সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/দেশ-বিদেশের গল্প/বুদ্ধিমান শিষ্য
(পৃ. ১৩৪-১৩৫)
বুদ্ধিমান শিষ্য
এক মুনি, তাঁর অনেক শিষ্য। মুনিঠাকুর তাঁর পিতৃশ্রাদ্ধে এক মস্ত যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সে যজ্ঞ এর আগে মুনির আশ্রমে আর হয় নি। তাই তিনি শিষ্যদের ডেকে বললেন, “আমি এক যজ্ঞের আয়োজন করেছি, সে যজ্ঞ তোমরা হয়তো আর কোথাও দেখবার সুযোগ পাবে না, কাজেই যজ্ঞের সব কাজ-কর্ম বিধি-ব্যবস্থা বেশ মন দিয়ে দেখো। নিজের চোখে সব ভালো করে না দেখলে শুধু পুঁথি পড়ে এ যজ্ঞ করা সম্ভব হবে না।”
মুনিঠাকুরের আশ্রমে বেড়ালের ভারি উৎপাত; যজ্ঞের আয়োজন সব ঠিক হচ্ছে, এর মধ্যে বেড়ালগুলো এসে জ্বালাতন আরম্ভ করেছে—এটাতে মুখ দেয়, ওটা উলটে ফেলে, কিছুতেই তাদের সামলান যায় না। তখন মুনিঠাকুর রেগে বললেন, “বেড়ালগুলোকে ধরে ঐ কোনায় বেঁধে রেখে দাও তো।” অমনি নয়টা বেড়ালকে ধরে সভার এক পাশে খোঁটায় বেঁধে রাখা হল। তারপর ঠিক সময় বুঝে যজ্ঞ আরম্ভ হল। শিষ্যেরা সব সভার সাজসজ্জা, আয়োজন, যজ্ঞের সব ক্রিয়া-কাণ্ড, মন্ত্রোচ্চারণের নিয়ম ইত্যাদি মন দিয়ে দেখতে আর শুনতে লাগল। নির্বিঘ্নে অতি সুন্দররূপে মুনিঠাকুরের যজ্ঞ সম্পন্ন হল।
কিছুকাল পরে শিষ্যদের মধ্যে একজনের বাবা মারা গেলেন। শিষ্যের ভারি ইচ্ছা হল তার পিতৃশ্রাদ্ধ সেও ঐরকম সুন্দর যজ্ঞের আয়োজন করে। সে গিয়ে তার গুরুকে ধরল। তিনি বললেন, “আচ্ছা, সব আয়োজন করতে থাক, আমি এসে যজ্ঞের পুরোহিত হব।” শিষ্য মহা সন্তুষ্ট হয়ে যজ্ঞের সব ঠিকঠাক করতে লাগল।
ক্রমে যজ্ঞের দিন উপস্থিত। মুনিঠাকুর সশিষ্য শ্রাদ্ধের সভায় উপস্থিত; ঠিক নিয়ম মতো যজ্ঞের সমস্ত ব্যবস্থা প্রস্তুত হয়েছে কিন্তু শিষ্যটি তখনো সভাস্থলে এসে বসছে না, কেবল ব্যস্তভাবে ঘোরাঘুরি করছে। এদিকে যজ্ঞের সময় প্রায় উপস্থিত দেখে মুনিঠাকুরও ক্রমে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি শিষ্যকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আর বিলম্ব কেন? সবই তো প্রস্তুত, যজ্ঞের সময়ও উপস্থিত, এই বেলা সভায় এস।” শিষ্য বলল, “আজ্ঞে একটা আয়োজন বাকি রয়ে গেছে, সেইটা নিয়ে ভারি মুশকিলে পড়েছি।” মুনি বললেন, “কই, কিছুরই তো অভাব দেখছি না।” শিষ্য বলল, “আজ্ঞে চারটে বেড়াল কম পড়েছে।” মুনি বললেন, “সে কিরকম?” শিষ্য মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “ঐ যে আপনার যজ্ঞে দেখলাম ঈশান কোণে নয়টা বেড়াল বাঁধা রয়েছে। আমাদের এ গ্রামে অনেক খুজে পাঁচটার বেশি পাওয়াই গেল না, কাজেই আর বাকি চারটার জন্য পাশের গ্রামে লোক গিয়েছে; তারা এই এসে পড়ল বলে।” শুনে গুরুর তো চক্ষুস্থির! তিনি বললেন, “আরে বুদ্ধিমান! কোন্টা যজ্ঞের অঙ্গ আর কোন্টা নয় তাও বিচার করতে শেখ নি? আশ্রমের বেড়ালগুলি উৎপাত করছিল তাই বেঁধে রেখেছিলাম। তোমার এখানে কোন উৎপাত ছিল না, তুমি আবার গায়ে পড়ে উৎপাত সংগ্রহ করতে গিয়েছ? বসে পড়, বসে পড়, আর বেড়াল ধরে কাজ নেই। এখন যজ্ঞটা নিবিঘ্নে শেষ হয়ে যাক্।”
শিষ্য নিজের আহম্মকিতে লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি অপ্রস্তুতভাবে সভার মধ্যে বসে পড়ল।