সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/আশ্চর্য প্রহরী
(পৃ. ২৮৩-২৮৫)
বড়ো-বড়ো রাজারাজড়া বা লাট-বেলাট যখন সমারোহ করে বেড়াতে বেরোন তখন তাদের সঙ্গে কতগুলি 'বডি-গার্ড’ বা ‘শরীর-রক্ষক’ ঘোড়ায় চড়ে যায়। তারা যখন নিশান উড়িয়ে বাহার দিয়ে চলে, তখন দেখতে বেশ জমকাল দেখায়। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায়, এ ছাড়া তাদের আর বিশেষ কিছু কাজ করবার থাকে না। বছরের পর বছর কেটে যায়। কিন্তু কারও শরীর রক্ষা করবার জন্য তাদের কোনো ডাক পড়ে না।
আমাদের শরীরে কোথায় কি হচ্ছে তাই নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেন তাঁরা বলেন, তুমি আমি রাম শ্যাম সকলের সঙ্গেই—এরকম দু-দশটা নয়, একেবারে লাখে লাখে-‘বডি-গার্ড’ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিনরাত তার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে, দিনরাত ছুটোছুটি করে পাহারা দিচ্ছে, শত্রুর সঙ্গে লড়াই করবার জন্য দিনরাত প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। শত্রু ধরবার জন্য এত ব্যস্ততা কেন? এত শক্রই-বা কোথায়? শত্রু চারিদিকেই। আকাশে বাতাসে রোগের বীজ সব কিল্বিল্ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা নিশ্বাসের সঙ্গে নাক দিয়ে, গলা দিয়ে একেবারে ফুস্ফুসের ভিতর পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছে, আর কতরকম জ্বরজারি সর্দিকাশির হাঙ্গামা বাধাচ্ছে। জলের সঙ্গে, দুধের সঙ্গে, নানারকম খাবারের সঙ্গে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগের বীজ শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। কোথায় একটু ঘা হলে বা কেটে গেলে সেই ফাঁক দিয়ে কত সাংঘাতিক ব্যারামের বীজ অনায়াসে ভিতরে ঢুকে অনর্থ বাধাবার চেষ্টা করছে। যদি বাঁচতে হয় তা হলে এই-সমস্ত শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখা দরকার। তাই, ধুলিকণার চাইতে সূক্ষ যে শত্রু, যাকে দেখতে হলে অণুবীক্ষণ লাগাতে হয়, তার সঙ্গে সারাদিন লড়াই করবার জন্য শরীরের মধ্যে আশ্চির্যরকম সূক্ষা ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আমাদের শরীরটা এমনভাবে তৈরি যে তার যেখানেই কাটো সেখানেই রক্ত বেরোয়। কোথাও একটা ছুঁচের সমান সরু জায়গা খুঁজে পাবে না যার মধ্যে খোঁচা দিলে রক্ত গড়ায় না। শরীরে যতক্ষণ প্রাণ থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত রক্তটা ক্রমাগত শরীরময় ছুটোছুটি করে বেড়ায়। তাও এলোমেলোভাবে ছুটবার হুকুম নাই। ঠিক তালে তালে, সারাদিন সারা বছর সারা জীবন তাকে পথ ধরে ধরে চলতে হয়-এক মুহর্ত বিশ্রাম করবার উপায় নাই। এইভাবে সর্বদা তাকে চালাবার জন্য শরীরের মধ্যে আশ্চর্য ‘পাম্পকল' বসানো আছে। বুকের মাঝখানে যে জায়গাটা সর্বদা ধুক্ধুক্ করে, যাকে আমরা হার্ট বা হৃৎপিণ্ড বলি, সেইটে হচ্ছে আমাদের পাম্পকল।
