সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/পাতালপুরী

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৫৭-১৫৯)
পাতাল পুরী

 পাতাল দেশটা কোথায় তাহা আমি জানি না। অনেকে বলেন আমেরিকার নামই পাতাল। সে যাহাই হউক, মোটের উপর পাতাল বলিতে আমরা বুঝি যে, আমাদের নীচে একটা কোনো জায়গা—আমরা এই যে মাটির উপর দাঁড়াইয়া আছি, তার উপরে যেন স্বর্গ আর নীচে যেন পাতাল!

 এখানে যে জায়গার কথা বলিতেছি সেটাকে পাতালপুরী বলা হইল এইজন্য যে সেটা মাটির নীচে। মাটির নীচে ঘরবাড়ি, মাটির নীচে রেলগাড়ি, মাটির নীচে হোটেল সরাই গির্জা—সমস্ত শহরটাই মাটির নীচে। শহরটা কিসের তৈয়ারি জান? নুনের! অসলে সেটা একটা নুনের খনি। অস্ট্রিয়ার কাছে—মাটির নীচে এই অদ্ভুত শহর। হাজার হাজার বৎসর লোকে এই খনিতে খুঁড়িয়া খুঁড়িয়া লবণ তুলিয়াছে। এখনো প্রতি বৎসর এই খনি হইতে প্রায় বিশ লক্ষ মণ লবণ বাহির হয়—কিন্তু তবু লবণ ফুরাইবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। মাটির নীচে পঁচিশ মাইল চওড়া পাঁচশো মাইল লম্বা লবণের মাঠ। খুঁড়িয়া দেখা গিয়াছে একহাজার ফুটের নীচেও লবণ।

 খনির মধ্যে খানিকটা জায়গায় বড়ো সুরঙ্গ কাটিয়া পথঘাট করা হইয়াছে তাহার মাঝে মাঝে এক-একটা বড়ো ঘরের মতো। খনিটা ঠিক যেন একটা সাততলা পুরী, তার নীচের চারতলায় কুলিরা কাজ করে, উপরের তিনতলায় লবণ প্রায় ফুরাইয়া আসিয়াছে-সেখানে এখন লোকে তামাশা দেখিতে আসে।

 খনির মুখে ঢুকিলেই লবণের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বাহিয়া লোকে নীচে নামে—কিম্বা যদি ইচ্ছা হয় নীচে নামিবার যে কল আছে সেখানে পয়সা দিলেই কলে চড়িয়া নীচে নামা যায়।

 প্রথমতলায় অর্থাৎ উপরের তলায়, একটা প্রকাণ্ড সভাঘর। চারিদিকে লবণের দেয়াল, লবণের থাম, লবণের কারিকুরি, তার মধ্যে লবণের ঝাড়লণ্ঠন। এই ঘর দেড়শত বৎসর আগে তৈয়ারি হইয়াছিল। কত বড়ো-বড়ো লোকে, রাজারাজড়া পর্যন্ত, এই সভায় বসিয়া আমোদ-আহ্লাদ করিয়া গিয়াছেন। সভার এক মাথায় একটা সিংহাসন। একখানা আস্ত লবণের টুকরা হইতে এই সিংহাসন কাটা হইয়াছে।

 ঘরের মধ্যে যখন আলো জ্বালানো হয়, তখন সমস্ত ঘরটি স্ফটিকের মতো জ্বলিতে থাকে। লাল নীল সাদা কতরকম রঙের খেলায় চোখে ধাঁধা লাগাইয়া দেয়। লবণ জিনিসটা যে কতদূর সুন্দর হইতে পারে শুধু খানিকটা নুনের গুড়া বা কর্‌কচের টুকরা দেখিয়া তাহার ধারণাই করা যায় না।

 সভাঘরের খুব কাছেই সেণ্ট আণ্টনির মন্দির। মন্দিরের মধ্যে আলো বেশি নাই, লবণের থামগুলি আধা-আলো আধা-ছায়ায় আর স্ফটিকের মতো ঝক্‌ঝক্ করে না। এক-এক জায়গায় সাদা মার্বেল পাথরের মতো দেখায়। মন্দিরের ভিতরটায় জঁকজমক বেশি নাই। চারিদিক নিস্তদ্ধ-সভাঘরের হৈ চৈ গোলমাল এখানে একেবারেই পৌঁছায় না।

 এখান হইতে দ্বিতীয় তলায় নামিবার জন্য আবার সিঁড়ি—সিঁড়িটা একটা প্রকাণ্ড ঘরের মধ্যে নামিয়াছে। ঘরের হদিটা একটা গম্বুজের মতো। চারিদিকে বড়ো-বড়ো কাঠের ঠেকা দেওয়া হইয়াছে তা না হইলে ছাদ ভাঙিয়া পড়িতে পারে। ঘরটা এত উঁচু যে তাহার মধ্যে আমাদের গড়ের মাঠের মনুমেণ্টটিকে অনায়াসে খাড়া করিয়া বসানো যায়। ঘরের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড লবণের ঝাড়লণ্ঠন, তাহার মধ্যে তিনশত মোমবাতি জ্বালানো হয়। কিন্তু তাতেও এত বড় ঘরের অন্ধকার দূর হয় না।

 দেড়শত বৎসর আগে এই ঘরেই খনির আড্ডা ছিল। লবণ খুঁড়িতে খুঁড়িতে খনিতে বড়ো-বড়ো ফাঁক হইয়া যায়। এই ঘরটিও সেইরকম একটি ফাঁক মাত্র। লোকে উপর হইতে লবণ তুলিতে আরম্ভ করে—ক্রমে যতই লবণ ফুরাইয়া আসিতে থাকে তাহারা একতলা দোতলা করিয়া ততই নীচে নামিতে থাকে।

 তৃতীয় তলায় নামিয়া কতগুলি ছোটোখাটো ঘর ও নানা লোকের কীর্তিস্তম্ভ দেখিয়া লবণের পোল পার হইতে হয়। তার পরেই হোটেল রেলওয়ে স্টেশন ইত্যাদি। সেগুলিও দেখিবার মতো জিনিস।

 মাটির সাতশত ফিট নীচে একটা লোনা হ্রদ আছে, এমন লোনা জল বোধ হয় আর কোথাও নাই। অন্ধকার গুহা, তার মধ্যে ঠাণ্ডা কালো জল কোথাও একটু কিছু শব্দ হইলে চারিদিকে গম্‌গম্ করিয়া প্রতিধ্বনি হইতে থাকে। সেই জলের উপর লোকে যখন নৌকা চালায় তখন জলের ছপ্‌ছপ্ শব্দ চারিদিক হইতে অন্ধকারে ফিস্‌ফিস্ করিতে থাকে—যেন পাতালপুরীর হাজার ভূতে কানে কানে কথা বলে।

সন্দেশ-অশ্বিন, ১৩২১