সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/ছাপাখানার কথা

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৬৩-১৬৪)
ছাপাখানার কথা

 ছেলেবেলায় একটা ছাপাখানা দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম একটা লোহার কল রয়েছে, সেটাকে তারা 'প্রেস’ বলে। তার পাশে একটা কালি-মাখানো টেবিল আর অন্য একটা টেবিলে একতাড়া কাগজ। প্রেসের সামনের দিকে একটা লোহার তার উপর অনেকগুলো উঁচু-উচু অক্ষর বসানো রয়েছে। একটা ছেলে একটা মোটা ‘রুল’ দিয়ে টেবিলের কালি নিয়ে সেই অক্ষরগুলোতে মাখাচ্ছে। আর একজন লোক সেই তক্তার সঙ্গে আঁটা একটা ফ্রেমের উপর কাগজ বসিয়ে, কাগজসুদ্ধ ফ্রেমটাকে মুড়ে সেই অক্ষরগুলোর উপর ফেলে দিচ্ছে। তার পর একটা হাতল ঘুরিয়ে সেইগুলোকে একেবারে প্রেসের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে আর একটা প্রকাণ্ড হাতল টেনে দিচ্ছে। তার পর হাতল ছেড়ে দেওয়া, তক্তা টেনে বার করা, কাগজ খুলে নেওয়া, আবার কালি দেওয়া, কাগজ দেওয়া, ইত্যাদি। এইরকম ক্রমাগত চলছে আর প্রত্যেকবার এক-একখানা ছাপা হচ্ছে। এমনি করে ঘণ্টায় দুশো-তিনশো করে ছাপা হয়। ব্যাপারটা আমার কাছে ভারি আশ্চর্য লেগেছিল। কিন্তু এসব প্রেস এখন আমাদের দেশেও নিতান্ত ‘সেকেলে' হয়ে গেছে!

 আজকালকার কোনো বড়ো ছাপাখানায় যদি যাও, প্রেসের রকমারি দেখে অবাক হয়ে যাবে। তার অধিকাংশ কলে চলে, আগাগোড়াই তার কলে কাজ হয়। প্রথম যে কলের প্রেস দেখেছিলাম সে কথা আমার এখনো মনে আছে। সেটাকে দর্জির সেলাই কলের মতো পায়ে চালাতে হয়। সেটা যখন চলে তখন বোধ হয় যেন একবার হাঁ করছে, একবার মুখ বুজছে। যে প্রেস চালায় সে ঐ হাঁ-করা প্রেসের মধ্যে তার কাগজ বসিয়ে দেয়। আর সেটা সেই কাগজের উপর অক্ষরের ‘টাইপ' দিয়ে এক কামড় বসিয়ে দেয় -তাতেই ছাপা হয়ে যায়। কালির জন্য ভাবতে হয় না। প্রেসের মাথায় কতগুলো রুল বসানো আছে, সেগুলো কালি মেখে তৈরি হয়ে থাকে, যেই প্রেসটা হাঁ করে, আর প্রেসম্যান তার কাগজ বদলিয়ে দেয় অমনি রুলগুলো সুড়ৎ করে সেই উঁচু-উঁচু অক্ষরগুলোর উপর কালি মাখিয়ে পালায়! পায়ে না চালিয়ে প্রেসের সঙ্গে মোটর জুড়ে দিলে মোটরেই প্রেস চালাতে পারে।

 কিন্তু পড়বার বই বা মাসিক কাগজপত্র ছাপবার জন্য যে-সব বড়ো-বড়ো প্রেস থাকে, সেগুলো আরো খটমটে। তাতে একটা প্রকাণ্ড লোহার চোঙা থাকে, তার গায়ে কাগজ ঠেলে দিলে সে আপনি কাগজ টেনে নেয়। একটা লোহার টেবিল মতো থাকে, তার উপর টাইপ বসানো; সেই টেবিলটা টাইপসুদ্ধ ছুটাছুটি করে। একবার রুলের তলা দিয়ে ছুটে কালি মেখে এসে আবার কাগজ-জড়ানো চোঙার নীচ দিয়ে গড়াতে গিয়ে চোঙাটাকে চেপে ঘুরিয়ে কাগজের গায়ে ছাপ মেরে দেয়। ছাপা হয়ে গেলে কাগজটাকে হাতে করে সরিয়ে নিতে হয় না-প্রেসটা আপনি তাকে ঠিক জায়গায় এনে ফেলে দেয়। এমনি করে ঘণ্টায় দু-তিন হাজার বেশ সহজেই ছাপা যায়।

 কিন্তু ছাপাখানা কি ভয়ানক ব্যাপার হতে পারে তা যদি তুমি দেখতে চাও তবে খুব বড়ো খবরের কাগজওয়ালাদের কাছে গিয়ে দেখ: সেখানে প্রেসের ঘরে ঢুকতেই মনে হবে যেন কানে তালা লেগে গেল। প্রেসের ভনভন শব্দে নিজের চেঁচানি নিজেই শুনতে পাবে না। কল এত তাড়াতাড়ি চলে যে, কখন কি করে ছাপা হচ্ছে কিছু বুঝবার জো নেই। এমন প্রেসও আছে, যাতে বারো পৃষ্ঠা খবরের কাগজ প্রতি ঘণ্টায় এক লাখ করে ছাপা হয়। যদি প্রেসটার ভিতর ভালো করে তাকিয়ে দেখ, দেখবে একদিকে একটা লোহার ডাঙায় প্রায় চার-পাঁচ হাত চওড়া কাগজের ফিতে জড়ানোফিতেটা লম্বায় হয়তো দু-তিন মাইল হবে। প্রেসের মধ্যে পর পর কতগুলো প্রকাণ্ড লোহার চোঙা ভয়ানক জোরে বন্ধ করে ঘুরছে—আর সেই সঙ্গে হড়হড় করে কাগজের ‘ফিতে' টেনে নিয়ে, তার উপর ছেপে যাচ্ছে। মাইলকে মাইল কাগজ চোখের সামনে দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিলাতে একটা বড়ো খবরের কাগজ (Daily Mail) ছাপতে প্রতি সপ্তাহে তিনশো মণ কালি আর দশ হাজার মাইল কাগজ খরচ হয়।

 এতে একদিনে যা ছাপা হবে, দেড়শো বছর আগেকার কাঠের প্রেসে এক বছরেও তা পেরে উঠত না।

সন্দেশ-বৈশাখ, ১৩২৩