সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/অদ্ভুত কাঁকড়া

অদ্ভুত কাঁকড়া

 রাক্ষুসে কাঁকড়ার চেহারাটি তেমন কিছু ভীষণ নয়, গায়ের রঙটিও বেশ সুন্দরই বলতে হবে। তবে একে রাক্ষুসে বলা হচ্ছে কেন? “রাক্ষুসে’ বলার একমাত্র কারণ হচ্ছে তার দেহের আয়তনটি। খুব, বড়ো একটি রাক্ষুসে কঁকড়ার বড়ো দুটি দাঁড়া ফাঁক করিয়ে তার এক আগা থেকে আর-এক অগাি পর্যন্ত মাপ নিয়ে দেখা গেছে, দশ-বারো হাত লম্বা! এটা হল কর্তা-কাঁকড়ার কথা-তাঁর গিন্নী যে কাঁকড়ি, তাকে তো আর যখন-তখন লড়াই করতে হয় না, কাজেই তাঁর অত বড়ো দাঁড়াও নেই।

 এই কাঁকড়া থাকে জাপান দেশে সমুদ্রের জলে। সেইখানে কূলের কাছে সমুদ্রের শ্যাওলাধরা পাথরের মধ্যে রাক্ষসে কাকড়া গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকে। নামটি রাক্ষুসে হলেও এদের স্বভাবটি মোটেও রাক্ষসের মতো নয়—সেইজন্য নানা জাতীয় মাছ, আর অক্টোপাস প্রভৃতি জলজন্তু এদের দেখতে পেলেই তেড়ে খেতে আসে। নানারকম শ্যাওলা প্রবাল আর ‘স্পঞ্জ’ তার গায়ের উপর বাসা করে তার আসল চেহারাটিকে এমন বেমালুম ঢেকে রাখে যে, খুব কাছে গেলেও অনেক সময় তাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়।

 আরো কতগুলি কঁকড়া রয়েছে, যেগুলিকে গেছে কাঁকড়া বলা যায়। এরা সত্যি সত্যি গাছে চড়ে কিনা তা নিয়ে আগে-নানারকম.তর্ক শোনা যেত, কিন্তু এখন এটা একেবারে সত্য বলে প্রমাণ হয়েছে। তবে এরা যে নারকেল গাছের আগায় চড়ে ডাব পেড়ে আনে, এ কথাটা অনেক সময় শোনা গেলেও এর কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। যাহোক, অল্পই উঠুক অরি বেশিই উঠুক, ডাব পাড়ুক আর নাই পাড়ক গাছে চড়া আর নারকেল খাওয়া এই দুই বিদ্যাতেই এর বেশ বাহাদুরি আছে। প্রশান্ত মহাসাগরের কতগুলি ছোটোছোটো দ্বীপে এই কাঁকড়ার বাড়ি। সেখানে নারকেল গাছের অভাব নেই, নারকেল মাটিতে। পড়লেই গেছো কঁকড়া তাকে আক্রমণ করে। প্রথমত সে নারকেলটার ছোবড়া ছাড়িয়ে -এই ছোবড়া তাদের গর্তে বিছাবার জন্য দরকার হয়। তার পর যে দিকে নারকেলের ‘চোখ থাকে, সেই দিকে সাড়া দিয়ে বুকে গর্ত করে সেই গর্তের মধ্যে দাঁড়া ঢুকিয়ে খুব মজা করে খায়। আস্ত নারকেলটিকে যে দাড়া দিয়ে ভাঙতে পারে-তার পাঁড়ার একটি চাপটে যে মানুষের হাড় পর্যন্ত ভেঙে দেয় সেটা কিছুই অশ্চির্য নয়। কিন্তু তবু মানুষ তাকে ধরতে ছাড়ে না কারণ এ কাঁকড়া খেতে নাকি অতি চমৎকার। তার পায়ে এত চর্বি যে সেই চর্বি গলিয়ে সেদেশের লোকেরা তেল বার করে রাখে। তার উপর সেদেশের বুননা শুয়োরগুলোরও কেমন বদভ্যাস—তারা গর্ত খুঁড়ে এই কঁকড়াদের বার করে খেয়ে ফেলে।

 রাক্ষুসে কাঁকড়ার মতো বড়ো না হলেও, এগুলিও নেহাত ছোটো নয়। একবার এইরকম একটা কাঁকড়াকে একটা মজবুত টিনের বাক্সে বন্ধ করে বাক্সটাকে তার দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরেরদিন দেখা গেল যে, কঁকড়াটা বাক্সের ধার মুচড়িয়ে ফাক করে তা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।

সন্দেশ—আশ্বিন, ১৩২৩