ঘরে ঘরে কলের জল পেতে হলে তার জন্য শহরের এক-এক জায়গায় স্টেশন করে প্রকাণ্ড কলকারখানা বসাতে হয়। সেই স্টেশনের সঙ্গে বড়ো-বড়ো ‘পাইপ’ জুড়ে শহরময় জল চালাবার ব্যবস্থা করতে হয়; তার পর সেই মোটা পাইপের গায়ে সরু মোটা মাঝারি নানারকম নল লাগিয়ে ঘরে ঘরে জল আনতে হয়। শরীরের রক্ত চলবার ব্যবস্থাটাও অনেকটা এইরকমের। হৃৎপিণ্ডটা হল আমাদের কলের স্টেশন। শরীরের মোটা মোটা শিরাগুলি সেই স্টেশন থেকে বেরিয়ে চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে—ঠিক যেন রাস্তার নীচে জলের পাইপ। তাদের গা থেকে আবার সরু সরু নলের মতো সূক্ষ্ম সূক্ষ শিরা বেরিয়ে সমস্ত শরীর ছেয়ে ফেলেছে-সুতোর মতো সরু, চুলের মতো সরু, তার চাইতেও আরো অনেক সরু। বুকের ধুকধুকানির তালে তালে শরীরের রক্ত শিরার ভিতর দিয়ে চলতে থাকে। চলতে চলতে যায় কোথায়? আর কোথাও যাবার জো নাই, বার বার সেই হৃৎপিণ্ডের মধ্যেই ফিরে আসতে হয়।
আমরা যতক্ষণ বেঁচে থাকি ততক্ষণ শরীরটা ক্রমাগত ক্ষয় হতে থাকে। যত বেশি কাজ করি, যত বেশি চিন্তা করি, যত বেশি কথা বলি, যতই নড়িচড়ি, চলি, ফিরি, শরীর ততই বেশি বেশি ক্ষয় হতে থাকে। কয়লা না পোড়ালে যেমন ইঞ্জিন চলে না তেমনি শরীরকে ক্ষয় না করলে শরীরের কাজ হয় না। কিন্তু কেবলই যদি ক্ষয় হতে থাকে তা হলে শরীর টিকবে কি করে? সেজন্য শরীরকে রোজ নিয়ম মতো খাবার জোগাতে হয়। সেই খাওয়া হজম হলে শরীরের রক্ত তাকে নানা কৌশলে চারিদিকে বয়ে নিয়ে সবরকমের ক্ষয় দুর করে। শরীর যে শুধু ক্ষয় হয় তা নয়; কয়লা পুড়লে যেমন ধোঁয়া বেরোয়, ঝুল জমে আর ছাই পড়ে থাকে তেমনি শরীরের ক্ষয়ের দরুন নানারকমের দৃষিত আবর্জনা শরীরের সর্বত্র জমে উঠতে থাকে। সেই আবর্জনা দূর করাও রক্তের কাজ। হৃৎপিণ্ডের ভিতর থেকে যে পরিষ্কার টাটকা লাল রক্ত বেরিয়ে আসে সেই রক্ত যেখানে যায় সেখানকার ময়লা সাফ করতে করতে শেষটায় নিজেই ক্রমে ময়লা হয়ে পড়ে। সেই ময়লা দূষিত রক্ত আবার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ফিরে এসে ফুসফুসের তাজা বাতাস খেয়ে টকটকে তাজা হয়ে ওঠে।
