সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/ডাকঘরের কথা

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৭২-১৭৪)
ডাকঘরের কথা

 সন্দেশের ধাঁধার উত্তরের চিঠিগুলি সেদিন দেখছিলাম। কেউ আধ মাইল দূর থেকে লিখেছে চিঠি, কেউ লিখেছে পনেরোশো মাইল দূর থেকে কিন্তু এক পয়সার পোস্টকার্ডে প্রায় সকলেই লিখেছে। এক পয়সা খরচে পনেরোশো মাইল চিঠি পাঠানো, একি কম সস্তা হল? হঠাৎ মনে হতে পারে অত কম মাশুলে এতদূর চিঠি পাঠাতে ডাকঘরের বুঝি লোকসান হয়। কিন্তু তারা কি দুই-এক খানা চিঠি পাঠায়? প্রতিদিন লাখে লাখে চিঠি আর পার্সেল তারা পাঠায়। তাতেই তাদের খরচে পুষিয়ে যায়। ডাকঘরের বন্দোবস্তই-বা কি কম আশ্চর্যরকম! তুমি হয়তো কলকাতায় বসে একটা পোস্টকার্ডে চিঠি| লিখে ডাকবাক্সে সেটাকে ফেলে দিলে। কিছুক্ষণ পরে ডাকঘরের লোক এসে ডাকবাক্সের চারি খুলে চিঠিগুলো ডাকঘরে নিয়ে গেল। সেখানে অনেকগুলি লোকে মিলে চিঠির উপরে ডাকঘরের ছাপ মারে, আর এক-একটা থলিতে এক-একটা রেলে পাঠাবার চিটিগুলি ভরে ফেলে—যেমন দার্জিলিং মেলে দার্জিলিং, খরসান, জলপাইগুড়ি, রাজসাহী, কুচবিহার, এসব জায়গার চিঠি; পঞ্জাব মেলে বর্ধমান, মধুপুর, পাটনা, বাঁকিপুর, এলাহাবাদ, দিল্লী, লাহোর এই-সব জায়গার চিঠি। তার পর সব ছোটো ডাকঘর থেকে বড়ো ডাকঘরে থলেগুলি পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে স্টেশনে চলে যায়! রেলের গাড়ির মধ্যে আবার ডাকঘরের বন্দোবস্ত আছে। সেখানে থলিগুলো খুলে প্রত্যেক জায়গাকার চিঠি আলাদা করে এক-একটা খোপে ভরে রাখে। তার পর সব চিঠি বাছা হয়ে গেলে এক-এক জায়গার চিঠি এক-একটা আলগা থলিতে ভরে ফেলে। সেখানে যখন রেল পৌঁছায় তখন রেলের ডাকঘর থেকে সেই সেই জায়গার চিঠিগুলো নামিয়ে দেয়। তার পর আবার ডাকঘরে সেই থলি নিয়ে গিয়ে তার থেকে চিঠি বের করে, বেছে, পিয়ন দিয়ে বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এত হাঙ্গামার পরেও চিঠি যে ঠিকমতো গিয়ে পৌছায় এই আশ্চর্য-কৃচিৎ ডাকঘরের কোনো লোকের দোষে হারাতে পারে। পৃথিবীর যেকোনো জায়গার একজন লোকের ঠিকানা খুঁজে বের করে তার ঠিকানায় একখানা চিঠি লিখে দাও। তার পর ব্যস, আর ভাবতে হবে না—সেটা ঠিক সেই লোকের কাছে হাজির হবে।

 সব সময়ই যে রেলে ডাক যায় তা নয়। রেলে যায়, জাহাজে যায়, ছোটো স্টিমারে যায়, নৌকায় যায়, গাড়িতে যায়, মানুষের পিঠে যায়, কুকুরে-টানা গাড়িতে যায়এমন-কি, এরোপ্লেনে করে আকাশ দিয়েও যায়। এমন জায়গাও তো আছে যেখানে ডাকঘর নাই। সেখানের ঠিকানাতে চিঠি লিখলেও চিঠি ঠিকই পৌঁছায়। তবে সেখানে চিঠি যেতে কিছু দেরি লাগে। ইউরোপে যে-সব সৈন্য যুদ্ধ করছে তাদের কাছেও চিঠি যাবার উপায় আছে। সে যেখানেই থাকুক-না কেন তার নাম আর তার সৈন্যদলের নাম, এইটুকু জানলেই লড়াইয়ের ডাকঘরওয়ালারা ঠিক তার কাছে চিঠি কিংবা পার্সেল পৌঁছে দেবে। আমাদের দেশে অনেক জায়গায় ‘রানার’-এর ডাকের বন্দোবস্ত আছে। একজন লোক কাঁধে করে চিঠির থলি নিয়ে এক ডাকঘর থেকে অন্য ডাকঘরে পৌছে দেয়। হাজারিবাগে আগে ঐরকম বন্দোবস্ত ছিল। তখন অনেক রানার বাঘের মুখে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। অনেক সময় দুষ্ট লোকে নির্জন রাস্তায় পেয়ে ‘রানার'কে মেরে চিঠিপত্র খুলে টাকাকড়ি নিয়ে চলে যায়।

