সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/দেশ-বিদেশের গল্প/দানের হিসাব

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১২৬-১২৯)

দানের হিসাব

 এক ছিল রাজা। রাজা জাঁকজমকে পোশাক পরিচ্ছদে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেন, কিন্তু দানের বেলায় তাঁর হাত খোলে না।

 রাজার সভায় হোমরা-চোমরা পাত্র-মিত্র সবাই আসে, কিন্তু গরিব-দঃখী পণ্ডিত সজ্জন এরা কেউ আসে না। কারণ সেখানে গুণীর আদর নাই, একটি পয়সা ভিক্ষা পাবার আশা নাই।

 রাজার রাজ্যে দুর্ভিক্ষ লাগল, পূর্ব সীমানার লোকেরা অনাহারে মরতে বসল। রাজার কাছে খবর এল, রাজা বললেন, “এ-সমস্ত দৈবে ঘটায়, এর উপর আমার কোন হাত নাই।”

 লোকেরা বলল, রাজভাণ্ডার থেকে সাহায্য করতে হুকুম হোক, আমরা দূর থেকে চাল কিনে এনে এ-যাত্রা রক্ষা পেয়ে যাই।”

 রাজা বললেন, “আজ তোমাদের দুর্ভিক্ষ, কাল শুনব আর-এক জায়গায় ভূমিকম্প, পরশু শুনব অমুক লোকেরা ভারি গরিব, দুবেলা খেতে পায় না। সবাইকে সাহায্য করতে হলে রাজভাণ্ডার উজাড় করে রাজাকে ফতুর হতে হয়!”

 শুনে সবাই নিরাশ হয়ে ফিরে গেল।

 ওদিকে দুর্ভিক্ষ বেড়েই চলেছে। দলে দলে লোক অনাহারে মরতে লেগেছে। আবার দূত এসে রাজার কাছে হাজির। সে রাজসভায় হত্যা দিয়ে পড়ে বলল, “দোহাই মহারাজ, আর বেশি কিছু চাই না, দশটি হাজার টাকা দিলে লোকগুলো একবেলা আধপেটা খেয়ে বাঁচে।”

 রাজা বললেন, “অত কট করে বেঁচেই বা লাভ কি? আর দশটি হাজার টাকা বুঝি বড় সহজ মনে করেছ?”  দূত বলল, “দেবতার কৃপায় কত কোটি টাকা রাজভাণ্ডারে মজত রয়েছে, যেন টাকার সমুদ্র। তার থেকে এক-আধ ঘটি তুললেই-বা মহারাজের ক্ষতি কি?”

 রাজা বললেন, “দেদার থাকলেই কি দেদার খরচ করতে হবে?”

 দূত বলল, “প্রতিদিন আতরে, সুগন্ধে, পোশাকে, আমোদে, আর প্রাসাদের সাজ-সজ্জায়ে টাকা বেরিয়ে যায়, তারই খানিকটা পেলে লোকগুলো প্রাণে বাঁচে।”

 শুনে রাজা রেগে বললেন, “ভিখারি হয়ে আবার উপদেশ শোনাতে এসেছ? আমার টাকা আমি সিদ্ধ করেই খাই আর ভাজা করেই খাই, সে আমার খুশি! তুমি বাপু আর বেশি জ্যাঠামি করলে শেষে বিপদ ঘটতে পারে। সুতরাং এই বেলা মানে মানে সরে পড়।”

 দূত বেগতিক দেখে সরে পড়ল।

 রাজা হেসে বললেন, “যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! দুশো পাঁচশো হত, তবু নাহয় বুঝতাম; দারোয়ানগুলোর খোরাক থেকে দু-চারদিন কিছু কেটে রাখলেই টাকাটা উঠে যেত। কিন্তু তাতে তো ওদের পেট ভরবে না, একেবারে দশ হাজার টাকা হেঁকে বসল! ছোটলোকের একশেষ!”

 শুনে পাত্র-মিত্র সবাই মিলে ‘হুঁ-হুঁ’ করল, কিন্তু মনে মনে সবাই বলল—“ছি ছি, কাজটা অতি খারাপ হল!”

