সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/যদি অন্যরকম হত
(পৃ. ২৮৮-২৮৯)
এই পৃথিবীটাকে জন্মে অবধি আমরা যেমন দেখে আসছি সে যে বরাবর ঠিক সেরকম ছিল না তা তোমরা সবাই জান। এখন সে যেমনটি আছে চিরকাল তেমনটিও থাকবে না। আমরা এখন তার যেরকম চেহারা দেখছি সেরকম না হয়ে যদি সে অন্যরকম হত, যদি তার শনির মতো আংটি থাকত কিম্বা বৃহস্পতির মতো দশ-বারোটা চাঁদ থাকত তা হলে আরো কত অদ্ভুত কাণ্ড দেখতে পেতাম। চাঁদ যেমন বারো মাসে তার একই পিঠ পৃথিবীর দিকে ফিরিয়ে থাকে, ও পিঠে কি আছে তা আমাদের দেখতে দেয় না বুধগ্রহ ঠিক তেমনি করে সারা বছর সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবী যদি তেমনি করে কেবল একটা দিকই সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে রাখত—তা হলে ব্যাপারটা কি হত একবার ভাব দেখি। একদিকে চিরকালই রোদ, চিরকালই গরম, একটু জুড়াবার অবসর নাই, সব মরুভূমি, সব ফেটে চৌচির। আর-একদিকে কেবলই রাত, কেবলই ঠাণ্ডা আর কেবলই বরফ। জীবজন্তুর সাধ্য কি যে তেমন ঠাণ্ডায় বা তেমন গরমে পাঁচ মিনিটও বেঁচে থাকে। এই দুইয়ের মাঝখানে যেখানে বারো মাস কেবলই সন্ধ্যা, যেখানে সূর্য অস্ত যায় না, উদয়ও হতে চায় না, কেবল আকাশের সীমান্তের কাছে উঁকিঝুঁকি মারে সেখানে হয়তো কষ্টেসৃষ্টে জীবজন্তুরা টিকে থাকতে পারে, গাছপালা যদি থাকে তবে তাও ঐ সন্ধের দেশটুকুতেই থাকবে।
এক জায়গায় মাটি যদি গরম হয় আর তার কাছেই আশেপাশে যদি তার চাইতেও ঠাণ্ডা জায়গা কোথাও থাকে তা হলে গরম জায়গার হাওয়া হালকা হয়ে উপরদিকে উঠতে থাকে, আর চারিদিকের ঠাণ্ডা বাতাস এসে সেই জায়গা দখল করতে থাকে। এমনি করে ছোটো-বড়ো ঝড়ের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর একটা দিক যদি আগুনের মতো গরম আর একদিক বরফের চাইতেও ঠাণ্ডা হত তা হলে সারা বছর ধরে যে ভীষণঝড়ের সৃষ্টি হত, তার কাছে এই পৃথিবীর বড়-বড়ো তুফানগুলো নিতান্তই ছেলেখেলা। সুতরাং পৃথিবীর যে এখনো চাঁদের মতো বা বুধগ্রহের মতো দশা হয় নি সেটা আমাদের পক্ষে খুবই সৌভাগ্যের কথা বলতে হবে। কিন্তু পণ্ডিতেরা বলেন যে পৃথিবীর দিনগুলো ক্রমেই লম্বা হয়ে আসছে। এখন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন হয় কিন্তু লক্ষ লক্ষ বছর পরে দিনগুলো বাড়তে বাড়তে ক্রমে ক্রমে ৩৬৫ গুণ লম্বা হয়ে আসবে অর্থাৎ এক বছরে পৃথিবীর একদিন হবে তখন উপরে যেরকম বর্ণনা করা হয়েছে পৃথিবীর ঠিক সেইরকম দশা হয়ে আসবে।
