সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/সবজান্তা

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১১৯-১২২)
সবজান্তা

 আমাদের 'সবজান্তা' দুলিরামের বাবা কোন একটা খবরের কাগজের সম্পাদক। সেইজন্য আমাদের মধ্যে অনেকেরই মনে তাহার সমস্ত কথার উপরে অগাধ বিশ্বাস দেখা যাইত। যে কোনো বিষয়েই হোক, জার্মানির লড়ায়ের কথাই হোক আর মোহনবাগানের ফুটবলের ব্যাখ্যাই হোক, দেশের বড়োলোকদের ঘরোয়া গল্পই হোক আর নানারকমের উৎকট রোগের বর্ণনাই হোক, যে কোনো বিষয়ে সে মতামত প্রকাশ করিত, একদল ছাত্র অসাধারণ শ্রদ্ধার সঙ্গে সে-সকল কথা শুনিত। মাস্টারমহাশয়দের মধ্যেও কেহ কেহ এ বিষয়ে তাহার ভারি পক্ষপাতী ছিলেন। দুনিয়ার সকল খবর লইয়া সে কারবার করে, সেইজন্য পণ্ডিতমহাশয় তাহার নাম দিয়াছিলেন ‘সবজান্তা'।

 আমার কিন্তু বরাবরই বিশ্বাস ছিল যে, সবজান্তা যতখানি পাণ্ডিত্য দেখায় আসলে তার অনেকখানিই উপরচালাকি। দু-চারিটি বড়ো-বড়ো শোনা-কথা, আর খবরের কাগজ পড়িয়া দু-দশটা খবর, এইমাত্র তার পুঁজি, তাহারই উপর রঙচঙ দিয়া নানারকম বাজে গল্প জুড়িয়া সে তাহার বিদ্যা জাহির করিত। একদিন আমাদের ক্লাশে পণ্ডিতমহাশয়ের কাছে সে নায়েগারা জলপ্রপাতের গল্প করিয়াছিল। তাহাতে সে বলে যে নায়েগারা দশ মাইল উঁচু ও একশত মাইল চওড়া! একজন ছাত্র বলিল, “সে কি করে হবে? এভারেস্ট সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, সেই মোটে পাঁচ মাইল—” সবজান্তা তাহাকে বাধা দিয়া বলিল, “তোমরা তো আজকালকার খবর রাখ না!” যখনই তাহার কোনো কথায় আমরা সন্দেহ বা আপত্তি করিতাম সে একটা যা-তা নাম করিয়া আমাদের ধমক দিয়া বলিত, “তোমরা কি অমুকের চাইতে বেশি, জান?” আমরা বাহিরে সব সহ্য করিয়া থাকিতাম, কিন্তু এক-এক সময় রাগে গা জ্বলিয়া যাইত।

 সবজান্তা যে আমাদের মনের ভাবটা বুঝিত না, তাহা নয়। সে তাহা বিলক্ষণ বুঝিত এবং সর্বদাই এমন ভাব প্রকাশ করিত যে আমরা তাহার কথাগুলা মানি বা না মানি, তাহাতে তাহার কিছুমাত্র আসে যায় না। নানারকম খবর ও গল্প জাহির করিবার সময় সে মাঝে মাঝে আমাদের শুনাইয়া বলিত, “অবিশ্যি, কেউ কেউ আছেন, যাঁরা এ-সব কথা মানবেন না” অথবা “যারা না পড়েই খুব বুদ্ধিমান তারা নিশ্চয়ই এ-সব উড়িয়ে দিতে চাইবেন” ইত্যাদি। ছোকরা বাস্তবিকই অনেকরকম খবর রাখিত। তার উপর তার বোলচালগুলিও ছিল বেশ ঝাঁঝালো রকমের, কাজেই আমরা বেশি তর্ক করিতে সাহস পাইতাম না।

 তাহার পর একদিন কি কুক্ষণে তাহার এক মামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া আমাদেরই স্কুলের কাছে বাসা লইয়া বসিলেন। তখন আর সবজান্তাকে পায় কে! তাহার কথাবার্তার দৌড় এমন আশ্চর্যরকম বাড়িয়া চলিল যে, মনে হইত বুঝিবা তাহার পরামর্শ ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পুলিশের পেয়াদা পর্যন্ত কাহারও কাজ চলিতে পারে না। স্কুলের ছাত্র মহলে তাহার খাতির ও প্রতিপত্তি এমন আশ্চর্যরকম জমিয়া গেল যে, আমরা কয়েক বেচারী, যাহারা বরাবর তাহাকে নানারকম ঠাট্টা-বিদ্রুপ করিয়া আসিয়াছি—আমরা একেবারে কোণঠাসা হইয়া রহিলাম। এমন-কি, আমাদের মধ্য হইতে দু-একজন তাহার দলে যোগ দিতে আরম্ভ করিল।

