠিল—সে আমৃতা-আম্তা করিয়া বলিল, “আজ্ঞে, আমার নাম শ্যামচাঁদ ঘটক।” মাস্টারমহাশয় অত কি বুঝিবেন—“শ্যামচাঁদ? আচ্ছা বেশ, খোকা বস।” তার পর কয়েকদিন ধরিয়া স্কুলসুদ্ধ ছেলে তাহাকে ‘খোকা, খোকা' করিয়া অস্থির করিয়া তুলিল। কিন্তু কয়দিন পরেই শ্যামচাঁদ ইহার শোধ লইয়া ফেলিল। সেদিন সে ক্লাশে আসিয়াই পকেট হইতে কালো চোঙার মতো কি একটা বাহির করিল। মাস্টারমহাশয় সাদাসিধা ভালোমানুষ, তিনি বলিলেন, “কি হে খোকা, থার্মোমিটার এনেছ যে। জ্বরটর হয় নাকি?” শ্যামাদ বলিল, “আজ্ঞে না থার্মোমিটার নয়-ফাউনটেন পেন।” শুনিয়া সকলের তো চক্ষুস্থির। ফাউনটেন পেন। মাস্টার এবং ছেলে সকলেই উদগ্রীব হইয়া দেখিতে আসিলেন, ব্যাপারখানা কি! শ্যামচাঁদ বলিল, “এই একটা ভাল্কেনাইট টিউব, তার মধ্যে কালি ভরা আছে। একটা ছেলে উৎসাহে বলিয়া উঠিল, “ও, বুঝেছি, পিচকিরি বুঝি? এইখানে টিপে দিলেই ছরর্র্ করে কালি বেরুবে?” শ্যামচাঁদ কিছু জবাব না দিয়া খুব মাতব্বরের মতো একটুখানি মুচকি হাসিয়া কলমটিকে খুলিয়া তাহার সোনালি নিবখানা দেখাইয়া বলিল, “ওতে ইরিডিয়ম আছে—সোনার চেয়েও বেশি দাম।” তার পর যখন সে একখানা খাতা লইয়া সেই আশ্চর্য কলম দিয়া তর্তর্ করিয়া নিজের নাম লিখিতে লাগিল, তখন স্বয়ং মাস্টারমহাশয় পর্যন্ত বড়ো-বড়ো চোখ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। তার পর শ্যামচাঁদ কলমটিকে তাঁর হাতে দিবামাত্র তিনি ভারি খুশি হইয়া সেটাকে নাড়িয়া চাড়িয়া দুইছত্র লিখিয়া বলিলেন, “কি কলই বানিয়েছে—বিলিতি কোম্পানি বুঝি?” শ্যামচাঁদ চটপট বলিয়া ফেলিল, “আমেরিকান স্টাইলো এণ্ড ফাউনটেন পেন কোং ফিলাডেল্ফিয়া।” সেইদিন হইতে ক্লাশে তাহার ‘খোকা’ নাম ঘুচিল—কিন্তু আমরা আরো বেশি করিয়া বলিতাম, “চালিয়াৎ!”
যাহা হউক চালিয়াতের চালচলনের আলোচনা চলিতে চলিতে পূজার ছুটি আসিয়া পড়িল। ছুটির দিন স্কুলের উঠানে প্রকাণ্ড শামিয়ানা খাটানো হইল, কলিকাতা হইতে কে-এক বাজিওয়ালা আসিয়াছেন, তিনি 'ম্যাজিক' দেখাইবেন। যথাসময়ে সকলে আসিলেন, মাষ্টার ছাত্র, লোকজন, নিমন্ত্রিত-অভ্যাগত সকলে মিলিয়া উঠান, সিঁড়ি, রেলিং, পাঁচিল একেবারে ভরিয়া ফেলিয়াছে। ম্যাজিক চলিতে লাগিল। একখানা সাদা রুমাল চোখের সামনেই লাল নীল সবুজের কারিকুরিতে রঙিন হইয়া উঠিল। একজন লোক একটা সিদ্ধ ডিম গিলিয়া মুখের মধ্য হইতে এগারোটা আস্ত ডিম বাহির করিল! ডেপুটিবাবুর কোচম্যানের দাড়ি নিংড়াইয়া প্রায় পঞ্চাশটি টাকা বাহির করা হইল। তার পর ম্যাজিকওয়ালা জিজ্ঞাসা করিল, “কারও কাছে ঘড়ি আছে?” শ্যামচাঁদ তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হইয়া বলিল, “আমার ঘড়ি আছে।” ম্যাজিকওয়ালা তাহার ঘড়িটি লইয়া খুব গম্ভীরভাবে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিল। ঘড়িটির খুব প্রশংসা করিয়া বলিল, “তোফা ঘড়ি তো।” তার পর