সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/সূক্ষ্ম হিসাব


সূক্ষ হিসাব

 একজন লোককে তাহার বয়স জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল। সে তৎক্ষণাৎ কাগজ পেনসিল লইয়া হিসাব করিয়া বলিল, “আঠারো বৎসর তিন মাস ষোলো দিন চার ঘণ্টা—কত মিনিট ঠিক বলতে পারলাম না।” যিনি প্রশ্ন করিয়াছিলেন তিনি তো উত্তর শুনিয়া চটিয়াই লাল। বাস্তবিক, আমাদের সকল কাজের যদি এরকম চুলচেরা সুক্ষ হিসাব রাখিতে হইত, তবে হিসাবের খবর লইতেই সমস্ত জীবনটা কাটিয়া যাইত।

 মনে কর বাহিরে ভয়ানক ঝড় বহিতেছে। একজন বলিল, “উঃ, ভয়ানক জোরে হাওয়া দিচ্ছে।” যিনি সক্ষম হিসাব চান তিনি তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করিবেন, “ভয়ানক জোরটা কিরকম জোর? ঘণ্টায় কত মাইল হিসাবে বাতাস চলছে? একদিকেই যাচ্ছে, না দিক বদলাচ্ছে? কিরকমভাবে বাড়ে কমে?” ইত্যাদি। যাঁহারা মেঘ বৃষ্টি বাতাস লইয়া আলোচনা করেন তাহারা এইরকম সব খবর সংগ্রহ করিবার জন্য নানারকম সূক্ষ-সুক্ষ কল ব্যবহার করেন। বাহিরে খুব একচোট বৃষ্টি হইয়া গেল। লোকে দেখিয়া বলিল, “বাস রে, কি ঝমাঝম বৃষ্টি।” কিন্তু আমাদের সক্ষম হিসাবী পণ্ডিত হয়তো বলবেন, “এই বৃষ্টিকে যদি সমানভাবে মাটির উপর ধরিয়া রাখা যাইত তবে ঠিক এক ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি জল দাঁড়াইত।”

 শীত গ্রীষ্ম বুঝাইবার জন্য আমরা কতখানি ঠাণ্ডা বা কতখানি গরম তাহাও ভাষায় কতকটা বলিতে চেষ্টা করি—যেমন, ‘শীতে হাড় জমে গেল। বড়ো শীত। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। একটু যেন গরম। বেশ গরম; ভয়ানক গ্রীম উঃ, গরমে গা ঝলসে গেল ইত্যাদি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতের কাছে যাও, তিনি চট করিয়া বলিয়া দিবেন আর এত ‘ডিগ্রী’ ঠাণ্ডা হইলেই বরফের মতো ঠাণ্ডা হইবে’ বা ‘আর এত “ডিগ্রী গরম বাড়িতে ফুটন্ত জলের মতো গরম হইবে।' এক ঘটি ঠাণ্ডা জল রহিয়াছে, তুমি তাহাতে এক ফোঁটা গরম জল ফেলিয়া দাও-কোনো তফাত বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু এমন যন্ত্র আছে যাহা দ্বারা পরীক্ষা করিয়া পণ্ডিতেরা তৎক্ষণাৎ বলিয়া দিতে পারিবেন, এই জলটা একটু গরম হইল।' এখন হইতে পঞ্চাশ হাত দূরে একটা বাতি জালিয়া রাখ আর এখানে বসিয়া যন্ত্রের মুখ তাহার দিকে ফিরাইয়া দাও। অমনি দেখিবে, কলের মধ্যে সুক্ষ কাঁটা সেই গরমেই চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। একটি কাগজের ঠোঙায় খানিকটা চাল রহিয়াছে। তুমি হয়তো দাঁড়িপাল্লা দিয়া মাপিয়া বলিলে, “আধ সের চাল।” বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতের কাছে যাও, তিনি তাহার চমৎকার দাড়িপাল্লায় ওজন করিয়া বলিবেন, “না, ঠিক আধ সের হয় নি। আরো প্রায় দেড়খানা চাল দিলে তবে ঠিক আধ সের হবে।”

আমরা কথায় বলি “চুল চেরা হিসাব আর মনে করি চুলকে চিরিতে গেলে বুঝি হিসাবটা নিতান্তই সূক্ষরকম হয়। কিন্তু যাঁহারা অণুবীক্ষণ লইয়া কাজ করেন তাহারা বলিবেন, “চুলটা তো একটা দস্তুরমতো মোটা জিনিস। একটা চুলকে হাজারবার চিরলে তবে বলি—“হ্যাঁ, হিসাবটা কতকটা সূক্ষ বটে।” অণুবীক্ষণের সাহায্যে পণ্ডিতেরা যে-সকল সুক্ষ জিনিসের খবর রাখেন, তাহাদের মধ্যে অনেকগুলি এতই সূক্ষম যে তাদের একটার কাছে একটা ছোটো পিঁপড়া যেন ছারপোকার পাশে হাতির মতো দেখায়। এক ইঞ্চিকে একশোভাগ, হাজারভাগ, লক্ষভাগে চিরিয়াও পণ্ডিতদের হিসাবের পক্ষে যথেষ্ট সুক্ষম হয় না। এক চৌবাচ্চা জলের মধ্যে একটা সরিষার মতো ছোটো চিনির টুকরা ফেলিয়া দাও। তাহার এক চামচ জলের মধ্যে যতটুকু চিনি থাকে তাহার চাইতেও অল্প পরিমাণ জিনিস পরীক্ষা করিয়া পণ্ডিতেরা সেই-সব জিনিস সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য খবর সংগ্রহ করিয়াছেন।

খুব তাড়াতাড়ি 'কাট' বলিতে চেষ্টা করতো। কতক্ষণ সময় লাগে? হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে কথাটা শেষ হইতে প্রায় এক সেকেণ্ডের দশভাগের একভাগ সময় লাগে। একটা দুত চলন্ত ট্রেন ততক্ষণে পাঁচ-ছয় হাত চলিয়া যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসাবীর কাছে সময়ের এ-হিসাবটা খুবই মোটা। ট্রেনটা এক চুল পরিমাণ নড়িতে যতটুকু সময় লাগে সেইটুকু সময়ের মধ্যে যাহা ঘটিতেছে বৈজ্ঞানিক তাহার সন্ধানও রাখিয়া থাকেন। এইখানে হঠাৎ একটা আলো জ্বালিয়া দেখ, আলোক ছুটিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িবে এবং তৎক্ষণাৎ লোকে দেখিবে এই আলো জ্বলিল’? তৎক্ষণাৎ বলিলাম কিন্তু বৈজ্ঞানিক বলিবেন ‘তৎক্ষণাৎ নয়, একটু পরে। ঐ অনেক দূরে যারা রয়েছে তাদের কাছে আলো পৌঁছিতে কিছু সময় চাই তো।' যদি জিজ্ঞাসা করো ‘কতখানি সময় লাগে’ তিনি বলিবেন, “ট্রেনটা যতক্ষণে এক ইঞ্চি যাবে, আলো ততক্ষণে কলকাতা থেকে ছুটে গিয়ে মধুপুরে হাজির হবে।”

সন্দেশ-মাঘ, ১৩২০