সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/দেশ-বিদেশের গল্প/বুদ্ধিমানের সাজা


বুদ্ধিমানের সাজা

 আলি শাকালের মতো ওস্তাদ আর ধূর্ত নাপিত সে সময়ে মেলাই ভার ছিল। বাগদাদের যত বড়লোক তাকে দিয়ে খেউড়ি করাতেন, গরিবকে সে গ্রাহ্যই করত না।

 একদিন এক গরিব কাঠুরে ঐ নাপিতের কাছে গাধা বোঝাই করে কাঠ বিক্রী করতে এল। আলি শাকাল কাঠুরেকে বলল, “তোমার গাধার পিঠে যত কাঠ আছে সব আমাকে দাও; তোমাকে এক টাকা দেব।” কাঠুরে তাতেই রাজি হয়ে গাধার পিঠের কাঠ নামিয়ে দিল। তখন নাপিত বলল, “সব কাঠ তো দাও নি; গাধার পিঠের ‘গদি’'টা কাঠের তৈরি; ওটাও দিতে হবে।” কাঠুরে তো কিছুতেই রাজি হলো না; কিন্তু নাপিত তার আপত্তি গ্রাহ্য না করে গদিটা জবরদস্তি করে কেড়ে নিয়ে, কাঠুরেকে এক টাকা দিয়ে বিদায় করে দিল।

 কাঠুরে বেচারা আর কি করে? সে গিয়ে খালিফের কাছে তার নালিশ জানাল। খালিফ বললেন, “তুমি তো ‘গাধার পিঠের সমস্ত কাঠ’ দিতে রাজি ছিলে; তবে আর এখন আপত্তি করছ কেন? কথামতই তো কাজ হয়েছে।” তারপর কাঠুরের কানে ফিস্‌ ফিস্‌ করে কি জানি বললেন; কাঠুরে মুচ্‌কি হেসে, “যো হুকুম” বলে সেলাম ঠুকে চলে গেল।

 কিছুদিন বাদে কাঠুরে আবার নাপিতের কাছে এসে বলল, “নাপিতসাহেব, আমি আর আমার সঙ্গীকে খেউরি করার জন্য দশ টাকা দেব, তোমার মত ওস্তাদের হাতে অনেক বেশি টাকা দিয়ে খেউড়ি হতে পারলে জন্ম সার্থক হয়। তুমি কি রাজি আছ?” নাপিত তো খোসামোদে ভুলে, কাঠুরেকে চটপট কামিয়ে দিল; তারপর তাকে বলল, “কই হে তোমার সঙ্গী?” কাঠুরে তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে তার গাধাটি এনে হাজির করল। নাপিত তো বেজায় চটে গিয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, ঘুঁষি বাগিয়ে বলল, “এত বড় বেয়াদবি আমার সঙ্গে! সুলতান, খালিফ, আগা, বেগ যার হাতে খেউড়ি হবার জন্য সর্বদাই খোসামোদ করে, সে কিনা গাধাকে কামাবে! বেরোও এখনি এখান থেকে!"

 কাঠুরে নাপিতের কথার কোন উত্তর না দিয়ে সটান গিয়ে খালিফের কাছে হাজির। খালিফ তার নালিশ শুনে আলি শাকালকে ডেকে পাঠালেন। নাপিত এসেই হাত জোড় করে বলল, “দোহাই ধর্মাবতার! গাধাকে কি কখনো মানুষের সঙ্গী ব’লে ধরা যেতে পারে?” খালিফ বললেন, “তা’ না হতেও পারে, কিন্তু গাধার পিঠের গদিও কি কখনো কাঠের বোঝার মধ্যে ধরা যেতে পারে? তুমি এ কথার জবাব দাও।” নাপিত তো একেবারে চুপ! কিছুক্ষণ বাদে খালিফ বললেন, “আর দেরি কেন? গাধাকে কামিয়ে ফেল; কথামত কাজ না করতে পারলে তার উচিত সাজার ব্যবস্থা হবে জানই তো।”

 নাপিত বেচারা আর করে কি? গাধাকে বেশ করে ক্ষুর বুলিয়ে কামাতে লাগল। সেই তামাশা দেখবার জন্য চারিদিকে ভিড় জমে গেল। কামানো শেষ হতেই নাপিত অপমানে মাথা হেঁট ক’রে বাড়ি পালাল। কাঠুরেও নেড়া গাধায় চড়ে নাচতে নাচতে বাড়ি পালাল।

সন্দেশ—১৩২৪