 দিন দুই বাদে কোথা থেকে এক বুড়ো সন্ন্যাসী এসে রাজসভায় হাজির; সন্ন্যাসী এসেই রাজাকে আশীর্বাদ করে বললেন, “দাতাকণ মহারাজ! ফকিরের ভিক্ষা পূর্ণ করতে হবে।”

 রাজা বললেন, “ভিক্ষার বহরটা আগে শুনি। কিছু কমসম করে বললে হয়তো-বা পেতেও পারেন।”

 সন্ন্যাসী বললেন, “আমি ফকির মানুষ, আমার বেশি দিয়ে  দরকার কি? আমি অতি যৎকিঞ্চিৎ সামান্য ভিক্ষা একটি মাস ধরে প্রতিদিন রাজভাণ্ডারে পেতে চাই। আমার ভিক্ষা নেবার নিয়ম এই—প্রথম দিন যা নিই, দ্বিতীয় দিন নিই তার দ্বিগুণ, তৃতীয় দিনে তারও দ্বিগুণ, আবার চতুর্থ দিনে তৃতীয় দিনের দ্বিগুণ। এমনি করে প্রতিদিন দ্বিগুণ করে নিই, এই আমার ভিক্ষার রীতি।”

 রাজা বললেন, “তা তো বেশ বঝেলাম। কিন্তু প্রথম দিন কত চান সেইটাই হল আসল কথা। দু-চার টাকায় পেট ভরে তো ভালো কথা, নইলে একেবারে বিশ-পঞ্চাশ হেঁকে বসলে সে যে অনেক টাকার মামলায় গিয়ে পড়তে হবে।”

 সন্ন্যাসী একগাল হেসে বললেন, “মহারাজ, ফকিরের কি লোভ থাকে? আমি বিশ পঞ্চাশও চাই নে, দু-চার টাকাও চাই নে। আজ আমায় একটি পয়সা দিন, তারপর উনত্রিশ দিন দ্বিগুণ করে দেবার হুকুম দিন।”

 শুনে রাজা মন্ত্রী পাত্র-মিত্র সবাই প্রকাণ্ড দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তখনি চটপট হুকুম হয়ে গেল, সন্ন্যাসী ঠাকুরের হিসাবমত রাজভাণ্ডার থেকে এক মাস তাঁকে ভিক্ষা দেওয়া হোক। সন্ন্যাসী ঠাকুর মহারাজের জয়-জয়কার করে বাড়ি ফিরলেন।

 রাজার হুকুমমত রাজ-ভাণ্ডারী প্রতিদিন হিসাব করে সন্ন্যাসীকে ভিক্ষা দেয়। এমনি করে দুদিন যায় দশদিন যায়। দু সপ্তাহ ভিক্ষা দেবার পর ভাণ্ডারী হিসাব করে দেখল ভিক্ষাতে অনেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখে তার মন খুঁৎ খুঁৎ করতে লাগল। রাজামশাই তো কখনো এত টাকা দান করেন না। সে গিয়ে মন্ত্রীকে খবর দিল।

 মন্ত্রী বললেন, “তাই তো হে, এটা তো আগে খেয়াল হয় নি। তা এখন তো আর উপায় নাই, মহারাজের হুকুম নড়চড় হতে পারে না!”

 তারপর আবার কয়েকদিন গেল। ভাণ্ডারী আবার মহাব্যস্ত হয়ে মন্ত্রীর কাছে হিসাব শোনাতে চলল। হিসাব শুনে মন্ত্রীমশায়ের মুখের তালু শুকিয়ে গেল।

 তিনি ঘাম মুছে, মাথা চুলকিয়ে, দাড়ি হাতড়িয়ে বললেন, “বল কি হে। এখনি এত? তা হলে মাসের শেষে কত দাঁড়াবে?”

 ভাণ্ডারী বলল, “আজ্ঞে তা তো হিসাব করা হয় নি!”

 মন্ত্রী বললেন, “দৌড়ে যাও, এখনি খাজাঞ্চিকে দিয়ে একটা পুরো হিসাব করিয়ে আন।”

 ভাণ্ডারী হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে চলল; মন্ত্রীমশাই মাথায় বরফ জলের পট্টি দিয়ে ঘন ঘন হাওয়া খেতে লাগলেন।

 আধ ঘণ্টা যেতে না যেতেই ভাণ্ডারী কাঁপতে কাঁপতে হিসাব নিয়ে এসে হাজির।

 মন্ত্রী বললেন, “সবসুদ্ধ কত হয়?”

ভাণ্ডারী হাত জোড় করে বলল, “আজ্ঞে, এক কোটি সাতষট্টি লক্ষ সাতাত্তর হাজার দুশো পনের টাকা পনের আনা তিন পয়সা।” মন্ত্রী চটে গিয়ে বললেন, “তামাশা করছ নাকি?” ভাণ্ডারী বলল, “আজ্ঞে তামাশা করব কেন? আপনিই হিসাবটা দেখে নিন!”

