সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/প্রাচীন কালের শিকার

প্রাচীন কালের শিকার

 মানুষকে যদি কেবল জন্তু হিসাবে শরীরের গঠন দেখিয়ে বিচার করা যায়, তবে তাহাকে নিতান্তই অনাড়ি জানোয়ার বলিতে হয়। সে না পারে ঘোড়ার মতো দৌড়াইতে, না জানে ক্যাঙারুর মতো লাফাইতে। দেহের শক্তি বলে অথবা নখ দাত প্রভৃতি যে-কোনো অস্ত্রের কথা বলো, সব বিষয়েই সে অন্যান্য অনেক জাননায়ারের কাছে হার মানিতে বাধ্য। অথচ এই মানুষই এখন আর-সব জানোয়ারের উপর টেক্কা দিয়া এই পৃথিবীতে রাজত্ব করিতেছে। এখনকার যুগের মানুষ তো অত্মরক্ষার জন্য সহস্ররকম উপায় করিয়া রাখিয়াছে—শহর বাড়ি লোকালয় বানাইয়া সে বনের জন্তুর কাছ হইতে আশ্রয় পাইবার নানাপ্রকার ব্যবস্থাও করিয়াছে। কিন্তু সেই আদিমকালের মানুষ, যার ঘরও ছিল না বাড়িও ছিল না—সে বন্দুক চালাইতে শিখে নাই, এমন-কি, তলোয়ার বল্লম পর্যন্ত বানাইতে পারিত না—সে কেমন করিয়া এতরকম হিংস্র জন্তুর সঙ্গে রেষারেষি করিয়া টিকিয়া রহিল, ভাবিতে আশ্চর্য লাগে।

 সে যুগের মানুষ পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইত। কেহ গুহা-গুহ্বরে, কেহ গাছের ডালে বাসা লইয়া বনের পশুর হাত হইতে আপনাকে বাঁচাইয়া রাখিত। চলিতে ফিরিতে কতরকম হিংস্র জন্তু আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইত—তাহাদের কোনো-কোনোটা এ যুগের জানোয়ারগুলির চাইতেও ভয়ানক। যেখানেই সেই প্রাচীন মানুষের কংকাল পাও—তাহারই অশেপাশে সেই-সব পাথরের স্তরের মধ্যেই দেখিবে আরো কতরকম জানোয়ারের কংকালচিহ্ন এমন অবস্থায় সেকালের মানুষ যে আত্মরক্ষার জন্য দল বাঁধিতে আরম্ভ করিবে, ইহা খুবই স্বাভাবিক।

 সেকাল কথাটা খুবই অস্পষ্ট। প্রবীণ লোকেরা নিজেদের বাল্যকালের কথা বলিবার সময় বলেন ‘সেকালে এইরূপ হইত। কোনো প্রাচীন যুগের উল্লেখ করিবার সময় ইতিহাসে বলে -সেকালে’ এইরূপ হইত। কিন্তু যাহারা পৃথিবীর লপ্ত ইতিহাস লইয়া চর্চা করেন, তাহাদের কাছে এ-সমস্ত নিতান্তই 'একাল'। ইতিহাস যাহার কথা লেখে না—যে সময়ে ইতিহাস তো দূরের কথা, লিখিত ভাষারই সৃষ্টি হয় নাই, সেই কালই যথার্থ ‘সেকাল'। কত লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া সেকালের মানষ ক্রমাগত সংগ্রাম করিয়াছে, কে তাহার হিসাব রাখে? কবে কেমন করিয়া সে অস্ত্র গড়িতে শিখিল, কত ঝগড়া কত লড়াইয়ের মধ্যে কেমন। করিয়া অল্পে অল্পে তাহার বুদ্ধি খুলিতে লাগিল, তাহার একটু-আধটু সাক্ষ্য যাহা পাওয়া যায়, তাহারই পরিচয় সংগ্রহ করিতে অজিও কত পণ্ডিতের সারাটা জীবন কাটিয়া যায়।

