সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/নন্দলালের মন্দ কপাল
(পৃ. ১২২-১২৪)
নন্দলালের ভারি রাগ, অঙ্কের পরীক্ষায় মাষ্টার তাহাকে “গোল্লা দিয়াছেন। অবশ্য সে যে খুব ভালো লিখিয়াছিল তাহা নয়, কিন্তু তা বলিয়া একেবারে গোল্লা দেওয়া কি উচিত ছিল? হাজার হোক, সে একখানা পুরা খাতা লিখিয়াছিল তো! তার পরিশ্রমের কি কোনো মুল্য নাই? ঐ যে ত্রৈরাশিকের অঙ্কটা সেটা তো তার প্রায় ঠিকই হইয়াছিল, কেবল একটুখানি হিসাবের ভুল হওয়াতে উত্তরটা ঠিক মেলে নাই। আর ঐ যে একটা ডেসিম্যালের অঙ্ক ছিল, সেটাতে গুণ করিতে গিয়া সে ভাগ করিয়া বসিয়াছিল, তাই বলিয়া কি একটা নম্বরও দিতে নাই? আরো অন্যায় এই যে, এই কথাটা মাষ্টারমহাশয় ক্লাশের ছেলেদের কাছে ফাঁস করিয়া ফেলিয়াছেন। কেন? আরেকবার হরিদাস যখন গোল্লা পাইয়াছিল, তখন তো সে কথাটা রাষ্ট্র হয় নাই। এ ভারি অন্যায়।
কেহ কেহ বলিল, “নন্দলাল চটো কেন? গোল্লা পাইয়াছ, তার জন্য কোথায় লজ্জিত ওয়া উচিত, না তুমি খামখা রাগিয়াই অস্থির।” নন্দলাল রাগিয়া আগুন হইল। কি। এতবড়ো কথা। সে যে ইতিহাসে একশোর মধ্যে পঁচাশি পাইয়াছে, সেটা বুঝি কিছু নয়? খালি অঙ্কে ভালো পারে নাই বলিয়াই তাহাকে লজ্জিত হইতে হইবে? সব বিষয়েই যে সকলকে ভালো পারিতে হইবে, তাহারই-বা অর্থ কি? স্বয়ং নেপোলিয়ান যে ছেলেবেলায় ব্যাকরণে একেবারে আনাড়ি ছিলেন, সে বেলা কি? তাহার এই যুক্তিতে ছেলেরা দমিল না এবং মাস্টারদের কাছে এই তর্কটা তোলাতে তাহারাও যে যুক্তিটাকে খুব চমৎকার ভাবিলেন, এমন তো বোধ হইল না। তখন নন্দলাল বলিল, তাহার কপালই মন্দ—সে নাকি বরাবর তাহা দেখিয়া আসিতেছে।
সেই তো যেবার ছুটির আগে তাহাদের পাড়ায় হাম দেখা দিয়াছিল, তখন বাড়িসুদ্ধ সকলেই হামে ভুগিয়া দিব্যি মজা করিয়া স্কুল কামাই করিল, কেবল বেচারা নন্দলালকেই নিয়মমতো প্রতিদিন স্কুলে হাজিরা দিতে হইয়াছিল। তার পর যেমন ছুটি আরম্ভ হইল, অমনি তাহাকেও জ্বরে আর হামে ধরিল—সমস্ত ছুটিটাই মাটি। সেই যেবার সে মামারবাড়ি গিয়াছিল, সেবার তাহার মামাতো ভাইয়েরা কেহবাড়ি ছিল না—ছিলেন কোথাকার এক বদমেজাজি মেসো, তিনি উঠিতে বসিতে কেবল ধমক আর শাসন ছাড়া আর কিছু জানিতেন না। তার উপর সেবার এমন বৃষ্টি হইয়াছিল যে একদিনও ভালো করিয়া খেলা জমিল না, কোথাও বেড়ানো গেল না। সেইজন্য পরের বছর যখন আর সকলে মামারবাড়ি গেল, তখন সে কিছুতেই যাইতে চাহিল না। পরে শুনিল সেবার নাকি সেখানে চমৎকার মেলা বসিয়াছিল, কোন রাজার দলের সঙ্গে পঁচিশটা হাতি আসিয়াছিল, আর বাজি যা-পোড়ানো হইয়াছিল সে একেবারে আশ্চর্যরকম! নন্দলালের ছোটো ভাই যখন বারবার উৎসাহ করিয়া তাহার কাছে এই-সকলের বর্ণনা করিতে লাগিল, তখন নন্দ তাহাকে একচড় মারিয়া বলিল, ‘যা যা! মেলা বক্বক্ করিস নে।” তাহার কেবল মনে হইতে লাগিল, সেবার সে মামারবাড়ি গিয়াও ঠকিল এবার না গিয়াও ঠকিল। তাহার মতো কপাল-মন্দ আর কেহ নাই।