এক ফোঁটা রক্ত যদি অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখ তা হলে দেখতে দেখাবে কালো কালো চ্যাপ্টা মতো। ঐ গোল গোল জিনিসগুলির আসল রঙ লাল। ঐগুলির জন্য রক্তের রঙ লাল দেখায়-তা না হলে রক্তের কোনো রঙ নাই। এই লাল দানা বা 'কণিকা'গুলি এক-একটা এত ছোটো যে এক ফোটা রক্তের মধ্যে ওরকম লাখে লাখে কণিকা ভেসে বেড়ায়। এই লাল জিনিসগুলোর ফাঁকে ফাঁকে সাদা মতন কি দেখা যাচ্ছে। সেইগুলিই হচ্ছে শরীরের প্রহরী বা বডি-গার্ড'। লাল দানাগুলি কেবল কুলি আর ধাঙড়ের কাজ করে বেড়ায়। শরীরের ময়লা সাফ করা, শরীরকে ধুয়ে মুছে বাতাস খাইয়ে তাজা রাখা, এ-সবই হচ্ছে ঐ লাল কণিকাদের কাজ। কিন্তু শত্রুর সঙ্গে যখন লড়াই করতে হয় তখন ডাক পড়ে ঐ সাদা প্রহরীদের।
যেমনি শরীরে রোগের বীজ ঢোকে অমনি চারিদিকে সাড়া পড়ে যায়। আর প্রহরীরা দলে দলে রক্তের স্রোতে ভেসে এসে রোগের সঙ্গে লড়াই বাধিয়ে দেয়। টপাটপ্ রোগের বীজ খেয়ে ফেলতে থাকে। লড়াই যখন সঙ্গীন হয় তখন দলে দলে প্রহরী মরতে থাকে, আর নূতন প্রহরীর দল দ্বিগুণ উৎসাহে সড়তে আসে। এরকম ছোট ছোট লড়াই শরীরের মধ্যে চব্বিশ ঘটাই চলছে। মানুষের রোগ যখন সাংঘাতিক হয়, যখন প্রহরীরা কিছুতেই আর রোগের বীজগুলোর সঙ্গে লড়াই করে পেরে ওঠে না তখন মানুষের প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়। যখন রোগের বীজ ক্রমশই শরীরটাকে দখল করতে থাকে তখন শরীরময় হৈচৈ পড়ে যায়, 'আরো প্রহরী পাঠাও, আরো প্রহরী পাঠাও।' শরীরের কারখানায় তখন লাখে লাখে শ্বেত-কণিকা তৈরি হতে থাকে। শরীরের মরণ-বাঁচন অনেকটা তাদেরই হাতে।
মনে কর তোমার হাতে এক জায়গায় একটুখানি কেটে গেছে; যেখানে কাটে সেখান দিয়ে তো রক্ত বেরোবেই কিন্তু ক্রমাগতই যদি রক্ত বের হতে থাকে, তা হলে সে তো বড়ো মারাত্মক কথা—তাই শরীর প্রথমেই চেষ্টা করে রক্ত থামাতে। রক্ত থামাবার উপায়টিও বড়ো চমৎকার; রক্তটা বাইরে এসে আপনা থেকেই কাটা ঘায়ের মুখে ছিপির মতো জমাট বেঁধে যায়। তখন সেই জায়গাটা যদি অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখ তা হলে দেখবে হাজার হাজার লাল কণিকা তার মধ্যে তাল পাকিয়ে মরে আছে। সাদা প্রহরীরাও ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে না; তারা সব ছুটে এসে মরা লাল কণিকাগুলিকে খেয়ে খেয়ে সাফ করতে থাকে, আর কাটা চামড়ার জায়গায় নূতন চামড়া গজাবার ব্যবস্থা করতে থাকে। কাটা ঘায়ের মুখটি হচ্ছে রোগের বীজ ঢুকবার খোলাপথ; যদি তেমন তেমন বীজ সেখান দিয়ে ঢুকতে পারে, তা হলেই শীঘ্র শীঘ্র ঘা শুকাবার পক্ষে মুস্কিল হয়, সামান্য একটা ঘা পেকে বা পচে উঠে বিষম কাণ্ড বাধিয়ে তোলে। তখন প্রহরীদের খাটুনিও খুব বেড়ে যায়। ঘা পাকলে তা থেকে যে পুঁজ বেরোয় তার মধ্যে দেখা যায় অসংখ্য শ্বেতকণিকা মরে আছে, আর তার মধ্যে রোগের বীজাণু কিল্বিল্ করছে।