 অবস্থাটা শেষটায় এমন দাঁড়াইল যে স্কুলে আমাদের টেকা দায় হইল। দশটার সময় আমরা কাঁচুমাচু করিয়া ক্লাশে ঢুকিতাম আর ছুটি হইলেই সকলের ঠাট্টা-বিদ্রুপ হাসি-তামাশার হাত এড়াইবার জন্য দৌড়িয়া বাড়ি আসিতাম। টিফিনের সময়টুকু হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘরের সামনে একখানা বেঞ্চের উপর বসিয়া অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো পড়াশুনা করিতাম।

 এইরকম ভাবে কতদিন চলিত জানি না, কিন্তু একদিনের একটি ঘটনায় হঠাৎ সবজান্তা মহাশয়ের জারিজুরি সব এমনই ফাঁস হইয়া গেল যে, তাহার অনেকদিনকার খ্যাতি ঐ একদিনেই লোপ পাইল—আর আমরাও সেইদিন হইতে একটু মাথা তুলিতে পারিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। সেই ঘটনারই গল্প বলিতেছি-

 একদিন শুনা গেল লোহারপুরের জমিদার রামলালবাবু আমাদের স্কুলে তিনহাজার টাকা দিয়াছেন—একটি 'ফুটবল গ্রাউণ্ড’ ও খেলার সরঞ্জামের জন্য। আরো শুনিলাম রামলালবাবুর ইচ্ছা সেই উপলক্ষে আমাদের একদিন ছুটি ও একদিন রীতিমতো ভোজের আয়োজন হয়। কয়দিন ধরিয়া এই খবরটাই আমাদের প্রধান আলোচনার বিষয় হইয়া উঠিল। কবে ছুটি পাওয়া যাইবে, কবে খাওয়া এবং কি খাওয়া হইবে এই-সকল বিষয় জল্পনা চলিতে লাগিল। সবজান্তা দুলিরাম বলিল, যেবার সে দাজিলিং গিয়াছিল, সেবার নাকি রামলালবাবুর সঙ্গে তাহার দেখা সাক্ষাৎ এমন-কি, আলাপ পরিচয় পর্যন্ত হইয়া ছিল। রামলালবাবু তাহাকে কেমন খাতির করিতেন, তাহার কবিতা আবৃত্তি শুনিয়া কি কি প্রশংসা করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সে স্কুলের আগে এবং পরে সারাটি টিফিনের সময়, এবং সুযোগ পাইলে ক্লাশের পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকেও, নানা অসম্ভবরকম গল্প বলিত। 'অসম্ভব’ বলিলাম বটে, কিন্তু তাহার চেলার দল সে-সকল কথা নির্বিচারে বিশ্বাস করিতে একটুও বাধা বোধ করিত না।  একদিন টিফিনের সময় উঠানে বড়ো সিড়িটার উপর একদল ছেলের সঙ্গে বসিয়া সবজান্তা গল্প আরম্ভ করিল, “আমি একদিন দার্জিলিঙে লাটসাহেবের বাড়ির কাছের ঐ রাস্তাটায় বেড়াচ্ছি-এমন সময় দেখি রামলালবাবু হাসতে হাসতে আমার দিকে আসছেন, তাঁর সঙ্গে আবার এক সাহেব। রামলালবাবু বললেন, “দুলিরাম! তোমার সেই ইংরাজি কবিতাটা একবার এঁকে শোনাতে হচ্ছে। আমি এঁর কাছে তোমার সুখ্যাত করছিলাম, তাই ইনি সেটা শুনবার জন্য ভারি ব্যস্ত হয়েছেন।” উনি নিজে থেকে বলছেন, তখন আমি আর কি করি? আমি সেই Casabianca থেকে আবৃত্তি করলুম-তার পর দেখতে যা ভিড় জমে গেল! সবাই শুনতে চায়, সবাই বলে ‘আবার কর'। মহামুস্কিলে পড়ে গেলাম, নেহাৎ রামলালবাবু বললেন তাই আবার করতে হল।” এমন সময়, কে যেন পিছন হইতে জিজ্ঞাসা করিল “রামলালবাবু কে?” সকলে ফিরিয়া দেখি, একটি রোগা নিরীহগোছের পাড়াগেঁয়ে ভদ্রলোক সিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়া আছেন। সবজান্তা বলিল, “রামলালবাবু কে, তাও জানেন না? লোহারপুরের জমিদার রামলাল রায়।” ভদ্রলোকটি অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন, “হাঁ তার নাম শুনেছি-সে তোমার কেউ হয় নাকি?” “না কেউ হয় না-এমনি, খুব ভাব আছে আমার সঙ্গে। প্রায়ই চিঠিপত্র চলে।” তদ্রলোকটি আবার বলিলেন, “রামলালবাবু লোকটি কেমন?” সবজান্তা উৎসাহের সঙ্গে বলিয়া উঠিল, “চমৎকার লোক। যেমন চেহারা, তেমনি কথাবার্তা, তেমনি কায়দাদুরস্ত। এই আপনার চেয়ে প্রায় আধ হাতখানেক লম্বা হবেন, আর সেইরকম তাঁর তেজ! আমাকে তিনি কুস্তি শেখাবেন বলেছিলেন, আর কিছুদিন থাকলেই ওটা বেশ রীতিমতো শিখে আসতাম।” ভদ্রলোকটি বলিলেন, “বল কি হে? তোমার বয়স কত?” আজ্ঞে এইবার তেরো পূর্ণ হবে।” “বটে! বয়সের পক্ষে খুব চালাক তো! বেশ তো কথাবার্তা বলতে পার। কি নাম হে তোমার?” সবজান্তা বলিল, “দুলিরাম ঘোষ। রণদাবাবু ডেপুটি আমার মামা হন।” শুনিয়া ভদ্রলোকটি ভারি খুশি হইয়া হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘরের দিকে ঢলিয়া গেলেন।