স্কুলেও ঠিক তাই। সে অঙ্ক পারে না-অথচ অঙ্কের জন্য দুই-দুইটা প্রাইজ আছে-এদিকে ভূগোল, ইতিহাস তাহার কণ্ঠস্থ কিন্তু ঐ দুইটার একটাতেও প্রাইজ নাই। অবশ্য সংস্কৃতেও সে নেহাত কাঁচা নয়, ধাতুপ্রত্যয়, বিভক্তি, সব চটপট মুখস্থ করিয়া ফেলে - চেষ্টা করিলে সে কি পড়ার বই আর অর্থপুস্তকটাকে সড়গড় করিতে পারে না? ক্ষুদিরাম পণ্ডিতমহাশয়ের প্রিয় ছাত্র-ক্লাশের মধ্যে সেই যা একটু সংস্কৃত জানে কিন্তু তাহা তো বেশি নয়। নন্দলাল ইচ্ছা করিলে কি তাহাকে হারাইতে পারে না? নন্দ জেদ করিয়া স্থির করিল, 'একবার ক্ষুদিরামকে দেখে নেব। ছোকরা এ বছর সংস্কৃতের প্রাইজ পেয়ে ভারি দেমাক করছে-আবার অঙ্কের গোল্লার জন্য আমাকে খোঁটা দিতে এসেছিল। আচ্ছা, এবার দেখা যাবে।'
নন্দলাল কাহাকেও না জানাইয়া সেইদিন হইতেই বাড়িতে ভয়ানকভাবে পড়িতে শুরু করিল। ভোরে উঠিয়াই সে 'হসতি, হসত, হসন্তি’, শুরু করে, রাত্রেও ‘অস্তি গোদাবরী তীরে বিশাল শাল্মলী তরু’ বলিয়া তুলিতে থাকে। কিন্তু ক্লাশের ছেলেরা এ কথার বিন্দুবিসর্গও জানে না। পণ্ডিতমহাশয় যখন ক্লাশে প্রশ্ন করেন তখন মাঝে মাঝে উত্তর জানিয়াও সে চুপ করিয়া মাথা চুলকাইতে থাকে—এমন-কি, কখনো ইচ্ছা করিয়া দুইএকটা ভুল বলে—পাছে ক্ষুদিরাম তাহার পড়ার খবর টের পাইয়া আরো বেশি করিয়া পড়ায় মন দিতে থাকে। তাহার ভুল উত্তর শুনিয়া ক্ষুদিরাম মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে, নন্দলাল তাহার কোনো জবাব দেয় না। কেবল ক্ষুদিরাম নিজে যখন একেকটা ভুল করে, তখন সে মুচকি-মুচকি হাসে আর ভাবে, পরীক্ষার সময়ে অমনি ভুল করলেই বাছাধন গেছেন। তা হলে এবার আর ওকে সংস্কৃতের প্রাইজ পেতে হবে না।'
ওদিকে ইতিহাসের ক্লাশে নন্দলালের প্রতিপত্তি কমিতে লাগিল। কারণ ইতিহাস আর ভূগোল নাকি একরকম করিয়া শিখিলেই পাশ করা যায়—তাহার জন্য নন্দর কোনো ভাবনা নাই। তাহার সমস্ত মনটা রহিয়াছে ঐ সংস্কৃত পড়ার উপরে-অর্থাৎ সংস্কৃতের প্রাইজটার উপরে। একদিন মাস্টারমহাশয় বলিলেন, “কি হে নন্দলাল, আজকাল বাড়িতে কিছু পড়াশুনা কর না নাকি? তা না হলে সব বিষয়েই যে তোমার এমন দুর্দশা হচ্ছে, তার অর্থ কি? বাড়িতে কি পড় বল দেখি।” নন্দ আরেকটু