সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/অলংকারের কথা
(পৃ. ১৯৯-২০২)
সুন্দর শরীরটিকে সাজাইয়া আরো সুন্দর করিব, মানুষের এই ইচ্ছাটি পৃথিবীর সর্বত্রই দেখা যায়। কিন্তু শরীরটি কিরকম হইলে যে ঠিক সুন্দর হয় আর কেমন করিয়া সাজাইলে যে তাহার সৌন্দর্য বাড়ে এ বিষয়ে নানাজাতির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত দেখা যায়। আমাদের দেশে সাধারণত সুন্দর পুরুষ বা সুন্দরী মেয়ে বলিতে আমরা যা বুঝি, আফ্রিকার বাসুটো বা হটেণ্টট জাতির কাছে তাহার বর্ণনা করিতে গেলে তাহারা হয়তো আমাদের নিতান্তই বেয়াকুব ঠাওরাইবে।
যে ছেলেটা একেবারে ধ্যাপ্সা মোটা, আমাদের দেশের ছেলেরা তাহাকে পাইলে প্রশংসা করা দূরে থাকুক বরং তাহাকে খ্যাপাইয়া অতিষ্ঠ করিয়া তুলিবে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কাছে পলিনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে যে-সব অসভ্য জাতি বাস করে, তাহাদের অনেকের মধ্যে মোটা হওয়ার শখটা খুবই বেশি। বিশেষত ছেলেপিলেরা যদি যথেষ্ট পরিমাণে মোটা না হয় তবে বাপমায়ের আর দুঃখের সীমা থাকে না। ছেলেদের চাইতে আবার মেয়েদের মোটা হওয়াটা আরো বেশি দরকার। যে সহজে মোটা হয় না তাহাকে জোর করিয়া খাওয়াইবার এবং ঘরে বন্ধ রাখিবার ব্যবস্থা করা হয়। তাহাকে কোনোরকম কাজকর্ম করিতে দেওয়া হয় না, পাছে সে খাটিয়া রোগা হইয়া পড়ে।
আফ্রিকার মুর জাতি এবং পারস্য তুরস্ক ও আমেরিকার কোনো কোনো জাতির পছন্দটা ঠিক ইহার উলটা। সেখানে মেয়েরা যে যত রোগা হইতে পারে ততই তার কদর বেশি। তাহারা কত কষ্টে কত সাবধানে আহার কমাইয়া, নানারকম পথ্যাপথ্য বিচার করিয়া চলে। একটু মোটা হইবার লক্ষণ দেখা দিলে তাহাদের ভাবনা-চিন্তার আর সীমা থাকে না।
চীন দেশে পা ছোটো করিবার জন্য মেয়েরা কত যন্ত্রণা সহ্য করে তাহা তোমরা বোধ হয় জান। তাহারা ছেলেবেলা থেকেই মুড়িয়া বাঁধিয়া পাগুলাকে এমন অস্বাভাবিক অকর্মণ্য ও বিকৃত করিয়া ফেলে যে দেখিলে আতঙ্ক হয়। আবার এমন জাতিও আছে যাহারা হাঁটুর নীচে তাগা আঁটিয়া পা-টাকে জন্মের মতো ফুলাইয়া দেয় অরি মনে করে পায়ের চমৎকার শোভা বাড়িয়াছে।
অস্ট্রেলিয়ার কোনো কোনো জাতি চ্যাপ্টা নাকের ভারি ভক্ত। সে দেশের মায়েরা নাকি খোকাখুকিদের নাকের ডগাগুলি প্রতিদিন চাপিয়া চাপিয়া অল্পে-অল্পে দমাইয়া দেয়। ইংরাজ ছেলেমেয়েদের নাক দেখিয়া তাহারা ভারি নাক সিটকায়, আর বলে যে, 'ইহাদের বাপমায়েরা নিশ্চয়ই ছেলেপিলেদের নাক ধরিয়া টানাটানি করে, নইলে নাকগুলা এমন বিশ্রীরকম বাড়ে কি করিয়া!'
