সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/আকাশ আলেয়া
(পৃ. ১৯৫-১৯৭)
মানুষের বুদ্ধিতে আজ পর্যন্ত কত অসংখ্যরকমের আলোর সৃষ্টি হয়েছে। সেই কাঠে ঘষা আগুন থেকে শুরু করে অজিকালকার বিদ্যুতের আলো পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তার নাম করতে গেলেও প্রকাণ্ড তালিকা হয়ে পড়ে। সেই কতরকমের তেলের প্রদীপ, কত শত চর্বি-বাতি, মোমের বাতি, কত অসংখ্য গ্যাসের আলো, বিদ্যুতের আলো, তার ঠাণ্ডা আলো হিসাব রাখে কে। মানুষের তৈরি জিনিসে কাজ চলে ভালো, তাতে আর সন্দেহ নাই। রোদের আলো আর চাঁদের আলো আর প্রকৃতির নানা খেয়ালের নানারকমের আলো, কেবল এই নিয়ে আজকালকার নিতান্ত অসভ্য মানুষের জীবন চলে না। কিন্তু তবু বলতে হয় যে, এই প্রকৃতির রাজ্যে আমরা যতরকমের আলো দেখি, মানুষের তৈরি এই-সব আলো তারই অতি সামান্য নকল মাত্র। সূর্যের কথা ছেড়েই দিলাম, আকাশের মেঘে যে বিদ্যুতের আলো চমকায় তার সঙ্গে মানুষের কোন ইলেকট্রিক লাইটের তুলনা হয়? সামান্য জোনাকি পোকার গায়ে যে আলো জ্বলে যাতে গরম হয় না অথচ আলো হয়, মানুষ তার নকলে ঠাণ্ডা আলো জ্বালাবার জন্য কত চেষ্টা করেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত পেরে ওঠে নি। সুর্যগ্রহণের সময় সূর্যের কিরণ-মুকুট হতে যে অদ্ভুত আলো বেরোয়, তার গম্ভীর শোভায় পশুপাখি পর্যন্ত ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়। মানুষের মাথায় সেরকম আলোর কল্পনাও আসে না।
কিন্তু এই পৃথিবীতে সবচাইতে অদ্ভুত আর সবচাইতে সুন্দর যে আলো সে হচ্ছে মেরুদেশের ‘আকাশ আলেয়া’ বা ‘মেরুজ্যোতি'। তাকে দেখতে হলে উত্তরে কিংবা দক্ষিণে মেরুর প্রদেশে যেতে হয়। সেখানে শীতকালের রাত্রে মেরুর চারিদিকে কয়েকশত মাইল দূর পর্যন্ত আলোর অতি চমৎকার খেলা চলতে থাকে। শুধু এই আলো দেখবার জন্যই প্রতি বৎসর কত দূরদেশের কত শত যাত্রী নরওয়ের উত্তরে দুরন্ত শীতের মধ্যে বেড়াতে যায়।
চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র এদের আলো কেমন স্থির। তারাগুলো অনেক সময়ে মিট্মিট্ করে বটে, কিন্তু এলোমেলোভাবে কেউ নড়েচড়ে বেড়ায় না। কিন্তু ‘আকাশ আলেয়া' বাস্তবিক ঐ সুদূর আকাশের জিনিস নয়, তার জন্মস্থান এই পৃথিবীর বাতাসেরই চূড়ার উপরে। বাতাস সেখানে অসম্ভবরকম হালকা, তার উপরে সূর্যের বিদ্যুৎকিরণ পড়ে তাকে চঞ্চল করে ‘আকাশ আলেয়া'র সৃষ্টি করে-সুতরাং ‘আকাশ আলেয়ার' চালচলনটাও কিছু অস্থিররকমের। কিন্তু অস্থির বলতে একেবারে বিদ্যুতের মতো দুরন্ত একটা কিছু মনে কোরো না। তার অস্থিরতা শ্রাবণের তুফান হাওয়ার মতো নয়, বসন্তের ঝিরঝিরে বাতাসের মতো।