 কত যুগের কত দেশের কতরকম মানুষ। তাহারা পৃথিবীর কতদিকে চলাফিরা করিয়াছে, আর নদীর গর্ভে পাহাড়ের স্তরে তাহাদের চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে। পাহাড়ের গুহার মধ্যে বাস করিয়া যে-মানুষ কাচা মাংস খাইত; কুটি-কপাল চ্যাটাল-চোয়াল যে-মানুষ দল বাঁধিয়া নরমাংস ভোজন করিত। গাছের ডালে বাসা বাঁধিয়া যে-মানুষ আপন পরিবার লইয়া লুকাইয়া থাকিত; চারিদিকে আগুন জ্বালিয়া তাহার মধ্যে যে-মানুষ দলেবলে রাত কাটাইত; পাথরে পাথর শানাইয়া যে-মানুষ অস্ত্রশস্ত্রে পোশাকে-পরিচ্ছদে সভ্য হইয়া উঠিতেছিল। বড়ো-বড়ো পাথরের স্তুপচ গড়িয়া যে-মানুষ না জানি কোন দেবতার পুজা করিত। তাহাদের কেহই এখন বঁচিয়া নাই কিন্তু তাহাদের প্রত্যেকেরই কিছু কিছু সংবাদ এই যুগের পণ্ডিতেরা তিল তিল করিয়া সংগ্রহ করিতেছেন।

 একবার ভাবিয়া দেখ সেই গুহাবাসীদের কথা; যাহাদের ঘরের পাশে সেকালের প্রকাণ্ড ভালুকগুলি অহরহই ঘুরিয়া বেড়াইত প্রতিদিন চলিতে ফিরিতে যাহারা নানা জানোয়ারের প্রচণ্ড তাড়ায় ব্যতিব্যস্ত হইয়া থাকিত, অস্ত্র বলিতে পাথর ছাড়া যাহাদের আর কিছুই ছিল না, তাহারা যে নিতান্ত শখ করিয়া শিকার করিত না, তাহা সহজেই বুঝিতে পার। হয় শত্রুকে মারা না হয় শত্রুর হাতে মরা, ইহা ছাড়া তাহার কাছে আর তৃতীয় কোনো পথ ছিল না। 'ম্যামথ' বা অতিকায় হস্তীর মতো অত বড়ো একটা জানোয়ারকে কাবু করা অথবা গুহা-ভল্লুক প্রভৃতি সাংঘাতিক জন্তুগুলির সহিত লড়াই করা একলা মানুষের সাধ্য নয়—সুতরাং শিকার কাজটা তাহাদের দল বাঁধিয়াই করিতে হইত। এই শিকার ব্যাপারের মধ্যে মানুষের প্রধান সম্বল যেটি ছিল, সেটি অস্ত্রও নয় শস্ত্রও নয়—সেটি তার বুদ্ধি। দশজনে মিলিয়া অগে হইতে পরামর্শ করিয়া শত্রুকে বেকায়দায় মারিবার চেষ্টাতেই মানুষের বুদ্ধিটা খুলিত ভালো।

 প্রথমত যেমন-তেমন একটা পাথর পাইলেই সে মনে করিত ভারি একটা অস্ত্র পাইলাম। ক্রমে পাথর ছুঁড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সে হয়তো এটা লক্ষ্য করিয়া থাকিবে যে, হাতের কাছে ছোটো পাথর না থাকিলে বড়ো পাথর ভাঙিয়া তাহাকে ছুঁড়িবার উপযোগী করিয়া লওয়া যায়। তার পর যখন হইতে সে বিবেচনাপূর্বক পাথর ভাঙিতে অভ্যাস করিল তখন হইতেই ক্রমে অস্ত্র গড়িবার নানারকম কায়দা দেখা দিল—ঠ্যাঙাইবার অস্ত্র, গুতাইবার অস্ত্র, ছুঁড়িয়া বিধাইবায় অস্ত্র, কোপাইয়া কাটিবার অস্ত্র, ভারী ভারী ভোঁতা অস্ত্র, পাথরে-খোদাই ধারালো অস্ত্র। যেদিন মানষ আগুনকে কাজে লাগাইতে শিখিল, আর যেদিন সে নানারকম ধাতর ব্যবহার শিখিল সেইদিন মানুষের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় দিন। সেইদিন হইতে মানুষ যথার্থরূপে বুঝিতে পারিয়াছে যে, জগতে তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেহ নাই।

সন্দেশ—জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৪