উত্তর আমেরিকার ‘রেড ইণ্ডিয়াম’দের মধ্যে চ্যাপ্টা কপালের ভারি খাতির। তাহারা ছেলেবেলায় কপালে এমনভাবে পট্টি বাঁধিয়া রাখে যে, কপালটি বনমানুষের কপালের মতো চ্যাপ্টা ও ঢালু হইয়া দাঁড়ায়। কানটা মাথার পাশে লাগিয়া থাকিবে কি বাদুড়ের মতো আলগা হইয়া থাকিবে এ বিষয়েও মতভেদ দেখা যায়। সুতরাং দেশ বিশেষে ও জাতি বিশেষে কানের উপরেও নানারকম চাপাচাপি ঠেলাঠেলির কৌশল খাটানো হয়। শরীরটিকে এইরকমে যতটা সম্ভব গড়িয়া পিটিয়া কোনোরকমে পছন্দসই করিতে পারিলে তার পরেও তাহাকে সাজাইবার দরকার হয়। সাজাইবার সবচাইতে সহজ উপায় তাহাতে রঙ মাখানো। এই রঙ লেপিবার শখটি অনেক জাতির মধ্যেই দেখা যায় এবং তাহার রকমারিও অনেক প্রকারের। লাল হলদে সাদা এবং কালো, সাধারণত এই কয়রকম রঙেই সব কাজ চলিয়া থাকে। এই-সকল রঙে সমস্ত দেহখানি চিত্র-বিচিত্র করিয়া আঁকিয়ে দেখিতে কেমন সুন্দর হয় বল দেখি? কেবল যে সৌন্দর্যের জন্যই রঙ লাগানো হয় তাহা নয়, অনেক দেশে লড়াইয়ের সময় বড়োবড় যোদ্ধারা নানারকম রঙ লাগাইয়া অদ্ভুত বিকট চেহারা করিয়া বাহির হয়। রঙ লাগাইবার কায়দা কানুন আবার এমন হিসাবমতো যে তাহাতে জাতি, ব্যবসায়, বংশ প্রভৃতি সমস্ত পরিচয়ই দেওয়া হয়।
কিন্তু রঙের একটা মস্ত অসুবিধা এই যে জীবন্ত চামড়ার উপর তাহাকে পাকা করিয়া মাখানো চলে না। স্নান করিতে গেলেই বা বৃষ্টিতে ভিজিলেই সমস্ত ধুইয়া যায়-সুতরাং যাহাদের শখ বেশি তাহারা কাঁচা রঙ ছাড়িয়া উল্কি আঁকিতে শুরু করিল। উল্কি আঁকা এক বিষম ব্যাপার। শরীরের মধ্যে ক্রমাগত ছুঁচ বিঁধাইয়া বিঁধাইয়া চামড়ার ভিতরে ভিতরে রঙ ভরিয়া তবে উল্কি আঁকিতে হয়। শৌখিন লোকেরা অল্পে-অল্প দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমন-কি, বৎসরের পর বৎসর এইরূপে শরীরকে রীতিমতো যন্ত্রণা দিয়া উল্কি রচনা করে। উল্কি আঁকার ওস্তাদ যাহারা, লোকে মোটা মোটা মাহিনা দিয়া তাহাদের কাছে উল্কি আঁকাইতে যায়। উল্কির কাজ অনেক দেশেই প্রচলিত, আছে, কিন্তু এ বিষয়ে জাপানীদের মতো কারিকর আর বোধ হয় কোথাও দেখা যায় না।
উল্কির অসুবিধা এই যে, গায়ের রঙটা নিতান্ত ময়লা হইলে তাহার উপর উকি ভালো খোলে না। সুতরাং আফ্রিকার নিগ্রো জাতিদের মধ্যে, বিশেষত কঙ্গো অঞ্চলের নিগ্রোদের মধ্যে এবং আরো অনেক দেশের কৃষ্ণবর্ণ লোকেদের মধ্যে উল্কির প্রচলন নাই। তাহাদের মধ্যে উল্কির বদলে একরকম ঘা-মরা দাগের ব্যবহার দেখা যায়, সে জিনিসটা উল্কির চাইতেও সাংঘাতিক! প্রথমত শরীরে অস্ত্র খোঁচাইয়া বড়ো-বড়ো ঘা বানাইতে হয়, তার পর নানারকম উপায়ে সেই তাজা ঘাগুলিকে অনেকদিন পর্যন্ত জিয়াইয়া রাখিতে হয়। এতরকম কাণ্ড-কৌশলের পর শেষে ঘা যখন শুকাইয়া উঠে তখন উঁচু উঁচু দাগের মতো তাহার চিহ্ন থাকিয়া যায়। কেবল সৌন্দর্যের খাতিরেই স্ত্রী-পুরুষ সকলে শখ করিয়া এত যন্ত্রণা সহ্য করে। শুনিয়াছি, ইউরোপ ও আমেরিকার কোনো কোনো শৌখিন মেমসাহেব দাঁতের মধ্যে ফুটা করিয়া তাহাতে হীরা মুক্তা বসাইয়া অলংকারের চূড়ান্ত করিয়া থাকেন।