যদি বাতাস না থাকত তা হলে পৃথিবীর কি অবস্থা হত? জীবজন্তু সব যে মরে যেত সে তো সহজেই বোঝা যায় কিন্তু পৃথিবীর চেহারাটা হত কিরকম? গাছপালা না হওয়ার দরুন চেহারার যে পরিবর্তন হত সেটা একরকম কল্পনা করে নেওয়া যায়—কিন্তু তা ছাড়াও আরো অনেক অদ্ভুত পরিবর্তন হত। বাতাস না থাকলে মেঘ, বৃষ্টি, ঝড় বা হাওয়ার চলাচল এ-সব কিছুই থাকত না। পাহাড় ধ্বসে পড়লেও তার শব্দ শোনা যেত না। যে জলের উপর সর্বদা চঞ্চল ঢেউ খেলতে থাকে সেই জল আশ্চর্যরকম স্থির হয়ে থাকত আর তার মধ্যে সব জিনিসের ছায়া পড়ত একেবারে আয়নার মতো পরিষ্কার। কিন্তু তাও বেশি দিন হবার জো থাকত না বাতাসের চাপ না থাকলে জল খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। সুতরাং অল্পদিনের মধ্যেই পৃথিবীর সব জল বাষ্প হয়ে উড়ে আকাশময় ছড়িয়ে পড়ত পৃথিবীর সাধ্য থাকত না যে সেই জলকে মেঘের আকারে বা কুয়াশার আকারে আটকিয়ে রাখে। সেই বাতাসহীন পৃথিবীর উপর যখন রোদ এসে পড়ত তখন দেখতে দেখতে পৃথিবী গরম হয়ে উঠত, আবার রোদ পড়লেই গরম মাটি চট্পট্ জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যেত!
আর-একটা কাণ্ড হত এই যে, পৃথিবীর চারিদিকের সমস্ত ধুলো আর বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়াতে পারত না; সব এসে পৃথিবীর গায়ের উপর জমে থাকত। ধুলো অতি সামান্য জিনিস। কিন্তু ঐ ধুলোটুকু না থাকার দরুন সমস্ত আকাশের চেহারা একেবারে বদলিয়ে যেত। আমাদের এই আকাশে যখন সূর্য ওঠে তখন সমস্ত আকাশ আলো হয়ে যায়। আকাশের যেখানেই তাকাও সেখানেই আলো। রাত্তিরের তারাগুলো সে আলোয় কোথায় যে চাপা পড়ে যায় তাদের আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। অমন যে ঝকঝকে চাঁদ সেও আলোর তেজে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিন্তু ধুলো যদি না থাকত তা হলে এ-সব কিছুই হওয়া সম্ভব হত না। যেখানে সুর্য থাকত শুধু সেইটুকুই ঝক্ঝকে আলো আর তার চারিদিকেই ঘুট্ঘুটে কালো আকাশ, সেই আকাশের গায়ে দিন দুপুরে তারাগুলো সব ফুটে থাকত। আর সূর্যের চেহারাও আশ্চর্যরকম বদলিয়ে যেত। সূর্যের চারিদিকে যে আগুনের খোলস আর আলোর কিরীট থাকে, পূর্ণগ্রহণের সময় ছাড়া যা এখন চোখে দেখবার উপায় নাই, সে-সব তখন শুধু চোখেই যখন-তখন দেখা যেত। একটা ঝক্ঝকে গোল পিশু, তার গা থেকে আগুনের শিখাগুলো লক্লকে জিব বার করে লাফাচ্ছে আর তার চারিদিকে অতি সুন্দর স্নিগ্ধ সবুজ আলো রঙের খেলা দেখিয়ে বহু দূর পর্যন্ত চঞ্চল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
যা হোক, এ-সমস্তই কল্পনার কথা। আসল কথা এই যে, পৃথিবী যেমন আছে আরো বহুকাল সে তেমনি থাকবে এবং সেটা তোমার পক্ষেও ভালো, আমার পক্ষেও ভালো-আমাদের হাজার হাজার বছর পরে যারা জন্মাবে তাদের পক্ষেও ভালো।