সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/সেকালের লড়াই

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ৩০০-৩০১)

সেকালের লড়াই

 “সন্দেশে’ তোমরা নানারকম জানোয়ারের লড়াইয়ের কথা পড়েছ। কিন্তু বাস্তবিক লড়াইয়ের মতো লড়াই কাকে বলে যদি জানতে চাও তবে সেকালের জানোয়ারদের খোজ নিতে হয়। যে কালের কথা বলছি সে সময়ে মানুষের জন্ম হয় নি—সে প্রায় লাখ লাখ বছরের কথা। সে সময়কার জন্তুরা তো এখন বেঁচে নেই, তাদের খোঁজ নেবে কি করে? খোঁজ নেবার উপায় আছে।

 যে-সকল পণ্ডিতেরা নানারকম জানোয়ারের শরীর পরীক্ষা করে থাকেন, তারা একএকটা জানোয়ারের সামান্য দু-একটা হাড়, দাঁত বা শরীরের কোনো টুকরা দেখে সেই জানোয়ার সম্বন্ধে এমন অনেক কথা বলে দিতে পারেন যে শুনলে অবাক হতে হয়। সে আমিষ খায় কি নিরামিষ খায়, জলে থাকে কি ডাঙায় থাকে, দু পায়ে চলে না চার পায়ে চলে, সে কোন জাতীয় জন্তু, এ-সব কথা শুধু খানিকটা কংকাল পরীক্ষা করে চট্ করে বলা যেতে পারে। কিন্তু অনেক সময়ে পাহাড় কাটতে বা মাটি খুঁড়তে গিয়ে এমন সব হাড় পাওয়া যায় যেটা আমাদের জানা কোনো জন্তুর হাড় হতেই পারে না। মনে কর, একটা পায়ের টুকরা পাওয়া গেল প্রায় পাঁচ হাত লম্বা আর একটা হাতির পায়ের চেয়েও মোটা। সে হাড় আর এখন হাড় নেই, সে কোনকালে পাথর হয়ে গিয়েছে কিন্তু তার চেহারাটা সেইরকমই আছে। এই-সব হাড় পরীক্ষা করে সেকালের অদ্ভুত জন্তু সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা জানা গিয়েছে।

 মনে করো একটা পাথর কাটতে গিয়ে তার মধ্যে একটা জানোয়ারের কংকাল পাওয়া গেল—সে পাথর এক সময়ে নরম মাটি ছিল—জানোয়ারটা তার মধ্যে মারা যায়।ক্রমে সেই নরম মাটি জমে সেই হাড়গোড়সুদ্ধ পাথর হয়ে গেছে। মাটি জমে পাথর হতে হয়তো কত লাখ বৎসর লেগেছে, তার পরে কত হাজার বৎসর কেউ তার কথা জানতে পারে নি। এতদিন পরে মানুষ আবার সেই জানোয়ারের সন্ধান পেল। পণ্ডিতেরা সেই পাথর পরীক্ষা করে হয়তো বলবেন এটা অমুক যুগের পাথর। তার পর হাড় পরীক্ষা করে জানোয়ারটার সম্বন্ধেও নানা কথা বলবেন। যদি অনেকগুলো হাড় পাওয়া যায় তবে হয়তো জানোয়ারটার একটা মোটামুটি চেহারাও খাড়া করতে পারবেন।

 এইরকম করে কত অদ্ভুত জানোয়ারের যে খবর পাওয়া গেছে সে কথা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। প্লীসিওসরাস (অর্থাৎ 'প্রায় কুমির জাতীয়’) জানোয়ারটির গলা সরু আর লম্বা ছিল আর লম্বায় প্রায় পঁচিশ-ত্রিশহাত হলেও মোটের উপর নিরীহ ছিল। আরেকটা ছিল ইকথিয়োসরাস ('মাছ কুমির')। আর দুটো জানোয়ার ছিল মেগালোসরাস আর ইগুয়া নোডন দেখতে ভয়ানক বটে, কিন্তু নিরামিষভোজী, মেগালোসরাস আমিষভোজী। এরা দুজনেই হাতির চেয়ে বড়ো ছিল।

 সেকালের কুমিরদের পিছনের পা দুটার গড়ন সাংঘাতিকরকম মজবুত-লড়ায়ের সময় পিছনের পা দুটাই আক্রমণ কিম্বা আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করত। এদের নাম টিরানোসরাস অর্থাৎ অত্যাচারী কুমির। এরাও হাতির চেয়ে বড়ো ছিল।

 এরকম আরো কত জানোয়ার সেকালে ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমরা যদি তখন বেঁচে থাকতাম তা হলে কি মুশকিল হত বল দেখি? এতগুলো হাতির চেয়ে বড়ো হিংস্র জানোয়ারের মধ্যে আমাদের দশাটা কেমন হত একবার ভেবে দেখো। কয়েক বৎসর আগে, অনেকের বিশ্বাস ছিল যে দক্ষিণ আমেরিকার প্যাটাগোনিয়ার জঙ্গলে সেকালের জন্তু এখনো আছে। একজন সাহেব অনেক লোকজন নিয়ে খুঁজতে গিয়েছিলেন; কিন্তু তাদের দেখা পেলেন না।

সন্দেশ—পৌষ, ১৩২১