 প্রায় সত্তর বৎসর আগে কোনো দেশে টিকিট অথবা পোস্টকার্ড ব্যবহারের নিয়ম ছিল না। তখন চিঠিপত্র পাঠাতে অত্যন্ত বেশি খরচ হত। ইংলণ্ডের সার রোল্যাণ্ড হিল প্রথমে টিকিট ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। সে সময়ে চিঠির মাশুল এত বেশি ছিল যে গরিব লোকের পক্ষে চিঠি পাওয়া বড়ো মুশকিলের কথা ছিল। যার কাছে চিঠি যাবে তাকেই মাশুল দিতে হত। আর অনেক সময় মাশুল দিতে না পারায় অনেক গরিব লোককে দরকারি চিঠিও ফিরত দিতে হত। লণ্ডন থেকে মাত্র চার মাইল দূরে একটা জায়গায় একটা চিঠি পাঠাতে এক টাকারও বেশি খরচ হত। পার্লামেণ্ট সভার সভ্যেরা বিনা পয়সায় চিঠি পাঠাতে পারতেন-চিঠির উপর তার একটা নাম সই থাকলেই হয়। তারা অনেক সময় তাদের বন্ধুদের চিঠির উপরও সই করে দিতেন আর বন্ধুরা সব বিনা পয়সায় চিঠি পাঠাতেন। কেবল চিঠি নয়, অনেক বড়ো-বড়ো জিনিসও তাঁরা ঐরকম সই করে বিনা পয়সায় পাঠাতেন। গরিব লোকেরই বড়ো মুশকিল হত। তারা নিরুপায় হয়ে শেষে নানারকম ফাঁকি দিতে আরম্ভ করল। একজন তার বোনকে বলল যে সে যখন তাকে চিঠি লিখবে তার উপরের ঠিকানার পাশে কতকগুলি চিহ্ন থাকবে, সেই চিহ্ন দেখে বোঝা যাবে সে ভালো আছে কি অসুস্থ হয়েছে। বোনও সেইরকম চিহ্ন দিয়ে তার ভাইকে চিঠি লিখত। চিঠির ভিতরে কিন্তু কেবল সাদা কাগজ। চিঠি যখন পৌঁছাত তখন তার উপরের চিহ্নগুলি দেখে নিয়ে তারা চিঠিটা ফেরত দিত আর বলত, “অত মাশুল দিয়ে চিঠি নেবার ক্ষমতা আমার নেই।” এইরকম আরো কত উপায়ে লোকেরা ডাকঘরকে ঠকাত।

 রোল্যাণ্ড হিল যখন টিকিট ব্যবহারের প্রস্তাব করেন তখন বিলাতে পার্লামেণ্ট সভায় ভয়ানক অপত্তি হয়। কিন্তু অনেক খবরের কাগজওয়ালা তার প্রস্তাবের সপক্ষে লেখেন আর সাধারণ লোকেও অনেক সভাসমিতি করে তাঁর হয়ে বলেন। রোল্যাণ্ড হিল ছেলেবেলায় গরিব লোক ছিলেন। তিনি গরিবের কষ্ট ভালো করে বুঝতেন আর তাদের জন্যে খাটতেও সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর মনে ছিল, ছেলেবেলায় একদিন তাঁকে একটা চিঠির মাশুল জোগাড় করার জন্য রাস্তায় ঘুরে হেঁড়া কাপড় বিক্রি করতে হয়েছিল। তিনি চিঠি পাঠাবার খরচ সম্বন্ধে অনেক হিসাব করে বললেন, “চিঠি পাঠাবার খরচ অত্যন্ত সামান্য; বেশি খরচ ডাকঘরেরই হয়! আর অনেক চিঠি লোকে নেয় না বলে ডাকঘরের বিস্তর টাকা লোকসান হয়। বড়ো লোকেরা তো বিনা পয়সায়ই অনেক চিঠি পাঠান। এর চেয়ে ভালো বন্দোবস্ত হয় যদি নিয়ম করা যায় যে, চিঠি পাঠাবার আগে মাশুল দিতে হবে। আর মাশুল দেওয়া হয়েছে কিনা বুঝবার জন্য চিঠির উপর একটা টিকিট লাগিয়ে দিলেই হবে। কত মাশুল দেওয়া হল তা টিকিটেই লেখা থাকবে।” আপত্তির পর পার্লামেণ্ট একবার এ উপায়টা পরীক্ষা করতে রাজী হলেন। রোল্যাণ্ড হিলের উপরেই সব বন্দোবস্তের ভার পড়ল। কয়েক বৎসর পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, এই ডাকটিকিটের বন্দোবস্ত এত সুবিধাজনক যে এর বিরুদ্ধে আর কোনো আপত্তিই ঠেকে না। তখন থেকে বিলাতে টিকিটের চল আরম্ভ হল আর দেখতে দেখতে সমস্ত পৃথিবীময় টিকিটের ব্যবস্থার আরম্ভ হল। ডাকঘরের বন্দোবস্তও রোল্যাণ্ড হিলের বুদ্ধিতেই অনেকটা হয়েছে।

সন্দেশ—অগ্রহায়ণ, ১৩২৩