সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/রাবণের চিতা

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৬০-১৬১)

রাবণের চিতা

 লোকে বলে রাবণের চিতায় যে আগুন দেওয়া হয়েছিল সে আগুন নাকি এখনো নিভানো হয় নি এখনো তা জ্বলছে। কোথায় গেলে সে আগুন দেখা যায় তা আমি জানি না-কিন্তু এমন আগুন দেখা গেছে যা বছরের পর বছর ক্রমাগতই জ্বলছে। মানুষ তাতে জল ঢেলে মাটি চাপা দিয়ে নানারকমে চেষ্টা করেও তাকে নিভাতে পারে নি।

 খনি থেকে কয়লা এনে সেই কয়লা দিয়ে লোকে আগুন জ্বালায়। কিন্তু তা না করে যদি একেবারে খনির মধ্যেই আগুন ধরিয়ে খনিকে খনি জ্বালিয়ে দেওয়া যায় তবে কিরকম হয়? বাস্তবিকই এমন সব কয়লার খনি আছে যার আশেপাশে বারোমাসই আগুন জলে। সে-সব খনির লোকেরা সব সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকে-কখন সে আগুন খনির মধ্যে এসে পড়ে। কোনোদিকে যদি খনির দেয়াল একটু গরম হয় কিম্বা খনির কাছে কোনো জায়গা যদি বসে-যাবার মতো হয়, তবেই হৈচৈ লেগে যায়—‘অগুিন আসিছে, আগুন আসছে। খনির একদল লোক আছে তাদের কাজ কেবল আগুন তাড়ানো। যেদিক দিয়ে আগুন আসছে বোধ হয়, তারা সেইদিকে ইট পাথরের দেয়াল তুলে আগুনের পথ বন্ধ করে দেয়। আগুন তখন বাধ্য হয়ে আর কোনো দিক ঠেলে তার পথ করে নেয়। কেমন করে কোথা হতে আগুন আসে তা সব সময়ে বলা যায় না। মাটির নীচে হয়তো বিশ-পঁচিশ মাইল জায়গা জুড়ে কয়লার স্তর রয়েছে—কোথাও একশো হাত, কোথাও হয়তো পাঁচ হাত মাত্র পুরু। তারই কোনোখানে যদি কোনো গতিকে আগুন ধরে আর তার আশেপাশে পাহাড়ের ফাটলে যদি বাতাস যথেষ্ট থাকে—তবেই সে আগুন একেবারে 'রাবণের চিতা' হয়ে দাঁড়ায়।

 খোলা বাতাসে কয়লা যেমন ধু ধু করে জ্বলে যায়, মাটির নীচে তেমন হয় না—সেখানে আগুন যেন শামুকের মতো আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে থাকে। যেদিকে তার পথ খোলা, যেদিকে একটু কয়লা আর বাতাস—আগুন একদিনে হোক এক বছরে হোক, সেদিকটা দখল করবেই। অনেক দিন আগে একবার ইংলণ্ডের একটা গির্জা হঠাৎ বসে যেতে আরম্ভ করল—তার দেয়াল মেঝে সব দেখতে দেখতে হাঁ করে উঠল। এঞ্জিনিয়ার এসে মাটি খুঁড়ে দেখেন বারো হাত নীচেই কয়লার স্তর আর তাতে আগুন লেগেছে—কয়লা যতই পুড়ে যাচ্ছে, উপরের মাটিও ততই ধ্বসে পড়ছে। তখন পরামর্শ করে সকলে গির্জার মেঝেটা খুঁড়ে প্রকাণ্ড একটা ফুটো করলেন। সেই ফুটোর মধ্যে প্রায় এক পুকুর জল ঢেলে দেওয়া হল—তার পর মাটি খুঁড়ে লোহার শিক বসিয়ে তার নীচে দেয়ালের গায়ে দেয়াল তুলে সবাই ভাবল, 'এবারে আগুন জব্দ হয়েছে।' কিন্তু সাতাশ বৎসর পরে আবার সেই আগুন কয়লা পুড়িয়ে পুড়িয়ে তিনদিক ঘুরে গির্জার পিছনে এসে হাজির।