১ম দিন—
২য় দিন—
৩য় দিন—
৪র্থ দিন—
৫ম দিন—
৬ষ্ঠ দিন—
৭ম দিন—
৮ম দিন—
৯ম দিন—
১০ম দিন—
১১শ দিন—
১২শ দিন—
১৩শ দিন—
১৪শ দিন—
১৫শ দিন—
 

৫ 
১০
৴৹   
৵৹   
৷৹     
৷৷৹     
১৲       
২৲       
৪৲       
৮৲       
১৬৲       
৩২৲       
৬৪৲       
১২৮৲       
২৫৬৲       
 

১৬শ দিন—
১৭শ দিন—
১৮শ দিন—
১৯শ দিন—
২০শ দিন—
২১শ দিন—
২২শ দিন—
২৩শ দিন—
২৪শ দিন—
২৫শ দিন—
২৬শ দিন—
২৭শ দিন—
২৮শ দিন—
২৯শ দিন—
৩০শ দিন—
মোট

৫১২৲    
১,০২৪৲    
২,০৪৮৲    
৪,০৯৬৲    
৮,১১২৲    
১৬,৩৮৪৲    
৩২,৭৬৮৲    
৬৫,৫৩৬৲    
১,৩১,০৭৩৲    
২,৬২,১৪৪৲    
৫,২৪,২৮৮৲    
১০,৪৮,৫৭৬৲    
২০,৯৭,১৫২৲    
৪১,৯৪,৩০৪৲    
৮৩,৮৮,৬০৮৲    
১,৬৭,৭৭,২১৫৸৶১৫

এই বলে সে হিসাবের কাগজখানা মন্ত্রীর হাতে দিল। মন্ত্রীমশাই হিসাব পড়ে, চোখ উলটিয়ে মূর্ছা যান আর কি! সবাই ধরাধরি করে অনেক কষ্টে তাঁকে রাজার কাছে নিয়ে হাজির করল।

 রাজা বললেন, “ব্যাপার কি?” মন্ত্রী বললেন, “মহারাজ, রাজকোষের প্রায় দু কোটি টাকা লোকসান হতে যাচ্ছে!” রাজা বললেন, “সে কিরকম?” মন্ত্রী বললেন, “মহারাজ, সন্ন্যাসী ঠাকুরকে যে ভিক্ষা দেবার হুকুম দিয়েছেন, এখন দেখছি তাতে ঠাকুর রাজভাণ্ডারের প্রায় দু কোটি টাকা বের করে নেবার ফিকির করেছে।”

 রাজা বললেন, “এত টাকা দেবার তো হুকুম হয় নি! তবে এরকম বে-হুকুম কাজ করছে কেন? বোলাও ভাণ্ডারীকো!”

 মন্ত্রী বললেন, “আজ্ঞে, সমস্তই হুকুমমত হয়েছে! এই দেখুন না দানের হিসাব।”

 রাজামশাই একবার দেখলেন,দুবার দেখলেন, তারপর ধড়্‌ফড়্‌ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তারপর অনেক কষ্টে তাঁর জ্ঞান হলে পর লোকজন ছটে গিয়ে সন্ন্যাসী ঠাকুরকে ডেকে আনল।

 ঠাকুর আসতেই রাজামশাই কেঁদে তাঁর পায়ে পড়লেন। বললেন, “দোহাই ঠাকুর, আমায় ধনে-প্রাণে মারবেন না। যা হয় একটা রফা করে আমার কথা আমায় ফিরিয়ে নিতে দিন।”

 সন্ন্যাসী ঠাকুর গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাজ্যের লোক দুর্ভিক্ষে মরে, তাদের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা চাই। সেই টাকা নগদ হাতে হাতে পেলে আমার ভিক্ষা পূর্ণ হল মনে করব।”

 রাজা বললেন, “সেদিন একজন এসেছিল, সে বলছিল দশ হাজার হলেই চলবে!”

 সন্ন্যাসী বললেন, “আজ আমি বলছি পঞ্চাশ হাজারের এক পয়সা কম হলেও চলবে না!”

 রাজা কাঁদলেন, মন্ত্রী কাঁদলেন, উজির-নাজির সবাই কাঁদল। চোখের জলে ঘর ভেসে গেল, কিন্তু ঠাকুরের কথা যেমন ছিল তেমনি রইল। শেষে অগত্যা রাজভাণ্ডার থেকে পঞ্চাশটি হাজার টাকা গুণে ঠাকুরের সঙ্গে দিয়ে রাজামশায় নিষ্কৃতি পেলেন।

 দেশময় রটে গেল, দুর্ভিক্ষে রাজকোষ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করা হয়েছে। সবাই বললে, “দাতাকর্ণ মহারাজ!”

সন্দেশ—১৩২৯