সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/কয়লার কথা

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২০৫-২০৬)
কয়লার কথা

 আমি এক টুকরো কয়লা। রাস্তার ধারে পড়ে আছি, কেউ আমার খবর নেয় না। একটি ছোট্টো ছেলে তার মার সঙ্গে যেতে যেতে খপ করে আমায় কুড়িয়ে নিল। দেখে মা বললেন, “অরে, ছি ছি-নোংরা। ওটা ফেলে দাও।” ছেলেটা অমনি আমায় তাচ্ছিল্য করে ফেলে গেল। দেখে রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলতে লাগল। হায় রে! আমার যদি কথা কইবার শক্তি থাকত, একবার আচ্ছা করে শুনিয়ে দিতাম।

 কি শোনাতাম? কেন, আমার বয়সের কথা, আমার বংশের কথা, আমার গুণের কথা। সে কথা এখন কি আর তোমরা বিশ্বাস করবে?

 হাজার হাজার বছর আগে যখন তোমরা কেউ ছিলে না, তোমাদের মতো দু-পেয়ে জন্তুরা যখন পৃথিবীর উপর সর্দারি করতে শেখে নি, আমি তখন ছিলাম ভীষণ বড়ো জঙ্গলের প্রকাণ্ড গাছের মধ্যে। তোমরা যাকে বল ‘বনস্পতি' আমি ছিলাম সেইরকম জাঁকালো গাছের জ্যান্ত ডাল। কত যুগের পর যুগ আমরা সেখানে ছায়া দিয়েছি, কত অদ্ভুত পাখি আমার উপর বসে বিশ্রাম করেছে, কত বিদঘুটে জন্তু সেই গাছের আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু অমন যে বিরাট জঙ্গল সে ও কি চিরকাল টিঁকতে পারে? এমন দিন এল, যখন সে জঙ্গলের আর চিহ্নমাত্র রইল না। যেখানে জঙ্গল ছিল সেখানে ছাই ভস্ম ধুলা বালির চাপের নীচে, ভিজা মাটি আর বৃষ্টির জলে মরা কাঠ পচতে লাগল। কত পথ-হারানো নদীর স্রোত কত কাদামাটি জঞ্জাল এনে তার উপরে ফেলে গেল। কত ভূমিকম্পে কত আগুনের উৎপাতে সেই জমি কতবার ধ্বসে পড়ল, কতবার কেঁপে উঠল। কত পাহাড়-গলা পাথর এসে কত নতুন জমি তৈরি হল, তার উপরে নতুন মাঠ, নতুন বন, নতুন প্রাণীর খেলা চলল। আমরা যুগ যুগ ধরে তারই তলায় পচতে পচতে চাপে আর গরমে পাথর হয়ে জমে উঠলাম। এমনি যে কত হাজার বছর ছিলাম, তার কি আর হিসাব রেখেছি? সেখানে মাটির নীচে কবরের মধ্যে বাইরের কোনো খবর পৌঁছায় না-বাইরের কেউ তার খবর জানে না।

 তার পর একদিন শুনলাম কিসের শব্দ—কে যেন কি ঠুকছে। দিনের পর দিন রোজই ঠুকছে—খটাখট্ ঠকাঠক্ খটাং খটাং। ডাইনে বাঁয়ে চারিদিকে সেই একই শব্দ। শব্দ কাছে আসতে আসতে একদিন একেবারে আমারই সামনে এসে পড়ল দেখলাম, তোমাদেরই মতো কতগুলো অদ্ভুত দু-পেয়ে জন্তু আমাদের সব ঠুকে ঠুকে কেটে নিচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম আমাদের কাজ বুঝি ফুরিয়েছে—এখন থেকে চিরটা কাল বুঝি এমনিভাবেই কাটাতে হবে। কিন্তু দেখলাম, তা নয়। আমাদের নেবার জন্যই এরা খেটেখুটে রাস্তা কেটে নেমে এসেছে।

 তার পর বাইরে এসে দেখলাম, পৃথিবী আর সে পৃথিবী নাই! সে-সব গাছপালা নাই, সে-সব জীবজন্তু নাই—যেদিকে তাকাই কেবল দেখি এই দু-পেয়ে জন্তুর আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানা। তুমি ছোকরা, বড়ো যে আমায় তাচ্ছিল্য করে কথা কইছ, তুমি জান আমার খাতির কত? আমারই এই কালো রূপকে রাঙিয়ে নিয়ে তোমার ঘরের আগুন জ্বলে, আমার গুণেই রেল চলে, স্টিমার চলে, কলকারখানা সবই চলে। এই কলকাতার রাস্তায় গ্যাসের বাতি, বলি, এ গ্যাস আসে কোথা হতে? কয়লা চুঁয়ে জ্বালানি গ্যাস হয় —আর হয় এমোনিয়া আর তেল-কয়লা—যাকে তোমরা বলো Coalter।

 শুধু কি তাই? ঐ এমোনিয়া দিয়ে কত যে কাজ হয়, প্রতি বছর কত হাজার মণ গাছের সার তৈরি হয়, তোমরা কি তার খবর রাখ? তার পর ঐ যে আলকাতরার মতো চটচটে কালো নোংরা জিনিস, যাকে তেল-কয়লা বললাম—তা থেকে রাসায়নিক পণ্ডিতেরা কত যে আশ্চর্য জিনিস বানিয়েছেন, তাদের নাম করতে গেলেও প্রকাণ্ড পুঁথি হয়ে যায়। কত আশ্চর্য সুন্দর রঙ, ছবির রঙ, কাপড়ের রঙ, কালির রঙ; কত নতুন নতুন সুগন্ধ, এসেন্সে ফুলের গন্ধ, সিরাপে ফলের গন্ধ। কত ডাক্তারি ওষুধপত্র-পোকা মারবার, রোগের বীজ মারবার কত অব্যর্থ ব্রহ্মাস্ত্র; কত নূতন নূতন যুদ্ধসামগ্রী, কত বোমার মসলা, কত বারুদের মসলা, আর ছোটোবড়ো কত যে নকল জিনিস তার আর অন্তই নাই। এ-সবই সম্ভব হচ্ছে কেবল আমার জন্যই, অথচ তোমরা তো আমায় খাতির করবে না—কারণ, আমি যে কয়লা, আমি যে নোংরা ময়লা কালো রাস্তার কয়লা।

সন্দেশ-ফাল্গুন, ১৩২৪