‘আকাশ আলেয়া’র রঙ রামধনুর চাইতেও সুন্দর, কারণ সেটা সত্যিকার অলোকশিখা; আলোকটা তার নিজেরই আলো—আর রামধনুর আলো সূর্যের আলোর ধার-করা ছায়া মাত্র। তা ছাড়া অন্ধকার আকাশের কালো জমির উপরে রঙের খেলা যেমন খেলে, দিনেরবেলায় মেঘের গায়ে তেমন করে খুলতেই পারে না। অতি সুন্দর অতি স্নিগ্ধ হালকা নীল লাল সবুজ রঙের শিখার মতো এই আলো আকাশ জুড়ে খেলা করে। কখনো উপরে ওঠে, কখনো নীচে নামে, কখনো মিনিটে মিনিটে বহুরূপীর মতো রঙ বদলায়, কখনো রঙিন পর্দার মতো দুলতে থাকে, কখনো ঘূর্ণার পাকের মতো ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে, কখনো ধূমকেতুর ল্যাজের মতো আকাশের গায়ে খাড়া থাকে, আবার কখনো আলগা হয়ে টুকরো হয়ে আকাশময় ছড়িয়ে পড়ে। এক-এক সময়, বিশেষত শীতের রাতে এই আলোর খেলা এমন সুন্দর হয় যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার তামাশা দেখেও ক্লান্তিবোধ হয় না।
এই পৃথিবীটা একটা প্রকাণ্ড চুম্বকের গোলা—সেই চুম্বকের এক মাথা উত্তরে আর এক মাথা দক্ষিণে, মেরুর কাছে। আর সূর্যটা যেন একটা প্রকাণ্ড বিদ্যুৎশক্তির কুণ্ড তার মধ্যে থেকে নানারকম আলো আর বিদ্যুতের তেজ আকাশের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তার খানিকটা আমরা দেখি, আর অনেকটাই হয়তো দেখি না। পণ্ডিতেরা বলেন, এই সূর্যের বিদ্যুৎ-ছটা আর পৃথিবীর চুম্বকশক্তি আর এই আলেয়ার আলো এই তিনটার মধ্যে ভিতরে ভিতরে খুব একটা সম্পর্ক দেখা যায়। সূর্যটা কেবল যে পৃথিবীকে আলো দেয় আর গরম রাখে তা নয়, সে নানারকম অদৃশ্য তেজে পৃথিবীকে ভিতরে বাইরে সব সময়েই নানানরকমে চঞ্চল করে রাখছে। সর্যের গায়ে যখন ঘূর্ণির মতো দাগ দেখা যায় তখন পৃথিবীতেও চুম্বকের দৌরাত্মে দিগদর্শন যন্ত্রগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে—আর মেরুর আকাশে যেখানে পৃথিবীর এই চুম্বকের মাথা সেখানে এই আলেয়ার আলো আরো দ্বিগুণ উৎসাহে নূতন বাহার দেখিয়ে খেলা করতে থাকে। এগারো বছর পর পর সূর্যের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের এক-একটা বড়ো-বড়ো উৎপাত দেখা যায়-ঠিক সেই সময়েই পৃথিবীতেও চুম্বকের উপদ্রব আর আকাশ আলেয়ার বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে।
তোমরা জান, পাম্প্ দিয়ে ফুটবলে বাতাস পোরা যায়—কিন্তু একরকম উলটা 'পাম্প' আছে তা দিয়ে বাতাস খালি করে ফেলে। পণ্ডিতেরা এইরকমে বোতলের মধ্যে থেকে বাতাস বের করে সেই ফঁকা বোতলের মধ্যে বিদ্যুৎ চালিয়ে আকাশ আলেয়ার নকল করতে পেরেছেন। কিন্তু একটা বোতলের মধ্যে আলোর তামাশা আর খোলা আকাশের প্রকাণ্ড শরীরে আলোর খেয়াল-খেলা, এ দুয়ের মধ্যে অনেক তফাত।