সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/আমরা বাঙালী
আমরা বাঙালী
আমরা বাঙালী, এ কথা জানাই গর্ব ও গৌরবে,
বাংলার বুকে আজো বেঁচে আছি অতীতের সৌরভে।
অতীতের সেই বলী-বাঙালীরা আনন্দময় জাতি,
মনের স্বাস্থ্যে, দেহের স্বাস্থ্যে অতুলন দিবারাতি।
ঢেঁকি ঘুরাইয়া, লাঠি উঁচাইয়া তাড়াত ডাকাত-চোরে,
গোটা পাঁঠা খেয়ে করিত হজম অজেয় মনের জোরে।
উন্নত গ্রীবা, কপাটবক্ষ, দেহ সুদীর্ঘ, উঁচা,
বিশ্বকর্মা-ঘরে যেন আজ ঘোরাফেরা করে ছুঁচা।
মরিতে বসেছি আমরা বাঙালী, সবই গেছে আজ ভেসে,
সোনার বঙ্গে মরিচা ধরেছে, ভাঙন ধরেছে দেশে।
ভাঙন ধরেছে বাঙালীর মনে, ভাঙন ধরেছে দেহে,
খাদ মিশে গেছে আন্তরিক সে শ্রদ্ধা-প্রণয়-স্নেহে।
যৌবন-ভরা মৌ-বনে আজ মৌ নাই এক কড়া,
তিক্ত রসেতে সিক্ত পরান, রিক্ততা আগাগোড়া।
বুকে নাই আশা, মুখে নাই ভাষা, নাহি সে পূর্ব খ্যাতি,
গৌরবময় বাঙালী এখন মুমূর্মু এক জাতি।
আমার কথার সত্যতা যদি করে কেউ সন্দেহ,
যতেক স্বাস্থ্য-নিবাসের প্রতি একবার মন দেহ।
বাঙালী সেথায় অগ্রগণ্য, সবার প্রধান তারা,
ভুগে ভুগে সার অস্থি-চর্ম, রোগে শোকে দিশেহারা।
ফুস্ফুসে ব্যথা, ঘুষ্ঘুষে জ্বর, খুস্খুসে কাসি আদি,
চুল হতে নোখে গিজ্গিজ করে বিচিত্র সব ব্যাধি।
পালাজ্বর আর কালাজ্বর-জ্বালা, নাহিকো রক্ষা তাতে,
অক্কা পাবার দাখিল হয়েছে যক্ষ্ণা-পক্ষাঘাতে।
আধি ও ব্যাধির ডিপো নিয়ে তারা অকালে আনিছে জরা,
জীবন মৃত্যু সমান তাদের, সগোত্র বাঁচা মরা।
অতীতের সেই প্রাণবান জাতি, জীবন্ত ছিল যারা—
কালের গর্ভে লয় পেয়ে গেছে, আজ আর নাহি তারা।
তাজা ফুলদল ঝরেছে ধুলায়, ম’রে গেছে কোন্ কালে,
বাংলা জুড়িয়া ঘোরা-ফেরা করে বাঙালীর কঙ্কালে।
কেন এই রোগ, কেন এই ভোগ? উত্তর কেবা দেবে?
স্বখাত-সলিলে মরিতেছি ডুবে, কেহ কি দেখেছ ভেবে?
কার্যের ধারা, চিন্তার ধারা সকলই গিয়াছে ঘুরে,
ভুল পথ ধ’রে ক্রমাগত মোরা কেবলি চলেছি দূরে।
স্বার্থ-আঁধারে ডুবেছি সবাই, অকপটে আজ বলি,
যেখানে বাঙালী সেখানে কেবল দল আর দলাদলি।
মাথা চাড়া দিয়ে ওঠো ভাই ফের ‘বিসুভিয়াসে’র মত,
আমরা যে ‘অমৃতস্য পুত্র’ মনে রেখো অবিরত।
যত ভুল ত্রুটি, দোষ অপরাধ, যাও একবারে ভুলে,
বাঙালী আবার স্বাধীন ভারতে খাড়া হও মাথা তুলে।
নৰ চেতনার বহালে জোয়ার কোথাও পাবে না বাধা,—
বাঙালী আবার ফিরে পাবে সেই শৌর্যের মর্যাদা।