বাস্তবিক ভাবিয়া দেখিলে, অলংকারের শখটা মানুষের এক অদ্ভুত খেয়াল বলিয়া মনে হয়। রসায়নশাস্ত্রে বলে হীরা আর কয়লা, এই দুইটা আসলে একই জিনিস। যে মুক্তার এত আদর সেই মুক্তাও একটা পোকার রস ছাড়া আর কিছুই নয়। সভ্যদেশে সোনা রূপা দিয়া অলংকার গড়ে, কিন্তু অনেক দেশে তামা, লোহা, দস্তা, সীসা পর্যন্ত অলংকার হিসাবে চলিয়া যায়। প্রবাল, নুড়ি, শঙ্খ, কড়ি, হাতির দাঁত, হাঙরের দাঁত, মানুষের হাড়, পাখির পালক, সমুদ্রের শ্যাওলা, কাচের পুঁথি, ছেড়া নেকড়া, ফলের বীচি, ফুল, পাতা, কাঠ—এমন-কি, জোনাকি পোকা বা জীবন্ত পাখি ও কচ্ছপ পর্যন্ত দেশ হিসাবে অলংকার বলিয়া আদর পাইয়া থাকে। কিন্তু যতরকম আশ্চর্য অলংকারের কথা শুনিয়াছি তাহার মধ্যে যেটি আমার কাছে সবচাইতে অদ্ভুত ঠেকিয়াছে সেটি হইতেছে টেলিগ্রাফের তার। প্রথম যখন পূর্ব আফ্রিকার নিগ্রো জাতিরা টেলিগ্রাফের নুতন পুরাতন তারগুলি খুব কিনিত তখন তাহার কারণ বুঝা যায় নাই। পরে দেখা গেল ঐ তারগুলিকে তাহারা মজবুত করিয়া হাতে বা পায়ে প্যাঁচাইয়া সদর্পে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। মেয়েদের মধ্যে যাহারা নিতান্ত শৌখিন তাহারা হাত-পা ও গলা একেবারে তারে ঢাকিয়া ফেলে। কেহ কেহ এমন মজবুত করিয়া তার বাঁধে যে, গায়ের চামড়ায় একেবারে স্ক্রুর মতো দাগ বসিয়া যায়। বর্মাতে কোনো কোনো জায়গায় মেয়েরা গলায় এমন করিয়া তার জড়ায় যে তাহাতে গলা অস্বাভাবিকরকম লম্বা হইয়া পড়ে।
গলার অলংকারের কথা বলিতে গেলে কঙ্গো প্রদেশের আর-এক জাতির কথা মনে পড়ে। তাহাদের মেয়েরা গলায় গোল জাঁতার মতো পিতলের হাঁসুলি পরে, সেগুলি যত বড়ো আর যত ভারি হয় ততই লোকে বেশি করিয়া বাহবা দেয়! তাহার এক-একটা প্রায় আধ মণ পর্যন্ত ভারি হইতে দেখা গিয়াছে।
তার পর নাক-কানের কথা আর বেশি কি বলিব! অমিাদের দেশেই এক-এক সময় নথ বা মাকড়ির যেরকম উৎকট চেহারা হয় তাহা দেখিয়া বিদেশী কেহ যদি হাসে, তবে সেটা কি খুব অন্যায় হয়? নাকের গহনার একটা অদ্ভুত ছবি দেখিয়াছি, তাহাতে একটি মেয়ের নাক ফুটা করিয়া কতগুলো মোটা-মোটা কাঠি বসানো হইয়াছে। কাঠিগুলা শিকারী বিড়ালের গোঁফের মতো মুখের দুই দিকে বাহির হইয়া রহিয়াছে।
নাক-কান ফুটা করিয়া গহনা পরা এ দেশে সকলেই দেখিয়াছ কিন্তু ঠোঁট বা গাল ফুড়িয়া অলংকার বসানো কোথাও দেখিয়াছি কি? দক্ষিণ আমেরিকার বামন জাতির মধ্যে উপরের ঠোটে আংটি গাঁথিবার প্রথা চলিত আছে। গ্রীনল্যাণ্ডের এস্কিমো জাতির মধ্যে এবং উত্তর আমেরিকার কোনো কোনো স্থানে তলার ঠোঁট চিরিয়া তাহার মধ্যে কাঠের চাকতি গুঁজিয়া রাখা হয়। আফ্রিকার কোনো কোনো স্থানে ঠোঁট বা গাল ফুটা করিয়া তাহাতে হাতির দাঁতের ছিপি বসাইবার দস্তুুর আছে। সৌন্দর্যের জন্য লোকে এত কষ্টও সহ্য করে।
এখন চুলের কথা বলিয়া শেষ করি। নানা ফ্যাশানের চুল ছাঁটা, টেরিকাটা, বাবড়ি রাখা, ঝুটি বাঁধা, এ-সব তো আমরা সর্বদাই দেখি। কিন্তু কোনো মেয়ে যদি মাথায় আঠা লেপিয়া, চুলগুলিকে দড়ির ছড়ের মতো ঝুলাইয়া তাহার উপর লাল রঙ মাখাইয়া আসে, তবে সেটা কেমন দেখাইবে? কিংবা যদি মাথায় চুনকাম করিয়া চুলগুলাকে একেবারে ইঁটের মতো চাকা বঁধিয়া রাখে, তাহা হইলেই-বা কেমন হয়? আফ্রিকা দেশে অনেক জায়গায় এরকম জিনিস অহরহই দেখিতে পাওয়া যায়।