 ছুটির পর আমরা সকলেই বাহির হইলাম। স্কুলের সম্মুখেই ডেপটিবাবুর বাড়ি, তাহার বাহিরের বারান্দায় দেখি সেই ভদ্রলোকটি বসিয়া দুলিরামের ডেপুটি মামার সঙ্গে গল্প করিতেছেন। দুলিরামকে দেখিয়াই মামা ডাক দিয়া বলিলেন, “দুলি এদিকে অয়ি, একে প্রণাম কর। এটি আমার ভাগনে দুলিরাম।” ভদ্রলোকটি হাসিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, এর পরিচয় আমি আগেই পেয়েছি।” দুলিরাম আমাদের দেখাইয়া খুব আড়ম্বর করিয়া ভদ্রলোকটিকে প্রণাম করিল। ভদ্রলোকটি বলিলেন, “কেমন? আমায় তো তুমি জানই?” দুলি বলিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ আজ স্কুলে দেখেছিলাম।” ভদ্রলোকটি আবার বলিলেন, “আমার পরিচয় জান না বুঝি?” সবজান্তা এবার আর ‘জানি’ বলিতে পারিল না, অম্‌তা-অম্‌তা করিয়া মাথা চুলকাইতে লাগিল। ভদ্রলোকটি তখন বেশ একটু মুচকি মুচকি হাসিয়া আমাদের শুনাইয়া বলিলেন, “আমার নাম রামলাল রায়, লোহারপুরের রামলাল রায়।”

 দুলিরাম খানিকক্ষণ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল—তার পর মুখখানা লাল করিয়া হঠাৎ এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া-গেল। ব্যাপার দেখিয়া ছেলেরা রাস্তার উপর হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল। তার পরের দিন আমরা স্কুলে আসিয়া দেখিলাম—সবজান্তা আসে নাই-তাহার নাকি মাথা ধরিয়াছে। নানা অজুহাতে সে দু-তিনদিন কামাই করিল—তাহার পর যেদিন সে স্কুলে আসিল তখন তাহাকে দেখিবামাত্র তাহারই কয়েকজন চেলা, “কি হে! রামলালবাবুর চিঠিপত্র পেলে?” বলিয়া তাহাকে একেবারে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। তার পর যতদিন সে স্কুলে ছিল, ততদিন তাহাকে খেপাইতে হইলে বেশি কিছু করার দরকার হইত না, খালি একটিবার রামলালবাবুর খবর জিজ্ঞাসা করিলেই বেশ তামাশা দেখা যাইত।

সন্দেশ-ভাদ্র, ১৩২৪