 অনেকদিন আগে লিভারপুলের কাছে টড্ নদীর ধারে এক কয়লার খনি ছিল। হঠাৎ কেমন করে সেই খনির এক কোণে আগুন লেগে যায়। খনিসুদ্ধ লোক প্রাণপণ চেষ্টা করেও যখন সে আগুন নিভানো গেল না, তখন খনির কর্তারা খাল কাটিয়ে টড নদীকে খনির মধ্যে ছেড়ে দিলেন। তাতে তখনকার মতো আগুন চাপা পড়ল বটে কিন্তু জলের স্রোত খনির এমন দুরবস্থা করল যে কর্তারা ভয় পেয়ে গেলেন। তার পর যখন কিছুদিন না যেতেই আগুন আবার আর একদিকে এসে উঁকি মারল তখন সকলেই বললেন আগুন নিভাবার চেষ্টা বৃথা—ওকে কোনোরকমে ঠেকিয়ে রাখ। যেদিকে অগুন অসবার ভয় সেদিকের কয়লা সরিয়ে ফেল, বড়ো-বড়ো খাল কেটে দেয়াল তুলে, তার পথ বন্ধ কর। তা হলেই আগুন আর ছড়াতে পারবে না- ক’দিন বাদে আপনি নিভে যাবে। এইরকমে ছাব্বিশ বছর আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ চলল। একদল লোক কেবল ঐ কাজেই দিনরতি লেগে রইল; যারা ছোটো ছিল তারা প্রায় বুড়ো হয়ে এল। খনির পাশে দেয়ালের পর দেয়াল উঠল, আগুনের উপর নীচে চারদিকে ঘেরাও হয়ে গেল। কিন্তু আগুন কি থামতে চায়। দেয়াল ভেঙে, পাথর ফাটিয়ে আগুনের শিখা বার বার দেখা দিতে লাগল। আগুন বেড়েই চলল।

 একদিকে যেমন আগুন, আর একদিকে জল! পাহাড়ের ফাটল দিয়ে টড্, নদীর জল এসে খনির মধ্যে দিনরাত পড়ত-সেই জল পাম্পকল দিয়ে ক্রমাগত বাইরে ফেলে দিতে হয়। একদিন টড্ নদীর জোয়ার লেগে উপরের মাটি ধ্বসে গিয়ে কবেকার পুরানো এক সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে খনির ভিতরে হ-হু করে জল ঢুকল। ভাগ্যিস তখন খনির মধ্যে লোক ছিল না, গোলমাল শুনে তারা সকলে খনির মুখের কাছে দৌড়ে এল। ব্যাপারটা কী বুঝতে কারও বাকি রইল না; সকলেই বলতে লাগল এই জল যদি আগুনে গিয়ে পড়ে, তবে কি হবে? আগুনে জলে যখন দেখা হল তখন কয়েক মিনিট ধরে একটা ভয়ানক গর্জন আর যুদ্ধ চলল—ফুটন্ত জল ফোয়ারার মতো দুশো হাত উঁচু হয়ে এমন জোরে ছুটে বেরুল যে তার ধাক্কায় খনির মুখের কলকব্‌জা সব কোথায় উড়ে গেল। তার পর দেখতে দেখতে সব চুপচাপ। আগুন ঠাণ্ডা হল আর সঙ্গে সঙ্গে খনির দফাও ঠাণ্ডা।

 গিরিধির কাছে একটা কয়লার স্তরে আজ ক’বছর হল আগুন ধরেছে। গরমে মাটি ফাটিয়ে পাহাড় তাতিয়ে সে আগুন এখনো জ্বলছে।

সন্দেশ-ফাল্গুন, ১৩২১