চেনসুদ্ধ ঘড়িটাকে একটা কাগজে মুড়িয়া একটা হামানদিস্তায় দমাদম্ ঠুকিতে লাগিল। তার পর কয়েক টুকরা ভাঙা লোহা আর কাচ দেখাইয়া শ্যামচাঁদকে বলিল, “এইটা কি তোমার ঘড়ি?” শ্যামচাঁদের অবস্থা বুঝিতেই পার। সে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল, দু-তিনবার কি যেন বলিতে গিয়া আবার থামিয়া গেল। শেষটায় অনেক কষ্টে একটু কাষ্ঠহাসি হাসিয়া রুমাল দিয়া ঘাম মুছিতে মুছিতে বসিয়া পড়িল। যাহা হউক, খানিক বাদে যখন একখানা পাউরুটির মধ্যে ঘড়িটাকে আস্ত অবস্থায় পাওয়া গেল, তখন ‘চালিয়াৎ' খুৰ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল—যেন তামাশাটা সে আগাগোড়াই বুঝিতে পারিয়াছে।এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
সবশেষে ম্যাজিকওয়ালা নানাজনের কাছে নানারকমের জিনিস চাহিয়া লইল—চশমা, আংটি, মনিব্যাগ, রূপার পেনসিল প্রভৃতি আট-দশটি জিনিস সকলের সামনে একসঙ্গে পোঁটলা বাধিয়া, শ্যামচাঁদকে ডাকিয়া তাহার হাতে পোঁটলাটা দেওয়া হইল। শ্যামচাঁদ বুক ফুলাইয়া পোঁটলা হাতে দাঁড়াইয়া রহিল—আর ম্যাজিকওয়ালা লাঠি ঘুরাইয়া, চোখটোখ পাকাইয়া বিড়বিড় করিয়া কি-সব বকিতে লাগিল। তার পর হঠাৎ শ্যামচাঁদের দিকে ভ্রকুটি করিয়া বলিল, “জিনিসগুলো ফেললে কোথায়?” শ্যামচাঁদ পোঁটলা দেখাইয়া বলিল, “এই যে।” ম্যাজিকওয়ালা মহা খুশি হইয়া বলিল, “সাবাস ছেলে। লাও, পোঁটলা খুলে যার যার জিনিস ফেরত দাও।” শ্যামচাঁদ তাড়াতাড়ি পোঁটলা খুলিয়া দেখে তাহার মধ্যে খালি কয়েক টুকরা কয়লা আর টিল। তখন ম্যাজিকওয়ালার তম্বি দেখে কে? সে কপালে হাত ঠুকিয়া বলিতে লাগিল, “হায় হায়—আমি ভদ্রলোকদের কাছে মুখ দেখাই কি করে? কেনই-বা ওর কাছে দিতে গেছিলাম? ওহে, ও-সব তামাশা এখন রাখ, আমার জিনিসগুলো একবার ফিরিয়ে দাও দেখি ” শ্যামচাঁদ হাসিবে কি কাঁদিবে কিছুই ঠিক করিতে পারিল না—ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া রহিল। তখন ম্যাজিকওয়ালা তাহার কানের মধ্য হইতে আংটি, চুলের মধ্যে পেনসিল, আস্তিনের মধ্যে চশমা—এইরূপে একটি-একটি জিনিস উদ্ধার করিতে লাগিল। আমরা হো হো করিয়া হাসিতে লাগিলাম—শ্যামচাঁদও প্রাণপণে হাসিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু সমস্ত জিনিসের হিসাব মিলাইয়া ম্যাজিকওয়ালা যখন বলিল, “আর কি নিয়েছ?” তখন সে বাস্তবিকই ভয়ানক রাগিয়া বলিল, “ফের মিছে কথা। কক্ষনো আমি কিচ্ছু নিই নি।” তখন ম্যাজিকওয়ালা তাহার কোটের পিছন হইতে জ্যান্ত একটা পায়রা বাহির করিয়া বলিল, “এটা বুঝি কিছু নয়?” এবার শ্যামচাঁদ একেবারে ভ্যাঁ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার পর পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়িয়া-সভা হইতে ছুটিয়া বাহির হইল। আমরা সবাই আহ্লাদে আত্মহারা হইয়া চেঁচাইতে লাগিলাম—'চালিয়াৎ! চালিয়াৎ!'