হইলেই বলিয়া ফেলিত, “আজ্ঞে, সংস্কৃত পড়ি। কিন্তু কথাটাকে হঠাৎ সামলাইয়া, “আজ্ঞে সংস্কৃত-না সংস্কৃত নয়” বলিয়াই সে ভারি থতমত খাইয়া থামিয়া গেল। মাস্টারমহাশয় এক ধমক দিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে সংস্কৃত—না সংস্কৃত নয়—এর অর্থ কি?” ক্ষুদিরাম তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “কই। সংস্কৃতও তো কিছু পারে না।” শুনিয়া ক্লাশসুদ্ধ ছেলে হাসিতে লাগিল। নন্দ একটু অপ্রস্তুত হইল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল-ভাগ্যিস, তাহার সংস্কৃত পড়ার কথাটা ফাঁস হইয়া যায় নাই।
দেখিতে দেখিতে বছর কাটিয়া আসিল-পরীক্ষার সময় প্রায় উপস্থিত। সকলে পড়ার কথা, পরীক্ষার কথা আর প্রাইজের কথা বলাবলি করিতেছে—এমন সময় একজন ছোকরা জিজ্ঞাসা করিল, “কি হে! নন্দ এবার কোন প্রাইজটা নিচ্ছ?” ক্ষুদিরাম নন্দর মতো গলা করিয়া, ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “আজ্ঞে সংস্কৃত, না সংস্কৃত নয়।” সকলে হাসিল, নন্দও খুব হো হো করিয়া সেই হাসিতে যোগ দিল। মনে ভাবিল, ‘বাছাধন, এ হাসি আর তোমার মুখে বেশিদিন থাকছে না।'
যথাসময়ে পরীক্ষা আরম্ভ হইল এবং যথাসময়ে শেষ হইল। পরীক্ষার ফল জানিবার জন্য সকলে আগ্রহ করিয়া আছে-নন্দও রোজ নোটিস বোর্ডে গিয়া দেখে, তাহার নামে সংস্কৃত প্রাইজ পাওয়ার কোনো বিজ্ঞাপন আছে কি না। তাহার পর একদিন হেডমাস্টার মহাশয় একতাড়া কাগজ লইয়া ক্লাশে আসিলেন, আসিয়াই তিনি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “এবার দুয়েকটা নতুন প্রাইজ হয়েছে আর অন্য বিষয়েও কোনো কোনো পরিবর্তন হয়েছে।” এই, বলিয়া তিনি পরীক্ষার ফলাফল পড়িতে লাগিলেন। তাহাতে দেখা গেল ইতিহাসের জন্য কে যেন একটা রূপার মেডেল দিয়াছেন। ক্ষুদিরাম ইতিহাসে প্রথম হইয়াছে, সে-ই ঐ মেডেলটা পাইবে। সংস্কৃতে নন্দ প্রথম, ক্ষুদিরাম দ্বিতীয়—কিন্তু, এবার সংস্কৃতে কোনো প্রাইজ নাই।
হায় হায়! নন্দের অবস্থা তখন শোচনীয়। তাহার ইচ্ছা হইতেছিল সে ছুটিয়া গিয়া ক্ষুদিরামকে কয়েকটা ঘুঁষি লাগাইয়া দেয়। তাহার এত চেষ্টার ফল কি না এই হইল। কে জানিত এবার ইতিহাসের জন্য প্রাইজ থাকিবে, আর সংস্কৃতের জন্য থাকিবে না। ইতিহাসের মেডেলটা সে তো অনায়াসেই পাইতে পারিত। কিন্তু তাহার মনের কষ্ট কেহ বুঝিল না—সবাই বলিল, “বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়েছে—কেমন করে ফাঁকি দিয়ে নম্বর পেয়েছে।” নন্দ দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, “কপাল মন্দ!”